হ্যালো, সুমন কি করছিস?
- এইতো আছি একরকম। তোর কি খবর?
- ভালো। পরশুতো ঈদ। আমি বাসায় ফিরছি। খুব আড্ডা হবে।
- হা হা হা। ওকে, বস। তাহলে পরশু দেখা হচ্ছে।
- না না। কি যে বলিস। ওকে ব্রাদার মঙ্গলবার কনফার্ম।
- পাক্কা। ভাবিকে নিয়ে আসবি কিন্তু।
- শিওর।
ফোনটা রেখেই মনটা আজ কেমন জানি বিষণ্ণ হয়ে গেলো। ইমরানের কথাগুলি এখনও কানে বাজছে। প্রতিবার ঈদ এর দিনটা এলেই আমার এমন হয়। ঈদ এর নিমন্ত্রণ এর কথা বললেই আমার মনে একটা অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। একটা সময় কাটিয়ে উঠার যন্ত্রণায়।
হিন্দু বাড়ির সন্তান হিসেবে একেবারে শৈশবেই আমার মনে একটা বীজ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল; আমাদের একটা ধর্ম আছে, ঠাকুর আছে, দেবতা আছে, যারা আমাদের সব কর্মের বিধান করেন!! বাড়িতে সকাল সন্ধ্যা নাটমন্দিরে বাড়ির বউয়েরা, মানে আমার কাকিমা-জ্যাঠিমারা পুজো দিতেন। যৌথ পরিবারে বড় হওয়ার দরুন কিছু সংস্কার এমনিতেই আমার মনের ভেতর জন্ম নিয়েছিল। কাজের দরুন দাদু বেশীরভাগ সময় বাড়ির বাইরেই থাকতেন। বাবা কাকারাও ঠিক একই। আর তাই পরিবারের হর্তা কর্তা – সবই ছিলেন ঠাকুমা। বাড়ির বউদের ক্ষেত্রে একেবারে দজ্জাল শাশুড়ি বলতে যা বোঝায় তাই ছিলেন আমাদের ঠাম্মা। তবে হাত চালানোর কোন ব্যাপার ছিলনা, বউদের খুঁত ধরা আর সারাক্ষণ গলা উঁচিয়ে চোপাবাজি করা ছিল উনার অন্যতম প্রধান কর্ম। মা আমাকে দুষ্টুমির জন্য বেতালে, পরক্ষণেই যখন কোনো কাজের জন্য বকুনি খেতেন তখন খুব মজা পেতাম।
ঠাকুমার চোখ এড়িয়ে বাড়িতে মাছি প্রবেশ করতে পারত না! পান থেকে চুন খসলেই বিপদ। আমরা যারা কাকাতো এবং জ্যাঠতুতো ভাইয়েরা ছিলাম সব সময়ই উনার ভয়ে গুটিসুটি মেরে থাকতাম। বাড়ির পরিবেশ তখন এমনি ছিল যে অন্য ধর্ম থাক দূরের কথা হিন্দুদের মধ্যেই অন্য জাতের লোকজনের সঙ্গে আমাদের উঠাবসা ছিলোনা। তথন আমাদের পারিবারিক অবস্থাও যথেষ্ট ভালো ছিল। এত শেকল যুক্ত পরিবেশের মধ্যে আমায় স্বস্তির বাতাস এনে দিত স্কুল। স্কুলে গেলে আর বাড়িতে আসতে ইচ্ছে করত না। কারণ বাড়িতে ঢুকে গেলেই সেই শৃঙ্খল। আমাদের বাড়ির পাশেই বিকেলবেলা মাঠে সব ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। অথচ আমাকে জোর করে বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। খুব কাঁদতাম। বালিস বেয়ে টুপটাপ শব্দে জল পড়ত। ছুটে যেতে ইচ্ছে করতো মাঠে। পারতাম না। আর ঘুমও আসতো না।
এই বন্ধ পরিবেশে বড় হওয়ার দরুন বোধ হয় কিছু জেদ চেপে বসেছিলো আমার মনে। সেই দিনের কথা। আমি স্ট্যান্ডার্ড - এইট এর ছাত্র। খানিকটা বড় হয়েছি। শরীরের বিভিন্ন পরিবর্তন জানান দিচ্ছে বড় হচ্ছি দ্রুত। স্কুলে ব্রেক টাইমে বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছি। হঠাত বাপ্পি এবং নৌসাদ এসে হাজির।
বাপ্পি বলল – কাল কিন্তু তোদের সব্বাইকে আমাদের বাসায় যেতে হবে। ঈদের নিমন্ত্রণ।
নৌসাদ বলল – আমার মা অনেক ভালো পিঠে বানায়, তোদের খুব ভালো লাগবে, তোরা সবাই আসবি কিন্তু।
বাপ্পির সঙ্গে আমার বিশেষ সখ্যতা ছিল। বাপ্পি আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল, গত বছরও কিন্তু তুই গেলিনা, এইবার কোনো বাহানা করলে চলবে না, তোকে যেতেই হবে।
আমি তাকে বললাম – যাবো এইবার শিওর।
মনে একটা ভয় ছিল, কিশোর মনে সঙ্কোচ ছিল, দ্বিধা ছিলো। কিন্তু তাতে কি? বড় হয়ে গেছি আমরা। বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে ভিতু অসিত যখন বলল, আমিও নিশ্চয়ই যাবো তখন আর কোনো দ্বিধা না রেখে ওদের জানিয়ে দিলাম আমরা যাচ্ছি।
পরেরদিন ঈদ। স্কুল ছুটি। তখন একটু হাল্কা পাতলা বাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুমতি মিলেছে। ক্রিকেট খেলতে পারছি। বিকেলে সব বন্ধুরা জড়ো হলাম। আজ ক্রিকেট খেলা বন্ধ। কিন্তু মজার বিষয় নিরেশ, বিমল, অজয়, সুকান্ত,
সুমিত, রাকেশরা সবাই এলেও অসিত আসেনি। কালকেতো ভালোই গলাবাজি করে গেছিল! পরে খবর পেয়েছিলাম ভীতু অসিত বাড়িতে বলেই দিয়েছিল সে কোথায় যেতে চায়, এবং যা হবার তাই হয়েছে – কেলানি খেয়েছে। যাই হোক সবাই মিলে রওনা দিলাম। প্রথমেই গেলাম নৌসাদ এর বাড়িতে। ওর মা আমাদের খুব আদর করে নিয়ে গিয়ে তাদের বসার ঘরে বসতে দিলো। তারপর ভুঁড়ি ভোজ। শেমাই দিয়ে তৈরি সেই বিখ্যাত পায়েস হাপুস করলাম তিন বাটি। বন্ধুদেরও একই কন্ডিশন। তারপর এল পিঠার পালা। পৌষ সংক্রান্তিতে আমাদের বাড়িতে যে পিঠা বানানো হয় সেই পিঠার সাথে এই পিঠার কোনো মিল খোঁজে পেলাম না। নাম জানা হলো না। তবে একটার মধ্যে কামড় বসিয়েই... তারপর একথালা কাবার। মোটামোটি পেট হাতাতে হাতাতে নৌসাদদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম আমরা। আন্টি মানে নৌসাদের মা আমাদের রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন, আদর করে বললেন – আবার এসো তোমরা। বললাম,
আসবো নিশ্চয়ই। অন্য বন্ধুরা পরে কথা রেখেছিলো কিনা আমি জানার চেষ্টা করিনি, তবে আমি কথা রেখেছিলাম।
নৌসাদদের বাড়ি থেকে বেরিয়েই দেখা হয়ে গেলো তৌফিকের সাথে, সেও আমাদের সাথে স্কুলে পড়ে। এইবার সে ধরল আমাদের বাসায় যেতে হবে। আমরা কোনোরকমে তাকে বুঝালাম যে আমাদের এখন বাপ্পিদের বাড়ি যেতে হবে। কিন্তু নাছোরবান্দা তৌফিক। শেষে তাকে বলে গেলাম, বাপ্পিদের বাড়ি থেকে সোজা ওদের বাড়ি যাবো। ছাড়পত্র পেলাম তৌফিকের কাছ থেকে। এইবার আবার বাপ্পিদের বাসার দিকে রওনা দিলাম। পথে আবার বিপত্তি। এইবার রাবেকা, সেও আমাদের সাথে পড়ে। আমাদের দেখে সে অবাক, হা হা হি হি কত হাসি, সাথে ওর বান্ধবিরা। আমরা লজ্জা পেলাম। এইবার ও ধরল তাদের বাসায় যেতে হবে। আবার মহা বিপদ। কোনো রকমে ওকে বুঝালাম আমরা বাপ্পিদের বাড়ি থেকে আগে গিয়ে আসি তারপর ওদের বাড়ি যাবো।
শেষে বাপ্পি মিয়ার বাসায় গিয়ে পৌছালাম আমরা। বাপ্পি তো মহা খুশি। সে আনন্দে নাচছিল। প্রথমেই আমাকে জরিয়ে ধরে একটা ঝাপ্পি দিল, বলল – ঈদ মুবারক। সাথে আমিও ওকে বললাম, ঈদ মোবারক। সবাই হৈচৈ করে বাপ্পিদের বাড়িটাকে মাথায় তুলে নিলাম। নৌসাদদের বাসায় এতটাই খেয়ে ফেলেছি যে এখানে এসে আর খেতে পারছি না। তবে বাপ্পিদের এখানে পিঠার ক্ষেত্রে দু’একটা নতুন আইটেম চোখে পড়ল। খুব মজা করে খেলাম। কিছুক্ষণ পর হাজির হলেন এমন একজন মানুষ যার কথা মনে পড়লে আমার এখনও কান্না চলে আসে। কারণ তাকে ঘিরে আমার অনেক সুন্দর স্মৃতি আবর্তিত হয়। বয়স্ক মহিলা। বয়স প্রায় ষাট এর কাছাকাছি হবে।
বাপ্পি বলল – এই হল আমার বুয়া। কেন জানিনা সেদিন বাপ্পির বুয়া আমাদের সব বন্ধুদের মধ্যে আমাকেই প্রথমে এসে আদর করে বলল, নাম কি তোর? আমি নাম বললাম। সেই শুরু। তারপর ক্লাস ক্লাস ইলেভানে পড়ার সময় বাপ্পি বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে। তখন নিয়মিত আড্ডা এবং যাতায়াত ওর বাড়িতে। আদর বলতে যা বোঝায়, সেই বৃদ্ধ মহিলা আমার আর বাপ্পির মধ্যে কোনো রেখা টেনে আদর করতেন না। কতদিন গেছে বাড়িতে পেট ভরে ভাত খেয়ে গিয়েও বাপ্পিদের বাসায় ভাত খেয়েছি, কেননা বুয়া বলেছেন খেতে। সবচেয়ে মজার বিষয়, বুয়া অনেক ভালো ভালো গল্প বলতেন, আর আমাদের হাসাতেন, ইনফেক্ট আমাদের গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা তারও খোঁজ নিতেন। আর বুয়ার সেই স্পেশালিটি। ঈদের জন্য যে কাঁচা পিঠা বানানো হত তারমধ্যে থেকে বুয়া একটা নিজস্ব কালেকশান রেখে দিতেন। তারপর তা ইউটিলাইজ হত সময় অসময়ে আমাদের পিঠা খাবার বায়না পূরনের মধ্যে দিয়ে। বছরের যেকোনো দিন যেকোনো সময় আমাদের জন্য ঈদ নিয়ে আসতেন বুয়া।
আমাদের সেই যৌথ পরিবার আজ আর নেই। সব ভেঙে গেছে। ঠাকুমাও নেই, দাদুও নেই। পরিবারের কঠোর নিয়মতান্ত্রিকতাও আজ আর নেই। আছে শুধু কিছু স্মৃতি।
tomainiyalekha.blogspot.com
সেই রাতের কথা এখনও বারবার স্মৃতিতে এসে আঘাত করে। যখন আমি বাপ্পির বাসা থেকে ফিরে এসে চুপ করে বসে আছি। মনে একটা চাপা উত্তেজনা। কেউ দেখে ফেলেনি তো! বাড়িতে যদি কেও বলে দেয়। তবুও কিশোর মনের উত্তেজনা। যেন কোন কিছু জয় করে ফিরেছি। টুপ করে আমার ছয় বছরের ছোট্ট ভাইটিকে বলে দিলাম। তারপর ঠাকুমার ন্যেওটা আমার ভাইটিও টুক করে সে খবর মা এবং ঠাকুমার কাছে পরিবেশন করে দিল। তারপর... থাক, আর বলে লাভ নেই। গঙ্গাজল, তুলসিপাতা, পৈতে উঁচিয়ে গায়েত্রি মন্ত্র এবং আমার শুদ্ধিকরণ......
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন