আজই নতুন বাড়িতে উঠেছে হিমেল ।নাহ্ ঠিক বাড়ি বলা যায় না,এক কামরার ছোট্ট একটা ঘর ।সাথে ছোট্ট টয়লেট,ব্যস এটুকুই ।পত্রিকা অফিসটা কাছে হওয়ায় এই ঘরটা ভাড়া নেয় সে ।অনেকদিন ধরেই অফিসের কাছাকাছি বাসা খুঁজছিল কিন্তু পায়নি আর পেলেও ব্যাচেলর হওয়ায় কেউ ভাড়া দেয় নি ।ভাগ্যগুনে অবশেষে এই ঘরটা পেয়ে যায় ।গতকালই বাড়িওয়ালার সাথে কথা পাকাপাকি করে তড়িঘড়ি করে আজই উঠে পড়ে ঘরটাতে ।বলা যায় না বাড়িওয়ালা আবার কখন মত পরিবর্তন করে ফেলেন ।ঘরে
valobasar sukh
ঢুকে দুপুর থেকেই রুমটা ঝাড়মুছ আর গোছগাছ করতে করতে বিকেল গড়িয়ে যায় ।অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে তাই ক্লান্ত দেহটা এলিয়ে দেয় বিছানায় ।কিছুক্ষন পরই প্রচন্ড শব্দে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয় ।পরপর কয়েকবার সমান তালে জোরে জোরে কড়া নাড়তে থাকে কেউ ।মেজাজ চরম খারাপ হয় হিমেলের । আশ্চর্য ,এত জোরে দরজায় নক করে কেউ !! দরজা খুলার সময়টাতো দিতে হবে না-কি ?প্রচন্ড রাগে দড়াম করে দরজা খুলে সে ।দরজার ওপাশে যে-ই থাকুক তাকে কড়া একটা কথা শুনানো দরকার ।কিন্তু দরজা খুলেই চুপসে যায় হিমেল ।মিটার স্কেলে তার রাগ একশো থেকে শূন্যতে নেমে আসে ।তার সামনে অপরূপ এক সুন্দরী দাঁড়িয়ে আছে ।যেন মিস ওয়ার্ল্ড ।অন্তঃত তার কাছে সেটাই মনে হচ্ছে ।কী সুন্দর,শান্ত নিবিড় মায়কাড়া চোখ তার ।মেয়েটির চেহারা দেখে কোন কড়া কথা বলতে পারল না হিমেল ।মনে মনে শুধু বলল এত সুন্দর একটা মেয়ে আর ভদ্রতাটা এই পর্যায়ের কেন ?তাকে দেখেই মেয়েটা বলল :

-''আপনি ভাড়া নিয়েছেন এই চিলে কোঠা”?
-''এখানে তো আর কেউ দেখছি না ।কাজেই.......
-''কথা পেচান কেন ?কথা পেচাবেন না ।কথা পেচানো লোক আমার একদম পছন্দ না''।
-''ও আচ্ছা ''।
-''ও আচ্ছা বললেই হলো ? sorry বলেন ''।
-''এ-তো দেখি engry bird .ওকে sorry ''।
-''এবার ঠিক আছে ।আপনি মানুষটা মন্দ না ।যাই হোক, বাড়িওয়ালী আপনাকে ডাকছেন '' কথাটা বলেই ছাদে চলে যায় মেয়েটি ।হিমেল চিন্তায় পড়ে যায় ।বাড়িওয়ালীর সাথে কিছুক্ষন আগেই দেখা হয়েছে ।রুমের সব কিছু ঠিকঠাক হয়েছে কি না দেখতে এসেছিলেন তিনি ।কিন্তু এখন আবার ডাকলেন কেন !!কিছুটা বিস্ময় নিয়ে নীচতলায় বাড়িওয়ালীর সাথে দেখা করে সে ।দরজা খুলতেই উনাকে জিজ্ঞেস করে-''আমাকে ডেকেছেন'' ?
-''কই ,না তো !কে বলেছে এ কথা ''?
-''সুন্দর, ফর্সা মতো একজন মেয়ে ''।
-''ওহ্ ,তাহলে এটা লাবন্য'র কাজ ।তুমি কিছু মনে করো না বাবা ।আমার মেয়েটা একটু পাগলাটে স্বভাবের''।
-''নাহ্ ,ঠিক আছে ।আমি কিছু মনে করি নি''।
-''মেয়েটা অতিরিক্ত ফাজিল হয়েছে ।আসতে না আসতেই তোমার সাথেও ফাজলামো শুরু করেছে !!''
-''না,না খালাম্মা ঠিক আছে ।এ আর এমন কী ।আমি এখন যাই''।
রুমে না গিয়ে সোজা ছাদে চলে আসে হিমেল ।অন্ধকার হয়ে আসছে ।এখন রুমে বসে থাকতে ভাল লাগবে না ।ছাদে এসে দেখে এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে লাবন্য ।ওদিকে না গিয়ে অন্যদিকে আরেক কোনায় দাঁড়ায় হিমেল ।তাকে দেখে এগিয়ে এসে লাবন্য বলল-''আমি ছাদে থাকলে আপনি ছাদে আসতে পারবেন না ।এটা বাবা আপনাকে ভাড়া দেয়ার সময় শর্তে বলেনি ''? লাবন্যকে এগিয়ে আসতে দেখে হিমেল ভাবে লাবন্য হয়তো আগের ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইবে ।কিন্তু লাবন্যর কথায় বেশ অবাক হয় সে ।নিজেকে সামলে নিয়ে বলে-''না,কোন শর্তই দেন নি আমাকে''।
-''কী মনে করে যে বাবা আপনাকে ভাড়া দিল বুঝলাম না !! আর আপনিই বা কেন এই চিলেকোঠাটা ভাড়া নিলেন''?
-''আমার জন্য আপনার কোন অসুবিধা হবে না ।কথা দিচ্ছি''।
-''অসুবিধা তো করেই ফেলেছেন ''।
-''কীভাবে''?
-''এই রুমটা ছিল আমার কান্না ঘর ।আপনি ভাড়া নেয়াতে এখন তো রুমটা আমি আর ব্যবহার করতে পারবো না''।
-''কান্না ঘর মানে কী ? আপনি খুব বেশি কাঁদেন নাকি ''?
-''আমি যখন কোন কারনে বাবা-মা কে কষ্ট দেই অথবা তারা আমাকে কষ্ট দেয় তখন আমি একা একা এই ঘরে বসে ইচ্ছা মতো কাঁদি''।
-''খুবই ইন্টারেষ্টিং তো''!!
-''ও হে, ভূত ভয় পান না তো ''?এই ঘরে কিন্তু ভূত আছে''।
-নাহ্, আমি ভূত ভয় পাই না''।
-''ভয় না পেলেই ভাল ।তারপরও বলছি রাতে সতর্ক থাকবেন'' কথাটা বলেই নিচে চলে যায় লাবন্য ।হিমেল দাঁড়িয়ে থাকে একা ।লাবন্য'র বলা কথাগুলো ভেবে হাসি পায় তার ।

(দুই)
...........
কয়েকদিন ধরে রুমে কিছুটা সমস্য হচ্ছে হিমেলের ।অফিস থেকে ফেরার পর দেখছে রুমের সব কিছু তছনছ করা ।মাঝে মাঝে রাতে দরজার বাইরে হাসির শব্দ, আবার কখনো কান্নার শব্দ শোনা যায় ।তার ধারনা তাকে ভয় দেখানোর জন্য লাবন্যই করছে এসব ভূতের ঢং।কিন্তু কেন এসব করছে লাবন্য !!এসব ভাবতে ভাবতে রুমে ঢুকে দেখে আজও রুমটা আগোছাল করে রাখা ।আজ অনেক আগেই অফিস থেকে ফিরেছে সে ।রুমের সব কিছু ঠিকঠাক করছে এ সময় ছাদে আসে লাবন্য ।রুম থেকে বেরিয়ে এসে হিমেল লাবন্যকে জিজ্ঞেস করে-''এত সুন্দর মানুষ আপনি আর কেন শুধু শুধু ভূত সাজার চেষ্ঠা করছেন''?
-''মানে কী''?
-''আমার রুমের একটা চাবি তো আপনাদের কাছে আছে ।এই সুযোগে আমাকে ভয় দেখানোর জন্য আপনি আমার রুমে ঢুকে রুমটা আগোছাল করে রাখেন''।
-''আমি কেন করতে যাব এসব''?
-''আমাকে ভয় দেখিয়ে রুমটা খালি করতে চাইছেন ? ঠিক আছে কিছুটা সময় দিন ।অন্য একটা বাসা পেলে আমি চলে যাব''।
-''আপনাকে কোথাও যেতে হবে না ।এখানেই থাকেন ।তবে আপনাকে sorry বলতে হবে''।
-''sorry কেন বলতে হবে ''?
-''আপনি যে আমার কান্না ঘরটা দখল করে নিয়েছেন তাই sorry বলতে হবে''।
-''o.k sorry .তবে আপনি ইচ্ছা করলে ঘরটা এখনো কান্নাঘর হিসাবে ব্যবহার করতে পারবেন ।আমিতো বাইরেই থাকি বেশির ভাগ সময়''।
-''না,এভাবে অন্যের ঘরে ঢুকে কান্না করতে ভাল লাগবে না ।ও হ্যাঁ,আপনি আমাকে আপনি আপনি করছেন কেন ?আমি তো আপনার ছোট তাই তুমি বলবেন''।
-''ঠিক আছে তাই হবে ।ও,ভাল কথা গতকাল তো অনার্সের রেজাল্ট বেরিয়েছে ।তোমার রেজাল্টের খবর কী''?
-''আলহামদুলিল্লাহ,ফার্ষ্ট ক্লাস পেয়েছি''।
-''ভেরি গুড ।রেজাল্টের মিষ্টি কই''?
-''মিষ্টিতো খাওয়াবেন আপনি আমাকে ।ভাল রেজাল্ট করলে appreciate তো করতে হয় না-কি''?
-''হুমম,তাই তো ।ঠিক আছে,তুমি যা খেতে চাও খাওয়াবো ।বল কী খাবে ?কাল অফিস থেকে ফেরার পথে নিয়ে আসবো''।
-''এই যে মিস্টার,আমি কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবো না ।তাছাড়া আমার কি হাত পা নাই নাকি যে আমি গিয়ে খেতে পারবো না !!যদি খাওয়াতেই চান তাহলে ফুঁচকা খাওয়ান আজ, এখনই''।
-''আজই খেতে চাও?এখন তো সন্ধ্যা হয়ে আসছে ।বাসা থেকে তোমাকে যেতে দিবে''?
-''আরে,আমার প্রিয় ফুঁচকার দোকানটা আমাদের বাসার পাশেই ।হেঁটেই যাওয়া যায়''।
-''তাহলে চল খেয়ে দেখি তোমার প্রিয় দোকানের ফুঁচকা খেতে কেমন''।

ঢাকা শহরে যত ফুঁচকা খেয়েছি তার মাঝে এই দোকানের ফুঁচকা সবচেয়ে ভাল লেগেছে ।আমি সিউর আপনারও ভাল লাগবে ।হাঁটতে হাঁটতে কথাগুলো বলে লাবন্য ।তারপর রেডিও জকিদের মত একে একে বলতে থাকে তার স্কুল এবংকলেজ লাইফের মজার মজার সব কাহিনী ।কোন ছেলে তাকে কীভাবে প্রপোজ করলো,কে তার উপর ক্রাশ খেল,সে কার উপর ক্রাশ খেল সব বলে যাচ্ছে অনর্গল ।বিস্ময় নিয়ে হিমেল শুধু শুনেই যাচ্ছে ।মাঝে মাঝে দু একটা কথা বলছে লাবন্য'র কথার বিপরীতে ।মেয়েটার কথা শুনতে বেশ ভাল লাগছে তার |অবাক লাগছে কী অবলীলায় মেয়েটা সব বলে যাচ্ছে হড়হড় করে ।দু,একদিন আগেও যে মেয়েটাকে তার বদরাগী আর একরোখা টাইপ মেয়ে মনে হত এখন সেটা মনে হচ্ছে না মোটেও ।বরংখুব সহজ সরল আর বন্ধু সুলভ মনে হচ্ছে ।ঠিক এই স্বভাবটাই যেন তার চেহারার সাথে যায় ।হিমেলের কাছে লাবন্যকে এখন আরো বহুগুন বেশি সুন্দর লাগছে আগের চেয়ে ।সে চুপ করে আছে দেখে লাবন্য বলল
-''আপনি কী আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছেন''?
-''আরে না,বরং ভালই লাগছে তোমার কথা শুনতে '' এরই মাঝে ফুঁচকার অর্ডার দিয়ে খাওয়া শুরু করেছে দু’জন ।খেতে খেতে হিমেল বলল ফুঁচকাটা আসলেই অসাধারন ।
-''বলেছিলাম না, অবশ্যই ভাল লাগবে আপনার ।আর এই ফুঁচকাটার মজা আরো বেড়ে যায় যখন আমি বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে এখানে দাঁড়িয়ে ফুঁচকাটা খাই''।
-''ফুটপাতে দাঁড়িয়ে খাওয়ার সাথে মজা বেড়ে যাওয়ার সম্পর্ক কী?
-''এতে এক ধরনের এ্যাডভেঞ্চার আছে ।তাই খেতে বেশি ভাল লাগে ।আমি সুযোগ পেলেই আমার ফ্রেন্ডদের এখানে নিয়ে আসি ।আপনিও কয়দিন খেয়ে দেখুন আপনারও শুধু এখানে খেতে ইচ্ছে করবে''।
-''তাই নাকি?আচ্ছা দেখা যাবে ।এবার চল বাসায় ফেরা যাক ।ফুঁচকার বিল মিটিয়ে হিমেল রিকশা খুঁজতে থাকে ।লাবন্য বাধা দিয়ে বলে চলেন হাঁটতে হাঁটতে যাই ।ভালই লাগছে হাঁটতে ।ফিরতি পথে হাঁটা ধরে তারা ।

( তিন)
..........
অফিস থেকে আজ একটু জলদি ফিরেছে হিমেল ।শুধু আজ না ইদানিং সুযোগ পেলেই অফিস থেকে জলদি ফিরে সে ।লাবন্য তাকে একদিন বলেছিল আপনি রোজ বিকেলে অফিস থেকে ফিরতে পারেন না ?সারাদিন ঘরে একা একা ভাল লাগে না ।বিকেলে আপনার সাথে একটু গল্প করে সময়টা বেশ ভাল কেটে যায় ।এরপর থেকে প্রতিটি বিকেলেই হিমেল ঘরে আসতে চেষ্টা করে ।আজও শরীর খারাপের কথা বলে একটু আগে ভাগেই চলে এসেছে ।সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতেই দরজার সামনে দেখা হয় লাবন্য'র সাথে ।ছাদে যাচ্ছে সে ।তাকে দেখেই একটা মুচকী হাসি দিয়ে লাবন্য বলল -''আপনি এত ক্ষেত টাইপ কেন ?একটু স্মার্ট হয়ে চলতে পারেন না'' ?
-''আমি এমনই ।ওভার স্মার্টনেস পছন্দ করি না ।আচ্ছা, হঠাৎ এ কথা কেন বলছো''?
-''আপনি প্রায় প্রতিদিন একই ধরনের ড্রেস পরে অফিসে যান ।আজকের এই ড্রেসটা গতকাল ও আপনার পরনে দেখেছি''।
-''হুমম,তোমার power of observation দেখি অনেক ভাল !!আসলে কাপড় ধোঁয়া,আয়রণ করা এগুলো ভাল লাগে না তাই ইচ্ছা করেই একটা কাপড় দুই দিন পরি''।
-''কাপড় ধোঁয়ার একজন মানুষ আনলেই পারেন''।
-''আমার মত ক্ষেত টাইপ মানুষকে কে পছন্দ করবে বল ''?
-''আরে ,আপনি মোটেও ক্ষেত না ।আপনাকে পছন্দ করার অনেক মানুষ আছে ।আচ্ছা,বাদ দেন এসব কথা ।আপনি কি ছাদে আসবেন''?
-''তুমি যাও, আমি ফ্রেস এন্ড আপ হয়ে আসছি''।
হাত মুখ ধুঁয়ে বাইরের কাপড়টা চেইঞ্জ করে কিছুক্ষনের মাঝেই ছাদে আসে হিমেল ।ছাদের এক কোনায় আনমনে দাঁড়িয়ে আছে লাবন্য । অপরূপ সুন্দর লাগছে তাকে ।যেন উজ্জ্বল আলোর বিচ্ছুরন ।তীব্র সৌন্দর্যে মাখামাখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন এক মানবী ।তীব্র তার চোখের দৃষ্টি ।মুখাবয়বের শীতলতা যে কোন কঠিন হৃদয়কে কাঁপিয়ে দেবে নির্ঘাত ।এই গোধূলী বেলায় পুরো ছাদের পরিবেশটাই লাবন্যে'র অবস্হানের কারনে যেন অন্যরকম সৌন্দর্য্যে লুটোপুটি খাচ্ছে ।কী এক ঘোর লাগা ঘোরো কিছুক্ষনের জন্য আবিষ্ট হয়ে থাকে হিমেল ।কী দেখছেন এমন করে? লাবন্যর কথায় বাস্তবে ফিরে আসে সে ।
-''না ,কিছু না ।তোমাকে দেখছি''।
-''আমাকে নতুন করে দেখার কী হল '!!
-''তোমাকে দেখছি আর ভাবছি একজন মানুষ এত সুন্দর হয় কী করে''।
-''আপনি কিন্তু বেশি বেশি বলে ফেলছেন''।
-''কেন? তোমাকে এই কথা আগে কেউ কখনো বলেনি ''?
-''বলেছে ।তবে আপনার মত এত সুন্দর করে কেউ বলেনি ।আসলে সুন্দর মন নিয়ে দেখলে সবকিছুই সুন্দর ।আচ্ছা, আপনি কি কখনো প্রেমে পড়েছেন ? i mean আপনার পছন্দের কেউ কি আছে''?
-''যদি একই প্রশ্ন আমি তোমাকে করি''?
-''আমি আগে প্রশ্ন করেছি,তাই উত্তরটা আপনি আগে দিবেন''।
-হুমম ,একজন আছে পছন্দের ।তবে সে আমাকে পছন্দ করে কি না জানি না''।
-''কখনো তাকে আপনার পছন্দের কথা বলেছেন?
-''নাহ্,বলা হয় নি ।তবে প্রতিদিনই তার সাথে দেখা হয়,কথা হয় কিন্তু ভয়ে পছন্দের কথাটা বলা হয় না''।
-''তাকে পছন্দের কথাটা অবশ্যই আপনার বলে দেয়া উচিত''।
-''বলবো খুব শ্রীঘ্রই ।এবার তোমার উত্তরটা শুনি''।
-''আমিও মনে হয় একজনকে পছন্দ করতে শুরু করেছি ।বুঝতে পারছি না কী ঘটছে আমার মাঝে ।সারাক্ষন তাকে দেখার জন্য অস্হির হয়ে থাকি ।আপনার মত আমিও তাকে পছন্দের কথাটা বলতে পারছি না''।
-''দ্বিধা না রেখে বলে ফেলো ।তোমাকে অপছন্দ করবে না কেউ-ই''।
-''হুমম |সেটা পরে দেখা যাবে এখন চলেন দুজনে চোখাচোখি খেলি''।
-''এটা আবার কী রকম খেলা''!!
-''চোখ বন্ধ না করে একজন আরেকজনের দিকে কতক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারে এটা সেই খেলা ।যে আগে চোখের পাতা বন্ধ করবে সে হেরে যাবে''।
-''বুঝলাম ।চল শুরু করা যাক''।
চোখাচোখি খেলা শুরু হয়েছে ।কিছুক্ষন লাবন্য'র চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে ইচ্ছা করেই হিমেল চোখ বন্ধ করে ফেলছে ।আর প্রতিবার খেলায় জেতার পর চরম আনন্দে লাফিয়ে উঠছে লাবন্য ।তার এই আনন্দ আর উচ্ছ্বলতা দেখতে বেশ ভাল লাগছে হিমেলের ।মুগ্ধ হয়ে সে তাকিয়ে আছে লাবন্য'র দিকে ।খেলার এক পর্যায়ে হিমেলকে অবাক করে দিয়ে লাবন্য বলল-''আপনি ইচ্ছে করে খেলায় হেরে যাচ্ছেন কেন''?মেয়েদের তৃতীয় একটা নয়ন থাকে,গভীর কোন কথা বা উদ্দেশ্য চট করে তারা তৃতীয় নয়নে দেখতে পায় বা বুঝতে পারে ।হিমেলের হেরে যাওয়ার ব্যাপারটাও তৃতীয় নয়নে লাবন্য ধরে ফেলেছে ।কিছুটা লজ্জিত হয়ে হিমেল বলল-''কী করে বুঝলে ?

-''প্রথমে বুঝতে পারি নি ।কিন্তু আপনি বার বার খেলতে চাওয়ায় বুঝলাম আমাকে খুশি করার জন্যই হেরে যাচ্ছেন ইচ্ছে করে ।its cheating ''
-''sorry আর cheating হবে না''।
-''তাহলে এবার অন্য একটা খেলা খেলি ।আমি যে বাক্য বলব এক সেকেন্ডের মাঝে আপনাকে তার বিপরীত বাক্য বলতে হবে ।দ্রুত বলতে না পারলে হেরে যাবেন''।
-''ওকে, আমি রেডি ।তুমি শুরু কর''।
-''আমি একটি মেয়ে ''।
-''আমি একটি ছেলে''।
-''আমি আকাশ দেখি''।
-''আমি পাতাল দেখি''।
-''অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে''।
-''আলোর দেখা মিলছে''।
-''i hate you''
-i love you''
হিমেলের এই কথাটা শুনার পর কিছুক্ষনের জন্য নীরব হয়ে যায় লাবন্য ।ভুলে যায় খেলার কথা ।তারপর অতি আনন্দিত হয়ে জিজ্ঞেস করে-''কথাটা কি সত্যি''?
-''যদি বলি হ্যাঁ''।
-''পাল্টা প্রশ্ন করবেন না ।সরাসরি বলেন হ্যাঁ অথবা না''।
-''হ্যাঁ''।
-''এত সাধারণ ভাবে ভালোবাসার কথা কেউ বলে ?আমার ইচ্ছে ছিল আমাকে কেউ প্রপ্রোজ করবে খুবই ব্যতিক্রম এবং আড়ম্বরপূর্ন ভাবে''।
-''ঠিক আছে আগামীকাল টিভিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে আমার ভালোবাসার কথা সবাইকে জানিয়ে দেব ।তার আগে খুবই সাধারন ভাবে আমি আরেকবার ভালোবাসার কথা বলতে চাই '' এ কথা বলেই লাবন্য'র সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে হিমেল ।হাতটা লাবন্য'র দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে-'' তুমি কি চিরদিনের জন্য তোমার হাতটা আমাকে ধরতে দিবে ''? কথার জবাব না দিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয় লাবন্য ।মুহুর্তেই হিমেলের মনটা বিশাদগ্রস্হ হয়ে উঠে । তাহলে কী এতক্ষন লাবন্য তার সাথে ফান করছিল ? সে কি তাকে ভালোবাসে না ?একটু সরে এসে লাবন্য'র মুখটা দেখার চেষ্টা করে হিমেল ।ওর চোখ দুটো ভিজে আসছে ।অথচ তাকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে এখন ।''মেয়েদের সবচেয়ে সুন্দর লাগে তাদের কেঁদে ফেলার আগ মুহূর্তে''মাইকেল এঞ্জেলোর এই কথাটা প্রথমবারের মত প্রমাণিত হল হিমেলের কাছে ।সে লাবন্য'র মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল-''কাঁদছো কেন !! বোকা মেয়ে '' চোখ মুছে লাবন্য জবাব দেয় -''এই কথাটা শুনতে আমাকে এত অপেক্ষা করতে হলো ।আরো আগে কেন ভালোবাসার কথা বললে না''?
-''ভয়ে বলি নাই ।যদি ফিরিয়ে দাও আমায়''।
-''তুমি কি এখন আমার হাত দুটো একটু ধরবে ।নাকি এখনও ভয় করছে ''?হিমেল আলতো করে লাবন্য'র দুটো হাত তার হাতের মাঝে রাখে ।চোখ দুটো লাবন্য'র চোখে রেখে বলে:-
“তোমার ঐ হাতে রেখে হাত
কেটে যাবে রাতের পর রাত ।
তোমার ঐ চোখে রেখে চোখ
এ জীবনে হবে যত সুখ ''।

(চার)
-----------
লাবন্য আর হিমেলের বিয়েটা হয়ে যায় খুব ধুমধাম করে ।তাদের একে অন্যকে পছন্দের ব্যাপারটা সহজেই মেনে নেয় দুই পরিবার ।লাবন্য তার পছন্দের কথাটা পরিবারকে বলায় কোন আপত্তি না করে বরং হিমেলের পরিবারের সাথে আলোচনা করে জলদি জলদিই বিয়ের আয়োজনটা শেষ করেন লাবন্য'র বাবা ।ছেলে হিসাবে হিমেলকে প্রথম থেকেই তার পছন্দ ।পরিবারের একমাত্র সন্তান হিমেল ।বাবার প্রচুর সম্পত্তি ।ঢাকায় নিজেদের বাড়ি, গাড়ি সবই আছে ।সবচেয়ে বড় কথা হিমেলের সাংবাদিক পেশাটার কারনেই হিমেলকে বেশি পছন্দ লাবন্য'র বাবার ।সাংবাদিক পেশাটার প্রতি কেন যেন তার এক রকমের দূর্বলতা আছে ।তার উপর বিয়ের কিছুদিন আগে পত্রিকা ছেড়ে একটি টিভি চ্যানেলের সিনিয়র ষ্টাফ রিপোর্টার হিসাবে জয়েন করে হিমেল ।এ কারনেই হিমেলকে সব দিক দিয়ে খুব পছন্দ করে লাবন্য'র পরিবার। বিয়ের পর প্রথম ক'মাস যেন হাওয়ায় ভাসতে থাকে লাবন্য আর হিমেল ।অফিস থেকে দু'মাসের ছুঁটি নেয় হিমেল ।তাদের টিভি চ্যানেলটি এখনও সম্প্রচারে না আসায় এই ছুঁটিটা পায় সে ।তাই অফুরন্ত সময় দুজনের হাতে ।হানিমুন থেকে ফিরে দুজনে ইচ্ছে মতো ঘোরাঘুরি করা ,বাইরে খেতে যাওয়া, শপিং করা, হিমেলের আত্নীয় স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া এবং বিশেষ করে জোছনা রাতে ঢাকার বাইরে গিয়ে খুলা প্রান্তরে বসে জোছনা দেখা তাদের রুটিনে পরিনত হয় ।দিন রাত কীভাবে কেটে যায় টেরও পায় না লাবন্য ।এত সহজে তার স্বপ্নগুলো পূরন হবে তা যেন বিশ্বাসই করতে পারে না সে ।সব সময় মনে হয় সে কি কোন স্বপ্নের মাঝে আছে ? ঘুম ভেঙ্গে গেলেই তার সুন্দর স্বপ্নটাও মিলিয়ে যাবে ।কিন্তু হিমেল লাবন্যকে চিমটি কেটে বুঝিয়ে দেয় তারা বাস্তবেই আছে ।কিন্তু সুখের সময়টা ফুরিয়ে যায় দ্রুত ।হিমেলের ছুঁটি ফুরিয়ে যায় ।কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে হিমেল ।আগের মতো ঘোরাঘুরি আর জোছনা দেখা হয় না দুজনের ।ছুটির দিনে শুধু সময় পেলে দুজনে বাইরে খেতে যায় ।তাও সব ছুটির দিনে না ।একা একা ঘরে বসে থাকতে থাকতে ভাল লাগে না লাবন্য'র ।শ্বশুর, শ্বাশুড়ী ঘরে থাকায় আগের মত বাইরে গিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডাও দেয়া যায় না আর ।সারাদিন ঘরে বসে বন্ধুদের সাথে ফেসবুকে চ্যাটিং,টিভি দেখা, খাওয়া দাওয়া আর বাকি সময়টা ঘুমিয়ে কাটায় লাবন্য ।এসব কোন কিছুই আর ভাল লাগে না এখন ।সব কিছুতেই বিরক্তি এসে গেছে। শ্বশুর, শাশুড়ী ছাড়া ঘরে কথা বলারও একটা লোক নেই ।হিমেল সেই সকালে অফিসে যায় আর ফিরে রাতে ।এসব কারনে জীবনটা দূর্বিসহ হয়ে উঠতে থাকে লাবন্য'র কাছে।একটা সন্তান নিলে তাকে নিয়েই তার সময়টা বেশ কেটে যেত ।কিন্তু হিমেল এখনই সন্তান নিতে চায় না ।তাই লাবন্য সিন্ধান্ত নেয় সে চাকরী করবে ।মাষ্টার্স দিয়ে ঘরে বসে থাকার মানেই হয় না ।সময়টাও ভাল কাটবে ।একটা টিভি চ্যানেলে সংবাদ পাঠিকা নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেখে বায়োডাটা রেডি করে লাবন্য ।কিন্তু পুত্রবধুর চাকরী করার ব্যাপারটা সমর্থন করেন না হিমেলের বাবা মা ।হিমেলও চায় না বাবা মা'র অমতে লাবন্য চাকরী করুক ।তাছাড়া চাকরী করার অনেক ঝামেলা আছে ।কী দরকার শুধু শুধু কষ্ট করার ।লাবন্যকে চাকরীর চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে বলে হিমেল ।এখানে ভাল না লাগলে কয়দিন বাবার বাসা থেকে বেড়িয়ে আসতে পরামর্শ দেয় সে।কিন্তু বুঝতে পারে না লাবন্য'র মানসিক অবস্হা ।

কয়েকদিন ধরেই লাবন্য'র মন খারাপ ।আজ আরো বেশি খারাপ ।আজ তার জন্মদিন আর আজও সেই সকালেই অফিসে চলে গেছে হিমেল ।রাত বারোটা বাজতেই তার দুজন ফ্রেন্ড তাকে উইশ করেছে অথচ হিমেল সকালে অফিসে যাওয়ার সময় উইশ করে গেছে ।তাই এই বিশেষ দিনটা লাবন্য'র কাছে অন্যান্য দিনের চেয়েও খারাপ মনে হচ্ছে ।তার কাছের বন্ধুরা এই বিশেষ দিনে তাকে নিয়ে বার্থডে পার্টি দিতে চেয়েছিল কিন্তু রাগ করে লাবন্য বন্ধুদের মানা করে দিয়েছে ।বলেছে আজ তার অন্য কাজ আছে ।সকাল থেকে কারো ফোন ও রিসিভ করছে না ।দুপুরের দিকে মোবাইলটা অফ করে শুয়ে থাকে লাবন্য ।হঠাৎ হিমেলের ডাকে ফিরে তাকায় সে ।বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে হিমেল ।তার মুখটা হাসি হাসি ।হাতে একটা অফিসিয়াল খাম ।হিমেল তার হাতের খামটা লাবন্য'র হাতে দিয়ে খুলতে বলে ।খামটা খুলে খুশিতে নির্বাক হয়ে যায় লাবন্য ।তার চাকরীর appointment লেটার ।হিমেল যে চ্যানেলে কাজ করে ঐ*টাতে সংবাদ পাঠিকা হিসাবে নিয়োগে পেয়েছে সে ।কাগজ থেকে চোখ তুলে হতবাক হয়ে লাবন্য প্রশ্ন করে-''আমি তো কোনখানেই বায়োডাটা জমা দেই নি !!এটা কীভাবে সম্ভব''?

-''যখনই জানলাম আমাদের চ্যানেলে সংবাদ পাঠিকা নিয়োগ দেয়া হবে তখন তোমাকে না জানিয়ে ড্রয়ারে রাখা বায়োডাটা নিয়ে আমিই জমা দেই ।অফিসিয়ালি আরো দুইদিন পর letter টা তোমার পাওয়ার কথা কিন্তু তোমার জন্মদিনে সারপ্রাইজ গিফ্ ট দিতে আজও আমাকে অফিসে যেতে হল হাতে হাতে এটা নিয়ে আসার জন্য” হিমেলের কথা শুনে নির্বাক হয়ে যায় লাবন্য ।খুশিতে তার চোখ দিয়ে পানি এসে গেছে ।সে মাথা নুইয়ে ফোঁপাচ্ছে ।ওর রেশমী চুলগুলো মুখের উপর এসে পড়েছে ।হিমেল আলতো ভাবে লাবন্য'র মুখ চেপে ধরে নোয়ানো মুখটা তার দিকে তুলে ধরে ।আলতো হাতে লাবন্য'র মুখের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে বলে এবার একটু হাসো, প্লিজ ।অনেকদিন ধরে তোমার মুখে হাসি দেখি না ।তোমার ঐ হাসি না দেখলে আমার পৃথিবীটাই যে অন্ধকার হয়ে থাকে ।হিমেলের কথায় চোঁখের পানি মুছে ফিক করে হেসে দেয় লাবন্য ।
 
Top