গোলাপের শরীর, পায়ের আলতা, হাতের মেহেদি, কপালে ঐ লাল টিপ, ঈদে লাল টকটকে জামা আর গায়ের বধূর লাল শাড়িতে কত সুখ যে লুকিয়ে থাকে তার হিসেব কেউ দিতে পারে না। এমনি লাল রঙের পাগল অনেকে। কিন্তু কেন মানুষ লাল রক্তের পাগল হয়?
খবরপিচ ঢালা পথে আজগরের বুক রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। সদ্য গরু জবাই করলে যেমন রক্ত ঠিক তেমনি
রক্তগুলো ভেঁসে যাচ্ছে রাস্তা ওপর দিয়ে। আজগর আলী ফল ব্যবসায়ি। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে। গ্রামের ছেলে জীবন ও জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় চলে এসেছে সেই ৯০ এর গণ আন্দোলনের সময়। এসেই পাঁকা পেঁপের ব্যবসায় শুরু করেছিল। ৯০ এ আজগরের পেঁপের ব্যবসায় ছিল জমজমাট। পল্টন আর বাইতুল মোকারম এলাকা আজগর ফালি ফালি পাঁকা পেঁপে পলিথিনে ভরে দৌঁড়ায়ে দৌঁড়ায়ে বিক্রি করতো মিছিলে মধ্যে। অনেক নেতাই তাকে চিনতো বিশেষ করে ছাত্র নেতারা। আজগর কোনো নেতার পাশে গিয়েই দাঁড়িয়ে একফালা পেঁপে বের করে দিয়ে বলতো-
ভাইজান, এইড্যা খাইয়্যা লন। যে গরম পড়ছে, মাথা ঠা-া থাকবো।
আজগরের অভ্যাস ছিল, পেঁপে দিয়ে কারো কাছ থেকে টাকা চাইতো না। ফলে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নেতা ও ছাত্রনেতারা আজগরের পেঁপের দাম দিত প্রায় ৬/৭ গুণ বেশি।
একদিন এক বড় দলের কর্মী আজগরের এক ফালি পেঁপে খেয়ে খুব খুঁশি হন। সদ্য বিদেশ ফেরত সেই কর্মী পরের দিন আজগরকে তার অফিসের ঠিকানা দিয়ে দেখা করতে বলেন। আজগর সকাল ১১টার মধ্যে তার গুলশান অফিসে চলে যায়। এমডির রুমের সামনে দাঁড়ানো আজগরকে দেখে দারোয়ান ছুটে আসে।
এই তোমার নাম কি?
আজগর।
এখানে কি চাও?
সাহেব দেখা করতে বলছে।
এমডি স্যার?
জ্বি।
দারোয়ান আজগরের নাম ঠিকানা নিয়ে এমডির রুমে ঢুকে পড়ে। কিছুক্ষণ পর বের হয়ে এসে আজগরকে বলে
তোমাকে সাহেব ভিতরে ঢাকছে।
আজগর সালাম দিয়ে রুমে মধ্যে ঢুকে পড়ে। বিশাল অফিস, ঠা-া রুম আর দামী দামী জিনিসপত্র দেখে আজগরের চোখ ওপরে ওঠে যায়। এত টাকার মালিক, যে নাকি দুই চার বিশটা নেতা কিনতে পারে সে কিনা কর্মী?
এমডি সাহেব আজগরকে পাশের চেয়ারটায় বসতে বলে। এমডি সাহেব কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছেন। ফোনটা রেখে এমডি সাহেব আজগরের কাছে জানতে চায়-
কেমন আছো আজগর?
ভাইজান আল্লাহ এই গরিবরে ভালোই রেখেছেন।
আচ্ছা আজগর তুমি এই পেঁপেগুলো কোথায় পাও?
ভাইজান সবই আমার বাড়ি থাইক্যা আনি। উন্নত জাতের অনেক পেঁপের চারা মারে কিনে দিছি। মায় সেইগুলো পুসকুনির পাড় দিয়া লাগাইছে। শত শত পেঁপে ধরছে ভাইজান। আল্লাহ গাছের গোড়া থাইক্যা মাথা পর্যন্ত ভইর‌্যা দিছে। আপনারা দ্যাশের ভালোর জন্য এ গরমের মধ্যে যে কষ্ট করতাছেন তাই দেইখ্যা মনটা কাঁদে। তাই গ্রারাম থাইক্যা পেঁপে আইন্যা বিক্রি করি। আমারও দুইড্যা পয়সা হয় আর আপনাদেরও আসল জিনিসটা খাওয়াতে পারি।
বাড়িতে কে কে আছে?
আমার মা, আর ছোট দুইড্যা বোন। ওরা পড়াশুনা করে। বাবা ক্যান্সারে মারা গেছে ৭ বছর আগে।
ভাইজান, কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করি?
কর।
আপনে কষ্ট কইর‌্যা মিছিল মিটিং করেন কেন? আপনের যা অবস্থা দেখতাছি তাতে আপনি চেয়ারে বইস্যা খালি হুকুম দিবেন, দেখবেন নেতারা আপনার অফিসে আইস্যা হুড়মুড় কইর‌্যা পড়তাছে।
আজগর তুমি বুঝতে পারছো না এই স্বৈরাচার আমাদের দেশের কত বড় ক্ষতি করছে।
কিছুটা বুঝি ভাইজান।
কি বুঝ?
এই ধরণের এই সরকারের সময় কষ্ট কইর‌্যা ভোট দিতে হয় না। যারা ভোট কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকে সকাল ১১টার পর হেরাই হিসাবের মেশিন লইয়্যা বসে। এরপর সরকারকে কত অংশ দেবো আর বিরোধী দল কত অংশ দেবো এইড্যা হিসাব কইর‌্যা বাইর কইর‌্যা শুরু হয়ে যায় ব্যালট পেপার কাটার কাজ। ভাইজান, আমাগো গ্রারামে বারেক নামে একটা ছেলে আছে, ব্যালট পেপার কাটার ওস্তাদ। ভোটের আগের রাইত থাইক্যা বারেকের সন্ধান করতে থাকে বিভিন্ন কেন্দ্রের সরকারি দলের মানুষগুলো। কারণ বারেকের মত এত তাড়াতাড়ি কেউ ব্যালট পেপারে এত নিখুঁত ভাবে সিল মারতে ও ভাজ করতে পারে না।
কী বলছো আজগর তুমি?
হ্যা ভাইজান ঠিক কথা কইছি। আরো শুনবে?
বলো-
এই শালার সরকার দেখবেন গ্রাম গঞ্জে ব্রিজ আর কালভার্ট কইর‌্যা ভইর‌্যা ফেলাইছে।
ভালোই তো করেছে।
ভাইজান, দূর থাইক্যা দেখলে মনে হইবো কত কাজই না করছে কিন্তু কাছে গেলে সাদা ফকফকা!
সেটা আবার কী?
ঐ যে ভোট কাটার প্লান কইর‌্যা ব্রিজ করছে।
একটু খুলে বলো তো-
ধরেন এইখানে একটা ব্রিজ দিছে এর আধা মাইল দূরে একটা ভোট কেন্দ্র। এখন এই ব্রিজের চওড়া যা করছে তাতে ওহ ওপর দিয়ে কোনো বাস-ট্রাক যাইতে পারবো না শুধু প্রাইভেটকার আর জিপ ছাড়া।
তাতে সমস্যা কী?
ভাইজান আপনারা এতবড় নেতা হইছেন আর এইড্যা বুঝেন না?
সত্যি বুঝতে পারছি না।
ধরেন, ১১টার সময় বারেককে নিয়ে সরকারি দলের নেতারা প্রাইভেটকার যোগে কেন্দ্রে উপস্থিত হল। বারেককে বইল্যা দেয়া হইল ১ ঘন্টার মধ্যে ৬০% ভোট কাইট্যা বাক্সে ভরতে। আর ১ ঘণ্টা পর দাঙা পুলিশ ট্রাক ভরে কেন্দ্রে উপস্থিত হইবো। সরকারি দলের লোকজনই পুলিশকে খবর দিতে কেন্দ্রে ভোট কাটা হইতাছে বইল্যা। পুলিশ আইস্যা পড়তো মাইনক্যা প্যাঁচে।
কী রকম?
এখন এই ব্রিজের ওপর দিয়া তো ট্রাক যায় না। পুলিশকে নাইম্যা হাঁইট্যা যাইতেছে হইবো। এর মধ্যেই বারেক প্রাইভেটকার যোগে অন্য রাস্তা দিয়া তার কনটাকের টাকা নিয়া পালাইয়া যাইতো।
আজগর তুমি তো দেখছি বিশাল এক অনিয়মের কথা বললে যা বাংলাদেশের শতকরা ৯০ জন লোকই জানে না।
সবাই জানে ভাইজান শুধু আপনি জানেন না।
যাকগে সেসব কথা, কেন দেখা করতে বলছেন?
এমডি রণি চৌধুরী ড্রয়ার থেকে একটা ৫০০ টাকার বা-িল আজগরের হাতে দিয়ে বললো-
এইখানে ৫০,০০০/- টাকা আছে। এখন থেকে এই টাকা দিয়ে তুমি পেঁপের সাথে লিচুর ব্যবসায় করবে। আজকে তুমি আমার যে কোটি কোটি টাকা সম্পত্তি দেখছো তার প্রথম শুরু হয়েছিল এই লিচু ব্যবসায় দিয়ে। আমি লিচুর ব্যবসায় করে কিছু টাকা জোগার করি। সেই টাকা দিয়ে প্রথমে ইটালি চলে যাই। এরপর আমেরিকা, ইউরোপ ভেঁজে খেয়েছি। বিদেশে আমার ১৮টির মত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এখনো চালু আছে।
তই ভাইজান, আপনে রাজনীতি করেন ক্যান?
সেটা তুমি বুঝবে না। এই স্বৈরাচার আমার যে কত বড় ক্ষতি করেছে তা ভাষায় বুঝানো যাবে না।
একটু ইঙ্গিতে বলেন।
আজগর!
মাফ চাই ভাইজান, আমার অন্যায় হয়েছে। ভাইজান আমার টাকার দরকার নাই, আমি শুধু আপনার পা-টা ছুয়ে যাই?
কেন তুমি মানুষ হয়ে মানুষের পা ছুবে?
অবশেষে বাধ্য হয়েই আজগর টাকাটা নিল এবং মনে মনে নিয়ত করলো ভাইজানের এই টাকা দিয়া সে অবশ্যই লিচুর ব্যবসায় করবে তবে মাইয়ের পেঁপের ব্যবসায়টাও সে ছাড়বে না।
আজগর বেড়িয়ে আসার পর রণি সাহেব পাশের টিস্যু বক্স থেকে একটা টিস্যু নিয়ে চোখের কোণে জমে থাকা পানিটুকু মুছতে লাগলো। তার সারা জীবনের ভালোবাসার মানুষটি ছিল ‘জারা’। তার জারাকে এই কুত্তার বাচ্চা নষ্ট করেছে। রণির যত সম্পদ আছে তা বিনিময়েও যদি এই স্বৈরাচারকে হটানো যায় তাও করবে সে।
রংপুর থেকে লিচুর চালান নিয়ে আজগর ঢাকায় পৌঁছে সন্ধ্যা ৬টার দিকে। ঐদিন হেফাজতে ইসলামের একটা কর্মসূচী ছিল ঢাকায়। ঢাকা অবরোধ কর্মসূচী। আগের কর্মসূচীতে আজগর হুজুরদের অনেক পানি সরবরাহ করেছে। বিনিময়ে কোনো টাকা পয়সা নেয় নি। যদি আল্লাহ এই গরিবের এই দানটুকু কবুল করে হাশরে মাফ করে দেয় সেই আশায় আজগর টাকা নেয় না। মাগরিবের নামাজের পর থেকেই হঠাৎ বাইতুল মোকারক এলাকায় গোন্ডগোল বেঁধে যায়। কে কার সাথে গোন্ডগোলে জড়িয়ে পড়ে আজগর তা বুঝতে পারে না। রিকসা ভ্যানে তার প্রায় ১ লক্ষ টাকার লিচু রয়েছে। রিকসাওয়ালা সামনে যেতে অস্বীকার করে। আজগর তার হাত ধরে বলে,
ভাই, তুমি যদি আমারে এইখানে ফালাইয়্যা যাও তইলে আমার লাখ টাকার মাল শেষ হইয়্যা যাইবো। আমি পথের ফকির হইয়্যা যাইবো। আমার সারা জীবনের সঞ্চয় রাস্তায় শেষ হইয়্যা যাইবো। কথার ফাঁকে ফাঁকে শুরু হয়ে গেল টিয়ারশেল নিক্ষেপ। পুলিশের সাথে কিছু সাদা পোশাকের মানুষ অনবরত ককটেল নিক্ষেপ করতে লাগলো হুজুরদের দিকে। হুজুরাও বসে নেই তারাও ইট পাথর ছুড়ছে পুলিশের দিকে। মূহুর্তের শুরু হয়ে গেল গোলাগোলি। বৃষ্টির মত গুলি চলতে লাগলো। ভ্যানওয়ালা ভ্যান ফেলে দিয়ে ছুটে পালালো গলির মধ্যে। কিন্তু আজগরের যাওয়া হলো না। সে লিচুর ঝুড়িগুলোর ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে দুহাত দিয়ে ধরে রাখলো। এ পাশ থেকে কেউ যেন আজগরকে ফলো করলো। সে ভাবলো শালা ভ্যানের ওপর শুয়ে পজিশন নিয়েছে। নিশানা ঠিক করে চালালো গুলি। গুলিটি আজগরের মাথা ভেদ করে পিট দিয়ে বেড়িয়ে গেল। আজগর লুটিয়ে পড়লো পল্টনের রাস্তায়। লাল রক্তে ভেঁসে যাচ্ছে রাস্তা। এক হাতে লিচুর ঝাকা ধরে থাকায় পড়ার সময় লিচুগুলি আজগরের শরীরের ওপরে এমন ভাবে পড়লো তা দেখলে দূর থেকে মনে হবে লাল চাদর পড়ে কে যেন শুয়ে আছে! আজগরের অন্য হাতে ছিল কালো একটি রুমাল। টি-আর গ্যাসের হাত থেকে বাঁচার জন্য যে কালো রুমাটি মুখে দিয়েছিল, সে রুমাটি মুখে দেয়াই আছে। রাত ৯টার দিকে আজগরের মৃতদেহটি যখন উদ্ধার করা হয় তখন অনেকেই তাকে হেফাজতের কর্মী, কিংবা শিবিরের কর্মী বলে মন্তব্য করতে থাকে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস!
আজগর বেঁচে থাকলে অনেক নতুন কথা জানা যেত যেমন জেনেছিলাম ৯০ এর গণ আন্দোলনের কথা। আজগররা ইতিহাস বিখ্যাত হয় না তবে আজগরদের রক্ত কোনোদিন বৃথা যায় না। কেননা আজগররা মানুষকে ভালোবাসে।

রাশেদ আজাদ
কবি ও লেখক
সূত্রে হ্যালো টুডে 
 
Top