চাঁদচুড়া আমার/ বুকজোড়া আমার সাতনলী।
টিপসগৌর আমার শঙ্খ শাড়ি -/ গৌর মালা পুঁইছে পলা চুল বাঁধা দড়ি/
গৌর দুই হাতের চুড়ি/ সে যে আমার গৌর, গৌর কাঁচুলি।

এখন কত রাত? সাঁই বলছে, একটু বেশি!

মঞ্চে দিব্য জমে উঠেছে সাধনগান। কাওয়ালি শুনছে জনতা এখন। সকলের চোখে মুখেই দারুণ কৌতুক! একটু আগে গান শুনিয়ে গেলেন দুই বাংলার তত্ত্বজ্ঞানী ফকির-ফকিরানী। অপূর্ব সে গানের নিবেদন! এরপর এবছরের আসরের শেষ আকর্ষণ পাল্লাগান, তারপর যুগলমিলন!

নিতান্ত নীরবে গান শুনছিলাম রঞ্জার পাশে বসে। কোহল আর মণিপুরি মশলার পর পর রিফারে দু’জনেই মাতোয়ারা। কীর্তন এরপর কী যে হবে! খঞ্জনি মনের অবশ্য কোনও চাপ নেই! যাদবপুর শক্তিগড়ের মতো এমন সব সহজিয়া উৎসবে এলে সে সারাক্ষণ যেন ‘আপন ঘরের পরের আমি’ হয়ে বসত করে! সে সমঝদারির তোয়াক্কা করে না।

একসময় আসরের মৌতাত ছেড়ে আমরা উৎসব উঠোন লাগোয়া একটি বাড়ির, অস্থায়ী রাত আখড়ায় ঢুকে পড়লাম সারিন্দার সুর শুনে। ঢুকে দেখি, মুর্শিদাবাদের ফকির নূর আলি সুর তুলেছেন টোঙের ঘোরে। ওপাশে, বোলপুরের লক্ষণ দাস বাউল। চোখে চোখে কুশল বিনিময় হল। গাঁজার গন্ধে ছয়লাম ধোঁয়া ঠেলে একটু একটু করে সহজিয়া নিশিঠেকের আসরে ঠাঁই হতেই ঠাহর হল চারপাশের অন্যসব প্রিয় স্বজন, বন্ধুদের মুখগুলি। সারিন্দার চড়া পর্দার সুর থামলে গান ধরলেন নদীয়ার গৌর সাধিকা সুধা বাউলানি। ‘গৌর চাঁদচুড়া আমার/ বুকজোড়া আমার সাতনলী’। আহা! নারীর নিত্য মধুরিমায় গৌর-গাথা গাইছিলেন মধ্য ত্রিশের কৃষ্ণকলি বাউলানি। গানের মাঝে গানের গহন কথার কথক সুধার চোখ দুটিতে এত প্রেম!

রাত আখড়ায় বসে এমন বাউলানির গান তো কম শুনলাম না! রঞ্জা কখনও এ নিয়ে বাধেনি আমায়। বরং আমি নিজেই অন্তর্লীন গানের কথা বলতে বলতে ওকে জিজ্ঞেস করেছি বহুবার। জানতে চেয়েছি, ওর এমন বেপরোয়া উদাসীনতার কারণ। মধুর হেসে ও ঠিক ততবার এড়িয়ে গেছে। কখনও বহু জনতার মাঝে চোখে চোখে আদর করতে করতে শুনিয়েছে একটি গৌরাঙ্গ গানের মধ্যপদ, ‘সে-অগ্নিতে হলে দাহন/ হয়ে যাবে অগ্নিবাহন/ কর্ম হবে সিদ্ধ কারক/ কাঞ্চন বর্ণ হবে তার’। গৌরনগরে রঞ্জার সুরাতিয়া উড়ানে নতজানু হয়ে আমাকেও মুখড়ায় ফিরে গাইতে হয়েছে, ‘গৌর তুমি দেখা দাও এবার’।

খাস কলকাতা শহরে বছরে দুটি দিন এমন লৌকিক নিশিঠেক, সত্যিই সহজ ধারা সঙ্গ যাপন। কলকাতার রেস্তো-বার, উলুখুলু রঙ-রসিয়া পানশালা, শহরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা গোপন এলিটি নিশিনিলয়, বউবাজার-পার্ক স্ট্রিট অথবা, চাঁদনি চকের নিয়ত ছুঁক-ছুঁক ছায়াবাজি সরিয়ে কখনও সখনও রাতের মৌতাতে এমন সব অজানা ঠেকের সাকিন নিঃসন্দেহে শান্তির শরণ এনে দেয় অন্তরমহলে। অন্তরে সেই নিশি উদযাপনের মিঠে আরামের বিভা রঞ্জার শরীরেও। দু’ হাতের বেড়ে ওকে হৃদমাঝারে ধরে রেখেছিলাম এতক্ষণ! ফিসফিসিয়ে ও আশ্চর্য একটা কথা বলল,

- গৌর কথাটার ভিতর কত আলো তাই না!

মনে পড়ল, ছেলেবেলায় গ্রামের চব্বিশ প্রহরে হীরুঠাকুরের গাওয়া কীর্তন গানে গৌরাঙ্গপদ শুনেছিলাম প্রথম। তারপর কত আখড়ায়, কত মহতী গুণিজনের গানে। কেউ তো কখনও এমন করে বলেনি, গৌর কথাটার মধ্যে এত আলোর কথা! এমনতরো মূ্হুর্তে রঞ্জাবতীকে অপলক দেখি আর তারাপদ রায়ের ‘একেকদিন’ বলি, ‘মনে হয়, মনে হয় এর হাতে ভাগ্য ভবিষ্যত/ সমর্পণ করে এক জন্ম চোখ বুজে ভাসা যায়’! বাউলানির গান ফুরোচ্ছে। গাবগুবি আর দোতারার যুগলবন্দীতে চমক ভেঙে বললাম,

- রঞ্জা, গোরা সাধন এক সুদীর্ঘ সময়ের লোকায়ত বিশ্বাস। যার ভিত অনেকটাই মিথ নির্ভর। নানা সম্প্রদায়ে তার নানা ব্যাখা। তুমি সুধীরবাবুর বইতে খানিকটা পাবে। কিন্তু, এসব গোপ্য তর্কের বাইরে সত্যিই গৌর কথাটায় অপূর্ব আলো আছে! দেহের ভিতর যেমন নদী আছে! সেই যে লালন শা-র গান আছে না, ‘দেহের মাঝে নদী আছে’।

ঠিক পাশেই বসে ছিল তারক দাস বাউল। কেঁদুলির গুণি বাউল কানাইলাল বাউলের ছেলে তারকদা। কেঁদুলির কাঙাল খ্যাপার সমাধি মন্দিরে বসে প্রথম আলাপ হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। নিশ্চয় আমাদের কানাকানি শুনে ফেলেছে! তাই রঞ্জাবতী কিছু বলার আগেই তারকদা উঠে দাঁড়িয়ে ধরল লালন শা’র ওই পদটি, ‘দিল-দরিয়ার মাঝে দেখলাম আজব কারখানা।/ ডুবলে পরে রতন পাবে ভাসলে পরে পাবে না’।,

- তোমার গৌর আর আমার ফকির একাকার হয়ে গেল ওই দেখো!

ক্রমশ…

-আবীর মুখোপাধ্যায়
 
Top