সময় সন্ধ্যা সাতটা পনেরো মিনিট।
বোকা ছেলেঅফিস থেকে বের হয়ে সোজা ফুটপাতে হাটা শুরু করলাম। কত দূর যেতে না যেতেই পেছন থেকে কেউ একজন স্যার বলে ডাক দিল, আমি পেছনে ফিরে তাকালাম। নীলা -
- কি ব্যাপার স্যার, আপনার গাড়ি? আজ হেটে হেটে বাসায় যাচ্ছেন যে?
- না এমনি, হাঁটতে ভালো লাগছে, হাঁটবো কিছু সময়
- যদি আমিও আপনার সাথে হাটতে চাই, আপনি কি খুব রাগ করবেন?
- রাগ করাটা কি যুক্তি যুক্ত হবে?
- না মনে হয়
- তাহলে হাটতে পারো, রাগ করবো না

আমার উত্তর শুনে নীলা প্রশান্তির একটা ছোট্ট হাসি দিল। বছর খানেক হবে এসিস্টেন ডিরেক্টর হিসেবে অফিসে জয়েন করেছে। ভীষণ মিষ্টি একটা মেয়ে। মুহূর্তেই যে কারো মনে জায়গা করে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। অফিসিয়াল ম্যাটার ছাড়া এটা ওর সাথে আমার চতুর্থ কথোপকথন। আপাতত চুপ চাপ হাঁটছি দুজন। কত টুকু হাঁটার পর খেয়াল করলাম, নীলা কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে আমাকে। হয় তো সাহস করতে পারছে না। আমি সাহায্য করলাম ওকে
- কিছু বলবে?
- আমার মাঝে মাঝেই ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে উনাকে। মানুষ এত বোকা কি করে হয়?
- আমাকেও তোমার কাছে বোকা মনে হয়?
- হুম হয়, উনার চেয়ে বেশি বোকা মনে হয় আপনাকে, আপনি হচ্ছেন বোকা দ্যা গ্রেট
আমি মৃদু হাসলাম, নীলা কিছুটা বিরক্ত হল। ওর ধারণা আমি সব সময়ের মত এবারও ওর এই কথার বিপরীতে কোন উত্তর দিবো না। নীলার ধারণা ভুল। আমি উত্তর দিবো। তবে মনে মনে। আমি উত্তর দিলাম। নীলা শুনল না। মন ভীষণ নিঃশব্দে কথা বলে। বাহির থেকে তা শোনা যায় না। আমার মনে মনে উত্তর দেওয়া শেষ হতে না হতেই নীলা আবার প্রশ্ন করলো -
- আচ্ছা, আপনাদের পরিচয় কি করে হইছিল?
- একাডেমির ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিছিলাম ওকে, ওখান থেকেই পরিচয়
আমার উত্তর শুনে নীলা হা করে আছে, ওর হা করা দেখে মনে হচ্ছে এত আশ্চর্যকর কথা ও আর কোনদিন শুনেনি, নিঃশ্বাস না ফেলেই বিস্ময়ের কণ্ঠে প্রশ্ন করলো
- ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিছিলেন? কিন্তু কেন?
- কেন তা ঠিক বলতে পারব না, সম্ভবত ও চাইছিল যেন ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই, সে জন্য
- মানে?
- মানে, তখন ভার্সিটি জীবন শুরু মাত্র। প্রয়োজন বশতই কিছু ফ্রেন্ড হয়। ছেলে ফ্রেন্ড, কোন মেয়ে ফ্রেন্ড ছিল না আমার। নিয়মিতই ক্লাসের ফাঁকে সবাই আড্ডা দিত আর আমি পাশে বসে চুপ চাপ ওদের আড্ডা উপভোগ করতাম। অবশ্য চুপ চাপ থাকার একটা কারণও ছিল। আড্ডার মুল বিষয় বস্তু থাকতো ভার্সিটির সুন্দরী রমণীরা। আর রমণী প্রসঙ্গে আমার জ্ঞান ছিল প্রায় শূন্যের ও নিচে। নিয়মিত প্রসঙ্গ ধরেই সেদিন তন্দ্রা'কে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তুমি যাকে উনি বলে ডাকো, তাকে নিয়ে। আমাদের ফ্যাকাল্টির অন্যতম এট্রাকটিভ সুন্দরী রমণী। সবাই এক এক করে উপস্থাপন করছিল এই মুহূর্তে তন্দ্রা'কে সামনে পেলে কে কি করতো। সবার ইচ্ছে প্রকাশের পর্ব প্রায় শেষ, শুধু আমি বাকি ছিলাম, আড্ডার নিয়ম অনুযায়ী আমাকেও ইচ্ছে ব্যাখ্যা করতে হবে। সবার দৃষ্টি আমার দিকে। অন্তু আমাকে প্রশ্ন করলো আমার ইচ্ছে সম্পর্কে। আমি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উত্তর দিলাম -কি আর করতাম সামনে পেলে, এখান থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিতাম। আমার উত্তর শুনে অন্তু আর সুজয় আশ্চর্য হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর সবাই ইয়ে মানে করতে করতে এদিক ওদিক তাকাতাকি করছে। কিছু বুঝতে না পেরে পেছনে তাকালাম আর আবিষ্কার করলাম স্বয়ং তন্দ্রা ঠিক আমার পেছনেই দাড়িয়ে আছে। তন্দ্রার মুখের দিকে তাকিয়ে অনুমান করতে কষ্ট হল না যে সিচুয়েশন খুব একটা সুবিধার না। সাধারণত সুন্দরী মেয়েরা রেগে গেলে তাদের ঠোঁট প্রায় বত্রিশ ডিগ্রি এঙ্গেলে বাঁকিয়ে রাখে। তন্দ্রার ঠোঁট ততো সময়ে বাঁকিয়ে মিউজিক ট্র্যাকের মত ঝির ঝির হয়ে গেছে। ওকে পাত্তা না দিয়ে আমি আবার সামনের দিকে ফেরার চেষ্টা করলাম। লাভ হল না। ততো সময়ে তন্দ্রা আমার কলার ধরে বসেছে -আমাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিবি না? দে ফেলে, তোর কত বড় সাহস আজকে আমি দেখে ছাড়বো। ও আমার কলার ধরে টানতে টানতে রেলিঙ্গলেস পাশের ছাদে নিয়ে গেল। আমি সহজ ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। খুব পাশে গিয়ে ওকে ধাক্কা দিতে বলল। আমি পুরোপুরি ঠাণ্ডা মাথায় ওকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিলাম। এমন একটা ভাব যেন মানুষ কে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেওয়া আমার কাছে পান্তা ভাত।

এই হল আমাদের পরিচয়ের প্রথম ঘটনা
আমি মৃদু হেসে নীলার দিকে তাকালাম। নীলার বড় হা এর সাথে সাথে এবার চোখ গুলও বড় বড় হয়ে গেল। ও কোন দিকে না তাকিয়ে মুহূর্তেই কিউরিয়াস ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো -তারপর? তারপর কি হল?
তারপর আর কি হবে। ঘটনার তদন্ত হল। আমাকে ভার্সিটি থেকে সাসপেন্ড করার নোটিশ জারি হল। এর মধ্যে অবশ্য তন্দ্রাও সুস্থ হয়ে গেল। একতলা ছাদ হওয়ায় তেমন কিছু হয়নি। একটা পা ভেঙ্গেছিল শুধু। সেটাও তেমন সিরিয়াস কিছু না। তন্দ্রা ভার্সিটি ব্যাক করার সাথে সাথেই ঘটলো মিরাকেল কিছু। আমাদের সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে তন্দ্রা নিজে এসে আমার জন্য রিকুয়েস্ট করলো। আমাকে যেন ভার্সিটি থেকে সাসপেন্ড করা না হয়। অবশ্য এই রিকোয়েস্ট করার পেছনে বিশেষ একটা উদ্দেশ্য ছিল তন্দ্রা'র। তাৎক্ষনিক ভাবে সেটা বুঝতে না পারলেও পরে আবিষ্কার করি।

আমার গল্পের মাঝ খানেই নীলা অতি উৎসাহে প্রশ্ন করলো
-কি উদ্দেশ্য?
- আমাকে শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্য। নিজ হাতে শিক্ষা। তন্দ্রা'র রিকোয়েস্টে আমাকে ভার্সিটি থেকে সাসপেন্ড করা হল না। আমি সরি বললাম ওর কাছে। ও হাসি মুখে নিজেও সরি বলল। তন্দ্রার সাথে আমার লেনদেন ঐ পর্যন্তই শেষ হলেও আমার সাথে তন্দ্রার লেনদেনের সবে মাত্র শুরু তখন। তন্দ্রা অনেকটা গায়ে পড়ে মিশা শুরু করে আমার সাথে। তখনই প্রথম আবিষ্কার করি তন্দ্রা কেন আমাকে ভার্সিটি থেকে সাসপেন্ড না করার জন্য রিকোয়েস্ট করেছিল। কারণ বশতই আমি ওকে কিছুটা এভয়েড করে চলতে থাকি। আর ওর এই লোক দেখানো প্রেম ভালোবাসা সত্য হলেও ওকে এভয়েড করে চলা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না। ওর বাবার বিরাট আধিপত্য। আর নিজেও জ্বালিয়ে পুরিয়ে শেষ করে দেওয়ার মত সুন্দরী। ওর এমন আল্লাদি সংস্পর্শ আমার মত মধ্যবিত্ত ছেলেদের জন্য ধারালো ছোরার এক পশলা ঝলক ছাড়া আর কিছুই না। ভালোবাসা মহৎ হলেও বাস্তবতা মহৎ না। বাস্তবতা নির্মম। আমি নিজেকে গুটিয়ে রাখার চেষ্টা করতে থাকলাম। আর তন্দ্রা চেষ্টা করতে থাকলো আমাকে ওর প্রেমে ফেলতে। একটা সময় পর গায়ে পড়ে ভালোবাসার অভিনয় করতে করতে ও নিজেই নিজের অজান্তে আমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। এটা ওর জেদ ভেবে আমি তখনও ওকে এভয়েড করতে থাকি। কোন ছেলে যে ওকে এভয়েড করতে পারে এটাই হয় তো ওর ধারণা তে ছিলনা। অবশ্য তখন পর্যন্ত আমি নিজেও যে ওর প্রতি আমার আবেগ কে জরিয়ে ফেলিনি এমনটা না। দুজনেই বুঝতে ছিলাম দেয়ার ইজ সাম্থিং গোয়িং অন বিটুইন আস। ব্যাস শুরু হয় পাওয়া না পাওয়ার হিসাব নিকাশ নিয়ে নতুন নাটক। আর তা শেষ হয় হাত কাটাকাটি দিয়ে। ও ভীষণ জেদী মেয়ে ছিল। হসপিটালের ব্যাডে ওকে প্রথম শুয়ে থাকতে দেখে নিজেকে আবিষ্কার করলাম ওকে ছাড়া জীবনের বাকিটা পথ চলা আর সম্ভব না।

সর্বনাশের বীজ বপন এখান থেকেই। শুরু হয় সাত রঙা দিন গুলোর পথ চলা। সারাদিন দুজন মিলে টোটো করে ঘুরে বেড়ানো, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে নদী দেখতে যাওয়া নদীর পানিতে পা ভিজিয়ে রাখা, হাত ধরে হাঁটাহাঁটি করা, ঘণ্টার পর পর ঘণ্টা দুজনের চোখের দিকে দুজন থাকিয়ে থাকা, অবুঝের মত মাঝ রাতে বাসা থেকে পালিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আইসক্রিম খাওয়া আর পাগলের মত দুজন দুজন কে সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসা। এভাবেই দেখতে দেখতে স্বপ্নের মত ভার্সিটি জীবনের চারটা বছর তন্দ্রা'র সাথে কেটে যায়। এর মাঝেই ভালোবাসার ছলে হাজারও চোখের জল ফেলা, কান্না, স্যাফারেট হয়ে যাওয়ার অর্থহীন চেষ্টা, ওকে ছাড়া প্রতিটা রাত নিঃশব্দে চিৎকার করে কাঁদা আর সব শেষে থাকতে না পেরে আবারও সেই একই নিঃশ্বাসে দুজন মিলে জরিয়ে থাকা। জানো? ওর হাসিটা না অসম্ভব বেশি সুন্দর। পৃথিবীর সব চেয়ে বেশি সুন্দর। আমি এখনো চোখ বন্ধ করলেই ওর হাসি মুখটা দেখতে পাই। একটা মানুষের হাসি কি করে এত সুন্দর হয়। ওর প্রায় সব ফ্রেন্ডরাই ওকে ওর হাসির জন্য মোনালিসা বলে ডাকে। যতই মন খারাপ থাকুক না কেন আমার, ওর ঐ পাগল করা ঠোঁট বাঁকানো হাসিটা দেখার সাথে সাথে আজও একদম ম্যাজিকের মত সব ঠিক হয়ে যায়। ভীষণ পাগলামি করতো ও। একদম বাচ্চাদের মত।

কথা বলতে বলতে কখন যে আমার চোখ ভিজে আসছে বুঝতে পারিনি। নীলা এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখেও পানি টলমল করছে। আমি ভেজা চোখে ওর দিয়ে তাকিয়ে ছোট একটা হাসি দিলাম। কান্না লুকানোর হাসি। যেই হাসি দ্বারা বোঝানো হয় চোখের বোকা জল গুলা ভীষণ অবাধ্য, বারন শোনে না। পুরুষদের কাঁদতে নেই, আমিও কাঁদছি না। হেঁটে হেঁটে বেশ খানিকটা পথ চলে আসছি। একটা পরিচিত চা'র দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম আমরা। শুধু পরিচিত না, অনেক বেশি পরিচিত। নীলার দিকে তাকিয়ে বললাম
- হাঁটতে হাঁটতে আজকে অনেক দূর চলে আসছি তাই না?
- উনি কোথায় এখন? দেখা হয় আপনার সাথে?
- হুম হয়। প্রতিদিনই হয়।
- আমাকে দেখাবেন একবার?
- সত্যিই দেখতে চাও?
- হুম সত্যিই দেখতে চাই, ভীষণ চাই
- পেছনে তাকাও
- মানে?
- রাস্তার ওপাশে ঐ বুটিক হাউজে সবুজ শাড়ি পড়া যে মহিলাটাকে দেখছ। ওটাই তন্দ্রা
আমার কথা শুনে মনে হল নীলা আকাশ থেকে পড়ছে। আশ্চর্যের চোখে একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার তন্দ্রার দিকে তাকাচ্ছে। নীলার আশ্চর্য হওয়াটাই স্বাভাবিক তন্দ্রাকে ও আগেও অনেকবার দেখেছে ওর বুটিক হাউজে ই হয় তো দেখেছে। কিন্তু ধারণাও করেনি কখনো, এটাই সেই তন্দ্রা। নীলা কিছু সময় তন্দ্রার দিকে চুপ চাপ তাকিয়ে থেকে বিস্ময়ের চোখেই আমাকে প্রশ্ন করলো
- ফ্রন্ট সাইডে বসে থাকা ঐ অন্ধ লোকটা উনার হাসব্যান্ড না?
- হুম, ঐ অন্ধ লোকটাই ওর হাসব্যান্ড আর প্রায়ই যে ছোট্ট মেয়েটা'কে সমস্ত দোকানে ছুটোছুটি করতে দেখ। ওইটা ওর মেয়ে। সায়ারা। সায়ারা মানে শেষ রাতের তারা। তন্দ্রার লাস্ট নেম আর আমার ফার্স্ট নেমের সাথে মিল রেখে সায়ারা আই মিন শেষ রাতের তারা। আমাদের ঝলসে যাওয়া হাজারও ছোট ছোট স্বপ্ন গুলো জুড়ে থাকা একটা স্বপ্ন ছিল ও।
- আপনারা একে ওপর কে এতটা ভালোবাসার পরেও বিয়ে করেন নি কেন তাহলে?
- তুমি নিয়তি বিশ্বাস করো নীলা?
- না করি না, নিয়তি মানুষ নিজে তৈরি করে
- না করে না, নিয়তি মানুষ কে কিছু অপশন দেয় মানুষ সেখান থেকে যে কোন একটা বেছে নিতে বাধ্য হয়। তন্দ্রা কে না পাওয়ার নিয়তিটা ও আমাকে বেছে নিতে হয়েছিল সেদিন। আমাদের ভার্সিটি গ্র্যাজুয়েশন সবে মাত্র শেষ হয়েছে। তখনও আমি ছিঁড়া নোটের মত মূল্যহীন একটা বেকার ছেলে। ম্যাচের খরচ জোগাতেই হিমশিম খেতে হত। তন্ত্রা'র বাসা থেকে ওর ইচ্ছের বাইরে প্রায় জোর করেই বিয়ে ঠিক করে। বিয়ের ঠিক আগের রাতে তন্দ্রা এসে হাজির হয় আমার ম্যাচে। আমাদের ফিউচার, আঙ্কেল অ্যান্টির মান সম্মান, তাদের ইচ্ছে, স্বপ্ন, সমাজ সব কিছু আমি শুধু মাত্র তন্দ্রা কে পাওয়ার লোভে বিলিয়ে দিতে পাড়িনি। পাড়িনি নিজে সুখি হওয়াটাকেই প্রাধান্য দিতে। আর এটাই হয় তো আমার জীবনের সব চেয়ে বড় ভুল অথবা নিঃস্বার্থক সঠিক সিদ্ধান্ত। সে দিন নিজ হাতে তন্দ্রা'কে ফিরিয়ে দিয়ে আসি ওর বাসায়। এটাই ছিল তন্দ্রার সাথে আমার সামনাসামনি শেষ দেখা। সে রাতে তন্দ্রা চিৎকার করে অনেক কেঁদেছিল। আমি পাড়ি নাই চিৎকার করে কাঁদতে। সদ্য জবাই হওয়া পাখির মত মৃত্যু যন্ত্রণায় শুধু ছটফট করেছিলাম। অসহায়ের মত আমার নিঃশব্দে করা হাজারও চিৎকার আর আর্তনাদ কেউ দেখেনি কেউ জানে ও নি কোনদিন। বেঁচে থেকে এই মৃত্যু যন্ত্রণা কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তা কল্পনা করাও হয় তো অসম্ভব। আমার প্রমিস রাখতেই নীলা ওর বাবা মা'র ইচ্ছায় বিয়ে করে। আমি দূর থেকে দাড়িয়ে চুপ চাপ দেখে যাই। আর অবাধ্য চোখের জল গুলো বার বার সেই বৃষ্টিতে ভেজায় আমাকে। বুক থেকে রক্ত ঝরে, অনবরত রক্ত। আমি মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করি। কিন্তু এই মৃত্যু আমাকে মুক্তি দেয় না। শুধু কষ্ট দেয়, মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর কোন এক কষ্ট।

আমি থামলাম। নীলা তখনও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ঝাপসা চোখে দেখতে পাচ্ছি ওর গাল বেয়ে টুপটাপ চোখের জল ঝরছে। নীলা কান্না জরানো কণ্ঠেই প্রশ্ন করলো
- উনি কি জানেন, আপনি যে আজও উনার জন্য কেঁদে কেঁদে রাত ভোর করেন? উনি ফিরে আসবে না জেনেও প্রতিদিন উনার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন? এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন? শুধু মাত্র উনার ভালোবাসাকে নিজের মধ্যে বাচিয়ে রাখার জন্য নিঃসঙ্গতার অসহায় জীবনযাপন করেন?
- না জানে না, এর কিছুই জানে না। ও জানে আমি বিয়ে করেছি। অনেক সুখি পরিবার আমার। একটা টুকটুকে মেয়েও আছে। নাম রেখেছি সায়ারা।
নীলা এবার মুখ চেপে হুহু করে কেঁদে উঠলো। আমি বলার মত কিছু পেলাম না। ও কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো
- আপনি ভীষণ বোকা, ভীষণ বেশি বোকা, আমি যতটা বোকা ভেবে ছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি বোকা আপনি। কি করে পারেন আপনি? যেদিন আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম সেদিন থেকেই মনে হত আপানার কি যেন কি একটা আমাকে ভীষণ টানে। আপনার ব্যক্তিত্ব, আপনার নীরবতা, আপনার চুপ করে থাকা, সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখা এই সব কিছু সব কিছু আঁকড়ে রাখত আমাকে। আমার স্বপ্নের মহাপুরুষ মনে হত আপনা কে। কিন্তু বাস্তবে আপনি তার কিছুই না। আপনি জাস্ট একটা বোকা। ভীষণ বোকা। ভীষণ। আই জাস্ট হেইট ইউ।

নীলা'র কথার কোন রকম উত্তর দিলাম না আমি। মনে মনেও না। শুধু নিরব থাকলাম। নীলা মুখ চেপে কাঁদতে কাঁদতে হেঁটে সামনের দিকে চলে গেল। আমি গেলাম না। রাস্তার ওপাশে থাকা তন্দ্রার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম গত দশটা বছর যেখানে নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
নীলা, আমি বোকা না, আমি অনেক চালাক। সব্বাই কে হার মানিয়ে দিয়েছি আমি। উপড়ে বসে যিনি নিয়তি তৈরী করেন, উনার নিয়তিকে ও হার মানিয়ে দিয়েছি। তন্দ্রার সব টুকু ভালোবাসা ঠিক সে দিনের মত আজও আগলে রেখেছি আমি।

আমি বোকা না নীলা, আমি অনেক চালাক।
 
Top