Love golpoপড়ন্ত বিকেল।শুভ্র বসে আছে ধানমন্ডি লেকের পাশে এক সুন্দর বাসার ড্রইংরুমে।অনেক ধনী লোকের বাসা,খুব সুন্দর করে সাজানো।দামি টি টেবিল,দামি সোফা,কোনার দিকে ফুলের ভাসের ভেতর ফুল।প্লাষ্টিকের ফুল নয় আসল ফুল।সামনে একটা বিরাট সিনেমা হলের পর্দার মত টিভি।শুভ্রর খুব টিভিটা অন করে দেখতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু সাহস হচ্ছে না।কিছুক্ষন আগে এক মহিলা চা দিয়ে গিয়েছে।যেন তেন
সাধারণ টঙ্গের দোকানের চা নয়।সুন্দর সবুজ কালারের চা।খেয়ে কেমন যেন চা এর মত লাগছে না তাই আর খায় নি শুভ্র।চা না খেয়ে শুভ্র ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাসা দেখছে।শুভ্রর কখনো এই রকম ধনী লোকের বাসায় আসার কথা ছিল না।সে এসেছে একজনের সাথে দেখা করতে।অনেক পুরোন একটা মানুষের সাথে।হঠ্যাৎ চারপাশে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা ছবির দিকে চোখ আটকে গেল।ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটা মেয়ের এক চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে আর সেই জলের ফোটাটা রোদের আলোয় লেগে মুক্তার মত জ্বলজ্বল করছে।দেখেই বোঝা যায় প্রশংসা করার মত ছবি।কিন্তু শুভ্র প্রশংসা করতে পারছে না।কারন ছবিটি তারই আঁকা আর নিজের প্রশংসা কোন শিল্পীর করতে মানা।অনেক দিন বাদে ছবিটা দেখতে পাচ্ছে শুভ্র।এই ছবিটা জুড়ে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে।তাই মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে শুভ্র।ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আপনমনেই অতীতে ফিরে যায় শুভ্র।

সেই দিন ছিল এমনি পড়ন্ত বিকেল।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার পক্ষ থেকে সবথেকে ভাল ৫০টা ছবির এক্সিভিশন হয় ছবির হাটে।তার মাঝে শুভ্রর ছবিও থাকে।এই ছবিটা নিয়ে অনেক আশা ছিল শুভ্রর।কারন এই ছবিটা এক্সিভিশনে উঠাতে পারলে শুভ্র ছবিটা বিক্রি করতে পারবে আর বিক্রির টাকা দিয়ে জমে থাকা রুম ভাড়া পরিশোধ,কিছুদিনের জন্য খাবার এবং কিছু কাগজ রঙ কিনতে পারবে।তাই এক বন্ধুর কাছ থেকে কাগজ এবং রঙ ধার নিয়ে এই ছবিটা আঁকে।সারারাত ধরে পরিশ্রমের ফল এই ছবি।আর ছবিটাও ভাল হবার ফলে এক্সিভিশনে উঠে যায় ছবি।এখন শুভ্রর চিন্তা এই ছবি কেউ কিনবে তো?তাই সে বারবার পায়চারী করতে থাকে।খুব সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়েছে কিন্তু পকেটে টাকা না থাকার ফলে তাও কিনতে পারছে না।মাসুম ভাই হঠ্যাৎ ছুটতে ছুটতে এসে বলে কোন এক ছবি যেন নিলামের মত দাম বেড়ে চলেছে আর যত মেয়ে আছে সবাই অই ছবিটা কেনার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছে।একটু মন খারাপ হয় শুভ্রর।জিজ্ঞেস করে,ছবির নাম কি?মাসুম ভাই বিরক্ত স্বরে বলে,এক ফোটা জল।নাম শুনে শুভ্র দৌড়ে যায় সেখানে কারন সেই ছবিটি আর কারো না ওটা তারই আঁকা ছবি।চারপাশে চিল্লাচিল্লি উপেক্ষা করে ও এগিয়ে যায় সামনে।সুজন ভাই বলে,আচ্ছা আর চেচামেচি করতে হবে না এই হল এই ছবিটির শিল্পী।তিনিই ঠিক করুক কে ছবিটি নিতে পারবেন?শুভ্র আমতা আমতা করে বলল,দেখুন ছবি একটা আর আপনারা নিতে চাচ্ছেন অনেক।অতএব বুঝতেই পারছেন যে কোন একজনকে এই ছবিটি নিতে হবে।কথা বলতে বলতে এক মেয়ের দিকে চোখ পড়ল শুভ্রর।মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে হাসছে আর হাত তুলে আছে।নিচু গলায় সুজন ভাইকে বলল শুভ্র,ঐ যে মেয়েটি হাত উচু করে আছে ছবিটি তাকে দিয়ে দিবেন যত দাম দিবে ততই নিয়েন সুজন ভাই।এই কথা বলে শুভ্র সেখান থেকে চলে আসল।মাগরিবের আযান পড়ছে।রাস্তার বাতিগুলো জ্বলে উঠছে আর শুভ্র তা এক কোণে বসে দেখছে।সেই মেয়েটি তার সামনে এসে দাড়ালো এবং বলল,

-আপনাকে ধন্যবাদ।অনেক ভাল লেগেছে ছবিটা।এত সুন্দর ছবি কেউ আঁকতে পারে তা আমার জানা ছিল না।অনেকের মাঝে ছবিটা কিনে আনতে পেরেছি বলে নিজেকে জয়ী মনে হচ্ছে।আচ্ছা একটা প্রশ্নের উত্তর দিবেন?
-জ্বী বলুন,নির্লিপ্ত স্বরে জবাব দেয় শুভ্র।
-অনেকেই তো এই ছবিটা কিনতে চেয়েছিল।আপনি কেন তাদের কাছে বিক্রি না করে আমার কাছে করলেন?
-আসলে এই ছবিটা আপনার প্রাপ্য তাই।কিছুক্ষন নিচে তাকিয়ে জবাব দেয় শুভ্র।
-আমার প্রাপ্য কেন?
-আসলে ছবিটা আঁকার সময় আমি একটা মানুষের ছবি মনে মনে কল্পনা করে নিয়েছিলাম আর সেই মানুষটি আপনি।
-আমি???অবাক স্বরে বলল মেয়েটি।
-জ্বী আপনি।
-ও আচ্ছা আমি চিত্রা আপনার নাম?
-শুভ্র।আচ্ছা এখন তাহলে আসি ভাল থাকবেন।
শুভ্র চিত্রা নামের মেয়েটিকে অবাক ঘোরের মাঝে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে হাটা শুরু করে।এরপর থেকে যখনি কোন এক্সিভিশন হত তখনি চিত্রাকে দেখতে পেত শুভ্র।শুভ্র খুব সহজেই বুঝতে পারছিল মেয়েটি তাকে ভালবাসতে শুরু করেছে।তবুও শুভ্র তার ভাঙ্গাচোড়া শিল্পী জীবনে চিত্রাকে জড়াতে চাইতো না।দেখা হলে কেমন আছেন ভাল আছি এই টুকুতে আটকে রেখেছিল শুভ্র চিত্রাকে।একদিনের কথা চিত্রা শুভ্রর সামনে এসে দাড়াল আর বলল,
-আমি আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।
-বলুন।
-এখানে নয়।আপনি কি আমার সাথে একটু সামনে যেতে পারবেন?
-আচ্ছা চলুন।
কিছুদুর সামনে হেটে যাওয়ার পর চিত্রা বলল,
-আচ্ছা আপনি কি বুঝতে পারেন না আমি আপনাকে কতটা ভালবাসি।আপনার আঁকা সকল ছবি আমি কিনে আমার ঘ্র ভর্তি করে ফেলেছি।আপনি কি একটি বারের জন্য বুঝতে পারেন না??
-না আমি বুঝতে চাই না চিত্রা তুমি আমাকে কতটুকু ভালবাসো।
-কেন?কিসের জন্য আপনি আমাকে ভালবাসবেন না?
-আমি এক সাধারণ শিল্পী।যে কিনা রংতুলির আঁচড়ে তার জীবনটাকে রাঙ্গাতে চায়।যার বাবা মা নেই।আমি ছোটবেলা থেকে মামার ঘরে মানুষ।আজ আমি এই সামান্য শিল্পীটুকু হয়েছি নিজের একান্ত চেষ্টায়।আমার জীবনটা ভাঙ্গাচোড়ায় গড়া।তুমি আমার কল্পনার রাজকন্যা।কল্পনার রাজকন্যা কখনো বাস্তবে আসে না।আর আজ তুমি নিজের ইচ্ছায় আমার জীবনে আসলে কিছুদিন পর নিজেই চলে যাবে নিজের ইচ্ছায়।আমি শত ভালবাসলেও তোমাকে ধরে রাখতে পারব না।
-আমি যদি আপনাকে এই মুহুর্তে বিয়ে করি আপনি কি বিশ্বাস করবেন কল্পনার রাজকন্যা সত্যি হয়?
-না চিত্রা এটা ঠিক নয়।তুমি অনেক ধনী পরিবারের মেয়ে।আমার জীবনের সাথে তুমি মানিয়ে চলতে পারবে না।
-আমি আজ পর্যন্ত বাবার কাছে যা চেয়েছি তাই পেয়েছি।আপনি একটি বার রাজী হন দেখবেন বাবাও রাজী হয়ে গিয়েছে।
-আমি তোমাকে খাওয়াবো কি?তুমি থাকবে কোথায়?
-আপনার কিচ্ছু করা লাগবে না।আপনি যেভাবে চলবেন আমিও সেভাবে চলব আমরা ছোট্ট দুই রুমের একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকব আর আপনি শুধু ছবি আকবেন।
-কিন্তু
-কোন কিন্তু নয় আমি আজি আপনাকে বিয়ে করব।

অতপর বিয়ে।কিভাবে যেন চিত্রা তার বাবাকে রাজী করিয়ে ফেলেছিল।ঘরোয়াভাবেই বিয়ে হল তাদের।শুভ্রর কাছে কেমন যেন স্বপ্ন আর সিনেমার মত লাগছিল।সে তার কল্পনার রাজকন্যাকে পেতে চলেছে বাস্তবে এটা তার বিশ্বাস হচ্ছিলো না।সে কেমন যেন ঘোরের মাঝে জীবনের সুখের সময়গুলো কাটাতে লাগল তার।কিন্তু এই সময়টাতে শুভ্র ভুলে গিয়েছিল রোদে ঝলমলে দিনের শেষে অন্ধকারছন্ন রাত আসে।হ্যা দেখতে দেখতে ২ বছর কেটে গেল।এর মাঝে অনেক পরিবর্তন এসে গেল চিত্রার মাঝেও।চিত্রা ছোট ছোট বিষয় নিয়ে ঝগড়া করত শুভ্রর সাথে।অনেক রাত করে বাসায় ফিরত কারণ ছাড়া।একটা সময় চিত্রা বাসা ছেড়ে তার বাবার বাসায় এসে উঠল।কারণ তার নাকি এই ছোট দুই রুমের বাসায় আর ভাল লাগছে না।১০ দিন যায় ১৫ দিন যায় তবু চিত্রা আর বাসায় আসে না।ফোন দিলে ফোন ধরে না।হঠ্যাৎ একদিন ফোন দিয়ে চিত্রা এই ধানমন্ডির বাসার ঠিকানা দিয়ে আসতে বলে কি যেন জরুরী কথা আছে।আর তার ফোনের কারনেই আজ শুভ্রর এই বাসায় আসা।

-শুভ্র এই শুভ্র।
চিত্রার ডাকে লাফ দিয়ে উঠে শুভ্র।কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল তার খেয়ালি ছিল নেই।
-স্যরি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।আচ্ছা তুমি যেন কি বলবে?
-আসলে শুভ্র তোমাকে একটা জরুরী কথা বলতে ডাক দিয়েছি।
-হ্যা বল।
-শুভ্র আমি আসলে তোমার সাথে থাকতে চাচ্ছি না।
-মানে?
-মানে আমি আসিফকে বিয়ে করতে যাচ্ছি সামনে।এটা আমার আর আসিফের বাসা।আমরা এই বাসাটা নতুন নিয়েছি।
-এখন আমি কি করব?আমাকে কি জন্য ডেকেছ?নিচের দিকে তাকিয়ে বলে শুভ্র।
-I want divorce শুভ্র।
-তার মানে তুমি মুক্তি চাও?
-মানে?
-নাহ কিছু না।বাসাটা সুন্দর সাজিয়েছ আমার সেই ছবিটাও এনে রেখেছ দেখছি।
-হ্যা তাহলে আমি ডিভোর্স পেপারটা পাঠিয়ে দিব ওটাতে তুমি সাইন করে দিও।
-আচ্ছা ঠিক আছে আজ তাহলে উঠি।
-চা খেয়েছ?আরেক কাপ চা দিতে বলি।
-নাহ থাক আজ যাই ভাল থেকো।

শুভ্রর কেন যেন পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।বলতে ইচ্ছে করছে,না আমাকে ছেড়ে যেও না চিত্রা।তুমি আমার রাজকন্যা।যে কিনা কল্পনা থেকে বাস্তবে এসেছিল।নাহ বলতে পারছিল না শুভ্র গলার ভেতর থেকে কি যেন স্বরটাকে আটকে ধরে রাখল।তাই চুপচাপ বাসা থেকে বের হয়ে আসল সে।সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে শুভ্রর গাল বেয়ে ঝরে পড়ল এক ফোটা জল।
 
Top