মা মা যাই না? দেখ আমি ঠিক জিতে আসব।
কথাটা শুনে নাতির দিকে একবার তাকালেন রাহেলা বেগম। নাতির নাম ঈশান। ক্লাস সিক্সে পড়ে। মায়ের কাছে আবদার করছে কাবাডি খেলতে যাবার জন্য। চোখে মুখে সেই ছাপ, যেন বিজয়ী হয়ে আসবেই। কাল রাত থেকে মাকে বুঝাচ্ছে, মা বুঝতে চাইছে না।জুনিয়র কাবাডি দলের অধিনায়ক ও। লুকিয়ে লুকিয়ে এতদিন খেলেছে। মাকে শুনতে দেয় নি। মা অকারণেই ভয় পায়। ক্রিকেট খেলতে গেলে মা বলে, আরে তোর গায়ে বল লেগে ব্যথা পাবি। ফুটবল খেলতে গেলে বলে, পা ভেঙ্গে ফেলবি। ব্যাডমিন্টন খেললে বলে, পড়ে গিয়ে ব্যথা পাবি। কিন্তু ছেলে যে সবকিছুতে অনেক ভাল খেলোয়াড়, মা তা বুঝতে চান না। মায়ের মন বলে কথা। সবকিছু কিছু কি বুঝে? তাই লুকিয়ে লুকিয়ে খেললেও এতদিন, আজ আর পারছে না ঈশান। ২ দিনের জন্য হোটেলে থাকতে হবে। সাথে স্যাররা থাকবে অবশ্য। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট কাবাডির। জুনিয়র কাবাডি প্রতিযোগিতা, ভারত , নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রী লঙ্কা, পাকিস্তান, আফগানিস্তান আর বাংলাদেশ এই টুর্নামেন্টে অংশ নিবে। আর বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ঈশান। ছোট বাচ্চা কাচ্চাদের আসর। শিক্ষকরা সন্তানের মত দেখাশুনা করবে। তবুও মা বুঝে না। ঈশানের ওখানে যাবার আবদার শুনে মা বললেন, তুই এর আগে একবার ট্রেনিং এ যেতে চাইছিস। দিনে দিনের ব্যাপার ছিল। তাই তোর বাবা যেতে দিল। আমি তোকে ট্রেনিং এ যেতেই মানা করছি, আর এখন তুই দুই দিনের জন্য বিদেশি মানুষগুলোর সাথে খেলতে যেতে চাচ্ছিস? তোর কিছু হলে আমি থাকব কি করে? তুই ব্যথা পাবি খেলতে গেলে বাবা।
- আমার কিছু হবে না। আমি জিতব আম্মু। আমাকে ছাড়া চলবে না।
রাহেলা বেগম আবার তাকালেন নাতির দিকে। চোখে মুখে তিনি আবারও সেই বিজয়ী ছাপ দেখছেন। চোখ ছলছল করছে তার। ছেলের বউকে ডেকে বললেন, বউ মা। যেতে দাও তো। ওর কিছু হবে না। ও পারবে দেখো।
- কিন্তু মা, আপনার ছেলে রাগ করবে।
- করবে না।আমার ছেলেকে আমি দেখব। যেতে দাও তো।
- মা, কিন্তু যদি কিছু হয়? এতটুকু বাচ্চা।
- হবে না বললাম তো। তুমি দেখে নিও। আমাদের ঈশান জিতে আসবে।
- দেখেন আপনি। আপনার কথার উপরে কথা বলি কি করে?
ঈশানের মা ছেলের সব গুছাতে চলে গেলেন। রাহেলা বেগম ঈশানকে ডাক দিলেন, শোন দাদু।
- বল।
- পারবি জিততে?
- হ্যাঁ পারব। জানো, দাদু আমি না অধিনায়ক। আমাকে ছাড়া কি করে জিতবে বল? আর অন্য দেশ খেলতে আসল, তাদের হারাতে না পারলে পচা বলবে সবাই আমাদের। আমি জিতব দাদু।
- তাই দাদু আমার? আচ্ছা, তোকে এই দোয়া করে দিলাম। মাথায় হাত রেখে, আমার দাদুটা জিতে আসবে।
রাহেলা বেগম ঈশানকে বুকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। তার চোখ আজ ভিজে আসছে বার বার।চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ঈশানের কাছে এটা নতুন না, দাদি যখনই ঈশানকে বুকে নেন এভাবে কাঁদেন। আজ বোধহয় একটু বেশিই কাঁদছেন। ঈশানের দিকে তাকিয়ে বললেন, দাদু তোকে একটা জিনিস দিব।
- দাও।
রাহেলা বেগম তার বিছানার পাশ থেকে একটা কাপড়ের মত কি একটা বের করলেন। ঈশানের হাতে দিয়ে বললেন, দাদু, জিততে হবে তোকে। জিতে এটা চাদরের মত শরীরে জড়িয়ে ছবি তুলবি।
ঈশান হাতে নিয়ে দেখল, একটা পতাকা।তবে এটা একটু কেমন যেন। বাংলাদেশের পতাকাই, তবে মাঝের বৃত্তের মধ্যে আবার বাংলাদেশের মানচিত্র। দাদি বলল, আগে পতাকা এমন ছিল।
মা সব গুছগাছ করে ফেলেছে। ঈশান বের হবে এখন। ওদের স্কুলের স্যার এসেছে ঈশানকে নিয়ে যেতে। ঈশান একটা ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে, ব্যাগের কোণায় দাদির দেয়া পতাকাটা। দাদির দিকে আর একবার তাকিয়ে বলল, দাদু, আমি জিতব।
রাহেলা বেগমের চোখ আবার চিকচিক করে উঠল,ঈশানের চোখের ভাষা দেখে। বুকের বা দিকটায় ব্যথা করছে রাহেলা বেগমের। পানি খেলেন কাজ হল না। বার বার ঈশানের সেই বিজয়ী হবার প্রত্যয়ী মুখটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। অনেক মিল এই দুই মুখের। একটা মুখ ঈশানের অন্যটা রাহেলা বেগমের স্বামী সাদেকের। সাদেক তখন ২৫ বছরের যুবক। দেশে খুব যুদ্ধ চলছে। স্বাধীনতার যুদ্ধ। এবার বাঙালি স্বাধীনতা নিয়ে আসবেই। যত রক্তচক্ষু , যত অত্যাচার হোক, যত নিপীড়ন, ভয় হোক। কিছু মানবে না। এবার প্রাণ দিয়ে হলেও স্বাধীনতা আনবে। স্বাধীন ভাবে বাঁচতে হবে। সাদেক তার মায়ের সাথে অনেকক্ষণ ধরে তর্ক করছে। মা বলছেন, তুই অখন আমার শুনবি ক্যান? তুই তো বাচ্চার বাপ হইছস। কত বড় হই গেছস। অনেক বুঝস।
- আম্মা, দেখেন, দেশের এই অবস্থায় ক্যামনে ঘরে বইসা থাকি। পাকিস্তানিরা একের পর এক মানুষ মারতাছে। আমাগো বাড়ি ঘর পুড়াইতেছে।সেদিন কাদেররে ধইরা নিয়া মাইরা ফেলছে। কাদের আমার ন্যাংটা কালের বন্ধু। বাসায় একটা ভাল কিছু রাঁধলেও আমারে দিয়া যাইত। আমারে ছাড়া কখনই থাকত না। গ্রামের মানুষগুলারে একের পর মারতাছে, আর আপনি আমারে ঘরে বইসা থাকতে বলেন।
- হ কই। তোর কি এতো? দেশে মানুষের অভাব? তারা যুদ্ধ করতাছে করুক। তোর যাওয়া লাগবে না। তোর কিছু হইলে আমি থাকব ক্যামনে?
- আম্মা ভয় পাইয়েন না। আমি জিতা ফিরা আসব।
বউ রাহেলার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে সাদেক। রাহেলার কোলে ১ বছরের বাচ্চা, জালাল।সেও মিটমিট করে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। আর রাহেলা তাকিয়ে আছে, সাদেকের চোখ মুখের দিকে। যেন বিজয় নিয়ে আসবেই, এমন ভাব চোখে মুখে। চোখ দুটোকে মনে হচ্ছে আগুনের গোলা, যেন সেই আগুনে সব পুড়িয়ে ছাই করে দিবে, শত্রুর এই আগুনের সামনে দাঁড়াবার মত অবস্থা নেই।
সাদেকের মা বলছেন, তুই ট্রেনিং এ যাবার সময়ই তোরে মানা করছি। অখন, যুদ্ধে যাইতে চাস? আমার কথা না ভাবলি, বউ বাচ্চার মুখটা দেখ একবার।
- আম্মা, আমি জিতে আসব বললাম তো। দেশ স্বাধীন কইরা আসব। আমার জালাল, স্কুলে বাংলার পতাকা উড়াবে। আম্মা আমি ছাড়া হবে না।
রাহেলা এখনও সাদেকের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে এখনও সেই আগুনের ছাপ।রাহেলা শাশুড়িরে বললেন, আম্মা, যেতে দেন তারে। তিনি ঠিক জিতে ফিরে আসবেন। এসে আমাদের জালালকে আদর করবেন।
সাদেকের মা আর কিছু বলে না। সাদেক বউয়ের কাছে যায়। বউয়ের হাত ধরে বলে, বউরে দেশের অবস্থা বড় খারাপ। ওরা খালি মানুষ মারতাছে। দেশটারে স্বাধীন করতে হবে রে। আমি জিতে ফিরে আসব দেখিস, এসে আমার জালালরে কোলে নিয়ে আদর করব। তোরে নিয়ে স্বাধীন দেশের মেলায় ঘুরব, তোরে লাল চুরি কিনে দিব।
- আমি জানি আপনি জিতে আসবেন।
সাদেক বাচ্চাটাকে একবার কোলে নেয়, কপালে একটা চুমু দেয়। আর বলে, বাপ রে, আমি জিতে ফিরে আসব। এসে তোরে আদর করব। তুই স্কুলে বাংলার পতাকা উড়াবি।
সাদেক মায়ের থেকে দোয়া নিয়ে চলে যায়। যুদ্ধে গিয়েছে। ঠিক দেশ স্বাধীন করে ফিরে আসবে, রাহেলা জানে।স্বামীর জন্য অপেক্ষা করে, রাহেলা। প্রতিদিন অপেক্ষা করে। আসে না। না আসাতে বাচ্চার সাথে একা একা কথা বলে, মা বলা শেখায়, বাবা বলা শেখায়। আশ্চর্য ভাবে জালাল, বাংলা বলাও শিখে যায়। অস্পষ্ট কণ্ঠে বলে, বানলা। জালালকে বলে, বাবা দেশ স্বাধীন করে আসবে। ওকে কোলে নিয়ে আদর করবে। অপেক্ষার প্রহর কাটতে চায় না।
একদিন হঠাৎ সাদেকের কণ্ঠ শোনা যায়, বউ বউ, আম্মা, জালাল।
খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘরে আসে। রাহেলা দৌড়ে এসে বলে, কি হইছে আপনার?
- বউরে দেশ স্বাধীন করে আসছি। বলছি না তোরে, আমি জিতা আসব। ঠিক আসছি রে বউ। সবগুলারে শেষ কইরা দিছি। আমার জালাল কই? ওরে দে একটু আদর করি।
রাহেলা বেগম কাঁদতে কাঁদতে জালালকে দেয় সাদেকের কোলে। সাদেক কোলে নিয়ে বাচ্চাকে আদর করে, বাপ তোরে কইছি না, আমি জিতে এসে তোরে আদর করব। আমি জিতে আসছি।
জালাল অস্পষ্ট স্বরে বাবা বলে। এই বাবা ডাক শুনে সাদেকের চোখ ভিজে আসে। বুকের সাথে জালালকে জড়িয়ে কাঁদে সাদেক। আনন্দের কান্না। বউ সাদেকের হাত ধরে আছে শক্ত করে। সাদেকের উরুতে আর কোমরের কাছে ২ টা গুলি লাগছে। গুলি বের করা হইছে। তবুও অবস্থা বেশি ভাল না। বাসায় আসার পর থেকে আরও খারাপ। বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। আজ বড় অস্থির লাগছে তার। এতো যন্ত্রণা কোনদিন হয় নি। রাহেলাকে কাছে ডেকে সাদেক বলে, বউরে তোরে নিয়া আর মেলায় যাওয়া হবে নারে মনে হয়।তোরে লাল চুরি কিনে দিতে পারব না। বড় শখ ছিল। আমারে মাফ কইরা দিস।
- আপনি কি বলেন এইসব?
- হ্যাঁ রে বউ। জালালটারে একটু আনবি, কোলে নিতাম।
জালালকে বুকের সাথে মিশিয়ে অনেকক্ষণ শুয়ে থাকে সাদেক। জালালের গায়ে একটা পতাকা জড়িয়ে দেয় সাদেক। আর মুখে বলে, আমার ছেলে বাংলার মানুষ। স্বাধীন বাংলার মানুষ। যার বাবা দেশ স্বাধীন করছে।
রাহেলা সাদেকের হাত ধরে বলে, আপনার ছেলে কি বলতে পারে শুনবেন?
- কি বলতে পারে?
রাহেলা জালালকে বলে, বাংলা বাংলা।
জালাল অস্পষ্টভাবে বলে, বানলা।
সাদেকের শুনে বুকের ভিতর বুক শান্তি লাগে। শরীরে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তবুও কানের কাছে জালালের অস্পষ্ট বাংলা বাজছে। বাংলা, আমার প্রাণের সাথে মিশে আছে। বাংলাদেশ আমার দেশ। এতো যন্ত্রণায়ও একটাই সুখ, দেশ স্বাধীন। জালাল স্কুলে বাংলার পতাকা উড়াবে। জালারের মুখ থেকে আর একবার বাবা শুনতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু কানে আর কোন শব্দই আসছে না।
সেদিন রাতেই সাদেক মারা যায়। স্বাধীন দেশ উপহার দিয়ে মারা যায়। রাহেলা বেগম স্বামীর দেয়া পতাকাটা যত্ন করে রেখে দিয়েছেন। আজ ঈশানকে দিলেন। ঈশানও ঠিক জিতে আসবে। কারণ ঈশানের মুখেও সাদেকের মত বিজয়ী হবার ভাষা রাহেলা বেগম দেখেছেন।
২ দিন ধরে টিভিতে খেলার খবরে সবার খুব মনোযোগ। রাহেলা বেগম, ঈশানের মা, জালাল, সবার। ঈশানের কাবাডি দল, সেমি ফাইনালে গেছে। সেমি ফাইনালে পাকিস্তানকে হারাল। রাহেলা বেগম চোখ মুছে মুছে বলেন, আমার দাদু কত ভাল খেলে।
তিনি খেলা বুঝেন না, তবুও জানেন ঈশান ভাল খেলছে। ফাইনালে ঈশানের দল খেলবে ভারতের সাথে। রাহেলা বেগম জানেন এখানেও ঠিক জিতে যাবে ঈশান। ঈশানের মা সারাক্ষণ বলেন, আল্লাহ । আমার ছেলেটা যেন ব্যথা না পায়।
রাহেলা বেগম বিশ্বাস নিয়ে আসেন তার নাতি জিতবেই। ঠিকই ফাইনালে জিতে গেল ঈশানের দল। ঈশানকে দেখাচ্ছে টিভিতে, গায়ে দাদির দেয়া পতাকা জড়িয়ে ক্যামেরার সামনে এসেছে। বাংলাদেশের পতাকা জড়িয়ে। রাহেলা বেগমের খুব খুশি লাগছে, আসলেই জিতল ঈশান।
বাঙালি হেরে যেতে জানে না। শুধু বিশ্বাস দরকার, আসলেই স্বাধীনতা ধরে রাখতে পারব, আসলেই দেশকে ভালবাসব। আসলেই জিতব, দেশের স্বার্থে।
রাহেলা বেগমের আজ বড় সুখের দিন, তার স্বামীর কথা খুব মনে পড়ছে। জালালকে কাছে ডেকে আনলেন। ডেকে বললেন, তোর ছেলে অনেক বড় খেলোয়াড় হবে। ও যে জানে দেশের জন্য জিততে হবে, তোর বাবার মত। জালাল আজ আবার ঐ গানটা শুনাবি?
- কোনটা মা?
- ঐ যে জন্ম আমার ধন্য হল।
সাদেক গান গাইছে,মায়ের কোলে মাথা রেখে, আর রাহেলা বেগম চোখ বুজে কাঁদছেন। এই দেশ আসলেই সাদেকের মত অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধার রক্তের বিনিময়ে, প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া। এই দেশের বুকে হাঁটতে গেলে এখনও তাদের নিঃশ্বাস পাওয়া যায়, স্বাধীন দেশের পতাকায় বা স্বাধীন দেশের ধুলি কণায়।ঈশানের মত তরুণদের হাত ধরে দেশ এগিয়ে যাবে আরও অনেক দূর,রাহেলা বেগমের মত কাউকে লাগবে সেখানে সাহস দেবার মত। আর সাদেকের মত, ঈশানের মত চোখে মুখে বিজয়ের স্পৃহা থাকতে হবে। জালালের কণ্ঠের গান এখনও বেজে যাচ্ছে রাহেলা বেগমের কানে।এই সুর ভালবাসার সুর, এই দেশ অনেক ভালবাসার, এই দেশ মায়ের সমান, তাইতো জালাল গেয়ে যাচ্ছে,
" জন্ম আমার ধন্য হল মাগো,
এমন করে আকুল হয়ে
আমায় তুমি ডাকো।।
তোমার কথায় হাসতে পারি,
তোমার কথায় কাঁদতে পারি,
মরতে পারি তোমার বুকে,
বুকে যদি রাখো মাগো।।
 
Top