(১)
রাতের আঁধার ছাপিয়ে একফালি চাঁদ মেঘের আড়ালে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।পরশের হাতে ঘড়ি নেই,তাই সময়টা আন্দাজ করতে পারছে না।অলসতায় মোবাইলটাও বের করতে ইচ্ছে করছে না।তার মনে হচ্ছে বৃষ্টি পরবে।বর্ষার শুরু হল কাঠফাটা রোদ দিয়ে।অনেকদিন পর আকাশে মেঘ করেছে।রাতেরবেলা ঘুরাঘুরি করা ইদানীং তার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।মেসের বন্ধুরা মাঝেমাঝে তাকে নিয়ে ঠাট্টা করে বলে “ভাই,তোর মদ-গাজা অথবা মেয়ের প্রতি নেশা হতো! মানতাম।কিন্তু রাত জেগে রাস্তায় হাঁটাহাঁটির নেশাটা হজম হয়
jana ajana
না” পরশ তাদের উত্তর দেই না।কুমিল্লা থেকে সে চট্টগ্রাম এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য।আজ দু বছর হল।এই শহরের অনেক কিছুই তার এখন জানা।কিছুদূর এগুতেই পরশ দেখল,দুজন টহলপুলিশ তার দিকেই আসছে।পরশ ভয় পেয়ে গেল,ঘাম ছুটছে তার।নিমেষেই তার ফর্সা উজ্জ্বল চেহারা রঙ বদলাতে শুরু করল।অনেকটা সাহস নিয়েই সে আজ ষ্টেশন রোডের এদিকটাই এসেছে।কিন্তু এখন তার সব সাহস এক নিমেষে উবে গেল।পুলিশ দুজন তার কাছে আসতেই সে নিজের অজান্তেই বলল “আসসালামুয়ালাইকুম স্যার”। “এতরাতে এখানে কি?” পরশ আমতা আমতা করে বলল “আমি হাঁটছি স্যার,রাতে হাঁটাহাঁটি করা আমার অভ্যাশ”।, “আমার সাথে মশকারি কর?” পরশের মনে হল এখনি সে কেঁদে দেবে।সে কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে,সে মুহূর্তে এক রিনরিনে নারীকণ্ঠ তার পেছন থেকে বলে উঠল “কি সাহেব! আজকাল গরীবের পেটে লাথিও মারবেন।এই ছোকরা আমার খরিদ্দার” পরশ মাথা তুলে পুলিশ দুটোর দিকে তাকাল,তাদের দৃষ্টি অনুপাতে পেছন ফিরে তাকাতেই তার চোখ আটকে গেল।এক অসাধারণ সুন্দরী মেয়ে তার পিছে দাঁড়িয়ে আছে।তার টানা চোখে গভীর কালো কাজল দেয়া,লাল রাঙা ঠোঁটে মিষ্টি হাসি,কপালে বড় কালো টিপ।পরশ তার এতবছরের জীবনে,এতো সুন্দর কোন মেয়ে দেখেনি।মেয়েটি তাকে অতিক্রম করে পুলিশ দুজনকে একপাশে নিয়ে কি যেন বলছে।পুলিশ গুলো মুচকি হেসে তার দিকে তাকাচ্ছে।মেয়েটি কি বলল পরশ জানেনা,কিন্তু পুলিশ দুজন চলে গেল।মেয়েটি তার কাছে এসে বলল “খোকাবাবু তুমি এখানে থাইকলে বিপদে পইরবে,আমার সাথে চল” পরশ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করতে লাগল।মেয়েটি তার মনের ভাব বুঝতে পেরেই যেন বলল “ভয় নেই! কোন ক্ষতি হইবেনা তোমার।সামনের রাস্তায় একটা খুন হইয়েছে,মানুষ মইরছে।তুমি আমার সাথে চল” পরশের কেন যেন তার কথায় ভরসা হল,সে মেয়েটির পিছু পিছু হাঁটতে থাকল।

(২)
পুরো পথ দুজন নিঃশব্দেই হেঁটেছে।মেয়েটি তাকে ষ্টেশন এর পাশের একটি বস্তিতে নিয়ে এল।মেয়েটি খুব হাস্যজ্জল।যার সাথেই দেখা হচ্ছে হাসি তামাশা করছে,খবর নিচ্ছে।জায়গায় জায়গায় কিছু মেয়ে দাড়িয়ে তাকে বিভিন্ন ইশারা করছে।পরশের বুঝতে বাকি নেই এরা কারা।কিছুদূর গিয়ে একটি সেমিপাকা ছোট ঘরের দরজা খুলে মেয়েটি তাকে ভেতরে ঢুকিয়ে বলল “তুমি এইখানটাই বইসে থাকো,আমি আইসতেসি” পরশ ভেতরে ঢুকতেই,মেয়েটি দরজা ভেজিয়ে চলে গেল।পরশ পুরো ঘরটা চোখ বুলিয়ে একবার দেখল।ছোট একটি ঘর।আর এর মাঝে ছোট খাট পাতা,এক পাশের দেওয়ালে কিছু অর্ধনগ্ন নায়িকাদের ছবি লাগানো,আর এক পাশে ছোট একটি আলমারি এর পাশে দেওয়ালে ঝুলনো আয়না।পরশের মাথার পেছনে ১০০ পাওয়ারের একটি বাল্ব জ্বলছে,মাথার ওপর ছোট্ট একটি ফ্যান।হঠাৎ পরশের মনে হল,মেসে একটা কল করে তার বিপদের কথা বলা উচিৎ।কেউ না কেউ তো সাহায্য করবে।পকেট থেকে মোবাইল বেড় করে পরশ দেখল মোবাইল অফ।সে যখন মোবাইল অন করার চেষ্টা করছিল,ঠিক তখনই মেয়েটি ফিরে এল।পরশ অনেক্ষন পর খেয়াল করল,মেয়েটি লাল রঙের একটি শাড়ি পরেছে।মেয়েটি তার সামনে দাড়িয়ে বলল “আইজকে আমি না থাইকলে ওই বড়সাহেবেরা তোমাকে নিইয়ে যাইত,তারা তোমাকে খুনি ভাইবসে”কথাটা বলেই মেয়েটি হাসতে লাগল।পরশ বলল “আপনি হাসছেন কেন?”
-তোমার মতন পুচকে ছোকরা খুন কইরবে,এইটা চিন্তা কইরেই হাসি।
-আমি পুচকে না,২২ বছর আমার।আর আমার নাম পরশ।
-ওমা! তোমাকে দেইখে লাগে না!ষোল সতর বছরের পোলার মতইন লাগে।
মেয়েটি কথাটি বলে হাসতে হাসতে তার গায়ে লুটিয়ে পরল।পরশ তার কাছ থেকে দূরে সড়ে গিয়ে বলল “আপনি আমাকে যেমন ভাবছেন আমি তেমন ছেলে নই।আমি এসব পছন্দ করি না”মেয়েটি শান্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলল।তারপর বলল “এত ঘেন্না কইর না।আমিও মানুষ” পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পরশ বলল “আপনার নাম কি?” মেয়েটি মিষ্টি হেসে বলল “আমার নাম ময়না,এইখানে ডাকে মেহেরজান” পরশ অনেকটা উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো “আপনি এই পেশায় কেন এসেছেন?”ময়না একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল “তুমি আমার খরিদ্দার না,তোমারে কইতে সমস্যা নাই”

(৩)
পাশের ঘর থেকে কিছুক্ষন পরপর কার যেন হাসি ভেসে আসছে।একটু আগেই একটা ট্রেন বিকট আওয়াজ করে পাশ দিয়েই যেন গেল।ময়না তার শাড়ির আঁচলে আঙ্গুল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলতে লাগল “আমি যেইবার পঞ্চম শ্রেণী পাশ কইরেছি,আমার চুড ভাইটা পুকুরে পইরে মইরে গেল।এর এক বছর পর গেরামের এক চাচা আমাদের ঢাকা নিইয়া গেল।আমাদের দিন বদলাইসে,আমার আর একটা ভাই হইল।পাশের ঘরের কলিম ভাই দুই বছর পরে আমারে একটা গার্মেন্টস এ ঢুকাইয়ে দিল।বয়স অল্প হইলেও গায়ে গতরে বড় আসিলাম।সইলের রংডাও আসিল সুন্দর”কথাটা শেষ করে ময়না একটু থামল।পরশ তার দিকে তাকিয়ে ছিল।সে বলল “আপনি এখনো কম সুন্দরী নন।আসলে আপনার মতো সুন্দরী আমি আগে দেখিনি” ময়না তার কথায় কটাক্ষের হাসি হেসে বলল “এই রংডাই আমার জীবনের বড় সর্বনাশ কইরা দিল” পরশ তার কথায় আহত হয়ে বলল “তারপর কি হল?”ময়না মাটির দিকে তাকিয়ে বলল “আমি কাম কইরতাম মনোযোগ দিইয়া।আমার দরকার আসিল টেকা।সেই সময় গার্মেন্টসের এক পোলা আমারে ভালবাসার কথা কইত,আমার লগে প্রেম কইরবার চাইত।তার নাম মাসুদ।আমি তারে মানা কইরা দিসিলাম।এক বছর সেই আমার পিছে ঘুরসে।এরপর একদিন আমারে কলিম ভাই কইল তার লগে প্রেম কইরবার কথা।সে নাকি করম ভাইয়ের পা ধরসে।আমি কলিমভাই এর উপর ভরশা কইরে সম্পর্ক কইরলাম।আব্বায় জানলো পরে আমাগোরে বিয়া দিইয়া দিল”পরশ অবাক হয়ে বলল “যদি আপনার বিয়েই হয়ে থাকে,তবে এমন কি হল যে আপনাকে এই পথে আসতে হল?”ময়না উচ্চস্বরে হেসে উঠলো।তারপর নিজেকে সামলে বলল “তার ইনকাম কম আসিল।দুইজন মিলা একটা ঘর ভাড়া নিলাম।বিয়ার তিন মাস গেলে একদিন আমারে কইল চিটাগাং যাইব,আমার সাথে বেরাইব।খুশি হইয়া গেলাম তার লগে।এইখানে আইসে সে আমারে হের বন্ধুর বাসাত নিইয়া গেল,কইল বন্ধুর বউ বাপের বাড়ি গেসে বন্ধু আসে বাকি খালি ঘর।আমরা বিকাল বেলাত আইসিলাম,তাই ঘুমাই গেসিলাম।ঘুম ভাঙ্গনের পর মাসুদ কইল তার কি কাম আসে।সে কাম সাইরা আইসা আমারে লইয়া সিনেমা দেইখতে যাইব।আমারে শাড়ি পইরে রেডি থাইকত বলল”ময়না একটু দম নিয়ে আবার বলতে লাগল, “সে যাওনের পর তার বন্ধু আইয়া আমারে...............”কথাটা বলেই ময়না কাঁদতে লাগলো।কিছুক্ষন নিরব ছিল পরিবেশ।পরশ ভাবতে পারছিল না কিভাবে সান্ত্বনা দেবে ময়নাকে।ময়না নিজেই শান্ত হল।নিজেকে সামলে বলল “মাসুদে তার কাছে আমারে বেচছে। আর মাসুদের বন্ধু আমারে সেইদিন রাতে এইখানে বেইচে দিসে।এই হইল আমার এইখানে আসার কাহিনী”কথা শেষ করে ময়না একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।পরশ নিশ্চুপ হয়ে নিজের আবেগকে সামলানোর বৃথা চেষ্টা করতে লাগল।

(৪)
কোথা যেন আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে।পরশ উঠে দাড়িয়ে বলল “আমি এখন যাই,পরিস্থিতি হয়তো এখন সামলে গেছে”কথা শেষ করে সে তার মানিব্যাগ খুলে আজকেই পাওয়া টিউশনের বেতনের পুরো টাকাটাই ময়নার দিকে বাড়িয়ে দিল।ময়না মিষ্টি হেসে বলল “লাইগবে না খোকাবাবু।তুমি আমার খরিদ্দার না,হইলে নিতাম।মেডামরে আমি আমার জমা থেইকে বুঝায়ে দিব”পরশ চলে যেতে যেতে থেমে পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করল “আপনাকে কখনো কেউ খুজতে আসেনি?”ময়না মাথা নিচু করে বলল “কে জানে! খুইচ্ছে হইত।এইখানে তো কেউ আইসবনা ভদ্দর লোকেরা আসে না”
-তো আপনি যাননি কেন আপনার পরিবারের কাছে ?চাইলেই তো যেতে পারতেন?
-এইখানে যারা আসে,তাদের আর ফিরবার পথ থাকে না।বহুত কান্দছ!মেডামের পাও ধইরা।তারও দোষ নাই।সে তো আমারে কিন্না নিসে।
-আপনার খারাপ লাগে না?যেতে ইচ্ছে করে না পরিবারের কাছে?
-যাইতে তো মনো চাই! কিন্তু সেই সমাজে আমার আর জাইয়গা হইত না।
পরশ আর পিছু ফিরে না দেখে হাঁটতে শুরু করল।তার চোখ থেকে পানি পরছে।সে কাউকেই এই বেদনা দেখাতে চাই না।তাই ঝুম বৃষ্টি তার চখের পানি ভাসিয়ে নিচ্ছে।তার ভেতরের পুরুষত্ব তাকে যেন ঠুকরে খাচ্ছে।ময়নার কি অপরাধ ছিল?ভালোই ত বেসেছিল।চেয়েছিল সুখের সংসার পাতবে।পরশ হয়তো আর এইখানে আসতে পারবে না।কিন্তু তার মনে হল পতিতালয়ের এই একরাত সে আজীবন ভুলতে পারবে না। 
 
Top