ভালবাসার গল্প শফিক তাড়াহুড়ো করে রিকশায় উঠলো। হসপিটাল থেকে ফোন এসেছে একজন রোগীর অবস্থা বেশ খারাপ। রাজশাহী মেডিকেলের শিশু মেডিসিন বিভাগের ইনডোর মেডিকেল অফিসার(IMO) সে। হসপিটালে ঢোকার পরই জানতে পারল রোগী মারা গিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। ব্যাডের কাছে গিয়ে দেখল মারা যাওয়া শিশুটির পাশে শিশুটির মায়ের পিঠে হাত রেখে ব্যাকুল নয়নে কেঁদে যাচ্ছে নতুন ইনটার্নশীপে জয়েন করা মেয়েটি। মৃত্যু দেখে এখনও অভ্যস্ত হয়ে উঠেনি। কাজলে চোখ মাখামাখি হয়ে আছে। অনেকদিন পর শফিক কোন মেয়ের জন্য মায়া অনুভব করল। তার জীবন থেকে শিলার চলে যাওয়ার পর মনটা কেমন জড় পদার্থের মত হয়ে গেছে। মনের আগল নিজেই বন্ধ করে দিয়েছে সে। মেয়েটির এমন কান্না দেখে বহুদিন পর যেন এক চিলতে বাতাস নাড়া দিয়ে গেল মনকে। কাছে গিয়ে শফিক বলল, “শান্ত হও নাদিয়া। ডাক্তার যখন হয়েছ মৃত্যুকে মেনে নিতে হবে। আবেগ এখানে অচল। যাও ডেথ সার্টিফিকেট লিখার ব্যবস্থা কর।“ নাদিয়া অনেকক্ষণ থেকেই নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু চোখের সামনে ফুটফুটে শিশুটির মৃত্যু মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। বাচ্চার মা কেমন পাথরের মত বসে আছেন। নাদিয়ার মনে হচ্ছে সে নিজে যেন মায়ের কষ্ট টা অনুভব করতে পারছে। শফিক স্যার এর কথায় টনক নড়ল তার। স্যার এর কথাই ঠিক। কিন্তু আবেগ তো তার নিয়ন্ত্রণে না। এই যে জয়েন করার কয়েকদিনের মাথায় স্যার এর ব্যক্তিত্ব তাকে মুগ্ধ করেছে এই মুগ্ধতা কি তার হাতে ছিল? কেমন গম্ভীর একজন মানুষ। হাসেনও যেন মেপে মেপে। ভারী কণ্ঠস্বরে যখন কথা বলেন তখন শুনে যেতেই ইচ্ছে করে শুধু। এত যত্ন করে দিয়ে আসা কাজল তো কান্না করেই নষ্ট করে ফেললাম! অবশ্য তাতেই কি, উনার কি আর এসব নজরে আসবে? সে ভাল করে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে নিয়ে স্যার কে দেখাল। “মন ভাল হয়েছে তোমার?” শফিক জিজ্ঞেস করল। “জী স্যার।“ বলে সার্টিফিকেট টা দেখাল। শফিক কিছু জিনিস ঠিক করে দিল। “ফ্রেশ হয়ে আস ওয়াশ রুম থেকে, কেঁদে কেটে মেয়ের কি অবস্থা। তারপর ঠিক করে আরেকবার লিখে নিয়ে আসবে।“ মিনমিন করে জী স্যার বলে ওয়াশ রুম এ গেল নাদিয়া। শফিক হাসল একটু। কয়েকদিন পর একটা রিপোর্ট দেখাতে শফিকের রুম এ আসল নাদিয়া।দরজায় নক করতে যাবে তখন শুনল ভেতরে শফিক আবৃত্তি করছে নিজের মনে। “তুমি মুখ তুলে চাওনি বলেই দেখ আমি সব কাজে মনোযোগ হীন সবখানে খাপছাড়া, তুমি মুখ তুলে তাকাওনি বলে কিভাবে যে ক্ষয়ে গেছি অন্তরে বাহিরে, কিভাবে যে হয়ে গেছি নিঃস্ব রিক্ত, উদ্দামহীন,” নাদিয়ার বুকের ভেতর কেমন করে উঠে। কি গাড় বিষাদ স্যার এর কণ্ঠে। দীর্ঘদিন বুকে কিছু চেপে রাখলে তবেই কণ্ঠ থেকে এমন অশ্রু ঝরে। দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকল নাদিয়া। “মহাদেব সাহার কবিতা না স্যার?” মুচকি হাসে শফিক,”তুমি কবিতা পড়?” “কবিতা আমার খুব প্রিয় স্যার” নানান কথা হতে থাকে তাদের মাঝে। হঠাৎ শফিকের মনে হয় এত কথা বলছে কেন সে মেয়েটির সাথে? আর কারও সাথে তো এমন হয়না তার। তবে কি মেয়েটি তার মনের কোথাও জায়গা করে নিচ্ছে? দিন গড়াতে থাকে। শফিক আর নাদিয়ার সখ্যতা সবারই একটু নজর কাড়ে।শফিক নিজেও বুঝতে পারে নাদিয়া তার প্রতি বেশ দুর্বল। শফিক ভাবে লুকোচুরি করার বয়স পার করে এসেছে অনেক আগে। শিলার কথা নাদিয়াকে জানিয়ে তার নিজের মনের কথা প্রকাশ করার সময় এসে গেছে। শফিক একদিন বাইরে দেখা করতে বলে নাদিয়াকে। নাদিয়া দুরু দুরু বুকে দেখা করতে যায়। অজানা আনন্দে আর শঙ্কায় তার মন দুলছে। কি বলবে স্যার? তার মনের কথা কি স্যার টের পেয়ে গেল? স্যার ও কি তাকে পছন্দ করে? এত গম্ভীর মুখোশের ভেতরের মানুষটাকে বুঝে উঠতে পারেনা সে। “বস নাদিয়া” কিছু না বলে পার্কের বেঞ্চে বসে পড়ে নাদিয়া। বুকের ভেতর ঢাক বাজছে যেন। “তোমাকে কিছু কথা বলার ছিল নাদিয়া।“ “বলেন স্যার” “আমি একটা মেয়েকে ভালবাসতাম। খুব বেশি। মেয়েটির নাম ছিল শিলা। আমরা এক কলেজে পড়তাম। বেশ ভাল বন্ধু ছিলাম। খুব আগলে রাখতাম তাকে। কোন মলিনতাকে স্পর্শ করতে দেইনি তাকে কোনদিন। কিন্তু আমার এ ভালোবাসার মূল্য সে দেয়নি। ফিরিয়ে দিয়েছিল আমার সব আবেগকে। এরপর নিজেই নিজের মনের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ভেবছিলাম কখনও ভালবাসতে পারবোনা কাউকে। কিন্তু তুমি আচমকা সেই দরজা খুলে সেখানে জায়গা করে নিয়েছ। বুঝতে পারছ আমি কি বলছি?” শফিক তাকিয়ে দেখে মেয়েটির চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে অঝরে। এত কাঁদতে পারে মেয়েটা। শফিক নাদিয়ার হাত ধরে আলতো করে। কাঁপছে হাত থরথর করে। নাদিয়ার মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে। একটু পর চোখ খুললে দেখবে সে নিজের রুমে। চোখ বন্ধ করে সে বলতে থাকে “স্বপ্ন না হোক , এ স্বপ্ন না হক” কি বলবে সে শফিক কে? সে তো ছাই স্যার এর মত এত গুছিয়ে কথাও বলতে পারেনা। স্যার কি বুঝতে পারছেনা তার মনের কথা? তার চোখের দিকে তাকালেই তো বুঝে যেতেন। তা না, উনি মুচকি হাসছেন! শফিক বলে উঠে, “তুই কি আমার শুষ্ক চোখে অশ্রু হবি? মধ্য রাতে বেজে ওঠা টেলিফোনের ধ্বনি হবি? একটি নীলাভ এনভেলাপে পুরে রাখা কেমন যেন বিষাদ হবি? প্রতীক্ষার এই দীর্ঘ হলুদ বিকেল বেলায় কথা দিয়েও না রাখার এক কথা হবি? তুই কি একা আমার হবি? তুই কি আমার একান্ত এক দুঃখ হবি?” নাদিয়া শফিকের হাত শক্ত করে ধরে রাখে। কেউ কোন কথা বলেনা। মৌনতাই মাঝে মাঝে সব কথা বলে যায়।
 
Top