রাত ১০টা। উত্তরবঙ্গে নভেম্বরের শীত ভালোই জেঁকে বসেছে। এই হিম ঠাণ্ডায় পড়তে বসতে কারইবা মন চায়, কিন্তু কিছু করার নেই। কাল একটা পরীক্ষা আছে, তাড়াতাড়ি পড়া শেষ করতে হবে। বইটা চোখের সামনে থেকে সরিয়ে একটা হাই তুলে মোবাইলটা হাতে নিতেই বিরক্তিতে চোখ কুঁচকে যায় দীপার। ইফতি আবারও ফোন দিয়েছে । ছেলেটার কি লজ্জা-শরম কিছুই নেই ?! এতো বার মানা করার পরও কিসের আশায় যে ও বার বার ফোন দেয়, কিছুতেই সেটা মাথায় ঢোকে না দীপার। নাহ, এর একটা বিহিত করতেই হবে। তিনবারের বার ফোনটা ধরল দীপা। -হ্যালো -(কিছুক্ষণ চুপ থেকে)….কেমন আছো দীপা ? -আমি তোমাকে অসংখ্য বার বলেছি তুমি আমাকে ফোন দিবা না, তার পরও তুমি ফোন দাও কোন সাহসে? আচ্ছা, তোমার বাপ-মা কি তোমাকে ভদ্রতা শেখায়নি? কী চাও এখন তুমি আমার কাছে আর ? -দীপা...দীপা...আমি….একটা কথা শোন...শুধু একটা কথা...... -আমি তোমার কোনও কথাই শুনবো না ইফতি,আমি জানি তুমি কী বলবা...আমার জীবনটা জ্বালিয়ে শেষ করে দিয়েছ তুমি, এরপরও আবার আমার সামনে কথা বলতে আসো…? -দীপা, আমি খুব অসুস্থ... -সেটা তুমি তোমার বাপ-মা কে গিয়ে বল, যাও ! তুমি তো সারা বছরই অসুস্থ থাকো, তাই না ? তোমার মতো বেশরম বেয়াদব ছেলে আমি কখনও দেখিনি...রাখ্ হারামজাদা, তুই ফোন রাখ্ ! আর একবার আমাকে ফোন দিয়ে দেখিস আমি তোর কী করি। লাই দিতে দিতে মাথায় উঠছিস,তাই না ? রাখ্, ফোন রাখ্ হারামজাদা……. অপ্রকৃতস্থের মতো চিৎকার করতে করতে ফোনের লাইনটা কেটে দেয় দীপা। অপর প্রান্তে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে ইফতি। ঝাপসা চোখে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বিশ্বাস হতে চায় না যে এই দীপাই ওর সেই পুরনো দীপা। দীপা তো ঠিকই বলেছে। বেহায়া-বেশরম না হলে কি আর ও ৭ বছরের পুরনো ধুলো পড়া সম্পর্কের দাবি নিয়ে আবারো দীপাকে ফোন দিতে পারতো ? কত সহজে দীপা পেরেছে ওদের সেই সব হাসিমাখা দিনগুলোকে হাসিমুখে কবর দিয়ে সুজয়ের জন্য জীবনকে প্রস্তুত করতে। অথচ ইফতির জীবন ? ও কেন পারে না এভাবে অবলীলায় সব ভুলে যেতে ? জীবনের কথা ভাবতে গিয়ে বরং হাসিই পায় ইফতির। কেউ জানে না। কাউকে বলেইনি ও। ল্যাব-এইডের ডাক্তার আশরাফ যখন ওর সিটি-স্ক্যান রিপোর্ট হাতে নিয়ে বিস্ময় মাখা গলায় জিজ্ঞেস করেছিলেন-“আপনার উপর দিয়ে কি অসম্ভব মানসিক অত্যাচার চালানো হয়েছে ?!”, তখন কিছুই বলার ছিল না ইফতির। ডাক্তার পই পই করে বলে দিয়েছে যেন দেরি না করে ও ভারতে গিয়ে অপারেশনটা করে ফেলে। সুবোধ বালকের মতো মাথা নেড়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আবর্জনার স্তূপে রিপোর্টটা ফেলে দিয়ে বাড়ি ফিরেছে ইফতি। এক দিক দিয়ে তো ভালোই হল। আস্তে আস্তে জীবন শেষ, তো আস্তে আস্তে কষ্টও শেষ । খালি খালি মানুষকে ব্যাতিব্যস্ত করার কী দরকার ? অনাগত সুখের সময়টার কথা ভাবতে ইফতির ভালোই লাগে। একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় দারিয়ে আকাশে ইতিউতি তাকিয়ে চাঁদটা খোঁজে ইফতি। আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে ঠিক করে, আর ফোন দেবে না দীপাকে। পুরনো স্মৃতিগুলো মাঝে মাঝে বুকের মধ্যে পিষ্ট হতে হতে অসহনীয় হয়ে পরে। কোনও ভালবাসা ছোঁওয়া পেতে নয়, কেবল দীপার কাছ থেকে একটু ভালো ব্যবহার পাওয়ার আশা নিয়ে আবারও ছুটে এসেছিলো ও। কিন্তু এখনকার সাজানো সংসারে দমকা হাওয়ার পরশ পেলে দীপাইবা ছেড়ে কথা কইবে কেন ? কুকুর বিড়ালের মতো তাড়িয়ে দিয়ে তো দীপা ঠিকই করেছে। কে যেন বুকের ভেতর থেকে চিৎকার করে ওঠে – “দীপার এখন আর কি কিছুই মনে পরে না ?!” অসঙ্গায়িত প্রশ্নটাকে পাত্তা না দিয়ে ইফতি গুনগুন করে দীপার সেই প্রিয় গানটা গেয়ে ওঠে ‘বুলবুল পাখি ময়না টিয়ে, আয় না যা না গান শুনিয়ে দূর দূর দেশের গান, নীল নীল নদের গান দুধ ভাত দেব সন্দেশ মাখিয়ে............’ আস্তে আস্তে চোখ বুজে আসে ইফতির। ওর মুখে তখন এক আশ্চর্য প্রশান্তির হাসি। ঠিক এমন সময় ওদিকে দীপা বইটা বন্ধ করে ফেসবুকে বসেছে। এতক্ষণে সুজয় নিশ্চয়ই ফেসবুকে ঢুকে দীপার খোঁজ করছে। লগ-ইন করার সাথে সাথে পেয়েও গেল সুজয়কে। -হাই ! -হ্যালো, কেমন আছো ? -এইতো ভালো, তোমার কী অবস্থা ? -আমিও ভালো। আরাম করে বিছানায় শরীর এলিয়ে সুজয়ের সাথে চ্যাট করায় মগ্ন হয়ে পরে দীপা। ইফতির কথা আর মনেই থাকে না। আরে, এসব তুচ্ছ থেকেও তুচ্ছতর ব্যাপারে মন খারাপ করলে কি আর চলে ? -------------------------------------------------------------------------- (এই ঘটনার মাস ছ’য়েক পর একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে চুপচাপ মারা যায় ইফতি। ইফতি চেয়েছিল দীপা যেন কিছুতেই জানতে না পারে ওর চলে যাওয়ার কথা। তার ড্রয়ারে পাওয়া অসংখ্য ঠিকানাবিহীন চিঠিতে বার বার করে উল্লেখ ছিল সে কথা। তার কথা রাখা হয়েছে। দীপাকে জানানো হয় নি। সবচেয়ে মজার কথা হল – দীপা নিজেই কোনোদিন জানতেই চায়নি। )
 
Top