চিকিৎসক সমাজকে নিয়ে লিখতে গেলে মাঝে মাঝে আমি দিশেহারা হয়ে যায়। এই সমাজের মানুষগুলোর এত দোষ যে কোনটা ছেঁড়ে কোনটা নিয়ে লিখবো তার সিরিয়াল দিতেই হিমশিম খেতে হয়। অনেকটা বড় বড় রক্তচোষাদের রোগীর সিরিয়াল দিতে হিমশিম খাবার অবস্থার মত। ডাক্তাররা আসলে কি?? আপাতত এই প্রজাতি সম্পর্কে যতগুলো বিশেষণ আবিষ্কৃত হয়েছে তার কোনটাই বোধকরি গত কালকের ‘ধর্ষক’ শব্দটির ধারে কাছ দিয়েও যায়নি। এর আগে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল ‘কসাই’ উপাধিটা। এছাড়া ‘গলাকাটা’, ‘রক্তচোষা’ উপাধিগুলো তো আছেই। এত উপাধি থাকার পরেও কিছু কিছু মহামানব/মানবীর মনে হয়েছে যে, না, এত অল্প গালিগালাজে ডাক্তারদের কিছু হবেনা। ওদের চামড়া গন্ডারের মত। ওদের জন্য আরো যুতসই কিছু শব্দ দরকার। সেই হিসাবে ‘ধর্ষক’ শব্দটিকে খুব একটা খারাপ বলা যায় না। বরং উপাধিটি পেয়ে ডাক্তার সমাজ গর্ব বোধ করতে পারে। দেশে যে আগে থেকে ধর্ষনের সেঞ্চুরী পালন করার রেওয়াজ চলে আসছে। তবে এটা নিয়ে পত্রিকা ওয়ালাদের খুব একটা মাথা ব্যথা নেই। তাদের সমস্ত মনযোগ এই ডাক্তার সমাজের প্রতি। লেখার এই পর্যায়ে কিছু বাস্তব সত্য না বলে পারছি না। কথাগুলো বলার আগে দুটো ঘটনা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
ঘটনা ১
আমরা তখন হলি-ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজে ইন্টার্নি করছি। গাইনি এন্ড অবস ওয়ার্ডে আমাদের অল্প কয়েকজনের প্লেসমেন্ট চলছে। আমাদের মধ্যে একজন ছিল বেশ লম্বা-হালকা পাতলা গড়নের। মুখে দাড়ি। অসম্ভব ভদ্র আর বিনয়ী। ছেলেটার নাম শুভ। কাজের ব্যাপারে আমরা কিছু ফাঁকি দিলেও ও খুব সিরিয়াস। লেবার রুমে প্লেসমেন্টের সময় তাকে বেশীরভাগ সময় লেবার রুমেই পাওয়া যেত। একদিনের কথা বলছি। লেবার রুমে শুভ একজন রোগীকে রিসিভ করেছে। প্রথমবার মা হতে যাওয়া সেই রোগী শুভ-র ব্যবহারে এতটাই মুগ্ধ যে ডেলিভারি টেবিলে শুয়ে সে শুভকে দেখতে না পেয়ে ম্যাডামকে অনুরোধ করেছে শুভকে ডেকে আনার জন্য। শুভ ডেলিভারির সময় হাতের কনুই দিয়ে হিপ এবডাকশন থেকে শুরু করে অন্য অনেক কাজ করেছে পরম যত্নে। সেই মায়ের চোখে আমি কৃতজ্ঞতা ছাড়া একজন পুরুষ ডাক্তারের প্রতি ভয় দেখিনি, দ্বিধা দেখিনি।
ঘটনা ২
ঘটনাটি আমাদের কলেজে প্রফের এক্সটার্নাল হয়ে আসা একজন প্রফেসরের মুখ থেকে শোনা। লেকচারার হিসাবে স্যারের কাছ থেকে শোনা অনেক অভিজ্ঞতার একটি শেয়ার করছি।
রেপ কেসের শুনানি হচ্ছে। ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের একজন মহিলা ডাক্তার এক্সপার্ট সাক্ষী হিসাবে গেছেন। সাথে স্যার-ও গেছেন। আসামী পক্ষের উকিল সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো একজন মহিলা ডাক্তারকে কীভাবে অপমান করেন তার কথা বলতে গিয়ে স্যার বারবার চোখ মুখ শক্ত করে ফেলছিলেন। জেরার একপর্যায়ে উকিল প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি কি কখনো রেপের সম্মুখীন হয়েছিলেন যে আপনি বুঝবেন রেপ ভিকটিমের মেন্টাল ট্রমা কি জিনিস???
ঘটনা দুটি উল্লেখ করার কারণ- প্রথম আলোর এক সাংবাদিকের রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারি করা নিয়ে লেখা রিপোর্টের একদম শেষের দিকের একটি লাইন, যা থেকেই আজকের লেখার শিরোনাম। লাইনটিতে এসেছে যে, রেপ ভিক্টিম যখন ডাক্তারী পরীক্ষার জন্য যান এবং একজন পুরুষ ডাক্তার যখন তাকে পরীক্ষা করেন তখন সে ২য় বার ধর্ষিত হয়। এই লাইনটি পড়ার পর নিজেকে একজন ধর্ষক ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে পারছি না। এই কথাটি শুনানির সময় আইনজীবিরা আদালতকে বলেছেন। তাদের কথাকে আমলে নিলে ফরেনসিক মেডিসিনের সাথে যে সকল পুরুষ ডাক্তার জড়িত আছেন তারা প্রত্যেকেই এক একজন ধর্ষক। সেই ধর্ষকদের একজন ছিলাম সাড়ে তিনবছর ধরে। সেই ধর্ষকদের একজন হয়েই আজ আবার কলম তুলে নিলাম কিছু বলার জন্য।
১. ঢাকা মেডিকেল কলেজে ফরেনসিক মেডিসিন ডিপার্টমেন্টে কোন নারী চিকিৎসক নেই। দোষ কার???? ডাক্তার সমাজের। কিন্তু কেন এই ফরেনসিক বিভাগে নারী চিকিৎসকরা আসতে চান না সেই কারণটি কি আদালত খতিয়ে দেখেছে?? ফরেনসিক বিভাগে কর্মরত প্রতিটি চিকিৎসককে কি পরিমাণ কষ্ট করতে হয় সে ব্যাপারে কি কোন ধারণা আছে সেই নারী সাংবাদিক বা আইনজীবিদের?? প্রতিদিন অনেকগুলো পোস্টমর্টেম, রেপ ভিক্টিম এক্সামিনেশন, কোর্টে দৌড়ানো, সাক্ষী দেয়ার ঝামেলা পোহানো, আদালতে আইনজীবিদের কাছ থেকে অসৌজন্যমূলক আচরণ এত হ্যাপা মেয়েরা সহ্য করতে পারেন না বলেই তারা ফরেনসিকে আসতে চাননা। এই ব্যাপারগুলোর জন্য কি আদালতের কোন রুল নেই??? নাকি তারা ডাক্তার বলে জাগতিক ও সামাজিক সব রুলের উর্ধ্বে তারা?
২. আমাদের একজন নারী চিকিৎসক নিজেকে ধর্ষনের হাত থেকে বাঁচাতে যেয়ে নৃশংসভাবে খুন হল। তখন কোথায় ছিল এই সাংবাদিক সমাজ??? তখন এই খুনের শাস্তি দাবী করে করা মানববন্ধনে এসে এক মহিলা রিপোর্টার বলেছিলেন যে ‘একজন ডাক্তার খুন হয়েছে এটা কোন সংবাদ না’।
ফরেনসিকের ডাক্তার যারা পোস্টমর্টেম করেন বা রেপ ভিক্টিম এক্সামিনেশন করেন তারা জানেন তাদের কি পরিমাণ হুমকি-ধামকি সহ্য করতে হয়। তাদেরকে মিথ্যা রিপোর্ট দেবার জন্য কি পরিমাণ বল প্রয়োগ করা হয়। এই যে মানসিক যন্ত্রণা যা মাঝে মাঝে অত্যাচারের পর্যায়ে পরে তা থেকে ডাক্তার সমাজকে রক্ষা করার জন্য কি করেছে আইন কিংবা আদালত??? নিজের রেস্ট রুমে একজন মহিলা ডাক্তারের জীবনের নিরাপত্তা যেখানে নেই সেখানে এই ফরেনসিক মেডিসিনের জগতে মেয়েরা কেন আসবেন?? এই প্রশ্ন কি কখনো মাথায় এসেছে বিজ্ঞ আদালতের?
৩. যে আইনজীবিরা আজকে ২য় ধর্ষনের কথা তুললেন, তারা কি কেউ কখনো কোন রেপ কেসে আসামী পক্ষ ডিফেন্ড করেননি??? নাকি তারা করবেন না??? যখন রেপ কেসের ভিক্টিমকে আদালতে সবার সামনে আসামী পক্ষের উকিল জেরা করেন, ভিক্টিমকে নিজের মুখে রেপের ঘটনা সবার উদ্দেশ্যে বলতে বলেন এবং কুৎসিত চোখে একটা ছিদ্র খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন, ভিক্টিমের উদ্দেশ্যে মন্তব্য ছুঁড়ে দেন যে, ‘তুমি তো ব্যাপারটা উপভোগই করেছো তাই না?’ তখন কি সেই মেয়েটা আবার ধর্ষিত হয় না??? তখন তো আসামী পক্ষের জোর প্রচেষ্টা থাকে মেয়েটাকে দুশ্চরিত্র বলে প্রমাণ করার। এই বিষয়গুলো কি সাংবাদিক বা আদালতের চোখে পড়ে না???
৪. ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাড়াও দেশে আরো অসংখ্য সরকারী মেডিকেল কলেজে রেপ ভিক্টিমের পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া জেলা সদর হাসপাতালে সিভিল সার্জন রেপ ভিক্টিম এক্সামিনেশন করেন। এখন প্রতিটি জায়গায় যদি মহিলা চিকিৎসক না পাওয়া যায় তাহলে কি রেপ ভিক্টিম এক্সামিনেশন বন্ধ থাকবে??? প্রতিটি স্থানে প্রতিটি দিন মহিলা ফরেনসিক এক্সপার্টের উপস্থিতি নিশ্চিত করা কি আদৌ সম্ভব??? না হলে কি হবে??? যে সাংবাদিক রিপোর্ট করেছেন তিনি কি জানেন যে দ্রুততম সময়ে এক্সামিনেশন না করা হলে সাসপেক্টকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দেয়া সম্ভব নয়। তাহলে কি আমাদের বোনেরা তাদের উপর নারকীয় অত্যাচার চালানোর জন্য বিচার চাওয়া বন্ধ করে দেবে???
হে সাংবাদিক মহাশয়া, হে আইনের রক্ষক সমাজের মহামানবেরা,
আমরা যারা রক্তচোষার দল আমরা রক্ত চুষে খাবার সময় নারী-পুরুষ ভেদাভেদ করি না। আমাদের রক্ত হলেই হয়। আমরা গলাকাটার সময় লক্ষ্য করিনা গলাটা কি পুরুষের খোঁচা খোঁচা দাড়িযুক্ত নাকি নারীর গলার মত মসৃন। আমরা কসাইগিরি করার সময় দেখিনা টাকাটা কোন হাত থেকে আসছে?? সেটা কি পুরুষের মোটা আঙ্গুল থেকে আসছে নাকি নারীর সরু হাত থেকে আসছে??
আমাদের ডিকশনারীতে তিনটি শব্দ আছে যার কোন লিংগ ভেদাভেদ নেই। কান খুলে শব্দ তিনটি শুনে রাখুন। শব্দ তিনটি হল- রোগ, রোগী এবং চিকিৎসা- যার কোন লিংগ ভেদাভেদ চিকিৎসক সমাজ করে না। আমরা সবাই ধোয়া তুলসি পাতা তা কখনোই বলবো না, কিন্তু যেভাবে ঢালাও ভাবে সব ফরেনসিক ডাক্তারদের ২য় ধর্ষক বানিয়ে দিলেন তাতে কিন্তু সমাজ দূষণ মুক্ত হবে না।
অবকাঠামো উন্নতির কথা না বলে, লোকবলের অভাবের কথা না বলে, সিস্টেম পরিবর্তনের কথা না বলে এভাবে যদি সব কিছুকেই অবৈধ ঘোষণা করে দেন তাহলে কিছুদিন পরে না জানি মহিলা ফরেনসিক ডাক্তারের মধ্যেও আপনারা লেসবো-র দোষ আবিস্কার করে বসেন। আপনাদের দ্বারা তো আবার সবই সম্ভব।
বর্তমানে আমাদের দেশের সবথেকে বড় ধর্ষক সমাজের একজন প্রতিনিধি হিসাবে আমার মোটেও গর্ব বোধ করার কথা না। কিন্তু আমি গর্ব করছি। আমি গর্ব করছি কারণ এই আমাদের ফরেনসিক ডাক্তার ভাইদের কারণেই ১০০ ভাগ না হলেও ৯০ ভাগ ধর্ষক তার শাস্তি পেয়েছে। সেই সব নির্যাতিত বোনদের পাশে কিন্তু সাংবাদিকরা আসেনি। তাদের পত্রিকায় পরিমলদের জন্য অ্যালিবাই বের করে রিপোর্ট করা হয়। আর যাদের কারণে পরিমলরা শাস্তি পায় তাদেরকে ২য় ধর্ষক উপাধি দেয়া হয়।
এত কিছুর পরেও আমি গর্বের সাথে উচ্চারণ করবো
‘আমি রক্তচোষা হব এটাই আমার অ্যাম্বিশন
আমি বড় কসাই হব এটাই আমার অ্যাম্বিশন
তবুও আমি ধর্ষক রবো এটাই আমার অ্যাম্বিশন’
লিখেছেন- Dr. Tanvir- UH, UK (16/04/13)
ঘটনা ১
আমরা তখন হলি-ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজে ইন্টার্নি করছি। গাইনি এন্ড অবস ওয়ার্ডে আমাদের অল্প কয়েকজনের প্লেসমেন্ট চলছে। আমাদের মধ্যে একজন ছিল বেশ লম্বা-হালকা পাতলা গড়নের। মুখে দাড়ি। অসম্ভব ভদ্র আর বিনয়ী। ছেলেটার নাম শুভ। কাজের ব্যাপারে আমরা কিছু ফাঁকি দিলেও ও খুব সিরিয়াস। লেবার রুমে প্লেসমেন্টের সময় তাকে বেশীরভাগ সময় লেবার রুমেই পাওয়া যেত। একদিনের কথা বলছি। লেবার রুমে শুভ একজন রোগীকে রিসিভ করেছে। প্রথমবার মা হতে যাওয়া সেই রোগী শুভ-র ব্যবহারে এতটাই মুগ্ধ যে ডেলিভারি টেবিলে শুয়ে সে শুভকে দেখতে না পেয়ে ম্যাডামকে অনুরোধ করেছে শুভকে ডেকে আনার জন্য। শুভ ডেলিভারির সময় হাতের কনুই দিয়ে হিপ এবডাকশন থেকে শুরু করে অন্য অনেক কাজ করেছে পরম যত্নে। সেই মায়ের চোখে আমি কৃতজ্ঞতা ছাড়া একজন পুরুষ ডাক্তারের প্রতি ভয় দেখিনি, দ্বিধা দেখিনি।
ঘটনা ২
ঘটনাটি আমাদের কলেজে প্রফের এক্সটার্নাল হয়ে আসা একজন প্রফেসরের মুখ থেকে শোনা। লেকচারার হিসাবে স্যারের কাছ থেকে শোনা অনেক অভিজ্ঞতার একটি শেয়ার করছি।
রেপ কেসের শুনানি হচ্ছে। ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের একজন মহিলা ডাক্তার এক্সপার্ট সাক্ষী হিসাবে গেছেন। সাথে স্যার-ও গেছেন। আসামী পক্ষের উকিল সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো একজন মহিলা ডাক্তারকে কীভাবে অপমান করেন তার কথা বলতে গিয়ে স্যার বারবার চোখ মুখ শক্ত করে ফেলছিলেন। জেরার একপর্যায়ে উকিল প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি কি কখনো রেপের সম্মুখীন হয়েছিলেন যে আপনি বুঝবেন রেপ ভিকটিমের মেন্টাল ট্রমা কি জিনিস???
ঘটনা দুটি উল্লেখ করার কারণ- প্রথম আলোর এক সাংবাদিকের রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারি করা নিয়ে লেখা রিপোর্টের একদম শেষের দিকের একটি লাইন, যা থেকেই আজকের লেখার শিরোনাম। লাইনটিতে এসেছে যে, রেপ ভিক্টিম যখন ডাক্তারী পরীক্ষার জন্য যান এবং একজন পুরুষ ডাক্তার যখন তাকে পরীক্ষা করেন তখন সে ২য় বার ধর্ষিত হয়। এই লাইনটি পড়ার পর নিজেকে একজন ধর্ষক ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে পারছি না। এই কথাটি শুনানির সময় আইনজীবিরা আদালতকে বলেছেন। তাদের কথাকে আমলে নিলে ফরেনসিক মেডিসিনের সাথে যে সকল পুরুষ ডাক্তার জড়িত আছেন তারা প্রত্যেকেই এক একজন ধর্ষক। সেই ধর্ষকদের একজন ছিলাম সাড়ে তিনবছর ধরে। সেই ধর্ষকদের একজন হয়েই আজ আবার কলম তুলে নিলাম কিছু বলার জন্য।
১. ঢাকা মেডিকেল কলেজে ফরেনসিক মেডিসিন ডিপার্টমেন্টে কোন নারী চিকিৎসক নেই। দোষ কার???? ডাক্তার সমাজের। কিন্তু কেন এই ফরেনসিক বিভাগে নারী চিকিৎসকরা আসতে চান না সেই কারণটি কি আদালত খতিয়ে দেখেছে?? ফরেনসিক বিভাগে কর্মরত প্রতিটি চিকিৎসককে কি পরিমাণ কষ্ট করতে হয় সে ব্যাপারে কি কোন ধারণা আছে সেই নারী সাংবাদিক বা আইনজীবিদের?? প্রতিদিন অনেকগুলো পোস্টমর্টেম, রেপ ভিক্টিম এক্সামিনেশন, কোর্টে দৌড়ানো, সাক্ষী দেয়ার ঝামেলা পোহানো, আদালতে আইনজীবিদের কাছ থেকে অসৌজন্যমূলক আচরণ এত হ্যাপা মেয়েরা সহ্য করতে পারেন না বলেই তারা ফরেনসিকে আসতে চাননা। এই ব্যাপারগুলোর জন্য কি আদালতের কোন রুল নেই??? নাকি তারা ডাক্তার বলে জাগতিক ও সামাজিক সব রুলের উর্ধ্বে তারা?
২. আমাদের একজন নারী চিকিৎসক নিজেকে ধর্ষনের হাত থেকে বাঁচাতে যেয়ে নৃশংসভাবে খুন হল। তখন কোথায় ছিল এই সাংবাদিক সমাজ??? তখন এই খুনের শাস্তি দাবী করে করা মানববন্ধনে এসে এক মহিলা রিপোর্টার বলেছিলেন যে ‘একজন ডাক্তার খুন হয়েছে এটা কোন সংবাদ না’।
ফরেনসিকের ডাক্তার যারা পোস্টমর্টেম করেন বা রেপ ভিক্টিম এক্সামিনেশন করেন তারা জানেন তাদের কি পরিমাণ হুমকি-ধামকি সহ্য করতে হয়। তাদেরকে মিথ্যা রিপোর্ট দেবার জন্য কি পরিমাণ বল প্রয়োগ করা হয়। এই যে মানসিক যন্ত্রণা যা মাঝে মাঝে অত্যাচারের পর্যায়ে পরে তা থেকে ডাক্তার সমাজকে রক্ষা করার জন্য কি করেছে আইন কিংবা আদালত??? নিজের রেস্ট রুমে একজন মহিলা ডাক্তারের জীবনের নিরাপত্তা যেখানে নেই সেখানে এই ফরেনসিক মেডিসিনের জগতে মেয়েরা কেন আসবেন?? এই প্রশ্ন কি কখনো মাথায় এসেছে বিজ্ঞ আদালতের?
৩. যে আইনজীবিরা আজকে ২য় ধর্ষনের কথা তুললেন, তারা কি কেউ কখনো কোন রেপ কেসে আসামী পক্ষ ডিফেন্ড করেননি??? নাকি তারা করবেন না??? যখন রেপ কেসের ভিক্টিমকে আদালতে সবার সামনে আসামী পক্ষের উকিল জেরা করেন, ভিক্টিমকে নিজের মুখে রেপের ঘটনা সবার উদ্দেশ্যে বলতে বলেন এবং কুৎসিত চোখে একটা ছিদ্র খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন, ভিক্টিমের উদ্দেশ্যে মন্তব্য ছুঁড়ে দেন যে, ‘তুমি তো ব্যাপারটা উপভোগই করেছো তাই না?’ তখন কি সেই মেয়েটা আবার ধর্ষিত হয় না??? তখন তো আসামী পক্ষের জোর প্রচেষ্টা থাকে মেয়েটাকে দুশ্চরিত্র বলে প্রমাণ করার। এই বিষয়গুলো কি সাংবাদিক বা আদালতের চোখে পড়ে না???
৪. ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাড়াও দেশে আরো অসংখ্য সরকারী মেডিকেল কলেজে রেপ ভিক্টিমের পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া জেলা সদর হাসপাতালে সিভিল সার্জন রেপ ভিক্টিম এক্সামিনেশন করেন। এখন প্রতিটি জায়গায় যদি মহিলা চিকিৎসক না পাওয়া যায় তাহলে কি রেপ ভিক্টিম এক্সামিনেশন বন্ধ থাকবে??? প্রতিটি স্থানে প্রতিটি দিন মহিলা ফরেনসিক এক্সপার্টের উপস্থিতি নিশ্চিত করা কি আদৌ সম্ভব??? না হলে কি হবে??? যে সাংবাদিক রিপোর্ট করেছেন তিনি কি জানেন যে দ্রুততম সময়ে এক্সামিনেশন না করা হলে সাসপেক্টকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দেয়া সম্ভব নয়। তাহলে কি আমাদের বোনেরা তাদের উপর নারকীয় অত্যাচার চালানোর জন্য বিচার চাওয়া বন্ধ করে দেবে???
হে সাংবাদিক মহাশয়া, হে আইনের রক্ষক সমাজের মহামানবেরা,
আমরা যারা রক্তচোষার দল আমরা রক্ত চুষে খাবার সময় নারী-পুরুষ ভেদাভেদ করি না। আমাদের রক্ত হলেই হয়। আমরা গলাকাটার সময় লক্ষ্য করিনা গলাটা কি পুরুষের খোঁচা খোঁচা দাড়িযুক্ত নাকি নারীর গলার মত মসৃন। আমরা কসাইগিরি করার সময় দেখিনা টাকাটা কোন হাত থেকে আসছে?? সেটা কি পুরুষের মোটা আঙ্গুল থেকে আসছে নাকি নারীর সরু হাত থেকে আসছে??
আমাদের ডিকশনারীতে তিনটি শব্দ আছে যার কোন লিংগ ভেদাভেদ নেই। কান খুলে শব্দ তিনটি শুনে রাখুন। শব্দ তিনটি হল- রোগ, রোগী এবং চিকিৎসা- যার কোন লিংগ ভেদাভেদ চিকিৎসক সমাজ করে না। আমরা সবাই ধোয়া তুলসি পাতা তা কখনোই বলবো না, কিন্তু যেভাবে ঢালাও ভাবে সব ফরেনসিক ডাক্তারদের ২য় ধর্ষক বানিয়ে দিলেন তাতে কিন্তু সমাজ দূষণ মুক্ত হবে না।
অবকাঠামো উন্নতির কথা না বলে, লোকবলের অভাবের কথা না বলে, সিস্টেম পরিবর্তনের কথা না বলে এভাবে যদি সব কিছুকেই অবৈধ ঘোষণা করে দেন তাহলে কিছুদিন পরে না জানি মহিলা ফরেনসিক ডাক্তারের মধ্যেও আপনারা লেসবো-র দোষ আবিস্কার করে বসেন। আপনাদের দ্বারা তো আবার সবই সম্ভব।
বর্তমানে আমাদের দেশের সবথেকে বড় ধর্ষক সমাজের একজন প্রতিনিধি হিসাবে আমার মোটেও গর্ব বোধ করার কথা না। কিন্তু আমি গর্ব করছি। আমি গর্ব করছি কারণ এই আমাদের ফরেনসিক ডাক্তার ভাইদের কারণেই ১০০ ভাগ না হলেও ৯০ ভাগ ধর্ষক তার শাস্তি পেয়েছে। সেই সব নির্যাতিত বোনদের পাশে কিন্তু সাংবাদিকরা আসেনি। তাদের পত্রিকায় পরিমলদের জন্য অ্যালিবাই বের করে রিপোর্ট করা হয়। আর যাদের কারণে পরিমলরা শাস্তি পায় তাদেরকে ২য় ধর্ষক উপাধি দেয়া হয়।
এত কিছুর পরেও আমি গর্বের সাথে উচ্চারণ করবো
‘আমি রক্তচোষা হব এটাই আমার অ্যাম্বিশন
আমি বড় কসাই হব এটাই আমার অ্যাম্বিশন
তবুও আমি ধর্ষক রবো এটাই আমার অ্যাম্বিশন’
লিখেছেন- Dr. Tanvir- UH, UK (16/04/13)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন