খুব আন্তরিকভাবে বলছি, তোমাকে আজ আমি একটা গল্প বলব, ভালোবাসার গল্প। অন্যরকম ভালোবাসার গল্প। গল্পটা শুনতে শুনতে তুমি বুঝতে পারবে-এ পৃথিবীটা আসলে ভালোবাসার, ভালোবাসার জন্যই এ পৃথিবীটা সৃষ্টি হয়েছে। গল্পের আরও গভীরে গিয়ে তুমি অনুভব করবে-তোমার হৃদয়টা দুলছে। সেই অদৃশ্য দোলায় তুমি নিজেও দুলছ। দুলছে তোমার আশপাশ, তোমার ঘর, তোমার টেবিলের মানিপ্লান্ট, তোমার জানালার মাধবীলতা। একসময় খুব আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলে-তোমার মন আর তোমার মাঝে নেই, সে উড়ে বেড়াচ্ছে। আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে সে, নদীতে উড়ে বেড়াচ্ছে সে। ঘাসফুল, বটবৃক্ষ, প্রজাপতির ডানাতেও উড়ে বেড়াচ্ছে সে।
ভালোবাসা হচ্ছে এমন একটা জিনিস, যা চাইলেও পাওয়া যায় না, আবার অনেক সময় না চাইলেও পাওয়া যায়। অনেকে এটা এত বেশি পায়, যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে যায়; অনেক না পেয়েও যন্ত্রণায় মরে যায়। তবে ভালোবাসার কাঙাল সবাই। সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান থেকে রাস্তার ওই ভিখারিও। ভালোবাসার জন্য যুদ্ধ করে সবাই প্রতিদিন-ঘুম থেকে উঠেই, ঘুমাতে যাওয়ার আগপর্যন্ত।
তোমাকে বোধহয় ভালোবাসার গল্প বলতে চেয়েছিলাম। তার আগে তোমাকে অন্য একটা গল্প বলি। আমাদের বাড়ির তিন বাড়ি পেছনে সাজাদ ভাই থাকতেন। সাজাদ ভাই হচ্ছেন এমন একটা মানুষ, যিনি প্রতি মিনিটে মিনিটে প্রেমে পড়েন। আরও একটু খোলাখুলিভাবে বললে বলা যায়, সেকেন্ডে সেকেন্ডে পড়েন। সাতচলি্লশ বছর বয়সেও তিনি সমানতালে প্রেম করে যাচ্ছেন। অল্পবয়সী থেকে শুরু করে মধ্যবয়সী, এমনকি পড়ন্ত বয়সীদের সঙ্গেও।
বাসে করে একদিন বাসায় ফিরছিলেন সাজাদ ভাই। তিনি আবার বসেছিলেন মহিলাদের সিটে। কয়েক স্টপেজ পার হওয়ার পর এক মহিলা উঠলেন বাসে। সাজাদ ভাই উঠে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে মহিলাটি বললেন, ‘না না, উঠতে হবে না আপনার। আপনি বসুন।’
সাজাদ ভাই বসলেন। তার পাশে বাসের ভেতরের রড ধরে দাঁড়িয়ে আছেন মহিলাটি। বাস দুলছে, মহিলাও দুলছেন। একটু পরপর সাজাদ ভাইয়ের গায়ে তার শাড়ির ছোঁয়া লাগছে, মহিলাও কিছুটা ঝুঁকে পড়ছেন তার দিকে, অন্যরকম এক অনুভূতিতে ছেয়ে যাচ্ছে সাজাদ ভাইয়ের মন। আরও দুই স্টপেজ যাওয়ার পর সাজাদ ভাই আবার উঠে দাঁড়ালেন। এবারও মহিলা বললেন, ‘বললাম না, আপনাকে উঠতে হবে না। বসুন আপনি।’
কিছুটা বিব্রত ভঙ্গিতে বসে রইলেন সাজাদ ভাই। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে বসে থাকার পর সাজাদ ভাই বললেন, ‘ম্যাডাম, ব্যাপারটা হয়েছে কী…!’
মহিলা সাজাদ ভাইকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনি বিব্রত হবেন না তো…।
‘আসলে হয়েছে কী…।’
সাজাদ ভাই এবারও কথা শেষ করতে পারলেন না। আর আগেই মহিলাটি ঝুঁকে এলেন তার দিকে। সাজাদ ভাইয়ের পুরো মুখ ঢেকে গেল তার শাড়ির আঁচলে। মনের ভেতরটা উথাল-পাতালে ভরে গেল তার। কিন্তু আরও একটা স্টপেজ পার হওয়ার পর ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললেন, ‘আপনি আসলে ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না ম্যাডাম।’
‘কে বলল বুঝতে পারছি না। বললাম না, এভাবে দাঁড়িয়ে যাওয়ার অভ্যাস আছে আমার। আমি বেশ কমফোর্ট ফিল করছি এভাবে দাঁড়িয়ে যেতে।’ মহিলাটি তার কাঁধে হাত রেখে কিছুটা জোর করে তাকে বসিয়ে দিলেন সিটে।
কিন্তু ঝট করে আবার উঠে দাঁড়ালেন তিনি। তারপর কিছুটা রূঢ় স্বরে বললেন, ‘আরে ধুর ম্যাডাম। আপনার অতি ভদ্রতার কারণে আমি আমার বাসা তিন স্টপেজ পেছনে ফেলে এসেছি!’
সত্যি করে বলো তো, কেমন লাগল গল্পটা। ভালোবাসার গল্প বলার আগে তোমাকে আরেকটা গল্প বলি। সাত বছর ভালোবাসাবাসি করার পর বিয়ে করেছিলেন রিয়াদ ভাই আর টুম্পা আপা। কিন্তু বিয়ের দেড় বছরের মাথায় বিয়েটা ভেঙে গেল তাদের। খুব বোকা ধরনের মানুষ রিয়াদ ভাই, না হলে সাত বছর ভালোবাসাবাসি করার পর কেউ বিয়ে করে!
ব্যাপারটাতে বেশ কষ্ট পেলেন রিয়াদ ভাইয়ের বল্পুব্দরা। তারা সবাই একদিন তার বাসায় এলেন এবং এক বল্পুব্দ রিয়াদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইদানীং ডিভোর্সের সংখ্যা বেড়ে গেছে। আচ্ছা বল তো, এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে বলে তোর মনে হয়!’
রিয়াদ ভাই খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘সম্ভবত বিয়ে!’
সরি, তোমাকে ভালোবাসার গল্প বলতে চেয়েছি আমি। আচ্ছা বলো তো-পারিবারিকভাবে বিয়ে আর ভালোবাসাবাসি করে বিয়ের মধ্যে পার্থক্য কী? পারিবারিকভাবে বিয়ে মানে অন্যের দ্বারা খুন হওয়া আর ভালোবাসাবাসি করে বিয়ে মানে আত্মহত্যা করা। একটা মিলও রয়েছে। পারিবারিকভাবে বিয়ের পর প্রেম শুরু হয়ে, তারপর যন্ত্রণা; প্রেম করার পর বিয়ে হয়, তারপর যন্ত্রণা।
আমি সত্যি দুঃখিত, তোমাকে ভালোবাসার গল্প বলতে চেয়েছি আমি। কিন্তু কী নির্লজ্জ আমি! কিশোরী হেনা মারা যায় বর্বর পুরুষ কর্তৃক, বিচারের নামে প্রহসন; চাঁদপুরের ৬০ বছরের মাদ্রাসার শিক্ষক আবদুল জলিল কর্তৃক ওই মাদ্রাসার ১১ বছরের একটি শিশুর অবৈধভাবে মা হওয়া আর সত্তরোর্ধ্ব ওই মানুষটি, সর্বস্ব দিয়ে শেয়ারবাজারে নেমে সর্বস্বান্ত হয়ে যার আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করা চিৎকার! তারপরও ভালোবাসার গল্প! প্লিজ আসো না, তার বদলে আমরা একবারের জন্য হলেও মানুষ হই, মানুষের নির্লজ্জতায় আমরা প্রকাশ্য দিবালোকে আত্মহত্যা করি!
 
Top