by- টিনটিন টিউলিপ
আলমারি থেকে শার্ট বের করতে গিয়ে হঠাত্ থমকে যায় শাহীন। বিয়ের পর আজ প্রথম অফিস যাওয়া বলে কথা। কোন শার্টটা পড়বে তা নিয়ে একটু দ্বিধাদন্দ্বে আছে, মুহুর্তেই ফ্লাশব্যাকে সে চলে যায় তার ফেলে আসা অতীতে। এই তো মাত্র কিছুদিন হলো বছর পাঁচ আগে ও প্রতিদিন ভার্সিটিতে যাবার আগে তার শার্ট পড়তে গিয়ে ব্যপক মাত্রায় ঝামেলায় পড়তে হতো। ফুচকা কিংবা আইসক্রীম অথবা কাজলের কল্যানে তৈরি বিচিত্র সব চিত্রকর্ম স্থান দখল করে রাখতো তার শার্ট । অসম্ভব রকম দুষ্টু আর চঞ্চল মাইশা নামের দুরন্ত মেয়েটির সাথে শাহীনের মতো সাধাসিদে শান্ত ক্যাবলাকান্তের কিভাবে প্রেম হয়েছিলো তা তাদের বন্ধুমহলে একপ্রকার অনআবিস্কৃত রহস্য হয়েছিলো। ফড়িংয়ের মতো লাফিয়ে বেড়াতো মাইশা। প্রতিদিনই ফুচকা চকলেট কিংবা আইসক্রীম শাহীনের গায়ের উপর ফেলে দেয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। একবার তো আস্ত ডাব ফেলে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলো শাহীনের নতুন কেনা জুতা জোড়ার। এতসব কি শুধুই মাইশার পাগলামি নাকি তাকে জ্বালানোর জন্য করা হয় তা নিয়ে কখনোই মাথা ঘামায় নি সে। শাহীন তো ডুবে ছিলে মাইশার অদ্ভুত সুন্দর দুই চোখের মায়াতে।যে চোখে কারনে অকারনে মান অভিমানের পালাবদলে অঝোরে বৃষ্টি নামতো। কাজল মাখা অশ্রুজল ভিজিয়ে দিতো শাহীনের শার্ট। সেই ভেজা স্যাতস্যাতে কালো দাগভরা শার্টগুলো বুকে চেপে ধরে কতরাত নির্ঘুম কাটিয়েছে সে। মাইশার মিষ্টি ছোঁয়া হারিয়ে যাবার ভয়ে কখনো শার্ট ধুতে পর্যন্ত দিতো না, এ নিয়ে বন্ধুরা কতো জ্বালাইছে তাকে কিন্তু সে নিজেও জানতো মাইশা তাকে কি পাগলের মতো ভালোবাসে। মাইশা নিজের পরীক্ষার আগের রাতে আড্ডা দিয়ে, মুভি দেখে, রাত ১০টা বাজতেই নাক ডেকে ঘুমাতে ব্যস্ত হয়ে গেলেও শাহীনের পরীক্ষা, এসাইনম্যান্ট কিংবা প্রেজেন্টেশন যাই থাকুক না সারারাত সজাগ থাকতো মাইশা যদিনা ভুলবশতো ভোরসকালে শাহীনের ঘুম ভাঙতে দেরি হয়। বড় অদ্ভুত সব বায়না ধরতো পাগল মেয়েটি। কোনো এক ঝড়বৃষ্টির রাতে শাড়ি পড়ে বাইরে ঘুরতে যাবার আবদার করেছিলো শাহীনের কাছে। নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেইরাতে মাইশার পাগলামীর সঙ্গী হতে গিয়ে নতুন এক মাইশার পরিচয় জানতে পারে সে। উদ্বাস্তু মানুষগুলোকে একটুমাথা গোঁজার ঠাই করে দিতে কি না করেছে সে। ভোররাতে বাসায় ফেরার সময় সাদা শাড়ি পড়া ক্লান্ত মাইশার দিকে তাকিয়ে অবাক হয় শাহীন। কতো শান্ত, স্থির গভীর ওই চোখদুটো। কতো রূপ, কতো ভাষা ধারন করে বসে আছে ওই ছোট্ট দুটি চোখ। আজকের এই মেয়েকে দেখলে কি কেউ বিশ্বাস করবে এই নাকি সে মেয়ে যে কিনা ঈদের দিনে তাকে নদীর পানিতে চুবানি খাইয়েছে। খুব শখ করে নৌকা নিয়ে ঈদের দিন পড়ন্ত বিকেলে ঘুরতে বের হয়েছিলো তারা। মাইশার অনুরোধে সেদিন শাহীনকে মাঝি হতে হলেও খুব একটা দূরে সে নৌকা নিয়ে যাচ্ছিল না কারন সে নিজে সাতার জানলেও মাইশা জানতো না যে। বহুদূরে কিছু সাদা বেগুনি কচুরিপানার ফুল দেখে মহারানীর মর্জি হয় তাকে নাকি এখন ওই ফুল দিয়েই প্রপোজ করতে হবে। শাহীন রাজি হচ্ছিল না দেখে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দেয় মাইশা। বেচারা শাহীন হাড়ে হাড়ে টের পায় এই মেয়ে কি জিনিষ। সে মনে মনে ভাবে পৃথিবীতে বহু প্রেমিক পুরুষ তার প্রেয়সীর মনোঞ্জনের জন্য সাতসাগর পাড়ি দিয়ে নীলপদ্ম কিংবা বৃষ্টিতে ভেজা কাক হয়ে ১০১ কদম ফুল খুঁজে নিয়ে আসলে এই প্রথম মনে হয় কাউকে এই বিদঘুটে কচুরিপানার ফুল আনতে হচ্ছে। বহুকষ্টে সাতার কেটে, মনে মনে কচুরিপানার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে অবশেষে ফুল নিয়ে নৌকায় ফিরে আসে সে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে তার হাত থেকে ফুলগুলে নিয়ে পাশে এসে বসে মাইশা। শাহীনের কাধে আলতো করে মাথা রেখে বলে- হয়তো তোমারই জন্য এই ভালোবাসা খুব সামান্য
হয়তো তোমায় ঘিরে আমার স্বপ্নগুলো অতি নগন্য
হয়তো তুমি পাশে তাই রংধনুর সব রং হয়ে যায় বিবর্ন
হয়তো তুমি হাত ধরেছো নিশ্চিন্তে আজ পাড়ি দেই উন্মত্ত সাগর কিংবা গহীন অরন্য
হয়তো তেমন কিছু নয় অথবা আমার সব হয়তো তোমারই জন্য না না শুধুই তোমার জন্য
এক মুঠো স্বপ্ন আর এক চিলতে হাসি শুধু এতটুকু আমার জন্য এই নিয়ে পাশে থেকো আর বলো "শুধু তোমায় ভালোবাসি" কিছু মুহুর্ত কেটে যায় নীরবে। ভেজা পান্জাবীটা আবার ভিজিয়ে দেয়া কান্না জলগুলো আলাদা করা যাচ্ছে বোধহয়। শাহীন ভেবে পায় না এই বোকা মেয়েটা কাদছে কেনো? সাদা বেগুনি কচুরিপানার ফুলগুলো এতো সুন্দর লাগছে কেনো? পড়ন্ত বিকেলের সূর্যস্নান নাকি মাইশার আদুরি হাতের ছোঁয়া এর জন্য দায়ী?
স্বপ্নের মতো সুন্দর ছিল যাদের জীবন কিছু অসুন্দর মুহুর্ত সবকিছু দুঃস্বপ্নে পাল্টে দেয়। খুব শখ করে ড্রাইভিং শিখেছিলো মাইশা। বাবা মাকে নিয়ে প্রথম লংড্রাইভে বের হয়েছিলো। কার ভুলে কিংবা কি কারনে জানা নেই সবাই চিরদিনের মতো বহুদূরে চলে গেলো। শুধুমাত্র মাইশা কেমন করে যেনো হয়তো শাহীনের ভালোবাসার টানেই সবাইকে আশ্চর্য করে ২৭ দিন পর ফিরে আসে কোমা থাকে। কিন্তু তার ফিরে আসাটা স্বাভাবিক ছিলোনা। অপটিক নার্ভে ইনজুরির কারনে চিরদিনের জন্য সে তার চোখের দৃষ্টি ফেলে আসে পিছনে।
চোখগুলো ঝাপসা হয়ে আসে শাহীনের। না আজ আর শার্ট বাছাই করতে ঝামেলা হয়না তার।
-অফিসে দেরি হয়ে যাবে তো, তাড়াতাড়ি নাস্তা করতে আসো
সদ্যবিবাহিত নতুন বৌ এর ডাকে অতীতের ঝাপি বন্ধ করে বর্তমানে ফিরে আসে শাহীন। তাড়াতাড়ি পা বাড়ায় ডাইনিং রুমের দিকে. . . . . . . . . . . .
কোনভাবে নাস্তা শেষ করে বাইরে বের হয়ে শাহীন। অতীতের স্মৃতিগুলো প্রচন্ড ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মাথা থেকে তাড়াতে পাড়ছে না কোনভাবে। দুর্ঘটনার পর থেকেই মাইশা বদলে যেতে শুরু করে ।শামুকের মতো গুটিয়ে নেয় নিজেকে, নিজের চারপাশে অদৃশ্য দেয়াল গড়ে তোলে। প্রথমদিকে কারো সাথে খুব একটা কথা বলতো না, দেখা করতো না। কেমন যেনো অনুভূতি শুণ্য হয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। শাহীন অনেক চেষ্টা করেছিলো মাইশাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে। সবসময় ঘাসফড়িং এর মতো লাফিয়ে বেড়ানো মেয়েটা হঠাত্ করেই অসম্ভব স্থির হয়ে গেলো। অনুরোধের ঢেকি গিলে মাঝে মাঝে কদাচিত্ দুই তিনবার বাইরে শাহীনের সাখে ঘুরতে গিয়েছিলো কিন্তু কেমন যেন অতিরক্ত সাবধানী হয়ে যায় সে। অন্ধকার পৃথিবীতে চলতে গিয়ে এতটুকুন ভুল হয়না তার, ভুল করেও এখন আর আইসক্রীম ফুচকারা চিত্রশিল্পী হবার সুযোগ পায়না। শার্টগুলো এখন আর ক্যানভাস হয়না। একসময় যে ভালোবাসা ছিল দুষ্টু অত্যাচার এখন তা অতি দুর্লভ কাঙ্খিত বস্তু হয়ে গিয়েছে শাহীনের কাছে। সময় কেটে যাচ্ছিল সময়ের নিয়মেই। শাহীনের বাসা থেকে একসময় বিয়ের জন্য চাপ আসতে শুরু করে। ওর বাবা মা কোনভাবেই মাইশার সাথে বিয়েতে রাজি হচ্ছিল না। একটা অনিশ্চিত জীবনের সাথে তাদের একমাত্র ছেলের জীবন মেলাতে তাদের আপত্তি ছিল চুড়ান্ত পর্যায়ের। মাইশাও কোনভাবে রাজি হচ্ছিল না। অবশেষে শাহীনের অসম্ভব জেদের মুখে পড়ে সবার অমতে অনেকটা দায়সারা ভাবেই বিয়েটা হয়ে যায় তাদের। বাসররাতে মাইশা মুখ ফুটে একটা কথাও বলেনি সারারাত শাহীনের বুকে মাথা রেখে পাগলের মতো কেঁদে পান্জাবী ভিজিয়েছে। শাহীন ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলো। মনে মনে ভাবছিলো জীবনে শেষবারের মতো আজ তোমার চোখের জল পড়তে দিচ্ছি।
বাসায় আজ অফিসে যাবার কথা বললে ও আজ শাহীনকে অনেক গুরুত্বপূর্ন একটা জায়গায় যেতে হবে। অনেক কিছুর ব্যবস্থা করতে হবে যে। শাহীন ভাবে নিজের হাতে আজ মাইশার চোখে সে কাজল দিয়ে দিবে। আজ কতোদিন হয়ে গেলো কাজলকালো চোখ জোড়া দেখা হয়না। ভালোবাসার কাজল দিয়ে আকাঁ সাজানো পৃথিবীটা মাইশা দেখতে পারবে তো? খুব বড় বোধহয় নয় ছোট্ট এক নৌকা ভর্তি কিছু সাদা বেগুনি কচুরিপানার ফুলের কি ক্ষমতা হবে মাইশা দু'চোখে সেই সাজানো স্বপ্নীল অতীত ফিরিয়ে দিতে? সামান্য কিছু জলে ভাসা ফুলের কি সাধ্য আছে একটিবার সেই হারানো উচ্ছ্বলতা ফিরিয়ে দেবার? আজ প্রয়োজনে শুধু পানি নয় বরং কাদামাটি মেখে ভুত সেজে এসে দাঁড়াবে শাহীন। হয়তো মাইশা দেখবেনা তবু যদি ভুল করেও বুঝতে পারে একটিবার। আর সেই আগের মতো হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়বে তো তার গায়ের উপর? পড়ন্ত বিকেলের ডুবন্ত সূর্যের আলো গায়ে মেখে আর একটিবার কি মাইশার হাতের ছোঁয়া পেয়ে হেসে উঠবে নৌকাভরা কচুরিপানার সাদা বেগুনি ফুলগুলো?
নাহ শাহীন আর কিছু ভাবতে পারছেনা। আজ কি হবে সে জানে না। তবু ও আজ তার অনেক কাজ। ইস একদম মনে পড়ছে না. . . . . . .
কি যেন কথাগুলো. . . . . . . . . . . . . . . . . . .আজ তাকে যে বলতেই হবে. . . . . . . . . . . . . . ."হয়তো তোমারই জন্য. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .না না শুধুই তোমার জন্য. . . . . . . . . . .
(কিছু কথাঃ আমার খুব কাছের আত্নীয় লাকি আন্টি এবং মিজান আংকেল, তাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় ১৫ বছর হতে চলেছে। তাদের ঘর আলো করে আছে তাদের ১০বছরের একমাত্র ছেলে। কিন্তু গতপ্রায় ১২ বছর যাবত অপটিক নার্ভ শুকিয়ে যাবার কারনে ধীরে ধীরে একটু একটু করে চির অন্ধত্ব মেনে নিতে হয়েছে আমার আন্টিকে। কিন্তু আংকেল যেভাবে এতোগুলো বছর আন্টিকে সাপোর্ট দিয়ে গেছে, তাদের ভালোবাসা দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ। তাদের সেই ভালোবাসার একমাত্র অবলম্বন আমার পিচ্চি আর লক্ষী ভাইটির জন্য এই গল্পটি। যারা এই গল্পটি ধৈর্য নিয়ে পড়েছেন তারা শুধু আমার আংকেল আন্টির জন্য একটু দোয়া করবেন)
আলমারি থেকে শার্ট বের করতে গিয়ে হঠাত্ থমকে যায় শাহীন। বিয়ের পর আজ প্রথম অফিস যাওয়া বলে কথা। কোন শার্টটা পড়বে তা নিয়ে একটু দ্বিধাদন্দ্বে আছে, মুহুর্তেই ফ্লাশব্যাকে সে চলে যায় তার ফেলে আসা অতীতে। এই তো মাত্র কিছুদিন হলো বছর পাঁচ আগে ও প্রতিদিন ভার্সিটিতে যাবার আগে তার শার্ট পড়তে গিয়ে ব্যপক মাত্রায় ঝামেলায় পড়তে হতো। ফুচকা কিংবা আইসক্রীম অথবা কাজলের কল্যানে তৈরি বিচিত্র সব চিত্রকর্ম স্থান দখল করে রাখতো তার শার্ট । অসম্ভব রকম দুষ্টু আর চঞ্চল মাইশা নামের দুরন্ত মেয়েটির সাথে শাহীনের মতো সাধাসিদে শান্ত ক্যাবলাকান্তের কিভাবে প্রেম হয়েছিলো তা তাদের বন্ধুমহলে একপ্রকার অনআবিস্কৃত রহস্য হয়েছিলো। ফড়িংয়ের মতো লাফিয়ে বেড়াতো মাইশা। প্রতিদিনই ফুচকা চকলেট কিংবা আইসক্রীম শাহীনের গায়ের উপর ফেলে দেয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। একবার তো আস্ত ডাব ফেলে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলো শাহীনের নতুন কেনা জুতা জোড়ার। এতসব কি শুধুই মাইশার পাগলামি নাকি তাকে জ্বালানোর জন্য করা হয় তা নিয়ে কখনোই মাথা ঘামায় নি সে। শাহীন তো ডুবে ছিলে মাইশার অদ্ভুত সুন্দর দুই চোখের মায়াতে।যে চোখে কারনে অকারনে মান অভিমানের পালাবদলে অঝোরে বৃষ্টি নামতো। কাজল মাখা অশ্রুজল ভিজিয়ে দিতো শাহীনের শার্ট। সেই ভেজা স্যাতস্যাতে কালো দাগভরা শার্টগুলো বুকে চেপে ধরে কতরাত নির্ঘুম কাটিয়েছে সে। মাইশার মিষ্টি ছোঁয়া হারিয়ে যাবার ভয়ে কখনো শার্ট ধুতে পর্যন্ত দিতো না, এ নিয়ে বন্ধুরা কতো জ্বালাইছে তাকে কিন্তু সে নিজেও জানতো মাইশা তাকে কি পাগলের মতো ভালোবাসে। মাইশা নিজের পরীক্ষার আগের রাতে আড্ডা দিয়ে, মুভি দেখে, রাত ১০টা বাজতেই নাক ডেকে ঘুমাতে ব্যস্ত হয়ে গেলেও শাহীনের পরীক্ষা, এসাইনম্যান্ট কিংবা প্রেজেন্টেশন যাই থাকুক না সারারাত সজাগ থাকতো মাইশা যদিনা ভুলবশতো ভোরসকালে শাহীনের ঘুম ভাঙতে দেরি হয়। বড় অদ্ভুত সব বায়না ধরতো পাগল মেয়েটি। কোনো এক ঝড়বৃষ্টির রাতে শাড়ি পড়ে বাইরে ঘুরতে যাবার আবদার করেছিলো শাহীনের কাছে। নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেইরাতে মাইশার পাগলামীর সঙ্গী হতে গিয়ে নতুন এক মাইশার পরিচয় জানতে পারে সে। উদ্বাস্তু মানুষগুলোকে একটুমাথা গোঁজার ঠাই করে দিতে কি না করেছে সে। ভোররাতে বাসায় ফেরার সময় সাদা শাড়ি পড়া ক্লান্ত মাইশার দিকে তাকিয়ে অবাক হয় শাহীন। কতো শান্ত, স্থির গভীর ওই চোখদুটো। কতো রূপ, কতো ভাষা ধারন করে বসে আছে ওই ছোট্ট দুটি চোখ। আজকের এই মেয়েকে দেখলে কি কেউ বিশ্বাস করবে এই নাকি সে মেয়ে যে কিনা ঈদের দিনে তাকে নদীর পানিতে চুবানি খাইয়েছে। খুব শখ করে নৌকা নিয়ে ঈদের দিন পড়ন্ত বিকেলে ঘুরতে বের হয়েছিলো তারা। মাইশার অনুরোধে সেদিন শাহীনকে মাঝি হতে হলেও খুব একটা দূরে সে নৌকা নিয়ে যাচ্ছিল না কারন সে নিজে সাতার জানলেও মাইশা জানতো না যে। বহুদূরে কিছু সাদা বেগুনি কচুরিপানার ফুল দেখে মহারানীর মর্জি হয় তাকে নাকি এখন ওই ফুল দিয়েই প্রপোজ করতে হবে। শাহীন রাজি হচ্ছিল না দেখে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দেয় মাইশা। বেচারা শাহীন হাড়ে হাড়ে টের পায় এই মেয়ে কি জিনিষ। সে মনে মনে ভাবে পৃথিবীতে বহু প্রেমিক পুরুষ তার প্রেয়সীর মনোঞ্জনের জন্য সাতসাগর পাড়ি দিয়ে নীলপদ্ম কিংবা বৃষ্টিতে ভেজা কাক হয়ে ১০১ কদম ফুল খুঁজে নিয়ে আসলে এই প্রথম মনে হয় কাউকে এই বিদঘুটে কচুরিপানার ফুল আনতে হচ্ছে। বহুকষ্টে সাতার কেটে, মনে মনে কচুরিপানার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে অবশেষে ফুল নিয়ে নৌকায় ফিরে আসে সে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে তার হাত থেকে ফুলগুলে নিয়ে পাশে এসে বসে মাইশা। শাহীনের কাধে আলতো করে মাথা রেখে বলে- হয়তো তোমারই জন্য এই ভালোবাসা খুব সামান্য
হয়তো তোমায় ঘিরে আমার স্বপ্নগুলো অতি নগন্য
হয়তো তুমি পাশে তাই রংধনুর সব রং হয়ে যায় বিবর্ন
হয়তো তুমি হাত ধরেছো নিশ্চিন্তে আজ পাড়ি দেই উন্মত্ত সাগর কিংবা গহীন অরন্য
হয়তো তেমন কিছু নয় অথবা আমার সব হয়তো তোমারই জন্য না না শুধুই তোমার জন্য
এক মুঠো স্বপ্ন আর এক চিলতে হাসি শুধু এতটুকু আমার জন্য এই নিয়ে পাশে থেকো আর বলো "শুধু তোমায় ভালোবাসি" কিছু মুহুর্ত কেটে যায় নীরবে। ভেজা পান্জাবীটা আবার ভিজিয়ে দেয়া কান্না জলগুলো আলাদা করা যাচ্ছে বোধহয়। শাহীন ভেবে পায় না এই বোকা মেয়েটা কাদছে কেনো? সাদা বেগুনি কচুরিপানার ফুলগুলো এতো সুন্দর লাগছে কেনো? পড়ন্ত বিকেলের সূর্যস্নান নাকি মাইশার আদুরি হাতের ছোঁয়া এর জন্য দায়ী?
স্বপ্নের মতো সুন্দর ছিল যাদের জীবন কিছু অসুন্দর মুহুর্ত সবকিছু দুঃস্বপ্নে পাল্টে দেয়। খুব শখ করে ড্রাইভিং শিখেছিলো মাইশা। বাবা মাকে নিয়ে প্রথম লংড্রাইভে বের হয়েছিলো। কার ভুলে কিংবা কি কারনে জানা নেই সবাই চিরদিনের মতো বহুদূরে চলে গেলো। শুধুমাত্র মাইশা কেমন করে যেনো হয়তো শাহীনের ভালোবাসার টানেই সবাইকে আশ্চর্য করে ২৭ দিন পর ফিরে আসে কোমা থাকে। কিন্তু তার ফিরে আসাটা স্বাভাবিক ছিলোনা। অপটিক নার্ভে ইনজুরির কারনে চিরদিনের জন্য সে তার চোখের দৃষ্টি ফেলে আসে পিছনে।
চোখগুলো ঝাপসা হয়ে আসে শাহীনের। না আজ আর শার্ট বাছাই করতে ঝামেলা হয়না তার।
-অফিসে দেরি হয়ে যাবে তো, তাড়াতাড়ি নাস্তা করতে আসো
সদ্যবিবাহিত নতুন বৌ এর ডাকে অতীতের ঝাপি বন্ধ করে বর্তমানে ফিরে আসে শাহীন। তাড়াতাড়ি পা বাড়ায় ডাইনিং রুমের দিকে. . . . . . . . . . . .
কোনভাবে নাস্তা শেষ করে বাইরে বের হয়ে শাহীন। অতীতের স্মৃতিগুলো প্রচন্ড ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মাথা থেকে তাড়াতে পাড়ছে না কোনভাবে। দুর্ঘটনার পর থেকেই মাইশা বদলে যেতে শুরু করে ।শামুকের মতো গুটিয়ে নেয় নিজেকে, নিজের চারপাশে অদৃশ্য দেয়াল গড়ে তোলে। প্রথমদিকে কারো সাথে খুব একটা কথা বলতো না, দেখা করতো না। কেমন যেনো অনুভূতি শুণ্য হয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। শাহীন অনেক চেষ্টা করেছিলো মাইশাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে। সবসময় ঘাসফড়িং এর মতো লাফিয়ে বেড়ানো মেয়েটা হঠাত্ করেই অসম্ভব স্থির হয়ে গেলো। অনুরোধের ঢেকি গিলে মাঝে মাঝে কদাচিত্ দুই তিনবার বাইরে শাহীনের সাখে ঘুরতে গিয়েছিলো কিন্তু কেমন যেন অতিরক্ত সাবধানী হয়ে যায় সে। অন্ধকার পৃথিবীতে চলতে গিয়ে এতটুকুন ভুল হয়না তার, ভুল করেও এখন আর আইসক্রীম ফুচকারা চিত্রশিল্পী হবার সুযোগ পায়না। শার্টগুলো এখন আর ক্যানভাস হয়না। একসময় যে ভালোবাসা ছিল দুষ্টু অত্যাচার এখন তা অতি দুর্লভ কাঙ্খিত বস্তু হয়ে গিয়েছে শাহীনের কাছে। সময় কেটে যাচ্ছিল সময়ের নিয়মেই। শাহীনের বাসা থেকে একসময় বিয়ের জন্য চাপ আসতে শুরু করে। ওর বাবা মা কোনভাবেই মাইশার সাথে বিয়েতে রাজি হচ্ছিল না। একটা অনিশ্চিত জীবনের সাথে তাদের একমাত্র ছেলের জীবন মেলাতে তাদের আপত্তি ছিল চুড়ান্ত পর্যায়ের। মাইশাও কোনভাবে রাজি হচ্ছিল না। অবশেষে শাহীনের অসম্ভব জেদের মুখে পড়ে সবার অমতে অনেকটা দায়সারা ভাবেই বিয়েটা হয়ে যায় তাদের। বাসররাতে মাইশা মুখ ফুটে একটা কথাও বলেনি সারারাত শাহীনের বুকে মাথা রেখে পাগলের মতো কেঁদে পান্জাবী ভিজিয়েছে। শাহীন ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলো। মনে মনে ভাবছিলো জীবনে শেষবারের মতো আজ তোমার চোখের জল পড়তে দিচ্ছি।
বাসায় আজ অফিসে যাবার কথা বললে ও আজ শাহীনকে অনেক গুরুত্বপূর্ন একটা জায়গায় যেতে হবে। অনেক কিছুর ব্যবস্থা করতে হবে যে। শাহীন ভাবে নিজের হাতে আজ মাইশার চোখে সে কাজল দিয়ে দিবে। আজ কতোদিন হয়ে গেলো কাজলকালো চোখ জোড়া দেখা হয়না। ভালোবাসার কাজল দিয়ে আকাঁ সাজানো পৃথিবীটা মাইশা দেখতে পারবে তো? খুব বড় বোধহয় নয় ছোট্ট এক নৌকা ভর্তি কিছু সাদা বেগুনি কচুরিপানার ফুলের কি ক্ষমতা হবে মাইশা দু'চোখে সেই সাজানো স্বপ্নীল অতীত ফিরিয়ে দিতে? সামান্য কিছু জলে ভাসা ফুলের কি সাধ্য আছে একটিবার সেই হারানো উচ্ছ্বলতা ফিরিয়ে দেবার? আজ প্রয়োজনে শুধু পানি নয় বরং কাদামাটি মেখে ভুত সেজে এসে দাঁড়াবে শাহীন। হয়তো মাইশা দেখবেনা তবু যদি ভুল করেও বুঝতে পারে একটিবার। আর সেই আগের মতো হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়বে তো তার গায়ের উপর? পড়ন্ত বিকেলের ডুবন্ত সূর্যের আলো গায়ে মেখে আর একটিবার কি মাইশার হাতের ছোঁয়া পেয়ে হেসে উঠবে নৌকাভরা কচুরিপানার সাদা বেগুনি ফুলগুলো?
নাহ শাহীন আর কিছু ভাবতে পারছেনা। আজ কি হবে সে জানে না। তবু ও আজ তার অনেক কাজ। ইস একদম মনে পড়ছে না. . . . . . .
কি যেন কথাগুলো. . . . . . . . . . . . . . . . . . .আজ তাকে যে বলতেই হবে. . . . . . . . . . . . . . ."হয়তো তোমারই জন্য. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .না না শুধুই তোমার জন্য. . . . . . . . . . .
(কিছু কথাঃ আমার খুব কাছের আত্নীয় লাকি আন্টি এবং মিজান আংকেল, তাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় ১৫ বছর হতে চলেছে। তাদের ঘর আলো করে আছে তাদের ১০বছরের একমাত্র ছেলে। কিন্তু গতপ্রায় ১২ বছর যাবত অপটিক নার্ভ শুকিয়ে যাবার কারনে ধীরে ধীরে একটু একটু করে চির অন্ধত্ব মেনে নিতে হয়েছে আমার আন্টিকে। কিন্তু আংকেল যেভাবে এতোগুলো বছর আন্টিকে সাপোর্ট দিয়ে গেছে, তাদের ভালোবাসা দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ। তাদের সেই ভালোবাসার একমাত্র অবলম্বন আমার পিচ্চি আর লক্ষী ভাইটির জন্য এই গল্পটি। যারা এই গল্পটি ধৈর্য নিয়ে পড়েছেন তারা শুধু আমার আংকেল আন্টির জন্য একটু দোয়া করবেন)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন