by ফরহাদ আহমদ নিলয়
লিপিকে ওর মা বাবার কাছে দিয়ে ইমরান নিজের বাড়িতে ফিরে যায় । লিপির আব্বা তো মহা ক্ষেপা ! মেয়েকে কিছুতেই ফিরিয়ে নেবেন না । এমন মেয়ে থাকার চেয়ে না থাকাই ভাল !
তবে বাড়ির বাকি মুরুব্বিরা তাকে বুঝিয়ে শান্ত করলেন । মেয়েকে থাকতে দিতে রাজি হলেন ঠিকই তবে সাথে ছোট একটি শর্ত জুড়ে দিলেন । বাড়িতে থাকতে হলে লিপিকে কাজ করে খেতে হবে । অর্থাত্ ঘরের মেয়ের মত সে আর থাকতে পারবে না, থাকতে হবে কাজের মেয়ের মত ।
লিপি হাসিমুখেই সব মেনে নিল । উল্লেখ্য, লিপি তখন পাঁচ মাসের প্রেগনেন্ট !
এদিকে ইমরানেরও একই অবস্থা । বাপে পারলে তো তখনই ত্যাজ্য করে দেয় ! তবে চাচার বুঝিয়ে কোন রকমে তাকে ঠান্ডা করলেন । তবে এমন ছেলেকে তিনি কোনদিনও ক্ষমা করবেন না । শুধু করুণা করে এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত বাসায় থাকতে দিয়েছেন । এরপর তার নিজের রাস্তা নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে ।
ইমরান হাঁফ ছাড়ল । অন্তত পরীক্ষা পর্যন্ত তো নিশ্চিত । তবে সমস্যা এরপরও পিছু ছাড়ল না । ইমরানদের ঘটনাটা পুরো উপজেলায় প্রচার হয়ে গিয়েছিল, যার কারণে স্কুলের রেপুটেশান যথেষ্ট খারাপ হয় । হেডস্যার ইমরান-লিপি দুজনকেই স্কুলে অবান্ঞ্চিত ঘোষণা করলেন । ইমরানের পরীক্ষা দেয়া সংশয়ে পড়ে যায় ।
আমরা, স্কুলের বাকি শিক্ষকরা, এলাকার চেয়ারম্যান সহ বেশ কয়েকজন হেড স্যারকে অনুরোধ করলাম, তাকে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ দেয়ার জন্য । সে না হয় একটা ভুল করেছে, কিন্তু এর জন্য তার জীবনটা যাতে নষ্ট না করে দেয়া হয় । অবশেষে পরিচালনা পর্ষদের বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে তাকে শুধু এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেয়া হয় । কিন্তু স্কুল বাউন্ডারিতে তার প্রবেশ আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় ।
ইমরান শাস্তিটা হাসিমুখেই মেনে নেয় । পরীক্ষা দিতে পারছে এজন্যই সে খুশী ! ইমরান আমাদের কাছে তখন রীতিমত হিরো ! এই বয়সেই তার একটা বউ আছে ! একদম সত্যিকারের বউ ! অথচ আমরা ঠিকমত একটা প্রেমও করতে পারি নি ! ইমরানের কাছ থেকে আমরা তার অভিসারের গল্প শুনি, তার অভিজ্ঞতার গল্প শুনি । কিভাবে সে ওয়ার্ড কমিশনারকে টাকা খাইয়ে বয়স বাড়িয়ে ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সনদ বানালো, কিভাবে বিয়ে করে কাবিন রেজেস্ট্রি করল, কিভাবে পালিয়ে রাঙামাটি গেল, সেখানে ভাই-বেরাদার বানিয়ে ছয় মাস থাকলো.... সেসব গল্প, হাজারো গল্প । পরীক্ষা শেষ, হাতে প্রায় দুই মাসের মত ছুটি পাওয়া গেল । আমরা যখন ছুটি কিভাবে কাটাবো, কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবো, কিসের কিসের কোর্স করব এইসব প্লান করছি, ইমরান তখন বাকি জীবনটা কিভাবে কাটাবে তার কঠিন হিসাব কষায় ব্যস্ত । দেখতে দেখতে সময় কেটে গেল । পরীক্ষার রেজাল্ট বের হল । আমরা খুশী, ইমরানও খুশী । আমাদের খুশির কারণ একটি, তবে ইমরানের খুশীর কারণ দুটি ! আমরা খুশী কারণ পরীক্ষা এ+ পেয়েছি । ইমরান খুশী কারণ সে পরীক্ষায় পাস করেছে এবং একই সাথে মেয়ের বাবা হয়েছে !!!
উন্নত শিক্ষার নাম করে গ্রাম ছাড়লাম, শহরের কলেজে এসে ভর্তি হলাম । এখানে নতুন নতুন বন্ধু জোটালাম । ইমরানের কোন খবর রাখিনি । প্রয়োজনবোধও করিনি । এভাবেই কেটে গেছে প্রায় তিন বছর । শহরে পড়তে এসে যে অনেক কিছু করে ফেলেছি এটা ভাবা ভুল হবে । আসলে কিছুই করতে পারি নি । কোন পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পাইনি । একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ই.ই.ই পড়ছি, বাপের কষ্টে উপার্জনের টাকা জলে ফেলছি ! এরই মাঝে একদিন ইমরানের সঙ্গে দেখা । মেয়েকে কাঁধে নিয়ে বাজার করে বাড়ি ফিরছে । তিন বছরের একটি মেয়ে আছে ওর !! কি অদ্ভুত !
আমাকে দেখেই পুরানো বন্ধুর মতই বুকে টেনে নিল । জোর করে ধরে বাসায় নিয়ে গেল । লিপিকে দেখলাম, প্রায় চার বছর পর । সেদিন পরীক্ষার হল থেকে বেরুনোর পর তার সাথে আর দেখা হয় নি ।
একটা মানুষ চার বছরে কতটা পরিবর্তন হতে পারে লিপিকে না দেখলে সেটা কখনোই বুঝতাম না । আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়েছে । সবচেয়ে বড় ব্যাপার মেয়েকে থেকে সে একজন নারী হয়েছে, পরিপূর্ণ নারী !
কথা বলতে বলতে কে এখন কোথায় আছি এসব ব্যাপারও চলে এল । নিজের সম্পর্কে জানালাম, ওদের সম্পর্কেও জানলাম । শুনতে শুনতে চোখ কপালে উঠে গেল !
কবিরহাট সরকারি কলেজে ইমরান এখন ইংরেজীতে অনার্স করছে । পাশাপাশি একটা কিন্ডারগার্টেনে চাকরি করে । সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাঁচ ব্যাচ স্টুডেন্ট পড়ায় । ইংলিশ এবং ম্যাথ, ক্লাস সিক্স টু টেন পর্যন্ত । বাজারে একটা ফার্মেসীও খুলে বসেছে । সন্ধ্যার পর সেখানে বসে । এদিকে লিপি পরের বছর উন্মুক্ত থেকে এসএসসি পাশ করে । সে এখন একটি প্রাইভেট পলিটেকনিকে কম্পিউটার ইন্জ্ঞিনিয়ারিং এ ডিপ্লোমা করছে । সব শুনে হিংসায় চোখ ছোট হয়ে এল । আমাদের সাথেরই ছেলে, অল্প বয়সে পালিয়ে বিয়ে করায় আমরা সবাই ভেবেছিলাম তার লাইফ বুঝি এখানেই শেষ, সেই ছেলেরই এখন মাসিক ইনকাম আপ টু ত্রিশ হাজার ! আর আমাদের এখনো মাস শেষে আব্বার কাছেই হাত পাততে হয় ।
তবে হিংসা করতে পারলাম না । এরপর যে কিছু কঠিন সত্যেরও মুখোমুখি হতে হল !
আমরা সবাই এলাকা ছাড়লেও সে লোকাল কলেজেই ভর্তি হয় । বাপ তাকে বাড়ি ছাড়া করে । বউ আর দুই মাসের বাচ্চা নিয়ে খালি হাতে ঘর থেকে বের হয়ে আসে । মাসে চারশো টাকা ভাড়ার একটা ঘরে উঠে । ভাড়ার এমাউন্ট শুনেই বোঝা যায় ঘরটা কেমন হতে পারে ! ছয় মাস রাজমিস্ত্রির হেল্পারের কাজ করে । দশটা ইট মাথায় নিয়ে ছয় তলার উপর উঠতে হত । কোন রেলিং ছিলনা সিঁড়িতে । একটু এদিকে সেদিক হলেই আর দেখতে হত না ।
পুরো দিন মাথায় করে ইট টানত বলে রাতে প্রচন্ড মাথাব্যথায় ছটফট করত । বেশীর ভাগ সময়ই ঘরে খাওয়ার কিছু থাকত না । মেয়েটা মায়ের বুকের দুধ পেত না । সারাদিন কাঁদত । মা-মেয়ে দুজনেই শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় । সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে রাতভর কাঁদত । দুহাত তুলে স্রষ্টার কাছে সাহায্য চাইত তার মেয়েটার জন্য । স্রষ্টা তাকে নারাজ করেনি । অবশেষে একদিন মুখ তুলে চাইলেন । লিপির এক মামা, ভাগ্নীর এই দুরাবস্থার কথা জানতে পেরে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন । তিনি তাদের শেল্টার দিলেন । ইমরানকে কিন্ডারগার্টেনের চাকরিটার ব্যবস্থা করে দিলেন । লিপিকে একটা সেলাই মেশিন কিনে দিলেন । ধীরে ধীরে তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যেতে লাগল । দুঃসময় কে পিছনে ফেলে অবশেষে সুখের দেখা পেল, যে সুখের জন্য দুজনেই ঘর ছেড়েছিল ।
ইমরান আর লিপিকে যতই দেখি আমি ততই অবাক হই । তারা কি ছিল, কি করেছিল এটা মোটেও বড় ব্যাপার নয় । তারা এখন কি সেটাই মূখ্য বিষয় । ইমরান একজন দায়িত্ববান স্বামী, একজন আদর্শ বাবা । লিপি একজন দায়িত্বশীল স্ত্রী, একজন আদর্শ মা । ঘর আলো করে তাদের ফুটফুটে এক মেয়ে- আর কি লাগে জীবনে ? প্রাণ খুলে দোয়া করি তাদের জন্য । যে দুঃসহ অতীতকে তারা পিছনে ফেলে এসেছে তা যেন কখনো তাদের আর তাড়া না করে । তাদের ভবিষ্যত দিনগুলো যেন অনাবিল প্রশান্তিতে ভরে উঠে ।
(সমাপ্ত)
অপটপিক ১: সত্য ঘটনা অবলম্বনে গল্পটি রচিত । কবিরহাট সরকারী কলেজে সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের (ইংরেজি সাহিত্য) ছাত্র ইমরান । চাইলেই কেউ তার খোঁজ করে জীবন সংগ্রামের সাহসী এই যোদ্ধাকে একটি স্যালুট দিয়ে আসতে পারেন ।
অফটপিক ২: ইমরানের সাথে আমার সরাসরি কখনো দেখা হয় নি । তবে তার কতা এত্ত বেশী শুনেছি যে তাকে আর অচেনা মনেই হয় না । আমার খুব ইচ্ছা তার সঙ্গে একবার সরাসরি দেখা করবো ।
অফটপিক ৩: ইমরানের কাহিনী থেকে আমরা কয়েকটি শিক্ষা নিতে পারিঃ
১,কথা দিলে কথা রাখতে হয় ।
২, কখনো সাহস হারাতে নেই ।
৩, ভাগ্য সবসময় সাহসীদেরই ফেবার করে ।
৪, লক্ষে অটুট থাকলে বিজয় সুনিশ্চিত ।
৫, লাইফের সকল সিদ্ধান্তই খুব ভেবে চিন্তে নিতে হয় ।
৬, একবার কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে সেটা ভুল হোক শুদ্ধ হোক সেটা নিয়ে আফসোস করার কোন মানে হয় না । সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরে সাহসের সাথে মোকাবেলা করে যেতে হয় ।
অপটপিক ৪: সব কথার মূল কথা হচ্ছে ইমরান-লিপির এই কাজটিকে আমি কখনো সাপোর্ট করি নি । তারা এখন যে অবস্থানে আছে অনেক ভাল আছে । কিন্তু এমনটাতো নাও হতে পারত । দুটো জীবন খুব সহজেই নষ্ট হতে পারত । সবাই তো আর ইমরান না । শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার সাহস সবার থাকে না । মাঝপথে খেই হারিয়ে ফেলা মানেই অতলে তলিয়ে যাওয়া । জীবনটা তো আর ছেলেখেলা নয়
লিপিকে ওর মা বাবার কাছে দিয়ে ইমরান নিজের বাড়িতে ফিরে যায় । লিপির আব্বা তো মহা ক্ষেপা ! মেয়েকে কিছুতেই ফিরিয়ে নেবেন না । এমন মেয়ে থাকার চেয়ে না থাকাই ভাল !
তবে বাড়ির বাকি মুরুব্বিরা তাকে বুঝিয়ে শান্ত করলেন । মেয়েকে থাকতে দিতে রাজি হলেন ঠিকই তবে সাথে ছোট একটি শর্ত জুড়ে দিলেন । বাড়িতে থাকতে হলে লিপিকে কাজ করে খেতে হবে । অর্থাত্ ঘরের মেয়ের মত সে আর থাকতে পারবে না, থাকতে হবে কাজের মেয়ের মত ।
লিপি হাসিমুখেই সব মেনে নিল । উল্লেখ্য, লিপি তখন পাঁচ মাসের প্রেগনেন্ট !
এদিকে ইমরানেরও একই অবস্থা । বাপে পারলে তো তখনই ত্যাজ্য করে দেয় ! তবে চাচার বুঝিয়ে কোন রকমে তাকে ঠান্ডা করলেন । তবে এমন ছেলেকে তিনি কোনদিনও ক্ষমা করবেন না । শুধু করুণা করে এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত বাসায় থাকতে দিয়েছেন । এরপর তার নিজের রাস্তা নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে ।
ইমরান হাঁফ ছাড়ল । অন্তত পরীক্ষা পর্যন্ত তো নিশ্চিত । তবে সমস্যা এরপরও পিছু ছাড়ল না । ইমরানদের ঘটনাটা পুরো উপজেলায় প্রচার হয়ে গিয়েছিল, যার কারণে স্কুলের রেপুটেশান যথেষ্ট খারাপ হয় । হেডস্যার ইমরান-লিপি দুজনকেই স্কুলে অবান্ঞ্চিত ঘোষণা করলেন । ইমরানের পরীক্ষা দেয়া সংশয়ে পড়ে যায় ।
আমরা, স্কুলের বাকি শিক্ষকরা, এলাকার চেয়ারম্যান সহ বেশ কয়েকজন হেড স্যারকে অনুরোধ করলাম, তাকে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ দেয়ার জন্য । সে না হয় একটা ভুল করেছে, কিন্তু এর জন্য তার জীবনটা যাতে নষ্ট না করে দেয়া হয় । অবশেষে পরিচালনা পর্ষদের বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে তাকে শুধু এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেয়া হয় । কিন্তু স্কুল বাউন্ডারিতে তার প্রবেশ আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় ।
ইমরান শাস্তিটা হাসিমুখেই মেনে নেয় । পরীক্ষা দিতে পারছে এজন্যই সে খুশী ! ইমরান আমাদের কাছে তখন রীতিমত হিরো ! এই বয়সেই তার একটা বউ আছে ! একদম সত্যিকারের বউ ! অথচ আমরা ঠিকমত একটা প্রেমও করতে পারি নি ! ইমরানের কাছ থেকে আমরা তার অভিসারের গল্প শুনি, তার অভিজ্ঞতার গল্প শুনি । কিভাবে সে ওয়ার্ড কমিশনারকে টাকা খাইয়ে বয়স বাড়িয়ে ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সনদ বানালো, কিভাবে বিয়ে করে কাবিন রেজেস্ট্রি করল, কিভাবে পালিয়ে রাঙামাটি গেল, সেখানে ভাই-বেরাদার বানিয়ে ছয় মাস থাকলো.... সেসব গল্প, হাজারো গল্প । পরীক্ষা শেষ, হাতে প্রায় দুই মাসের মত ছুটি পাওয়া গেল । আমরা যখন ছুটি কিভাবে কাটাবো, কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবো, কিসের কিসের কোর্স করব এইসব প্লান করছি, ইমরান তখন বাকি জীবনটা কিভাবে কাটাবে তার কঠিন হিসাব কষায় ব্যস্ত । দেখতে দেখতে সময় কেটে গেল । পরীক্ষার রেজাল্ট বের হল । আমরা খুশী, ইমরানও খুশী । আমাদের খুশির কারণ একটি, তবে ইমরানের খুশীর কারণ দুটি ! আমরা খুশী কারণ পরীক্ষা এ+ পেয়েছি । ইমরান খুশী কারণ সে পরীক্ষায় পাস করেছে এবং একই সাথে মেয়ের বাবা হয়েছে !!!
উন্নত শিক্ষার নাম করে গ্রাম ছাড়লাম, শহরের কলেজে এসে ভর্তি হলাম । এখানে নতুন নতুন বন্ধু জোটালাম । ইমরানের কোন খবর রাখিনি । প্রয়োজনবোধও করিনি । এভাবেই কেটে গেছে প্রায় তিন বছর । শহরে পড়তে এসে যে অনেক কিছু করে ফেলেছি এটা ভাবা ভুল হবে । আসলে কিছুই করতে পারি নি । কোন পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পাইনি । একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ই.ই.ই পড়ছি, বাপের কষ্টে উপার্জনের টাকা জলে ফেলছি ! এরই মাঝে একদিন ইমরানের সঙ্গে দেখা । মেয়েকে কাঁধে নিয়ে বাজার করে বাড়ি ফিরছে । তিন বছরের একটি মেয়ে আছে ওর !! কি অদ্ভুত !
আমাকে দেখেই পুরানো বন্ধুর মতই বুকে টেনে নিল । জোর করে ধরে বাসায় নিয়ে গেল । লিপিকে দেখলাম, প্রায় চার বছর পর । সেদিন পরীক্ষার হল থেকে বেরুনোর পর তার সাথে আর দেখা হয় নি ।
একটা মানুষ চার বছরে কতটা পরিবর্তন হতে পারে লিপিকে না দেখলে সেটা কখনোই বুঝতাম না । আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়েছে । সবচেয়ে বড় ব্যাপার মেয়েকে থেকে সে একজন নারী হয়েছে, পরিপূর্ণ নারী !
কথা বলতে বলতে কে এখন কোথায় আছি এসব ব্যাপারও চলে এল । নিজের সম্পর্কে জানালাম, ওদের সম্পর্কেও জানলাম । শুনতে শুনতে চোখ কপালে উঠে গেল !
কবিরহাট সরকারি কলেজে ইমরান এখন ইংরেজীতে অনার্স করছে । পাশাপাশি একটা কিন্ডারগার্টেনে চাকরি করে । সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাঁচ ব্যাচ স্টুডেন্ট পড়ায় । ইংলিশ এবং ম্যাথ, ক্লাস সিক্স টু টেন পর্যন্ত । বাজারে একটা ফার্মেসীও খুলে বসেছে । সন্ধ্যার পর সেখানে বসে । এদিকে লিপি পরের বছর উন্মুক্ত থেকে এসএসসি পাশ করে । সে এখন একটি প্রাইভেট পলিটেকনিকে কম্পিউটার ইন্জ্ঞিনিয়ারিং এ ডিপ্লোমা করছে । সব শুনে হিংসায় চোখ ছোট হয়ে এল । আমাদের সাথেরই ছেলে, অল্প বয়সে পালিয়ে বিয়ে করায় আমরা সবাই ভেবেছিলাম তার লাইফ বুঝি এখানেই শেষ, সেই ছেলেরই এখন মাসিক ইনকাম আপ টু ত্রিশ হাজার ! আর আমাদের এখনো মাস শেষে আব্বার কাছেই হাত পাততে হয় ।
তবে হিংসা করতে পারলাম না । এরপর যে কিছু কঠিন সত্যেরও মুখোমুখি হতে হল !
আমরা সবাই এলাকা ছাড়লেও সে লোকাল কলেজেই ভর্তি হয় । বাপ তাকে বাড়ি ছাড়া করে । বউ আর দুই মাসের বাচ্চা নিয়ে খালি হাতে ঘর থেকে বের হয়ে আসে । মাসে চারশো টাকা ভাড়ার একটা ঘরে উঠে । ভাড়ার এমাউন্ট শুনেই বোঝা যায় ঘরটা কেমন হতে পারে ! ছয় মাস রাজমিস্ত্রির হেল্পারের কাজ করে । দশটা ইট মাথায় নিয়ে ছয় তলার উপর উঠতে হত । কোন রেলিং ছিলনা সিঁড়িতে । একটু এদিকে সেদিক হলেই আর দেখতে হত না ।
পুরো দিন মাথায় করে ইট টানত বলে রাতে প্রচন্ড মাথাব্যথায় ছটফট করত । বেশীর ভাগ সময়ই ঘরে খাওয়ার কিছু থাকত না । মেয়েটা মায়ের বুকের দুধ পেত না । সারাদিন কাঁদত । মা-মেয়ে দুজনেই শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় । সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে রাতভর কাঁদত । দুহাত তুলে স্রষ্টার কাছে সাহায্য চাইত তার মেয়েটার জন্য । স্রষ্টা তাকে নারাজ করেনি । অবশেষে একদিন মুখ তুলে চাইলেন । লিপির এক মামা, ভাগ্নীর এই দুরাবস্থার কথা জানতে পেরে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন । তিনি তাদের শেল্টার দিলেন । ইমরানকে কিন্ডারগার্টেনের চাকরিটার ব্যবস্থা করে দিলেন । লিপিকে একটা সেলাই মেশিন কিনে দিলেন । ধীরে ধীরে তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যেতে লাগল । দুঃসময় কে পিছনে ফেলে অবশেষে সুখের দেখা পেল, যে সুখের জন্য দুজনেই ঘর ছেড়েছিল ।
ইমরান আর লিপিকে যতই দেখি আমি ততই অবাক হই । তারা কি ছিল, কি করেছিল এটা মোটেও বড় ব্যাপার নয় । তারা এখন কি সেটাই মূখ্য বিষয় । ইমরান একজন দায়িত্ববান স্বামী, একজন আদর্শ বাবা । লিপি একজন দায়িত্বশীল স্ত্রী, একজন আদর্শ মা । ঘর আলো করে তাদের ফুটফুটে এক মেয়ে- আর কি লাগে জীবনে ? প্রাণ খুলে দোয়া করি তাদের জন্য । যে দুঃসহ অতীতকে তারা পিছনে ফেলে এসেছে তা যেন কখনো তাদের আর তাড়া না করে । তাদের ভবিষ্যত দিনগুলো যেন অনাবিল প্রশান্তিতে ভরে উঠে ।
(সমাপ্ত)
অপটপিক ১: সত্য ঘটনা অবলম্বনে গল্পটি রচিত । কবিরহাট সরকারী কলেজে সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের (ইংরেজি সাহিত্য) ছাত্র ইমরান । চাইলেই কেউ তার খোঁজ করে জীবন সংগ্রামের সাহসী এই যোদ্ধাকে একটি স্যালুট দিয়ে আসতে পারেন ।
অফটপিক ২: ইমরানের সাথে আমার সরাসরি কখনো দেখা হয় নি । তবে তার কতা এত্ত বেশী শুনেছি যে তাকে আর অচেনা মনেই হয় না । আমার খুব ইচ্ছা তার সঙ্গে একবার সরাসরি দেখা করবো ।
অফটপিক ৩: ইমরানের কাহিনী থেকে আমরা কয়েকটি শিক্ষা নিতে পারিঃ
১,কথা দিলে কথা রাখতে হয় ।
২, কখনো সাহস হারাতে নেই ।
৩, ভাগ্য সবসময় সাহসীদেরই ফেবার করে ।
৪, লক্ষে অটুট থাকলে বিজয় সুনিশ্চিত ।
৫, লাইফের সকল সিদ্ধান্তই খুব ভেবে চিন্তে নিতে হয় ।
৬, একবার কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে সেটা ভুল হোক শুদ্ধ হোক সেটা নিয়ে আফসোস করার কোন মানে হয় না । সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরে সাহসের সাথে মোকাবেলা করে যেতে হয় ।
অপটপিক ৪: সব কথার মূল কথা হচ্ছে ইমরান-লিপির এই কাজটিকে আমি কখনো সাপোর্ট করি নি । তারা এখন যে অবস্থানে আছে অনেক ভাল আছে । কিন্তু এমনটাতো নাও হতে পারত । দুটো জীবন খুব সহজেই নষ্ট হতে পারত । সবাই তো আর ইমরান না । শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার সাহস সবার থাকে না । মাঝপথে খেই হারিয়ে ফেলা মানেই অতলে তলিয়ে যাওয়া । জীবনটা তো আর ছেলেখেলা নয়
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন