valobasar golpoবুকের বামপাশে একটা চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে।তার সাথে শুরু হয়েছে প্রচণ্ড মাথাব্যথা।প্রচণ্ড অভিমানও হচ্ছে।মনে হচ্ছে অভিমানগুলো জমা আছে বলেই চিনচিনে ব্যথাটা হচ্ছে।মন খুলে কাঁদলে সেই অভিমানগুলোও বুক থেকে বেরিয়ে যেতো,সাথে কমে যেতো ব্যথাও।প্রিয় মানুষটাকে হারানোর কষ্টটা বুঝি এমনি হয়।আমার এই প্রিয়মানুষটার নাম বীথি।জ্ঞান হবার পর থেকে এই একটা মেয়েকেই চিনে এসেছি।ওই ছিল আমার বন্ধু,শত্রু,অভিভাবক সব।এতদিনের সম্পর্কটা সামান্য কয়েকটা কথার জন্য এভাবে ভঙ্গুর হয়ে গেল।এই বীথিই যে আমাকে প্রপোজ করে বসবে তা আমি ঘুনাক্ষরেও ভাবিনি।কোনকালেই ওকে এই চোখে দেখিনি।ওর মুখে এই কথাটা শুনে বুকটা যেমন কষ্টে ফেটে যাচ্ছিল,তেমনি ওর প্রতি রাগও হচ্ছিল।যে বন্ধুত্বে প্রেম প্রবেশ করে সেটা হয় পরিপূর্ণ প্রেম হয়ে যায়,নয়তো সেটা বন্ধুত্বটাকেই ধ্বংস করে দেয়।আমার ক্ষেত্রে বন্ধুত্বটাকেই গলা টিপে হত্যা করেছে।সমবয়স্ক কাউকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে কল্পনাও করতে পারি না।এইসব কিছুই বীথি ভাল করেই জানতো।আর এজন্যই ওর প্রতি খুব রাগ আর অভিমান হচ্ছিল।তারপরও ভেবেছিলাম সব ভুলে আবার আগের মতো করে নেব।কিন্তু শত চেষ্টাতেও আগের মত হল না।কোথায় যেন সম্পর্কের সুরটা কেটে গেছে।

বীথির সাথে এভাবে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আমি প্রচণ্ড একা হয়ে গেলাম।আমার আসলে তেমন কোন বন্ধুও ছিল না।কেমন যেন বাধনহাঁরা হয়ে গেলাম।পরীক্ষার রেজাল্টও খারাপ হতে লাগলো,পাশাপাশি হতাশা আমাকে প্রচণ্ড ভাবে ঘিরে ধরল।বীথির সাথে ক্লাসে দেখা হলে খুব মায়া বোধ করতাম,মনে হতো ওর ইচ্ছাটা পূর্ণ করে দেই।নিজেকে হাজারবার বোঝানোর পরও বীথিকে ওইভাবে কল্পনা করতে পারছিলাম না।সেই থেকে ঠিক করলাম কোন সমবয়স্ক মেয়ের সাথেই বন্ধুত্ব করবোনা।সময় কাটানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে গেলাম ভার্চুয়াল জগতে।

তখনো ফেসবুকের প্রচলন তেমন হয়নি,চারিদিকে শুধু মিগের জয়জয়কার।সেখানে রুমি খান নামে একজনের সাথে পরিচয় হল।কেন জানিনা অল্পকিছুদিনের মাঝেই তার সাথে খুব চমৎকার একটা সম্পর্ক হয়ে গেল।ছেলেটা আমার সমবয়সী আর খুব বন্ধুবৎসল টাইপের।বন্ধু দিবসের দিন ওর সাথে ফোনে প্রথম কথা হল।ওইদিন আমি যেন কারেন্টের শক খেলাম।সেদিন আমার অতিপরিচিত ছেলে ‘রুমি’ মেয়ে হয়ে গেল।আমি এতোটাই অবাক হলাম যে কথাই বলতে পারছিলাম না।ভুলটা আসলে হয়েছিল আমারই।রুমি নামের যে মেয়ে হতে পারে সেটা আমার ধারনাই ছিল।তাছাড়া আমি যে ‘সমবয়সী নারীবিদ্বেষী’ হয়ে পরেছি তা আমার চ্যাট থেকেই রুমি বুঝে নিয়েছে।এজন্যই রুমি ইচ্ছে করে ওটা ক্লিয়ার করেনি।শুধু আমার ‘কাণ্ডকারখানা’ দেখে মজা নিয়ে গেছে।যেটাই হোক না চাইতেও আমার জীবনে বীথির মত আরেকজন মেয়েবন্ধুর আগমন হল।ওর সাথে যে এতদিনে পরিমান ঘনিষ্ঠতা হয়েছে তাতে অবশ্য ফিরে আসবারও উপায় ছিল না।তবুও বীথির স্মৃতি মাথায় রেখেই রুমির সাথে মিশতে লাগলাম।

মানুষকে আপন করে নেবার অদ্ভুত একটা ক্ষমতা আছে রুমির।অতি অল্প সময়েই আমার আপন কেউ হয়ে গেল।আমার পড়াশুনা থেকে শুরু করে প্রাত্যহিক অনেক সিদ্ধান্তেই ও আমাকে সাহায্য করতো।আমার প্রতি ওর take care এর বর্ণনা দিলে সত্যি সত্যিই মনে হবে সে আমায় ভালবাসে।অন্তত আমার বন্ধুরা তাই ভাবতো।কিন্তু ও এমন ভাবে take care করতো,তাতে আমার কখনই মনে হয়নি যে সে আমাকে ওইভাবে চিন্তা করে।যেমনটা সকাল ঘুম উঠতে দেরি হলেই এমন একটা ‘সুন্দর’ বাংলা গালি দিবে যে ঘুম থেকে না উঠে পারা যায় না।আর ওর হাতে যে প্রতিদিন কতো খামচি খেতে হয় তারতো ইয়ত্তা নেই।ও ছিল কখনো মা,কখনো বড় বোন আর কখনোবা আমার বন্ধু হিসেবে।রুমির জন্যই বীথির স্মৃতি আমার মাথা থেকে মুছে যেতে বেশি সময় লাগলো না।বরং অনেকক্ষেত্রেই বীথিকে ছাপিয়ে গিয়েছিলো রুমি।বীথির কারনে আমার মনে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল সেটা রুমি অল্পদিনেই কাটিয়ে দিয়েছিল।ওর কাছে এমন কিছু ছিল না আমি শেয়ার করতাম না।এমনকি ছেলেদের ‘স্পেশাল’ ব্যাপারগুলাও বাদ যেত না।রাস্তায় কোন মেয়ে দেখলে আমরা ছেলেরা যেভাবে আলাপ করি ওর সাথেও সেভাবে করতাম।রুমিকে প্রায়ই বলতাম কলেজের জুনিয়র মেয়েদের কারো সাথে প্রেম করবো।কিন্তু কোন মেয়ে ভাল লাগলেও সেই ভালোলাগাটা বেশীদিন থিতু হত না।এজন্য রুমিকে কোন মেয়ের ব্যাপারে বললেই হেসে বলতো তোর দ্বারা আর যাই হোক প্রেম হবে না।

এভাবেই তাইরে নাইরে করে ভালয় ভালয় ভার্সিটি লাইফের ৩ টা বছর পার করে দিলাম।অবশেষে আমার জীবনে প্রেম এলো।নতুন বর্ষে কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হওয়া দিয়াকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম প্রেম কি জিনিস।টলটলে চোখ আর হালকা টোল পরা কাচা হলুদ বর্ণের মেয়েটায় আমার সমস্ত পৃথিবী কেন্দ্রিভুত হয়ে গেল।আগে কোন সুন্দরী মেয়ে দেখলেই রুমিকে বলতাম ভাল লাগার কথা।কিন্তু দিয়ার কথাটা অন্য কেউতো নয়ই, রুমিকেও বলতে পারলাম না।দিয়াকে প্রপোজ করবো সেই সাহসটাও সঞ্চয় করতে পারলাম না।পুরো কলেজ জুড়ে যে আমি সবাইকে জ্ঞান দিয়ে বেড়াতাম প্রেম না করার জন্য,সেই আমিই যদি প্রেম করি তবে আর রক্ষা নেই। তাছাড়া দিয়া যদি আমাকে ফিরিয়ে দেয়,তবে এই মুখ নিয়ে ভার্সিটিতে থাকতে পারব না।নিজের ভালোলাগা প্রকাশ না করতে পেরে কেমন যেন কুঁকড়ে গেলাম।ক্লাসে অনিয়মিত হয়ে গেলাম আর রুমিকেও এড়িয়ে চলতে লাগলাম।এইভাবে প্রায় ৩ মাস পার হয়ে গেল।ডুবে যাওয়া মানুষের মত খড়কুটো আঁকড়ে ধরতে চাইলাম।রুমিকে বললাম দিয়ার নাম্বার জোগাড় করে দিতে।কপালে যা আছে ভেবে দিয়াকে ফোন দিয়েই বসলাম।প্রথম দিন কথা বলেই চমকে গেলাম।দিয়া বোধহয় এতদিন আমার ফোনেরই অপেক্ষা করছিল।মাত্র ৭দিন কথা বলতেই দিয়া আমাকে হ্যাঁ বলে দিল।আমি যেন স্বর্গ হাতে পেয়ে গেলাম।প্রিয় মানুষকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দের মাঝেও কেমন যেন একটা অস্বস্তি কাজ করছিল।দিয়ার এতো সহজে মেনে নেয়াটা আমি কেন যেন মেলাতে পারলাম না।সেই রহস্য ভেদ করলো দিয়াই।আমার হঠাৎ স্তব্দ হয়ে যাওয়াটা রুমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না।তাছাড়া আমিও কিছু বলছিলাম না।বাধ্য হয়েই চুরি করে আমার ডায়েরি থেকে দিয়ার কথা জানতে পারে।সেই থেকে ২টা মাস তার দায়িত্ব ছিল দিয়ার মাথায় আমার ভুত ঢুকিয়ে দেয়া।এবং এই কাজটা সে দক্ষতার সাথে করেছে।

রুমি এমনিতেই আমার সবচেয়ে বন্ধুদের একজন।এই ঘটনার পর ওর প্রতি আমার ভালোলাগাটা অসম্ভব রকম বেড়ে গেলো।দিয়াকে আরো কাছে টানতে যা যা করার সবই রুমি আমাকে শিখিয়ে দিল।মেয়েরা মেয়েদের মন ভাল বুঝে।তাই খুব অল্প সময়েই দিয়ার সঙ্গে আমার বোঝাপরাটা হয়ে গেল।দিয়ার সঙ্গে প্রেম হয়ে গেলেও রুমিকে নিঃসঙ্গ করার মতো অকৃতজ্ঞ হলাম না।আমার প্রেমটা যে রুমির জন্যই হয়েছে তা দিয়া ভাল করেই জানতো।তাই হয়তো প্রথমদিকে রুমির সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি দিয়া।কিন্তু দুর্ভাগ্যই বলতে হবে আমার।আর দশটা মেয়ের চেয়ে দিয়াও বেতিক্রম হতে পারল না।প্রথম দিক থেকেই দিয়া রুমির সাথে আমার সম্পর্কটা অবচেতনভাবেই ঘৃণা করে এসেছে।কিন্তু অল্পকিছুদিনের মধ্যেই সেটা সচেতন ঘৃণায় পরিনত হল।সেটা বুঝেই রুমিও আমাকে এড়িয়ে চলতে লাগলো।দিয়ার এই ব্যাপারটায় আমি খুব বেশি দুঃখ পেলাম,যদিও মুখে কিছুই বললাম না।কিন্তু ওই থেকেই কেন জানিনা দিয়ার সাথে ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা লেগেই থাকতো।এই ঝামেলার হাত ধরেই মাত্র ১১ মাসের মাথায় আমাদের সম্পর্কের ইতি ঘটলো।ওর প্রতি এতই বিরক্ত হয়ে পরেছিলাম যে সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ায় একটুও খারাপ লাগেনি।রুমি বোধহয় এই কারনে কিছুটা অপরাধবোধে ভুগত।এইজন্যই বরাবরের মতো এড়িয়ে চলতো।কিন্তু এরপর আমার জীবনে যা ঘটলো তা বোধহয় দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি।জানুয়ারির এক শীতের রাতে রুমির বাসা থেকে ফোন করে বলল,আমার আর রুমির সম্পর্কটা প্রেম কিনা জানতে চাইল।মাথায় বাজ পরলেও বোধহয় এতো অবাক হতাম না।কয়েকদিন পর রুমির মা ফোন করে অনেক কান্নাকাটি করলো।রুমি কিছুতেই বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না।আবার কাউকে পছন্দ করে কিনা সেটাও বলছে না।রুমির ভাইয়ের ধারনা আমাকে ভালবাসে বলেই ও বিয়েতে রাজি হচ্ছে না।জীবনে দ্বিতীয়বারের মত স্থবির হয়ে গেলাম।রুমি কি চাইছে তা আমার আর বুঝতে বাকি রইল না।দুঃখে মরে যেতে ইচ্ছে করলো।আমি ভাল করেই বুঝতে পারলাম আমি যদি ওর সাথে সম্পর্ক রাখি,তাহলে আর ওর বিয়ে করা হবে না।ওর কাছ থেকে সরে আসার জন্যই মিথ্যে ছুতো ধরে বিশাল ঝগড়া লাগিয়ে রুমির সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে দিলাম।আমার এরকম বদলে যাওয়া দেখে রুমি বোধহয় মারাত্মক অবাক হল।

অনেক কষ্ট হলেও রুমির সাথে যোগাযোগ করিনি।এই ঘটনার এক বছর পর পারিবারিক সম্মতিতে নুহার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়।ভেবেছিলাম কিন্তু রুমিকে বিয়ের দাওয়াত দিয়ে কাটা ঘায়ে আর নুনের ছিটা দেবো না।সম্পর্ক না রাখলেও রুমিকে আমি এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারিনি।তাই বিয়ের দাওয়াত না দিয়ে পারলাম না।সেইদিন অনেক দ্বিধা নিয়ে ভয়ে ভয়ে রুমিকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম কেন সে বিয়ে করছে না।উত্তর না দিয়ে রুমি কাঁদতে লাগলো।অনেক জোরাজুরির পর সে বলল ডাক্তার বলেছেন রুমির মা হবার সম্ভাবনা খুব কম।তিন বছর আগে হরমোন টেস্টে এটা ধরা পরেছে,যেটা এখনো রুমির পরিবারের কেউ জানেনা।সেদিন রুমির কান্না দেখে নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারলাম না।তীব্র অপরাধবোধ আমাকে ঘিরে ধরল।রুমিকে এতদিন আমি কতোটাই না ভুল বুঝেছি।আর ভুল বুঝে কতো পবিত্র একটা সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলেছি।

নুহার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে ১৭ মাস হয়ে গেলো।এঁর মধ্যে নুহা আমাকে একজন দেবদূত উপহার দিয়েছে।এর জন্য আমি ওর কাছে অনেক কৃতজ্ঞ।নুহার সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে সে সবকিছুকেই সহজভাবে নিতে পারে।আমার সাথে রুমির সম্পর্কটা খুব সহজভাবেই নিয়েছে।আজমিনের জন্মের সময় রুমিই ছিল সব।নিজেকে মাঝে মাঝে খুব ভাগ্যবান মনে হয়।নুহা না চাইলে আমার জীবনের সবচেয়ে সেরা বন্ধুটাকে হয়তো আর কাছে পাওয়া হতো না।নুহার তাগিদেই দেশে রুমির চিকিৎসার অনেক চেষ্টা করেছি।কিন্তু ভাগ্যদেবী এখনো সাড়া দেয়নি।এইবার আমি আর নুহা মিলে ঠিক করেছি রুমিকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে চিকিৎসা করাবো।ভাগ্যদেবীর সাথে এইবার আমার একটা সেইরকম বোঝাপড়া হবে।আমার পৃথিবীসেরা বন্ধুটার ভাগ্য নিয়ে আর ছিনিমিনি খেলতে দেবো না তাকে...
 
Top