কিছুদিন ধরেই মনটা কু ডাকছে, আমার ঘুমদেবী সম্ভবত কারো সাথে ভেগেছে। ঘুম আসেনা তো আসেই
valobasa diboser golpo
না। আর কেনই বা যাবে না। প্রতিরাতেই চোখদুটো জুড়ে থাকতে চাইত, কিন্তু প্রায়ই জোর করে বিদায় করতাম। ভোর সাড়ে পাঁচটা, ফ্ল্যাটে তালা ঝুলিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। উত্তরা ৩নম্বরের জসীমউদ্দিনের ওভারব্রীজের কাছে আসতেই দেখলাম কেউ একজন উপরে তাকিয়ে হাউকাউ করছে। উপরে তাকিয়ে দেখি একটা মেয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। কাধে ব্যাগ হাতে এপ্রন টাইপের কিছু। সম্পর্কে বাপ মেয়ে হবে হয়তো।

তবে মেয়েটা মেডিক্যাল ছাত্রী নাকি নার্স তা বোধগম্য হয়নি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লোকটার একাকী হাউকাউ শোনেই বুঝলাম কোন এক দুরূহ কারনে এই সাতসকালে দুজনেই ঘর থেকে বিতারিত। আমি সিগারেট নিয়ে পকেটে হাত দিয়েই মনে হল লাইটার নিয়ে বের হইনি। তাকিয়ে দেখি আঙ্কেল সিগারেট ধরাচ্ছেন। কোন কিছু না ভেবেই উনার কাছে আগুন চাইলাম, তখনি তিনি একটা অগ্নি চাহনি দিয়ে বললেন,
- তোমার সাহস তো কম না, তুমি একজন আর্মি পারসনের কাছে সিগারেট ধরাতে আগুন চাইছ! তুমি কি জান, আমি একজন কর্নেল।

- আঙ্কেল, আপনার গায়ে তো ইউনিফর্ম নেই, তাই বুঝিনি। আর আপনাকে দেখে তা মনে হয়নি।
- আসলে হয়েছে কি বারখুরদার, আমি দেখতে বরাবরের মতই ইয়াং। [মুখ ভর্তি মুলায়েম হাসি দিয়ে]
- ওহ, না মানে আমি ভেবেছিলাম আপনি রিটায়ার্ড করেছেন।
সাথে সাথেই আঙ্কেলের চিকেনশর্মা টাইপের Expressionটা অগ্নিশর্মা হয়ে গেল।ব্রিজে উঠলাম ঐপাড়ে দোকান খোলা থাকবে ভেবে। রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, গাড়ি তেমন একটা নেই। আর তাছাড়া সকালের হালকা শীত শীত আমেজ। সে এক অসাধারণ অনুভূতি।প্রায় প্রতিদিনই এখানে দাঁড়িয়ে আমি সকাল দেখতাম। তারপর Scholasticaর বাচ্চাদের দেখতাম। প্রত্যেককেই কেউ না কেউ দিয়ে যেতে আসে। দূর থেকেই দেখতাম।

কিছুক্ষণ পর নিচে নেমে একটা দোকান পেয়ে গেলাম। প্রায় আধাভাসমান দোকান। এর আগে দোকানটা দেখিনি। দোকানে একটা ছেলে বসা। শরীরের আকৃতিটা Square Shapeএর ছিল। দৈর্ঘ্যে যা, প্রস্থেও তাই। ঠিক তখনি দেখলাম ব্রিজের উপরে যাকে দেখেছিলাম, সেই মেয়েটি দোকান থেকে বের হয়ে গেল। দোকানের সামনে রাখা টুলটায় বসতেই ছেলেটি চা দিতে চাইল।
- আমি চা খাইনা। কফি হবে?
- না, তয় আমার চা খায়া দেহেন। অঝর আফা আমার চা না খাইয়া কেলাসেই [ক্লাসে] যায় না।
- তোর অঝর আপাটা আবার কে? কই ক্লাস করে?
- আরে আপনে দোকানে আসতেই যেই আফা বাইর হইল। ঐটাই অঝর আফা। ডাক্তারি পড়ে।
- বুঝলাম, তোর চা তুই খা। বিল আমি দিচ্ছি। বলেই সিগারেট টানতে শুরু করলাম।

ছেলেটার সাথে কথা বলতে ভালই লাগত। খুব সহজ সরল। বেচারার নাম রইস উদ্দিন। তার অঝর আপু ছোট করে রাসু ডাকে আর তাতে সে মহা খুশি। প্রায় প্রতিদিনই রাসুর চা বারে বসা হত। রাসুর অঝর আপুর সাথে প্রায় সকালেই দেখা হত। এসে রাসুর সাথেই চা খেত, সাথে ক্ষণিকের খোশ গল্প, তারপরেই চলে যেত।
এক সকালে, ব্রিজে দাঁড়িয়ে আছি, ঠিক তখনি বেশ ভালো টাইপের ঝগড়ার শব্দ কানে আসতে লাগল। বুঝলাম রাসুর সাথে ঝামেলা বেঁধেছে, সাথে যখন মেয়েলি আওয়াজ এল তখন দ্রুত নিচে যেয়ে দেখলাম একটা ছেলে রাসুর গলা চেপে ধরে আছে আর পাশে আরেকটা ছেলে অঝরের দিকে তাকিয়ে হাসছে। আর অঝর ২টাকেই বকা ঝকা করছে রাসুকে ছেড়ে দেবার জন্যে।ঝামেলায় জড়াতে ভালো লাগেনা। কিন্তু এখানে চুপ থাকা হয় নি। সামনে গিয়ে বললাম,

- কিরে, তোর হাত তো দেখি অনেক লম্বা হয়ে গেছে, বল তো কেটে দেই।
- ঐ মিয়া নিজের কাজে যান, এইখানে পার্ট নিতে আইসেন না। বহুত মাইর জুটবে।
বুঝলাম কথায় কাজ হবে না। তাকিয়ে দেখি টুলের পাশে একটা গিটার পরে আছে। আর কিছু না ভেবেই গীটারটা হাতে নিয়ে ছেলেটার মাথায় মারলাম। কোনা লেগেছিল, তাই ছেলেটার মাথা দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হল। ব্যাপারটা এতই দ্রুত হল যে কেউ কিছু বলতে পারছিল না। ছেলেটা চিৎকার দিয়ে মাথা চেপে শুয়ে পড়ল আর পাশেরটা কি কি যেন হুমকি দিতে দিতে পালিয়ে গেল। সামনেই মেডিক্যাল কলেজ যেটায় অঝর পড়ে।
- রাসু দোকানে থাক, ভয় পাবি না। আমি হারামিটাকে হাসপাতালে রেখেই আসছি। অঝর আমার সাথে এস।

এটাই অঝরের সাথে আমার প্রথম কথা। আমি কোন মতে ছেলেটাকে উঠিয়ে হাসপাতালের দিকে চললাম আর অঝর সুবুধ বালিকার মত পেছনে আসছে। হাসপাতালের ভেতরে অঝরের সাথে অনেকক্ষণ কথা হল। সেখানেই জানতে পারলাম,
- ছেলেগুলো চা সিগারেট আরও কি সব খেয়েছে। তারপর বিল না দিয়ে চলে যাচ্ছিল, আমি বিলের কথা বলতেই ওরা আমাকে বাজে কথা বলে আর তখন রাসু ছেলেটাকে মারতে ধরে। আর তারপরে তো আপনি এলেন।
- গীটারটা কার ছিল?
- দুর্ভাগ্যবশত আমার ছিল, ভেবেছিলাম ঠিক করিয়ে বাজানো শিখব, তার আগেই তো ১২টা বাজিয়ে দিলেন।

লজ্জায় আর কথা বাড়াইনি। হাসপাতাল থেকে বের হবার আগে ছেলেটাকে কিছু বলে এলাম। তারপর থেকে আর তাদের রাসুর দোকানের আশেপাশে দেখা যায় নি।
ঐদিন সায়েন্সল্যাব থেকে Oscar Schmidtএর একটা গীটার কিনে আনলাম। তারপর এটা নিয়ে পরদিন সকালে রাসুর দোকানে গেলাম। ঢুকেই দেখি অঝর আর রাসু চা খাচ্ছে আর হাসাহাসি করছে। আমি যেতেই চা এনে দিল।
- রাসু আমি চা খাইনা রে।
- ভাই, খাইয়া দেহেন একবার।
- বললাম তো, আমি খাই না।
- আজব তো, এতো করে সাধছে, নিচ্ছেন না কেন, আপনার সমস্যাটা কি? [অঝর with ঝাজ]

ঝাড়ি খেয়ে মুখে দিয়েই দেখি কফি। রাসু বলে উঠল,
- আফা গতকাল ফ্লাক্সডা কিনায়া আনছে, যখন আমি কইলাম আফনে চা খান না, কফি খান।
অঝর সাথে সাথেই প্রতিবাদ করে উঠল,
- মোটেও না, রাসুর Business যেন বেশী হয় সে জন্যে দেয়া।
ওর চেহারা দেখেই বুঝলাম লজ্জা পাচ্ছিল। তখন ওর দিকে গীটারটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
- কাল যে ভেঙেছি, সে জন্যে না, আজকের ফ্লাক্সটার জন্যে এটা।
- লাগবে না।
- আরে আজব, লাগবে না তো কাল আফসোস করলে কেন? আমার এতোগুলা টাকা বেঁচে যেত।
- আপনার কাছে রেখে দিলেই তো আর নষ্ট হবে না।
- আমার বাসায় এমনিতেই ২টা পড়ে আছে। এতগুলো দিয়ে কি আমি Exhibition করব?
- ওকে নিচ্ছি, আর আপনার টাকা নিয়ে আফসোস করতে হবে না। আমি কিস্তিতে শোধ করে দেব।
- এই মেয়ে আমাকে কি তুমি গ্রামীণ ব্যাংক পাইছো?
- আপনার কাছে ২টা গীটার, তার মানে আপনি গাইতে পারেন?

আমি অবাক, মুহূর্তেই ঝগড়ার ঝড় গায়েব। মেয়েটা পারেও।
- না আমি গাইতে পারি না, গীটার বাজানো আমার শখ। তাই মাঝে মাঝে নিয়ে টুংটাং করি।
- আমাকে এখন একটু বাজিয়ে শোনাতে হবে।
- হ, ভাইজান, আমিও শুনুম।
- আহা, এত সহজে ছারছি না, আমাকে তো বুঝতে হবে আমাকে কি ভালো নাকি পচা গীটার দেয়া হচ্ছে।
- আমি কারো সামনে বাজাই না।
- আপনাকে বাজাতেই হবে। [পুরাই ক্ষ্যাপা]
হুট করেই দেখি রাসু পায়ে ধরে বসে পড়েছে।
- আরে ছাড়, কি শুরু করলি?
- ভাই, আমার খুব শখ গীটার বাজানো শুনুম, আর আফা এতবার কইছে। আফারে কেউ কষ্ট দিলে আমার অনেক খারাপ লাগে।
- ওকে ওকে, তুই উঠ।

ব্যাপক ইমুশনাল পরিস্থিতি। কি আর করা, অবশেষে Slashএর কিছু Instrumental বাজালাম। বাজাবার সময় অবাক হয়ে দেখাল, ২জন মুগ্ধ শ্রোতা অনেক একাগ্রতা নিয়ে শুনছে। বাজানো শেষ হবার পরেও আরও ৩-৪বারের মত বাজাতে হয়েছিল। আর ছুটি পাবার জন্যে কথা দিতে হয়েছিল যে প্রতিদিন বাজিয়ে শোনাতে হবে। শুরুটা এভাবেই হয়েছিল। আগে অঝর তার ক্লাসমেটদের নিয়ে আসত। এখন একা আসে। রাসু আমার আর অঝরের জন্যে আলাদা টুল বসিয়েছে। আমি এলেই একটা নতুন বেনসনের প্যাকেট আরেকটা লাইটার দিয়ে যাবে। ওখানে গেলে নিজেকে মহারাজা মহারাজা মনে হত। দিনগুলো কেমন যেন স্বপ্নের মত লাগছিল। জীবনটা এতো সুন্দর হতে পারে, আমি তা কখনই ভাবি নি। এর মাঝেই কবে যে অঝর আপনি থেকে তুমিতে উঠে এসেছে খেয়াল করতে পারিনি। মাঝে মাঝেই ফোনে কথা হত।

শীত আসি আসি করছে, অফিসের কাজে বাইরে থাকতে হচ্ছিল। টানা ২দিন বৃষ্টি, পরোটা আমার উপর দিয়েই গেছে।অবশেষে বাসায় ফেরার সময় দুনিয়া কাঁপানো জর নিয়ে ফিরলাম। এটা নতুন কিছু না, অভ্যেস আছে। শুধু প্রথমবারের মত বাসায় না থেকে রাসুর দোকানে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু শরীরের যা অবস্থা, বিছানা ছাড়তেই জান যাবার অবস্থা।পরদিন দুপুরবেলা, কলিং বেল একটানা বেজেই চলছে। চেষ্টা করেও উঠতে পারছিনা। পরে উঠে অনেক কষ্টে দরজা খুলেই দেখি রাসু দাঁড়িয়ে।
- ভাই, কি হইছে আপনের? ফোন বন্ধ, দোকানে আসেন না। কি হইছে?
- আরে তেমন কিছু না, একটু জর হয়েছে।

রাসু আমার কপালে হাত দিয়ে মনে হয় কারেন্টের শক খেল। হাত দিয়েই উল্টা দিকে দউর। বুঝলাম না কি হল। দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। জ্ঞান হারাবার অবস্থা। এরকম অনেকবার হয়েছে, তাই ভয় হচ্ছে না। একসময় মনে হল আমাকে কেউ টানছে, তারপর মাথায় পানি দেয়ার অনুভূতি হচ্ছিল। একসময় চোখ খুললাম, দেখি অঝর আর রাসু বিছানার পাশে বসে আছে।
- অবশেষে মহারাজের জাগার সময় হল। [খুব রাগত স্বরে অঝর বলছিল]
- আফা, আমি যাই। পরে আবার আসুম নে। [বলেই রাসু বেড়িয়ে গেল]
- তোমার সমস্যা কি? একটা মানুষ এভাবে থাকে কি করে? মোবাইল বন্ধ, কোন খোজ নাই। একটা বার জানাবার প্রয়োজনও মনে হয় নি? আমি কি কেউ না? তুমি জানো, কত বার তোমার সাথে contact করতে চেয়েছি, ফোন বন্ধ, এখানেও আসনা। রাসু আর আমি কত চিন্তা করেছি? আজ যখন রাসু তোমার জরের কথা জানাল, ক্লাস ফেলে ছুটে আসি, এসে তোমার অবস্থা দেখে রাসুকে দিয়ে Medicine আনাই। আমি আর রাসু মিলে তো তোমাকে নিয়ে কোথাও যেতেও পারতাম না, এখানে থেকে যদি তোমার কিছু হয়ে যেত? কি কিছু বলছনা কেন?

- আরে এভাবে বলছ কেন?এটা এমন কিছু না। এমনিতেই ঠিক হয়ে যেত। তুমি অযথাই দুশ্চিন্তা করছ।
- অযথাই মানে কি? এভাবে থাক কেমন করে। তোমার Family Memberরা কোথায়? তোমার বাবা মা কি করে?
- হুহ, শুধু ঝগড়া করে।
- মানে?
- মানে কিছুই না, বাদ দাও, এই নিয়ে কথা বলতে চাই না।
- না আজ তোমাকে বলতেই হবে। বল তুমি।
- বাবা মা এই মুহূর্তে কোথায় আছে তা আমি সত্যি জানিনা। তবে যতটুকু ধারনা, সম্ভবত বেঁচেই আছে।
- হেয়ালি রাখ, আজকে তোমাকে বলতেই হবে। এতটা লোকানোর কি আছে। আর আমাকে যদি বলার মত কেউ মনে না কর তাহলে থাক, জোর করব না। [বলেই ঢুকরে কেঁদে উঠল]

এই মেয়েটা পারেও। অবাক হলাম, আমার কাহিনী জানার কি দরকার, আমি নিজেই তো মনে করতে চাই না। এমনিতে তো ভালই ছিলাম। অঝরের দিকে তাকাতেই দেখি সে কাঁদছে। কেন কাঁদছে তা আমার জানা নেই। আমি এমন কেউ নই যার জন্যে কাঁদতে হবে। তারপরেও কেন যেন খুব ভালো লাগছিল এই ভেবে, জীবনে প্রথমবার কেউ আমার ব্যাপারে জানতে চাইছে।

- আমি তখন অনেক ছোট, ঠিক মত বুঝতেও শিখিনি। তখন শুনেছিলাম, আমার দুনিয়াতে আসাটা আব্বু আম্মু কারোরই পছন্দ হয় নি। আমার জন্যে আম্মু ভালো একটা চাকরি ছেরে দিয়েছিল। কারন সে সময়ে হয়ত মাতৃত্বকালিন ছুটির System ছিল না। আব্বুর দেশের বাইরে কিছু Business Conference ছিল, ঐগুলোও বাদ দিতে হয়েছিল। আর এই জন্যে দুজনেরই অনেক সমস্যা হয়েছিল।প্রায় প্রতিদিন অনেক ঝগড়া হত। বাড়িতে আত্মীয় স্বজনেরা আসা ছেড়ে দিয়েছিল। আব্বু আম্মু আলাদা থাকত। তারপর থেকে তাদের সম্পর্কের অবনতি শুরু হয়, যেটা প্রতিনিয়ত খারাপ থেকে জঘন্য পর্যায়ে চলে যেতে থাকে। আমি কারো কাছেই থাকতে পারতাম না। রাতে একা ঘুমাতে খুব ভয় লাগত। প্রায় প্রতি রাতেই একবার আব্বুর দরজার সামনে আরেকবার আম্মুর দরজার সামনে যেয়ে ডাকাডাকি করতাম। কেউ শুনত না। একরাতে আব্বু দরজা খোলে এসে আমাকে অনেক মারে, বয়স তখন ৪এর মত ছিল। আমার এখনও মনে আছে প্রথমে অনেক বেথা পাচ্ছিলাম, পরে শুধু শরীরটা নড়ছিল, আমি অনুভূতি শুন্য হয়ে পরেছিলাম। তারপর থেকে মার খাওয়ার ভয়ে আর কাউকে কখনো ডাকিনি।

একসময় স্কুলে ভর্তি হলাম, আমি খুব ভালো করে পড়তে লাগলাম, যদি ভালো রেজাল্ট দেখে আব্বু আম্মু একবারের জন্যে হলেও বুকে জড়িয়ে নেয়। আমি কখনো দ্বিতীয় হইনি। খুব কষ্ট লাগত যখন Parents Dayতে সবার বাবা মা আসত, যখন রেজাল্ট হলেই ক্লাসমেটদের বাবা মা তাদের গিফট দিত। আমি আজ পর্যন্ত একটা খেলনা কারো কাছ থেকে পাইনি। আব্বু আম্মুর কারো কোন সমস্যা হলেই আমাকে মারত। একসময় ইচ্ছে হত পালিয়ে যাই বা আত্মহত্যা করি। কেন যেন পারিনি। তাই ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে Scholasticaর বাচ্চাদের দেখে আপনমনে ভাবতাম, যদি আমার জীবনটাও এমন হত। বাবা মায়ের হাত ধরে আসা যাওয়া করতে পারতাম। তারপর ক্লাস নাইনে হোস্টেলে চলে গেলাম। তারপর অনেক ভাল ছিলাম, শুধু রাতে ঘুমাতে পারতাম না। এখনও আমার রাতে ঘুমাতে ভয় হয়।

হোস্টেলে ভালো ছিলাম কারন সেখানে কারনে অকারনে আমানুষের মত মার খেতে হত না। স্কুল বন্ধের কথা শুনলে যেখানে সবাই খুশিতে আত্মহারা হয়ে যেত, সেখানে আমি বিমর্ষ হয়ে পড়তাম। আমার তো যাবার কোন জায়গা নেই। কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজের পেছনেই একটা চায়ের দোকান ছিল, সেখানে কাজ জুটিয়ে নিয়েছিলাম। জতদিন বন্ধ, দোকানেই থাকব, সব কাজ করব, ২বেলা খেতে দেবে। এভাবেই HSC শেষ হয়, তারপর BUETএ ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে এখন এখানে। কখনো কোন ক্লোজ বন্ধু পাইনি, না ভুল বললাম, কারো সাথে তেমনভাবে মিশিনি। সম্পর্কের প্রতি অনিহা এসে যায়। বাবা মা মাঝে মাঝে টাকা পাঠাত, ড্রাইভারকে দিয়ে খোঁজ নিত, এখন যে একাউন্টে টাকা আসত, সেটা আর চেক করিনা। ড্রাইভারের সাথে কথাও বলি না। রাসুর সাথে চলার কারন তাকে দেখে ছোটবেলার কথা মনে পরে যায়। এমন একটা চায়ের দোকানেই রাতে মাথা গুঁজার জন্যে দিনরাত খাটতে হয়েছিল। আমি শুধু উপরে তাকিয়ে একতাই প্রশ্ন করতাম, কি এমন অপরাধ ছিল, যে কারনে আমি আমার শৈশব হারিয়েছি।

মুখ দিয়ে আর কথা বেরুচ্ছিল না। ঠিক তখনি গালে অঝরের হাতের স্পর্শ পাই। অবাক হলাম, চোখের পানিতে গাল ভিজে গেছে। এর আগে শেষবারের মত কবে কেঁদেছিলাম, মনে নেই।
- ধুর, জ্বরের ঘোরে কি কি সব প্রলাপ করেই যাচ্ছি? আমার কথা বাদ দাও। বক বক করার স্বভাব তো, তাই
- আবির, আমি এখন বের হব। অনেক দেরি হয়ে গেছে। কাল সকালে শরীর ভালো লাগলে চা বারে এস। তুমি না এলে সকালটা মলিন লাগে।ঔষধ খেয়ে নিও।
- চল, তোমাকে পৌঁছে দেই।
- এই অবস্থায় বের হতে হবে না, আমি রাসুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

আজ প্রথমবারের মত বেঁচে থাকার মানে খুঁজে পাচ্ছিলাম। আবার ভয় হচ্ছিল, স্বপ্ন দেখছি না তো আবার! পরদিন বেশ সকালেই বেড়িয়ে পড়লাম। শীতটা ভালই পড়েছে। তাই গায়ে জ্যাকেট জড়িয়ে নিলাম। দোকানে যেয়ে দেখি, অঝর গায়ে শাল জড়িয়ে আছে, আর রাসু ৫-৬টা সার্ট আর গেঞ্জি গায়ে দিয়ে কাপছে। ওর পোশাক দেখে হাসি পেল। সব খুলতে বললাম, অবাক হলাম যখন দেখলাম এই শীতে একটা গেঞ্জি রেখে বাকিগুলো খুলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। জ্যাকেটটা খুলে রাসুকে পড়িয়ে দিলাম। জ্যাকেটটা বেচারার হাঁটু পর্যন্ত নেমে গেছে। ঐদিন আমি আর অঝর মিলে রাসুর জন্যে শপিং করে আনলাম। শপিঙের সময় বেশ খাটনি গেছে। সারমর্মঃ রাসুর সাইজ এন্টিক।

একদিন সকালে এসে দেখি অঝর নেই। রাসু আপনমনে একটা হকিতে তেল মারছে।
- অঝর আসেনি?কি করিস তুই?
- ভাই মাথা গরম, আফারে কেডায় জানি জালায়। তাই এইডা ঠিক করতাছি। খালি সামনে পাই একবার, মাইরা ছাতু বানায়া দিমু।
- মানে কি, তোকে কে বলছে?
- আফায় কইল, খুব মন খারাপ ছিল, নৃপ নামের কে নাকি জালাইতাছে।
আমারও অফিসে কাজ ছিল, তাই আর সময় নষ্ট না করে চলে আসি। পরে ফোনে জানতে পারি ওর আক্কেল দাঁত গজাচ্ছে। সবাই এটার নাম নৃপ দিয়েছে। পরে যখন রাসুর সামনে তা বলা হল, বেচারা লজ্জায় মেরুন কালারের হয়ে গিয়েছিল। অঝর আর রাসু প্রায় আমার বাসায় চলে আসত। দুজনের কাছেই চাবি ছিল। প্রায় সময় বাসায় ৩জনের পার্টি হত। ৩জনের এই ছোট দুনিয়াটা আমার কাছে স্বর্গ হয়ে উঠল। একদিন ফোনে,
- আবির, তুমি কি জানো তুমি একটা উচু প্রজাতির গ আকার ধা?
- আয় হায়, এটা বুঝতে এতদিন লাগল?
- ফাজলামো রাখ, ১৪ই ফেব্রুয়ারির প্ল্যান কি?
- অফিস আছে।
- বহুত হইছে, শোন ছেলে, ১৪তারিখ বিকালে চলে আসবা। আমাদের কলেজের পেছনের যায়গাটায় আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে। তারপর আমাকে প্রপোজ করবে। আমি জানি তুমি আমাকে পছন্দ কর। শুধু তুমি কেন, সবাই করে। আমি প্রপোজ করব না, করলে পরে সারাজীবন তুমি ভাব নেবে। কি বললাম, বুঝলা কিছু?

ফোনটা কখন কেটে গেল বুঝিনি। কি হচ্ছে এসব? সত্যি নাকি এটা কেবলি স্বপ্নখোরের স্বপ্নঘোর! যাই হোক, ঠিক হল ১৪ তারিখ বিকাল ৫টায় দেখা হবে। ঝামেলা শেষ করতেই দেরি হয়ে গেল। তারপরে কি দেব না দেব, কিছুই মাথায় আসছিল না। অনেক ইচ্ছে ছিল ফুল দেব, কেন যেন অনেকবার ফুলের দোকানের পাশে থেকে ঘুরে এসেছি। লজ্জায় কেনা হয় নি। পরে অনেকগুলো চকলেট নিলাম। যেতেই ৫:২০ বেজে গেল। সামনে যেতেই যে একটা টাফ লুক দিল, জীবনেও ভুলব না।

- No, excuse. সোজা হাট। তোমার হাতে শুধু ১০ মিনিট আছে।
কি করি কি বলি, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। হাঁটছি, টুকটাক কথা হচ্ছে আর আমি ওকে একটার পর একটা চকলেট দিচ্ছি। একসময় আবার উল্টা ঘুরে সে কলেজের দিকে আসতে শুরু করল। কলেজের গেইটে এসেই বলল,
- আর মাত্র এক মিনিট।
যা আছে কপালে, বলতেই হবে। বাকি চকলেটগুলো ওর হাতে একসাথে দিয়ে “আলাভু” বলেই দউর। এক দউরে রসুর চা বারে। সাথে সাথেই ওর কল, অনেক সাহস নিয়ে রিসিভ করলাম। ফোনে শুধুই ওর হাসি শোনা যাচ্ছে। সে কি হাসি। তারপর মাথায় এল, কি করতে যাচ্ছি। আমি এমন একজন যার কেউ থেকেও নেই। ভবিষ্যৎ কি, তা জানিনা। পরদিনই অঝরকে ডেকে সব বললাম। আমাকে ওদের পরিবারের কেউ কখনই মেনে নেবে না। ও কোন কথাই শুনল না। বলে,
- আমার কাউকেই লাগবে না। আর আমি তো ডাক্তার হচ্ছি, তোমাকে কিছুই করতে হবে না, সারাক্ষন আমার পাশে থাকবে আর ভালবাসবে। পারবে তো?

আমার কিছুই বলার ছিল না, ভয় পাচ্ছিলাম। এত সুখ, Digest হবে তো? অঝর স্বপ্ন দেখতে ভালবাসত। সেই প্রথম যে আমাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিল। স্বপ্নের মত করেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। আর বাসায় এলেই ২টা মিলে বসত, গীটার বাজাতে হবে। একদিন বাথরোমে গান গাইছিলাম, কুটনা রাসু তা শুনে ফেলে আর অঝরকে জানিয়ে দেয়। তারপরদিন অঝর দেখা হতেই মারতে শুরু করল, থামার পর বলল
- এতক্ষণ হাতে বুঝিয়েছি, এখন মুখে বুঝাচ্ছি। একবারেই বলব। এখুনি একটা গান গাও
মানে কি, কি বলে মেয়েটা, আমি কিছু বলতে যাব, সেই পরিচিত টাফ লুক। বুঝলাম পার পাব না। গাইলাম একটা। শেষ হতেই আবার মার শুরু।
- আরে, গান খারাপ হতেই পারে, তাই বলে কি মারতে হবে নাকি?
- ভাব নাও আমার সাথে না? তুমি গান গাও আর আমাকে শুনাও নি? আজকে আর ছাড়ছি না, বলেই তেড়ে এল।

এভাবেই চলছিল খুনসুটি টুনাটুনির সংসার। আমি অবাক হতাম, অঝর ডাক্তার, আমি ইঞ্জিনিয়ার। দুজনেই বেশ বেস্ত থাকি, তারপরেও কত ভালো আছি। বাবা মা কেন পারেনি? কেন?

কিছুদিন পরের কথা, অঝর কেমন যেন হয়ে গেছে, কিছু জানতে চাইলেই বলে, সামনে প্রফ, তাই একটু ঝামেলায় আছে। রাসু আমাকে কিছু বলতে চেয়েও পারছে না। কিছু একটা হয়েছে। আমি বুঝতে পারছি না। হুট করেই অঝরের কল দেয়া বা ধরার হারটা কমে গেল। আমার অঝর আর আগের মত নেই। অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছে। একরাতে অঝর বাসায় এল, রাসু ছিল, তাকে বেড়িয়ে যেতে বলল, রাসু সাথে সাথেই বেড়িয়ে গেল। সে চুপ করে বসে আছে। তারপর
- আবির তোমাকে কিছু কথা বলার ছিল।
- বল
- তুমি আসার আগে একজন ছিল আমার জীবনে। আমার সবকিছু জুড়েই। সবকিছুই ঠিকঠাক ভাবে চলছিল, পরে পারিবারিক সমস্যার কারনে সে আমাকে ছেড়ে চলে যায়। এখন আবার সে ফিরে আসতে চায়, আমি কি করব বুঝতে পারছি না। আমাকে তুমি বল আমি কি করব। বলেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

মানতে পারছিলাম না, কেন আমার সাথেই এমনটা হবে, কেন আপন বলে কেউ আমার থাকবে না। আমার চারিদিকে অন্ধকার ছেয়ে যাচ্ছিল। বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, অঝর, তুমি জানো কি, আমি শুধু তোমার স্বপ্ন দেখি, তোমার পথ চেয়ে বসে থাকি, আমার হৃদয় জুড়ে ভালবাসা শুধু তোমার জন্যেই। সারাবেলা শুধু তোমার কথাই ভাবি, তোমার স্মৃতিগুলো আমায় ঘিরে রাখে সবসময়। আমার সমস্ত প্রার্থনা তোমাকে ঘিরেই। সারাটা জীবন তোমার হাতটি ধরে কাটিয়ে দিতে চাই, তোমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে চাই না, প্লিজ রাগ কর না আমার সাথে। আমাকে ছেড়ে যেও না। তুমি ছাড়া আর কেউ নেই যে আমার। মনের জমানো কথামালা মনের ভেতরেই গুমরে মরল।

- তোমাকে আমার জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিলাম অঝর। তোমাকে তোমার জান্নাত ফিরিয়ে দিলাম। ভালো থেক। অঝর আর কোন কথা না বলেই চলে গেল। জীবনটা আবার অর্থহীন মনে হচ্ছিল। রাসুর দোকানে আর যাওয়া হচ্ছিল না। কাজে বেস্ত হয়ে সব ভুলে থাকার চেষ্টা করলাম। একদিন সন্ধ্যায় অঝরের কল, সে কাঁদছে আর দেখা করতে চাইছে। কে যেন ওর বয়ফ্রেন্ডের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। সে অঝরের সাথে দেখা করতে এসেছিল। যাবার বেলায় অঘটনটা ঘটে। হাসপাতালের যাবতীয় ঝামেলা শেষ করে ফেরার পথে দেখি রাসুর দোকান বন্ধ, কয়েকদিন ধরে নাকি দোকানে আসে না। পরে যেখানে মাথা ফেটেছে, সেখানে যেয়ে রক্ত মাখা একটা হকি পাই। পরে আর বুঝতে বাকি থাকে না কি হয়েছিল। বাসায় ফিরে দেখি রাসু বসে আছে।

- রাসু, এমনটা কেন করলি?
- অঝর আফারে আপনের সাথে ছাড়া আর কারো সাথে দেখলে আমার অনেক কষ্ট হয় ভাইজান। আর আপনের কষ্ট আমার সহ্য হয় না।
- আমি কাল এখান থেকে চট্রগ্রামে চলে যাচ্ছি। সেখানেই থাকব। তুই জাবি আমার সাথে?
- আপনে যেখানেই যান, আপনার পাশেই থাকব। ভাই কেন এমন হইল, এরপরে কি করবেন?
- এরপর –
“কি হয়েছে ?” , “কেন ?” – দূরে থাক ।
আমি ও আমরা আছি ভালো, শুধু -
ভালবাসা টুকু নির্বাক ।
 
Top