(এই সিরিজের প্রতিটি গল্প সত্যকাহিনী; পাত্রপাত্রী বদলানো হয়েছে, আর সাথে প্রেজেন্টেশানেও একটু রোম্যান্টিক ভাব আনা হয়ে থাকতে পারে)

*****************************************************
সেবার চিটাগাং গেলে মোস্তাক ভাইর সাথে দেখা হলো, ভীষন হাসিখুশী মানুষটা।
আমার সাথে তেমন খাতিরও নেই আসলে, লতায়-পাতায় আত্নীয়;
অথচ আমাকে দেখে এমনভাবে হৈ-হৈ-রৈ-রৈ করে উঠলেন যেন আমার সাথে এতদিন দেখা না হওয়ায় তিনি মারা যাচ্ছিলেন ।
জোর করে ধরে বাসায় নিয়ে গেলেন।

উনাদের বাড়ীর মাঝখানে উঠোন, উঠোনকে ঘিরে চারপাশে থাকার ঘর, পাকঘর এটাসেটা।
উঠোনে মোস্তাক ভাইর মা, মানে আমার খালা, একমনে শাকসব্জি কুটছিলেন।
যেটা বলিনি তা হলো, মোস্তাক ভাই যখন আমাকে ধরে নিয়ে গেলেন বাসায়,
আমি একশ' ভাগ উৎসাহের সাথে গিয়েছিলাম।
কারণ, খালাকে দেখব বলে।
এর আগে তাঁকে কখনও দেখিনি।
কিন্তু মা-খালাদের মুখে উনার গল্প শুনেছি অনেক।
খুব দেখার ইচ্ছে ছিল।

খালা মজার মজার রান্না দিয়ে দুপুরে ভাত খাওয়ালেন।
খেয়েদেয়ে বিদায় নিতে যখন আবার সেই উঠোনে গেলাম,
তখন আমার আত্না কেঁপে উঠল।
দেখি, উঠোনের এককোনে একটা নিঃসঙ্গ বড়ই গাছ দাঁড়িয়ে আছে।
মুহূর্তেই আমি খালুর দিকে তাকাই -- আহা! কি আরাম করেইনা বেতের চেয়ারটায় বসে পেপার পড়ছেন।

আসার পথে ভাবতে লাগলাম,
বিকেল গড়িয়ে যখন করুণ সুরে সন্ধ্যা নামে তখন কি খালা এই বড়ই গাছটাকে ধরে আকাশের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকেন?
আবার মনে হলো, কি জানি! হয়ত পুরোটাই কাকতালীয়।
হয়ত এই বড়ই গাছের কোন মানেই নেই।

পৃথিবীটা বড় অদ্ভুত! সবকিছু কি আমরা বুঝি? সবকিছু কি বোঝা যায়?

খালার গল্পটা কত শুনেছি! কতজনের মুখে!

খালার নাম আমি জানিনা।
মা-নানীরা তার নাম বলত 'সাবিনার মা'।
আর এটা বলত যে এমন সুন্দর মেয়ে নাকি তারা কেউই কখনও দেখেনি।

খালার যখন 13/14 বছর বয়েস,
তখনই তার রূপের খ্যাতি গ্রামের পর গ্রাম ছড়িয়ে পড়ে।
তার বাবা গেরস্তমানুষ, আয় রোজগার ভাল।
এদিক ওদিক থেকে অনেক সন্মন্ধ আসে।
বাবা-মা চিন্তায় পড়ে যান, মেয়েকে কোথায় বিয়ে দিলে ভাল হবে!
এও এক মধুর যন্ত্রণা!!

এদিকে এলাকার জমিদার বাড়ীর (তখন জমিদার প্রথা উঠে গেলেও এই পরিবারটিকে সবাই জমিদারের মতই দেখত, এখনও দেখে) মেঝ না সেজ ছেলেটি খালাকে ভীষন পছন্দ করেছিল।
ছেলেটির নাম জাকির চৌধুরী।
(ছোটবেলায় গ্রামে গেলে তাঁকে দেখতাম, এক বড়ই গাছের নীচে বাঁশী বাজাচ্ছে। মায়েদের কাছে বাচ্চাদের একটা কমন প্রশ্ন ছিল, জাকির মামা সারাদিন এত বাঁশী বাজায় কেন? আমার কাছে লোকটাকে উদভ্রান্ত পাগলের মতো মনে হতো)

মা-খালাদের গল্পে বলে, জাকির চৌধুরী সাবিনার মাকে যেমন ভালবেসেছিল তেমনটি নাকি লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদেও হয়নি।

এই জাকির চৌধুরী বাবার ভয়েই হোক বা দাদার ভয়েই হোক, বা অন্য কারণেই হোক,
খালাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারেনি।
শুধু খালা যখন সখীদের সাথে স্কুলে যেত,
তখন তাদের যাবার পথের একটু দূরে সরে দাঁড়িয়ে করুণ চোখ করে দেখত।
মনে মনে হয়ত ভাবত, 'না হয় একটু রূপসীই, তাই বলে কি মন গলবেনা!'

এমনি এক হাটবারে খালার বাবা বাসায় এলেন কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে।
এদের মাঝেই একজন খালার পাত্র, ছেলে চিটাগাঙে সরকারী চাকুরী করে।
সেযুগে সরকারী চাকুরী হলে আর কোন কথা ছিলনা।
সেই সন্ধ্যায় মোরগ জবাই করে, ঘিয়ে ভাজা পোলাউ করে খালার বিয়ে হয়ে গেল।

রাত দশটায় যখন জাকির চৌধুরী খবর পেলেন, তখন অনেক দেরী! সবশেষ!!

পরদিন সকাল দশটার দিকে বউ নিয়ে যখন গরুর গাড়ী চলে যাচ্ছিল গ্রাম ছেড়ে,
জাকির চৌধুরী তখন পথের ধারে এক বড়ই গাছের নিচে বসে জোরে জোরে বেসুরো বাঁশী বাজাচ্ছিল।
কে জানে?
হয়ত অদৃষ্টের প্রতি এ ছিল তার অস্থির প্রতিবাদ।
যারা জানত, জাকির চৌধুরী খালাকে ভালবাসে, তারা নাক সিঁটকালো।

জাকির চৌধুরী খালাকে ভুলেই যেত। সেরকমই হবার কথা ছিল।
কিন্তু একটি কথা, একটি কথাই তার জীবনকে এলোমেলো করে দেয়।

খালার সখী, আয়না বেগম, জাকির চৌধুরীর কাছে ফাঁস করে দেয় যে,
খালা বিয়ের কিছুক্ষণ আগে হঠাৎ করেই বেশকয়েকবার তাকে(আয়না বেগমকে) জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল আর বলছিল,
'মাকে বল, জাকির ভাইর সাথে বিয়ে না হলে আমি বাঁচবনা।'

মা-খালাদের গল্পে বলে, সেই সেদিন থেকে জাকির চৌধুরী প্রতিদিন সকাল দশটায় সেই বড়ই গাছের তলায় বসে বাঁশী বাজাত, কোনদিন দুপুরে চলে যেত, কোনদিন সারাবেলা বাঁশী নিয়েই থাকত।
শুধু খালা যেদিন গ্রামে আসত সেদিন তাকে কোথাও দেখা যেতনা।
খালা চলে গেলে, আবার বাঁশী বাজানো শুরু হতো।
তার বেসুরো বাঁশীর দিনে দিনে সুর পেল।
করুণ থেকে হলো করুণতর।

অদ্ভুত এই অভিমান জাকির চৌধুরীর কার উপর ছিল, কেমন করে ছিল, তা আমি বুঝিনা।

জাকির চৌধুরী মাত্র 45 বছর বয়েসে মারা যান।
যেদিন তিনি মারা যান, সেদিন তার বাবা চিৎকার করতে করতে অভিশপ্ত সেই বড়ই গাছটি কেটে ফেলেন।
তার বাবা হয়ত ভেবেছিলেন এই বড়ই গাছটির জন্যই তার ছেলের জীবনটা এভাবে তছনছ হয়ে গেল।

আর আমি ভাবি, 'কয়জনে পারে?'
 
Top