By--অনন্যা
বিকেল ৪ টা। 'বেইলি শর্মা হাউস' এর একেবারে গ্লাসের সাইডে বসেছে শুভ্র।এখানে আসলে বরাবরই এই সোফাটায় বসে সে।ভীষণ ভাললাগে কাঁচের ওপাশে ব্যস্ত শহরের কোলাহল দেখতে। সে বসে আছে তার বন্ধু আবিরের জন্য।কয়েকটা নোটস আর দুইটা গেমসের ডি.ভি.ডি. নিয়ে এখানেই আসার কথা ওর। তাই অপেক্ষা করতে করতে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছিল সে, চোখে পড়ছিল কিছু জোড়া মনের সুখে গল্প করছে,কার সাথে কাকে কেমন মানিয়েছে ভাবতে বেশ মজা পাচ্ছিল । শুক্রবার বিকেল বলে কোথাও একটুও ফাঁকা নেই,তার সোফাটা ছাড়া। দেখতে দেখতে হঠাৎ দেখে কাউন্টারে একটা মেয়ে,ভীষণ মিষ্টি চেহারার,তার প্রিয় নীল-সাদা রঙের শাড়ি পড়া, চোখে সুন্দর একটা ফ্রেমের চশমা। একরাশ কাল চুল পিঠে ছড়ানো। খাবারের অর্ডার দিচ্ছে,খুব তাড়াহুড়ায় আছে মনে হয়। অসহায়ভাবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে বসার জায়গা পাওয়ার আশায়। মনে মনে ভাবছে শুভ্র,'ইশ কি সুন্দর মেয়েটা! আমার পারফেক্ট ক্রাশ! নিশ্চয়ই বয়ফ্রেন্ড আছে,তার সাথেই দেখা করতে আসছে হয়ত। আজকালকার মেয়েরা আর কিছু পারুক আর না পারুক একটা বয়ফ্রেন্ড ঠিক ঝুলায়ে রাখবে সঙ্গে। ' নিজের জন্যে ভীষণ আফসোস হতে থাকে তার। বুয়েটের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সে।সবার মতে ভীষণ হ্যান্ডসাম দেখতে,অথচ এপর্যন্ত একটা নিষ্পাপ মিষ্টি মিষ্টি চেহারার মেয়ে পাইলনা সে ! ধ্যাৎ,জীবনটাই বৃথা ! মাঝে মাঝে তো তার থেকে দুই বছরের ছোট ভাগ্নে লজ্জা দেয় এই বলে যে, 'মাম্মা! তোমার তো ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখতেসি।আজ পর্যন্ত একটা মেয়ে পটাইতে পারলানা! তুমি তো আমার নাম ডুবাবা! ' উত্তরে মাথায় জোরে একটা গাট্টা দিয়ে বলে ,'হইসে আর পাকনামো করা লাগবেনা! নিজেরটা নিয়ে খুশি থাক। আমার জন্য কেউ না কেউ নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছে !' কিছুক্ষণের জন্যে সাহিত্যিক হয়ে ওঠা আর কি ! ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই হেসে ওঠে শুভ্র !
সাহিত্যের পোঁকা হওয়ায় উপন্যাসের নায়ক হিসেবে নিজেকে কল্পনা করতে ভালবাসত।কিন্তু কলেজে ভর্তি হয়ে যখন বাইরের জগতে খুঁজতে যায়,তখন কল্পনার সাথে মিল খুঁজে পায়না। আসলে এখনকার ফাস্ট যুগে,গল্প থেকে উঠে আসা নায়িকা পাওয়া মুশকিল ! একটা মেয়ে হয়ত ভালবাসে সাদা-সিধে একটা মধ্যবিত্ত ছেলেকে,কিন্ত যেই পরিবার থেকে বিজনেসম্যান ছেলে পছন্দ করা হল,ওমনি সুরসুর করে বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়ে ! সবাই ভীষণ অভিনয় বাজ,আর এই বিষয়টাই ওর সবচেয়ে অপছন্দ। নিজের জন্য এমন কাউকে খোঁজে,যে হয়ত ডানাকাটা পরী হবেনা,কিন্তু নিষ্পাপ একটা চেহারা হবে,যে তাকে সত্যিকারের ভালবাসবে।এতদিন মনে হত,তাড়া কিসের! সময় হলে হবেনে! কিন্ত ইদানিং নাটক - সিনেমা আর আশেপাশে দেখে মনে হয়,কাউকে অধিকার করতে পারার,কাউকে জীবন দিয়ে ভালবাসার খুব প্রয়োজন।। এমন একজনকে অবশ্য পেয়েও গেছিল,কিন্তু ... এমনই সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে একটা মিষ্টি কন্ঠে হুঁশ হয় তার। - এক্সকিউয মি,বসতে পারি ? তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে যায় সে,আরে! এ তো ঐ মেয়েটা ! চশমার আড়ালে কাজল কাল চোখের দিকে তাকিয়ে সব ভাষা হারিয়ে ফেলে সে যেন... - ইয়ে,মানে...আসলে...বলছিলাম কি... আমার একটা ফ্রেন্ডের জন্য ওয়েট করছিলাম। - সমস্যা নাই,আমার দশ মিনিটের মত লাগবে।আসলে আমার এক ফ্রেন্ড এর বাসায় অনুষ্ঠান। এখানে খাবারের অর্ডার দিয়েছিলাম, দিতে একটু সময় লাগবে, আর সব সিট ফিল আপ, তাই.. - জী,আ-আচ্ছা..বসুন তাহলে । এরপর ধন্যবাদ বিনিময়। - কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি ? - জ্বী,বলুন। - আপনি তখন ওভাবে তোতলাচ্ছিলেন,আপনার কি কথা বলায় সমস্যা আছে ? আরে এই মেয়ে কী বলে ! কলেজে কবিতা আবৃত্তিতে পুরস্কার পাই, আর আমি তোতলা ! কত্ত বড় ফাজিল ! মনে মনে এসব ভাবলেও মুখে একটা শুকনো হাসি ফুটিয়ে বলে, - জ্বী না। - ও আচ্ছা।
কি আজব সরি ও বলেনা ! কেমন বেত্তমিজ ! আবার মুচকি মুচকি হাসে ! এমনে তাকায়ে আছে, যেন জীবনেও ছেলে দেখেনাই ! মোবাইল টিপতে টিপতে এগুলাই ভাবতেসিল শুভ্র। এদিকে নীলাঞ্জনা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে শুভ্রর দিকে ! কেন যেন ছেলেটাকে খুব চেনা চেনা লাগছে,বলে দেখব নাকি ?না থাক এমনেই বেচারা মুখ কাল করে বসে আছে,খুব মজা লাগছে দেখতে! এমনসময় শুভ্র দেখে, কল আসে মেয়েটার, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে যেন! নিশ্চয়ই বয়ফ্রেন্ড এর ফোন,নাইলে এত হাসে! গোমড়া মুখে,কিছুটা সন্দেহের চোখে আর মুগ্ধনয়নে দেখছিল সে , ইশ কি সুন্দর হাসি ! মনে হচ্ছে যেন রিনিঝিনি সুরে হাতভর্তি কাঁচের চুড়ি বাজছে,নাকি মেয়েটার হাতের চুড়িই বাজছে ? নাহ!এটা হাসিরই শব্দ।
কথা বলা শেষ। একমূহুর্তের জন্য মনে হল,মেয়েটাকে আরেকবার হাসতে বলে...!হঠাৎ বেরসিক ওয়েটার এসে জানাল, 'ম্যাম,প্যাকেট রেডি।' শুভ্রর ইচ্ছে করছিল একটা ঘুসি মারতে ওয়েটারের মুখে।কি ভাল লাগছিল মেয়েটাকে ! আরো কিছুক্ষণ না হয় থাকত বসে ! মেয়েটা মোবাইলটা টেবিলে রেখে খাবার আনতে যায়।মেয়েটা বলছি কেন ! ইতিমধ্যে শুভ্র মনে মনে একটা নাম দিয়ে ফেলেছে, "নীলাবতী" অথবা" নীল পরী "। কিন্ত কোনটা বেশি মানাবে বুঝতে পারছেনা ! শেষমেশ সিদ্ধান্তে পৌছাল যে,নীল শাড়িতে,খোলা চুলে আর বেলী ফুলে, যাকে এত্ত সুন্দর মানিয়েছে, তার নাম হওয়া উচিত" নীলাম্বরী" নিজের কৃতিত্বে,নিজেই পুলকিত হয় সে। বাহ কি সুন্দর একটা নাম দিয়েছি! ^_^্হঠাৎ টেবিলে চোখ যায় তার। আরে!এটা তো আমার ফোনের মডেল! নাহ! সুন্দরীর চয়েস ও আছে বলতে হয় ! হঠাৎ আবির , মানে,যার জন্য অপেক্ষা করছিল সে,তার কল। ' কিরে দোস্ত,কই তুই ? আধা ঘন্টা ধরে বসায়ে রাখছিস!' উত্তরে বোঝে সে,জ্যাম এ আটকেছে ব্যাটা !আসতেসে।'উফ' বলে ফোনটা টেবিলে রাখে শুভ্র। এমনসময় ফিরে আসে নীলাম্বরী , ব্যাগ গুছাতে গুছাতে বলে, - শুনুন,আরেকটা কথা বলি ? - জ্বী বলুন,তখন থেকে তো বলেই যাচ্ছেন ! শুনে হাসতে হাসতে মেয়েটা বলে, - শুনতে বাংলা সিনেমার মত মনে হলেও, আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে,কোথায় দেখেছি বলুনতো ? - জ্বী,আল্লাহর রহমতে আমার চেহারা বিশ্বের অন্যতম কমনচেহারা,মেয়েদের সবসময়ই চেনা চেনা লাগে ! শুনে হা হয়ে যায় সে! বলে কী ছেলেটা,এমনে অপমান করল! নিজেকে ভাবে কি সে ? রণবীর কাপুর ? চেহারা একটু ভাল হইলেই হইসে,ছেলেদের ভাব এর জ্বালায় বাঁচা যায়নাহ ! হুহ! মুখ বাঁকিয়ে ,ফোনটা হাতে নিয়ে, চলে যায় ওখান থেকে। মনে মনে খুশি হয় শুভ্র। হুহ!আমারে পচাইতেসিলা না, এখন কেমন লাগল ?
অবশেষে অবশ্য তার নীলাম্বরীর চলে যাওয়া দেখে কিছুটা মন খারাপ হয় ! ইশ ! না জানি কার ভাগ্যে আছে তার "নীল পরী " যদিও একটু পচানিমার্কা কথা বলে !জন্মের পর মনে হয় মুখে মধুর পরিমাণ কম দিয়ে ফেলসিল ওর মা।তাতে কি ? আমি না হয় "ডেইরি মিল্ক সিল্ক" খাওয়ায়ে মিষ্টি মুখ করায়ে দিতাম ! দরজা থেকে চোখ ফেরে টেবিলের উপর,রিংটোনের আওয়াজ শুনে।কিন্তু আশ্চর্য হয় সে,আমার ফোনে আবার তাহসানের গানের রিংটোন হইল কবে থেকে ! বিস্ফোরিত চোখে কতক্ষণ ফোনটার দিকে তাকায়ে থাকে শুভ্র। বেজে চলছে - 'মাঝে মাঝে তোমায় ভেবে এলোমেলো লাগে সবই, মাঝে মাঝে তোমার চোখে, কে আঁকে অন্য ছবি '.....তাহসানের মধুময় কন্ঠে। স্ক্রিনে ভাসছে 'মেঘলা কলিং ' ,সাথে একটা মেয়ের লাস্যময়ী ছবি। শুভ্র স্মৃতির পাত্র হাতড়ে খুঁজতে থাকে ,এই নামে এমন চেহারার কোন মেয়েকে সে চেনে কিনা,চিনলেও তার কাছে নাম্বার গেল কেমনে ? আর গেলেও,এই মেয়ে আমাকে ফোন দিসে !!!ধাতস্থ হতে কিছুক্ষণ সময় লাগে তার। কি হয়েছে বুঝে উঠতেই সব ফেলে দরজার দিকে দৌড় দেয়।তিন চার লাফে সিঁড়ী পার হয়ে রাস্তায় পৌঁছে, এদিক - ওদিক খুঁজতে থাকে।যখন বোঝে যে তার দৃষ্টিসীমানার মধ্যে একমাত্র মাথার ওপরের আকাশ ছাড়া আর কোথাও নীল রং পরিহিতা কেউ নেই,রাগে, দু:খে নিজের মাথায় নিজেরই বাড়ি মারতে ইচ্ছা করে। মেয়েটার সৌন্দর্য তাকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে,আশেপাশের কিছুর দিকে কোনো খেয়াল ছিলনা। এখন বোঝ মজা ! 'আচ্ছা,মেয়েটাকে দেখে তো কত ভদ্র মনে হল,ও নিশ্চয়ই আমার ফোনটা চুরি করার জন্যে নেয়নি !অবশ্যই ভুলে নিয়েছে' নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দেয় যেন। 'আর যদি চোর হয়! প্রোফেশনাল পকেটমার না তো ! ওরা তো এমনই করে,সুন্দরী মেয়েদের দিয়ে...হয়ত মেয়েটার দোষ নাই কোনো, অভাবে পড়ে করতে হচ্ছে। ' ছি ছি !কি ভাবছি আমি! এত পবিত্রতা যার চেহারায়,সে কখনই এমন করতে পারেনা। আর ঐ হাসি, তাতে যে সরলতা ছিল.... , কক্ষণো না! নিজের সাথেই দ্বন্দে মেতে ওঠে শুভ্র। সম্বিত ফেরে আবার কলের শব্দে। উফ!এই মেয়ের ফোন তো বাজতেই থাকে! 'কত কথা বলে রে !' [ ক্ষণকালের জন্যে নীলাম্বরী, নীল পরী সব বিশেষণ বাদ ,এখন এই মেয়ে,শুধুই এই মেয়ে]
ফোনটা কেটে নিজের ফোনে কল দেয় সে,কিন্তু সুইচড অফ !!!! এইবার ওর মাথায় বাজ ! সত্যিই চুরি করসে নাকি !আমার নতুন Xperia-Z .... কল্পনায় কেমন যেন কাঁদো কাঁদো লাগে নিজের কন্ঠস্বর ! ক্রমাগত ট্রাই করে অবশেষে রাতে খোলা পাওয়া যায়, জানে যেন পানি ফিরে আসে শুভ্রর। ফোন করতেই,এক মিষ্টি কন্ঠস্বরে সে আবার মোহিত হয়ে যায়। কিন্ত ওপাশ থেকে যখন ঝাড়ি ভেসে আসে,- "এই যে,আপনি ফোন চুরি করলেন কেন আমার, হ্যা? একে তো অপরিচিত মেয়েদের অপমান করেন,তার উপর আবার চুরি করেন !সাহস তো কম না আপনার ! আপনার ফোন তো আছে আমার কাছে,RAB এর কাছে যদি ধরায়ে না দিসি,আমার নাম নীলা না! RAB এর ডি.আই.জি. আমার আপন মামা! আপনার বারোটা না বাজায়ে ছাড়ব না! ...." " আরে! এর নাম দেখি সত্যিই নীলা! মেয়েটার কথা মাথায় ঢুকছিল খুব কম কারণ সে এক নিশ্বাসে বলে যাইতেসে তো যাইতেসে.." শ্বাস নেওয়ার জন্য একটু থামতেই শুভ্র বলে, - ও হ্যাল্লো ম্যাডাম শোনেন,আমার কোন শখ নাই,আপনার পুরানো সেট চুরি করার,আমারটা একদম নতুন ছিল,একমাস আগে আমার খালামনি পাঠিয়েছে অস্ট্রেলিয়া থেকে,বুঝছেন ? আর বলেন তো ফোনটা নিয়ে চলে গেসিল কে ?আপনি না আমি? তাই দয়া করে আপনার বকবকানি বন্ধ রেখে,বলেন কোথায় আসবেন। - কি ! একে তো চুরি করেন,তারপর আবার বড় বড় কথা! আসবো মানে কি হ্যা? আপনি বল্লেই আমি আসবো ?নিজেকে মনে করেন কি বলেন তো, টম ক্রুজ ?.....' - মিস,আমি একটু বলি ? - না,আপনি শুধু শুনবেন,আমার এত সাধের ফোনটা নিয়ে গেসেন,আবার বলেন, "কোথায় আসবেন? " কেন ?আমি কি gf নাকি আপনার, যে আপনার বলার সাথে সাথে আহ্লাদে আটখানা হয়ে রওনা দিব ?' আহারে ফোনের শোকে মেয়েটার মাথা পুরাই গেসে ! কিছু বলতে গিয়ে হেসে ফেলে শুভ্র। ওপাশে নীলা বলেই যাচ্ছিল,কিন্ত হঠাৎ হাসির শব্দে যেন সে থমকে যায়। তার মনে হতে থাকে এই হাসির মালিককে আর যাই হোক বকা দেওয়া যায়না।এত প্রাণোচ্ছল যার আনন্দের প্রকাশ,সে কি মিথ্যা বলতে পারে ? চুপ হয়ে যায় সে। - কি ব্যাপার মিস,থামলেন কেন? আরো বলেন। গলা শুকায়ে গেসে? পানি দিব? হাসতে হাসতে বলে সে। নীলা তখনো চুপ।আসলেই সে এবার একটু লজ্জা পেয়ে যায়। অচেনা একজনকে তখন থেকে একভাবে বকেই যাচ্ছে, তার ফোনটাও তো আমার কাছে।- মিস নীলা,আপনাকে আমার gf হয়ে আসতে বলছিনা বিশ্বাস করুন, শুধু ফোনটা দিয়ে যেতে বলছি। এবার নীলা আর চুপ করে থাকতে পারলনা,হেসে দিল জোরে। মুহূর্তের জন্য শুভ্রর মনে হল, পৃথিবী যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে।তার কানে বাজছে শুধু সেই রিনরিনে শব্দ। মনে হচ্ছে শুধু দুটো লাইন, " কাঁচ ভাঙা হাসির শব্দে আমি এলোমেলো হয়ে যাই,আরেকবার সে শব্দ শুনতে আমি পৃথিবীর মালিকানা ছাড়তে রাজি আছি। " নীলাম্বরীকে আরেকবার হাসতে বলার পুরনো ইচ্ছেটা আবার নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিল।। কিন্ত না ,এবার নীলা স্বাভাবিক সুরেই বলল, - সরি ভাইয়া, আসলে ওটা হারানোর পর থেকে মাথা ঠিক নাই আমার।অনেক প্রিয় আমার এই সেট টা। - আরে আমার তো তার চেয়ে দ্বিগুণ প্রিয়। এমনকি আমার ফ্রেন্ড রা এটাকে আমার gf টাইটেল ও দিয়ে দিসিল। - (হেসে) জ্বী বুঝলাম,এবার আপনার gf কে ফেরত নিয়ে আমার ফোনটা দিলে খুশি হতাম।আজকে বিকালে আসেন, বসুন্ধরা সিটির ফুড কোর্টে ? - ( মুগ্ধ ) জ্বী জ্বী অবশ্যই। টাইম টা বলেন। - উমম.... ৪:৩০ ...? - ওকে, তাহলে ঐ কথাই থাকল। কিছু নীরবতার পর,নীলা যখন ফোন রাখতে যাবে, - মিস নীলা, আরেকটা অনুরোধ করতে পারি ? রাখবেন ? - অনুরোধ ! আমাকে! রাখব কি না তা তো বলতে পারিনা,আপনি বলে দেখতে পারেন। - আসলে,মানে....আপনার নামের মতই নীল ড্রেস- এ আপনাকে খুব মানায়... - (বিব্রত)...জ্বী ধন্যবাদ। রাখছি। শুভ্র একদম বোকা বনে গেল।কথাটা বলা ঠিক হল কিনা,বুঝলোনা। ' থাক ! বলে তো ফেলসিই।প্রশংসা কোন মেয়ে না পছন্দ করে ?এ ও নিশ্চয়ই করসে,একটু ভাব দেখাইল আর কি ...' নিজেকে সান্ত্বনা দেয় সে। বিকেলবেলা — ৪:৩০ শুভ্র কথামত দাঁড়িয়ে আছে এস্কেলেটর এর পাশে।নিচে তাকিয়ে উপর থেকে পুরো টা দেখছিল সে।খুব ভাললাগে তার এভাবে দেখতে।এমন সময় চোখ আটকে গেল একটা মেয়ের দিকে। আরে এই তো নীল পরী।আজকেও নীল পড়েছে।নীল,সাদা,সবুজ আর সোনালী রঙে মিশ্রিত একটা ড্রেস। অপূর্ব লাগছে দেখতে।নীল রঙের কথাটা বলাতে সে যে খুশি ই হয়েছে,বোঝা যাচ্ছে। শুভ্র কখনই 'love at first sight ' এ বিশ্বাসী না।মানুষের মনকে ভালবাসতেই ভাললাগে তার।কিন্ত এই মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে, ' কাউকে দেখলেই প্রেমে পড়া যায়না হয়ত,তবে প্রেমে পড়ার যে ইচ্ছাটা মনে জাগে,তাই বা কম কিসের।'
কিছুক্ষণের মধ্যেই নীলা পৌঁছাল।তার মনে শুধু এখন একটাই চিন্তা,ফোনটা ঠিক মতন ফেরত পাব তো ?সেদিন দেখে তো ভালই মনে হচ্ছিল। কথাবার্তাও ভদ্র।আল্লাহই জানে....!' নীলা উঠে আসে সিঁড়ী বেয়ে। অস্থির চোখে শুভ্রকে খুঁজে বেড়ায়।এবং মজার ব্যাপার শুভ্রর দিকে একবার নজর দিয়েও চোখ ফিরিয়ে নেয়। শুভ্রর খুব মজা লাগে নীলার অস্থির চেহারা দেখতে। সে দেখে নীলা গিয়ে কে.এফ.সি এর সামনে বসে। দু'মিনিট পর শুভ্র সেখানে গিয়ে বসল। নীলা প্রথমে কিছুক্ষণ তাকিয়ে প্রথম যে লাইনটা বলে, - আমার ফোনটা এনেছেন তো? দেন। শুভ্র ভাবছে, 'কেমন মেয়ে !ভাল-খারাপ কেমন আছি তা ও জিজ্ঞেস করলনা ! ' - জ্বী, আপনি আমারটা এনেছেন তো? - হুম,নিন.... অবশেষে এক শুষ্ক ফোন আদান প্রদান এর মধ্যে দিয়েই ঘটনার সমাপ্তি ঘটে। - থ্যাংকস। বলেই নীলা যেন উড়ে চলে যায়। শুভ্র কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে অবশেষে চলে যায়,কিছুটা মনমরা হয়েই। ভাবে মেয়েটা হয়ত এমনই,অমিশুক!
এরপর প্রায় এক মাস কেটে যায়। কোন অলস দুপুরে ,একলা বিকেলে অথবা বিষন্ন সন্ধ্যায় কিংবা নির্ঘুম রাত্রির সঙ্গে মিতালি পাতায় সে ' স্বপ্নিল নীলাম্বরীর ' সাথে। কোন সুন্দর মেয়ে দেখলেই আর ঝটপট 'ক্রাশ' এ পড়েনা, চশমা পড়া এক জোড়া কাজল-কালো চোখ যেন তার চোখে বাসা বেঁধেছে। শুভ্র সারাটাক্ষণই মেঘলার চিন্তায় বিভোর। বারবার তার মনে হয়, 'ইস!' বন্ধুরা ইতিমধ্যেই ওকে 'নীল ' নাম দিয়ে দিয়েছে ! কিন্তু মাসখানেক অনেক খোঁজাখুঁজি করেও না পেয়ে,তাকে হয়তোবা ভুলেই যেত শুভ্র, যদি না.....
সকাল থেকেই মনটা ভাল ছিল না। ভার্সিটির ক্লাস শেষ হতেই ক্যাম্পাস এ ঘুরতে বের হয়,একা একা। হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে চারুকলার দিকে।তার প্রিয় চা এর টং এ বসে আনমনে এদিকওদিক দেখছিল। দোকান থেকে কিছু দূরে একটা জটলা দেখতে পাচ্ছিল কিছু ফুল,চা,চকলেট, পেপার বিক্রেতা বাচ্চা জড় হয়ে আছে ; কে যেন খাওয়াচ্ছে তাদের,বিরিয়ানি,ঘ্রাণ ভালই আসছে !! একটু এগিয়ে যায় মানুষটাকে দেখতে, একটা মেয়ে,সাদা রঙের জামা,খোলা চুল..... মেয়েটা ফিরে তাকাতেই শুভ্রর দুনিয়া যেন থমকে যায়।। চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকে। বলা বাহুল্য, এ তার সেই শত অপেক্ষার প্রহর আর বিনিদ্র রজনী জুড়ে থাকা রমণীরত্ন, নীলা। হঠাৎ মেয়েটার ডাক, 'শুনছেন '... শুভ্র ভাবে নীলা চিনেছে তাকে! !! তার বুকে যেন প্রাণ ফিরে আসে। - শুনছেন, আমাকে একটু সাহায্য করতে পারবেন ? আমার ফ্রেন্ড গুলার এখানে আসার কথা, অথচ একটাকেও খুঁজে পাচ্ছিনা। আমি আবার আমার ফোন টা ফেলে এসেছি! আপনার মোবাইল টা একটু দেওয়া যাবে প্লিজ? শুভ্র প্রমাদ গোনে মনে মনে,আবার ফোন!তবে খুশি ই হয়,ভাবে আমাকে মনে হয় চিনেনাই,ফোন দেখলে হয়ত চিনবে! - জ্বী অবশ্যই। (৩২ দাঁত বের করা একটা হাসি দিয়ে ) নীলা একটু অবাক হয়েই ফোনটা নেয়। কিন্তু শুভ্রর আশায় গুড়েবালি! চিনতে পারেনি তাকে ! কথা বলা শেষে শুকনো মুখে বলে, - জ্যামে পড়েছে ওরা! আপনি একটু আমার সাথে থেকে যদি সাহায্য করতেন.... - জ্বী জ্বী অবশ্যই, এত ভাল একটা কাজ করছেন। প্রায় দেড় ঘন্টা খেঁটে সব শেষ করে দুজনে মিলে। নীলার স্বতঃস্ফূর্ত হাসিতে শুভ্র ভুলে যায় সব ক্লান্তি। এরপর নীলা শুরু করে পরিচয়পর্ব। যেন কস্মিনকালেও শুভ্রকে চেনেনা! - " আমি নীলাঞ্জনা । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি।চারুকলার এই জায়গাটা আমার খুব পছন্দ আর এই বাচ্চাগুলোও। আমার জন্মদিন উপলক্ষে আজকের এই প্ল্যানটা করেছি। বদমাইশ ফ্রেন্ডগুলা! আগে রওনা দিতে পারেনা! - ওহহ! শুভ জন্মদিন ।:)- থ্যাংকস।যেটা বলতেসিলাম... ক্লাস শেষে আসতে বলসিলাম! অন্য ভার্সিটি তে ওরা। আর আপনি! আপনাকে এএএএত্তওও গুলা থ্যাংকস !! এত সাহায্য করলেন! দুপুরবেলা, কেউ নাই,আর কাউকে চিনিওনা ছাই! চলুন আমার সাথে লান্চ করবেন। " একনাগাড়ে গড়্গড় করে সব বলে যায়। - " বাব্বাহ! আপনার কথা শেষ হইল তাইলে! (মুচকি হেসে) লজ্জা পেয়ে যায় নীলা। - (হেসে) সরি, আসলে আমি এতই বেশি এক্সাইটেড যে ! - হুম,ব্যাপার নাহ! তাইলে আপনার ফ্রেন্ডদের জন্যে অপেক্ষা করেন,আমি এবার যাই ? - যাই মানে কি! আমার কথা কানে কিছুই যায়নাই? এতটাই বিরক্ত আপনি ! আজকের খাবারটা আমার রান্না করা,আমি আমাদের সবার জন্যে আলাদা করে আনসি।আপনাকে দিয়ে শুভ উদ্বোধন টা করব বুঝচ্ছেন? - না নাহ! কি যে বলেন!বিরক্ত হব কেন! কিন্ত, আ-আমার উপর এত্ত বড় অত্যাচার! - অত্যাচার !!!!! - না,আসলে... মানে,জীবনে প্রথম রাঁধলেন নাকি ? - ( শয়তানিমার্কা একটা হাসি দিয়ে ) খেয়েই বুঝবেন ! খাওয়া শেষে,শুভ্রর প্রথম উক্তি, - এরপর যখনি কখনো বিরিয়ানি খাব, আপনারটার কথা পাক্কা মনে পড়বে! ভাগ্যিস এখানে এসেছিলাম! - ওহ! মেনশন নট ! ক্ষুধার্তদের খাওয়াতে আমি বড় ভালবাসি! - হা হা হা... খাবারের সাথে খোঁচাটা হজম করে নিলাম!এমন সময় হৈ -চৈ করে কারা যেন নীলাকে ডাকতে শুরু করে,ওর ফ্রেন্ডরা চলে আসছে। - দেখেছেন! সবাই খেতে হাজির! আমি আসি তাহলে। আপনার সাহায্যের জন্যে আবারো অন্নেক থ্যাংকস!" শুভ্র মনে মনে আর্তনাদ করে ওঠে! কিন্তু কিভাবে বলবে বুঝতে পারেনা। কিছু ঠিক করার আগেই — - আর শুনুন,'আপনার চেহারা বিশ্বের কমন তম চেহারা না।আমার সারাজীবন মনে থাকবে....' এটুকু বলে,এক রহস্যময় হাসি দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় নীলা।
শুভ্রকে পাগল করে দেয়ার জন্য ওটুকুই যথেষ্ট ছিল।
কাহিনীটা নাটক সিনেমার হলে হয়ত ওদের হয়ত আবার কোথাও দেখা হত,একসময় হয়ত রিলেশন টা হয়েই যেত এতদিনে...!
কিন্তু বাস্তবের নীলাঞ্জনা রা হারিয়েই যায়.... তাদের খুঁজে পেতে যে মিরাকেলের দরকার হয় , সেটা খুব কম শুভ্র দের ভাগ্যেই ঘটে... অবশ্য চেষ্টা বলতে একটা কথা আছে, শুভ্রও কম করেনি সেটা... ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকটা অনুষদ খুঁজেছে পাগলের মতন। নীলা নামের পাঁচজন কে পেয়েছিল কিন্তু আফসোস,একজনও তার নীলাঞ্জনা না.. যে বাচ্চাগুলোকে সেদিন খাওয়েছিল,তাদেরকে জিজ্ঞেস করেও কোন পাত্তা পায়নি... ফেবুতেও অনেক খোঁজ নিয়েছিল..... অবাক হয়ে মাঝেমাঝে ভাবত মেয়েটা উধাও হয়ে গেল কেমনে! নাকি আমাকে ভুল ইনফরমেশন.... না না,তা কেন.... অবশেষে নিয়তির লিখন ভেবে মেনে নিয়েছে....
এই ক'দিনে নীলাঞ্জনা র প্রতি তার আবেগ কিভাবে সংজ্ঞায়িত করবে,বুঝতে পারেনা শুভ্র। এটাকে ঠিক প্রেম ও বলা যায়না আবার ক্রাশ পর্যন্ত ও আটকে ছিলনা...... কেমন যেন একটা অদ্ভুত আকর্ষণ!
বর্তমানে,শুভ্র অবশ্য আছে আরেক চিন্তায়।ওর ছোটবেলার বেস্ট ফ্রেন্ড শ্রাবন্তী কে নিয়ে... ওর আচার-আচরণ কেমন যেন বদলায়ে গেসে শুভ্রর প্রতি.... গাধীটা সারাক্ষণ হা করে তাকায়ে থাকে ওর দিকে ইদানিং .. শুভ্র অবশ্য নীলাঞ্জনা কে রেখে দিয়েছে মনের কোন এক জায়গায় ....কখনো কখনো মনে আসলে একটা হাসি একান ওকান হয়ে যায় এই আর কি .....।
# প্রতিদিন চলার পথে,যাত্রা পথে,অথবা যেকোন স্থানে...কত মানুষের সঙ্গেই দেখা হয় আমাদের। এর মধ্যে কাউকে কাউকে হয়ত বিশেষভাবে ভাল লেগে যায়।কিন্ত পরিস্থিতির কারণে,লজ্জা পেয়ে অথবা সম্পূর্ণ অচেনা কারো সাথে কিভাবে কথা বলা যায়..এরকম নানা দ্বন্দে কখনো সেই পরিচয় আর এগোয়না।কিন্তু কোন অবসর সময়ে,অবচেতন বা চেতনাগ্রস্ত মনের মাঝে সেই ঘটনার স্মৃতিচারণ মৃদু সুখানুভূতির দোলা লাগায়না,এ কথা হয়ত কেউ বলবেননা।
এই গল্পটা, #উৎসর্গ আমার সেইসব অজানা অচেনা #crush , অথবা আমার উপর #crush খাওয়া বেচারাদের প্রতি
বিকেল ৪ টা। 'বেইলি শর্মা হাউস' এর একেবারে গ্লাসের সাইডে বসেছে শুভ্র।এখানে আসলে বরাবরই এই সোফাটায় বসে সে।ভীষণ ভাললাগে কাঁচের ওপাশে ব্যস্ত শহরের কোলাহল দেখতে। সে বসে আছে তার বন্ধু আবিরের জন্য।কয়েকটা নোটস আর দুইটা গেমসের ডি.ভি.ডি. নিয়ে এখানেই আসার কথা ওর। তাই অপেক্ষা করতে করতে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছিল সে, চোখে পড়ছিল কিছু জোড়া মনের সুখে গল্প করছে,কার সাথে কাকে কেমন মানিয়েছে ভাবতে বেশ মজা পাচ্ছিল । শুক্রবার বিকেল বলে কোথাও একটুও ফাঁকা নেই,তার সোফাটা ছাড়া। দেখতে দেখতে হঠাৎ দেখে কাউন্টারে একটা মেয়ে,ভীষণ মিষ্টি চেহারার,তার প্রিয় নীল-সাদা রঙের শাড়ি পড়া, চোখে সুন্দর একটা ফ্রেমের চশমা। একরাশ কাল চুল পিঠে ছড়ানো। খাবারের অর্ডার দিচ্ছে,খুব তাড়াহুড়ায় আছে মনে হয়। অসহায়ভাবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে বসার জায়গা পাওয়ার আশায়। মনে মনে ভাবছে শুভ্র,'ইশ কি সুন্দর মেয়েটা! আমার পারফেক্ট ক্রাশ! নিশ্চয়ই বয়ফ্রেন্ড আছে,তার সাথেই দেখা করতে আসছে হয়ত। আজকালকার মেয়েরা আর কিছু পারুক আর না পারুক একটা বয়ফ্রেন্ড ঠিক ঝুলায়ে রাখবে সঙ্গে। ' নিজের জন্যে ভীষণ আফসোস হতে থাকে তার। বুয়েটের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সে।সবার মতে ভীষণ হ্যান্ডসাম দেখতে,অথচ এপর্যন্ত একটা নিষ্পাপ মিষ্টি মিষ্টি চেহারার মেয়ে পাইলনা সে ! ধ্যাৎ,জীবনটাই বৃথা ! মাঝে মাঝে তো তার থেকে দুই বছরের ছোট ভাগ্নে লজ্জা দেয় এই বলে যে, 'মাম্মা! তোমার তো ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখতেসি।আজ পর্যন্ত একটা মেয়ে পটাইতে পারলানা! তুমি তো আমার নাম ডুবাবা! ' উত্তরে মাথায় জোরে একটা গাট্টা দিয়ে বলে ,'হইসে আর পাকনামো করা লাগবেনা! নিজেরটা নিয়ে খুশি থাক। আমার জন্য কেউ না কেউ নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছে !' কিছুক্ষণের জন্যে সাহিত্যিক হয়ে ওঠা আর কি ! ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই হেসে ওঠে শুভ্র !
সাহিত্যের পোঁকা হওয়ায় উপন্যাসের নায়ক হিসেবে নিজেকে কল্পনা করতে ভালবাসত।কিন্তু কলেজে ভর্তি হয়ে যখন বাইরের জগতে খুঁজতে যায়,তখন কল্পনার সাথে মিল খুঁজে পায়না। আসলে এখনকার ফাস্ট যুগে,গল্প থেকে উঠে আসা নায়িকা পাওয়া মুশকিল ! একটা মেয়ে হয়ত ভালবাসে সাদা-সিধে একটা মধ্যবিত্ত ছেলেকে,কিন্ত যেই পরিবার থেকে বিজনেসম্যান ছেলে পছন্দ করা হল,ওমনি সুরসুর করে বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়ে ! সবাই ভীষণ অভিনয় বাজ,আর এই বিষয়টাই ওর সবচেয়ে অপছন্দ। নিজের জন্য এমন কাউকে খোঁজে,যে হয়ত ডানাকাটা পরী হবেনা,কিন্তু নিষ্পাপ একটা চেহারা হবে,যে তাকে সত্যিকারের ভালবাসবে।এতদিন মনে হত,তাড়া কিসের! সময় হলে হবেনে! কিন্ত ইদানিং নাটক - সিনেমা আর আশেপাশে দেখে মনে হয়,কাউকে অধিকার করতে পারার,কাউকে জীবন দিয়ে ভালবাসার খুব প্রয়োজন।। এমন একজনকে অবশ্য পেয়েও গেছিল,কিন্তু ... এমনই সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে একটা মিষ্টি কন্ঠে হুঁশ হয় তার। - এক্সকিউয মি,বসতে পারি ? তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে যায় সে,আরে! এ তো ঐ মেয়েটা ! চশমার আড়ালে কাজল কাল চোখের দিকে তাকিয়ে সব ভাষা হারিয়ে ফেলে সে যেন... - ইয়ে,মানে...আসলে...বলছিলাম কি... আমার একটা ফ্রেন্ডের জন্য ওয়েট করছিলাম। - সমস্যা নাই,আমার দশ মিনিটের মত লাগবে।আসলে আমার এক ফ্রেন্ড এর বাসায় অনুষ্ঠান। এখানে খাবারের অর্ডার দিয়েছিলাম, দিতে একটু সময় লাগবে, আর সব সিট ফিল আপ, তাই.. - জী,আ-আচ্ছা..বসুন তাহলে । এরপর ধন্যবাদ বিনিময়। - কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি ? - জ্বী,বলুন। - আপনি তখন ওভাবে তোতলাচ্ছিলেন,আপনার কি কথা বলায় সমস্যা আছে ? আরে এই মেয়ে কী বলে ! কলেজে কবিতা আবৃত্তিতে পুরস্কার পাই, আর আমি তোতলা ! কত্ত বড় ফাজিল ! মনে মনে এসব ভাবলেও মুখে একটা শুকনো হাসি ফুটিয়ে বলে, - জ্বী না। - ও আচ্ছা।
কি আজব সরি ও বলেনা ! কেমন বেত্তমিজ ! আবার মুচকি মুচকি হাসে ! এমনে তাকায়ে আছে, যেন জীবনেও ছেলে দেখেনাই ! মোবাইল টিপতে টিপতে এগুলাই ভাবতেসিল শুভ্র। এদিকে নীলাঞ্জনা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে শুভ্রর দিকে ! কেন যেন ছেলেটাকে খুব চেনা চেনা লাগছে,বলে দেখব নাকি ?না থাক এমনেই বেচারা মুখ কাল করে বসে আছে,খুব মজা লাগছে দেখতে! এমনসময় শুভ্র দেখে, কল আসে মেয়েটার, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে যেন! নিশ্চয়ই বয়ফ্রেন্ড এর ফোন,নাইলে এত হাসে! গোমড়া মুখে,কিছুটা সন্দেহের চোখে আর মুগ্ধনয়নে দেখছিল সে , ইশ কি সুন্দর হাসি ! মনে হচ্ছে যেন রিনিঝিনি সুরে হাতভর্তি কাঁচের চুড়ি বাজছে,নাকি মেয়েটার হাতের চুড়িই বাজছে ? নাহ!এটা হাসিরই শব্দ।
কথা বলা শেষ। একমূহুর্তের জন্য মনে হল,মেয়েটাকে আরেকবার হাসতে বলে...!হঠাৎ বেরসিক ওয়েটার এসে জানাল, 'ম্যাম,প্যাকেট রেডি।' শুভ্রর ইচ্ছে করছিল একটা ঘুসি মারতে ওয়েটারের মুখে।কি ভাল লাগছিল মেয়েটাকে ! আরো কিছুক্ষণ না হয় থাকত বসে ! মেয়েটা মোবাইলটা টেবিলে রেখে খাবার আনতে যায়।মেয়েটা বলছি কেন ! ইতিমধ্যে শুভ্র মনে মনে একটা নাম দিয়ে ফেলেছে, "নীলাবতী" অথবা" নীল পরী "। কিন্ত কোনটা বেশি মানাবে বুঝতে পারছেনা ! শেষমেশ সিদ্ধান্তে পৌছাল যে,নীল শাড়িতে,খোলা চুলে আর বেলী ফুলে, যাকে এত্ত সুন্দর মানিয়েছে, তার নাম হওয়া উচিত" নীলাম্বরী" নিজের কৃতিত্বে,নিজেই পুলকিত হয় সে। বাহ কি সুন্দর একটা নাম দিয়েছি! ^_^্হঠাৎ টেবিলে চোখ যায় তার। আরে!এটা তো আমার ফোনের মডেল! নাহ! সুন্দরীর চয়েস ও আছে বলতে হয় ! হঠাৎ আবির , মানে,যার জন্য অপেক্ষা করছিল সে,তার কল। ' কিরে দোস্ত,কই তুই ? আধা ঘন্টা ধরে বসায়ে রাখছিস!' উত্তরে বোঝে সে,জ্যাম এ আটকেছে ব্যাটা !আসতেসে।'উফ' বলে ফোনটা টেবিলে রাখে শুভ্র। এমনসময় ফিরে আসে নীলাম্বরী , ব্যাগ গুছাতে গুছাতে বলে, - শুনুন,আরেকটা কথা বলি ? - জ্বী বলুন,তখন থেকে তো বলেই যাচ্ছেন ! শুনে হাসতে হাসতে মেয়েটা বলে, - শুনতে বাংলা সিনেমার মত মনে হলেও, আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে,কোথায় দেখেছি বলুনতো ? - জ্বী,আল্লাহর রহমতে আমার চেহারা বিশ্বের অন্যতম কমনচেহারা,মেয়েদের সবসময়ই চেনা চেনা লাগে ! শুনে হা হয়ে যায় সে! বলে কী ছেলেটা,এমনে অপমান করল! নিজেকে ভাবে কি সে ? রণবীর কাপুর ? চেহারা একটু ভাল হইলেই হইসে,ছেলেদের ভাব এর জ্বালায় বাঁচা যায়নাহ ! হুহ! মুখ বাঁকিয়ে ,ফোনটা হাতে নিয়ে, চলে যায় ওখান থেকে। মনে মনে খুশি হয় শুভ্র। হুহ!আমারে পচাইতেসিলা না, এখন কেমন লাগল ?
অবশেষে অবশ্য তার নীলাম্বরীর চলে যাওয়া দেখে কিছুটা মন খারাপ হয় ! ইশ ! না জানি কার ভাগ্যে আছে তার "নীল পরী " যদিও একটু পচানিমার্কা কথা বলে !জন্মের পর মনে হয় মুখে মধুর পরিমাণ কম দিয়ে ফেলসিল ওর মা।তাতে কি ? আমি না হয় "ডেইরি মিল্ক সিল্ক" খাওয়ায়ে মিষ্টি মুখ করায়ে দিতাম ! দরজা থেকে চোখ ফেরে টেবিলের উপর,রিংটোনের আওয়াজ শুনে।কিন্তু আশ্চর্য হয় সে,আমার ফোনে আবার তাহসানের গানের রিংটোন হইল কবে থেকে ! বিস্ফোরিত চোখে কতক্ষণ ফোনটার দিকে তাকায়ে থাকে শুভ্র। বেজে চলছে - 'মাঝে মাঝে তোমায় ভেবে এলোমেলো লাগে সবই, মাঝে মাঝে তোমার চোখে, কে আঁকে অন্য ছবি '.....তাহসানের মধুময় কন্ঠে। স্ক্রিনে ভাসছে 'মেঘলা কলিং ' ,সাথে একটা মেয়ের লাস্যময়ী ছবি। শুভ্র স্মৃতির পাত্র হাতড়ে খুঁজতে থাকে ,এই নামে এমন চেহারার কোন মেয়েকে সে চেনে কিনা,চিনলেও তার কাছে নাম্বার গেল কেমনে ? আর গেলেও,এই মেয়ে আমাকে ফোন দিসে !!!ধাতস্থ হতে কিছুক্ষণ সময় লাগে তার। কি হয়েছে বুঝে উঠতেই সব ফেলে দরজার দিকে দৌড় দেয়।তিন চার লাফে সিঁড়ী পার হয়ে রাস্তায় পৌঁছে, এদিক - ওদিক খুঁজতে থাকে।যখন বোঝে যে তার দৃষ্টিসীমানার মধ্যে একমাত্র মাথার ওপরের আকাশ ছাড়া আর কোথাও নীল রং পরিহিতা কেউ নেই,রাগে, দু:খে নিজের মাথায় নিজেরই বাড়ি মারতে ইচ্ছা করে। মেয়েটার সৌন্দর্য তাকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে,আশেপাশের কিছুর দিকে কোনো খেয়াল ছিলনা। এখন বোঝ মজা ! 'আচ্ছা,মেয়েটাকে দেখে তো কত ভদ্র মনে হল,ও নিশ্চয়ই আমার ফোনটা চুরি করার জন্যে নেয়নি !অবশ্যই ভুলে নিয়েছে' নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দেয় যেন। 'আর যদি চোর হয়! প্রোফেশনাল পকেটমার না তো ! ওরা তো এমনই করে,সুন্দরী মেয়েদের দিয়ে...হয়ত মেয়েটার দোষ নাই কোনো, অভাবে পড়ে করতে হচ্ছে। ' ছি ছি !কি ভাবছি আমি! এত পবিত্রতা যার চেহারায়,সে কখনই এমন করতে পারেনা। আর ঐ হাসি, তাতে যে সরলতা ছিল.... , কক্ষণো না! নিজের সাথেই দ্বন্দে মেতে ওঠে শুভ্র। সম্বিত ফেরে আবার কলের শব্দে। উফ!এই মেয়ের ফোন তো বাজতেই থাকে! 'কত কথা বলে রে !' [ ক্ষণকালের জন্যে নীলাম্বরী, নীল পরী সব বিশেষণ বাদ ,এখন এই মেয়ে,শুধুই এই মেয়ে]
ফোনটা কেটে নিজের ফোনে কল দেয় সে,কিন্তু সুইচড অফ !!!! এইবার ওর মাথায় বাজ ! সত্যিই চুরি করসে নাকি !আমার নতুন Xperia-Z .... কল্পনায় কেমন যেন কাঁদো কাঁদো লাগে নিজের কন্ঠস্বর ! ক্রমাগত ট্রাই করে অবশেষে রাতে খোলা পাওয়া যায়, জানে যেন পানি ফিরে আসে শুভ্রর। ফোন করতেই,এক মিষ্টি কন্ঠস্বরে সে আবার মোহিত হয়ে যায়। কিন্ত ওপাশ থেকে যখন ঝাড়ি ভেসে আসে,- "এই যে,আপনি ফোন চুরি করলেন কেন আমার, হ্যা? একে তো অপরিচিত মেয়েদের অপমান করেন,তার উপর আবার চুরি করেন !সাহস তো কম না আপনার ! আপনার ফোন তো আছে আমার কাছে,RAB এর কাছে যদি ধরায়ে না দিসি,আমার নাম নীলা না! RAB এর ডি.আই.জি. আমার আপন মামা! আপনার বারোটা না বাজায়ে ছাড়ব না! ...." " আরে! এর নাম দেখি সত্যিই নীলা! মেয়েটার কথা মাথায় ঢুকছিল খুব কম কারণ সে এক নিশ্বাসে বলে যাইতেসে তো যাইতেসে.." শ্বাস নেওয়ার জন্য একটু থামতেই শুভ্র বলে, - ও হ্যাল্লো ম্যাডাম শোনেন,আমার কোন শখ নাই,আপনার পুরানো সেট চুরি করার,আমারটা একদম নতুন ছিল,একমাস আগে আমার খালামনি পাঠিয়েছে অস্ট্রেলিয়া থেকে,বুঝছেন ? আর বলেন তো ফোনটা নিয়ে চলে গেসিল কে ?আপনি না আমি? তাই দয়া করে আপনার বকবকানি বন্ধ রেখে,বলেন কোথায় আসবেন। - কি ! একে তো চুরি করেন,তারপর আবার বড় বড় কথা! আসবো মানে কি হ্যা? আপনি বল্লেই আমি আসবো ?নিজেকে মনে করেন কি বলেন তো, টম ক্রুজ ?.....' - মিস,আমি একটু বলি ? - না,আপনি শুধু শুনবেন,আমার এত সাধের ফোনটা নিয়ে গেসেন,আবার বলেন, "কোথায় আসবেন? " কেন ?আমি কি gf নাকি আপনার, যে আপনার বলার সাথে সাথে আহ্লাদে আটখানা হয়ে রওনা দিব ?' আহারে ফোনের শোকে মেয়েটার মাথা পুরাই গেসে ! কিছু বলতে গিয়ে হেসে ফেলে শুভ্র। ওপাশে নীলা বলেই যাচ্ছিল,কিন্ত হঠাৎ হাসির শব্দে যেন সে থমকে যায়। তার মনে হতে থাকে এই হাসির মালিককে আর যাই হোক বকা দেওয়া যায়না।এত প্রাণোচ্ছল যার আনন্দের প্রকাশ,সে কি মিথ্যা বলতে পারে ? চুপ হয়ে যায় সে। - কি ব্যাপার মিস,থামলেন কেন? আরো বলেন। গলা শুকায়ে গেসে? পানি দিব? হাসতে হাসতে বলে সে। নীলা তখনো চুপ।আসলেই সে এবার একটু লজ্জা পেয়ে যায়। অচেনা একজনকে তখন থেকে একভাবে বকেই যাচ্ছে, তার ফোনটাও তো আমার কাছে।- মিস নীলা,আপনাকে আমার gf হয়ে আসতে বলছিনা বিশ্বাস করুন, শুধু ফোনটা দিয়ে যেতে বলছি। এবার নীলা আর চুপ করে থাকতে পারলনা,হেসে দিল জোরে। মুহূর্তের জন্য শুভ্রর মনে হল, পৃথিবী যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে।তার কানে বাজছে শুধু সেই রিনরিনে শব্দ। মনে হচ্ছে শুধু দুটো লাইন, " কাঁচ ভাঙা হাসির শব্দে আমি এলোমেলো হয়ে যাই,আরেকবার সে শব্দ শুনতে আমি পৃথিবীর মালিকানা ছাড়তে রাজি আছি। " নীলাম্বরীকে আরেকবার হাসতে বলার পুরনো ইচ্ছেটা আবার নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিল।। কিন্ত না ,এবার নীলা স্বাভাবিক সুরেই বলল, - সরি ভাইয়া, আসলে ওটা হারানোর পর থেকে মাথা ঠিক নাই আমার।অনেক প্রিয় আমার এই সেট টা। - আরে আমার তো তার চেয়ে দ্বিগুণ প্রিয়। এমনকি আমার ফ্রেন্ড রা এটাকে আমার gf টাইটেল ও দিয়ে দিসিল। - (হেসে) জ্বী বুঝলাম,এবার আপনার gf কে ফেরত নিয়ে আমার ফোনটা দিলে খুশি হতাম।আজকে বিকালে আসেন, বসুন্ধরা সিটির ফুড কোর্টে ? - ( মুগ্ধ ) জ্বী জ্বী অবশ্যই। টাইম টা বলেন। - উমম.... ৪:৩০ ...? - ওকে, তাহলে ঐ কথাই থাকল। কিছু নীরবতার পর,নীলা যখন ফোন রাখতে যাবে, - মিস নীলা, আরেকটা অনুরোধ করতে পারি ? রাখবেন ? - অনুরোধ ! আমাকে! রাখব কি না তা তো বলতে পারিনা,আপনি বলে দেখতে পারেন। - আসলে,মানে....আপনার নামের মতই নীল ড্রেস- এ আপনাকে খুব মানায়... - (বিব্রত)...জ্বী ধন্যবাদ। রাখছি। শুভ্র একদম বোকা বনে গেল।কথাটা বলা ঠিক হল কিনা,বুঝলোনা। ' থাক ! বলে তো ফেলসিই।প্রশংসা কোন মেয়ে না পছন্দ করে ?এ ও নিশ্চয়ই করসে,একটু ভাব দেখাইল আর কি ...' নিজেকে সান্ত্বনা দেয় সে। বিকেলবেলা — ৪:৩০ শুভ্র কথামত দাঁড়িয়ে আছে এস্কেলেটর এর পাশে।নিচে তাকিয়ে উপর থেকে পুরো টা দেখছিল সে।খুব ভাললাগে তার এভাবে দেখতে।এমন সময় চোখ আটকে গেল একটা মেয়ের দিকে। আরে এই তো নীল পরী।আজকেও নীল পড়েছে।নীল,সাদা,সবুজ আর সোনালী রঙে মিশ্রিত একটা ড্রেস। অপূর্ব লাগছে দেখতে।নীল রঙের কথাটা বলাতে সে যে খুশি ই হয়েছে,বোঝা যাচ্ছে। শুভ্র কখনই 'love at first sight ' এ বিশ্বাসী না।মানুষের মনকে ভালবাসতেই ভাললাগে তার।কিন্ত এই মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে, ' কাউকে দেখলেই প্রেমে পড়া যায়না হয়ত,তবে প্রেমে পড়ার যে ইচ্ছাটা মনে জাগে,তাই বা কম কিসের।'
কিছুক্ষণের মধ্যেই নীলা পৌঁছাল।তার মনে শুধু এখন একটাই চিন্তা,ফোনটা ঠিক মতন ফেরত পাব তো ?সেদিন দেখে তো ভালই মনে হচ্ছিল। কথাবার্তাও ভদ্র।আল্লাহই জানে....!' নীলা উঠে আসে সিঁড়ী বেয়ে। অস্থির চোখে শুভ্রকে খুঁজে বেড়ায়।এবং মজার ব্যাপার শুভ্রর দিকে একবার নজর দিয়েও চোখ ফিরিয়ে নেয়। শুভ্রর খুব মজা লাগে নীলার অস্থির চেহারা দেখতে। সে দেখে নীলা গিয়ে কে.এফ.সি এর সামনে বসে। দু'মিনিট পর শুভ্র সেখানে গিয়ে বসল। নীলা প্রথমে কিছুক্ষণ তাকিয়ে প্রথম যে লাইনটা বলে, - আমার ফোনটা এনেছেন তো? দেন। শুভ্র ভাবছে, 'কেমন মেয়ে !ভাল-খারাপ কেমন আছি তা ও জিজ্ঞেস করলনা ! ' - জ্বী, আপনি আমারটা এনেছেন তো? - হুম,নিন.... অবশেষে এক শুষ্ক ফোন আদান প্রদান এর মধ্যে দিয়েই ঘটনার সমাপ্তি ঘটে। - থ্যাংকস। বলেই নীলা যেন উড়ে চলে যায়। শুভ্র কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে অবশেষে চলে যায়,কিছুটা মনমরা হয়েই। ভাবে মেয়েটা হয়ত এমনই,অমিশুক!
এরপর প্রায় এক মাস কেটে যায়। কোন অলস দুপুরে ,একলা বিকেলে অথবা বিষন্ন সন্ধ্যায় কিংবা নির্ঘুম রাত্রির সঙ্গে মিতালি পাতায় সে ' স্বপ্নিল নীলাম্বরীর ' সাথে। কোন সুন্দর মেয়ে দেখলেই আর ঝটপট 'ক্রাশ' এ পড়েনা, চশমা পড়া এক জোড়া কাজল-কালো চোখ যেন তার চোখে বাসা বেঁধেছে। শুভ্র সারাটাক্ষণই মেঘলার চিন্তায় বিভোর। বারবার তার মনে হয়, 'ইস!' বন্ধুরা ইতিমধ্যেই ওকে 'নীল ' নাম দিয়ে দিয়েছে ! কিন্তু মাসখানেক অনেক খোঁজাখুঁজি করেও না পেয়ে,তাকে হয়তোবা ভুলেই যেত শুভ্র, যদি না.....
সকাল থেকেই মনটা ভাল ছিল না। ভার্সিটির ক্লাস শেষ হতেই ক্যাম্পাস এ ঘুরতে বের হয়,একা একা। হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে চারুকলার দিকে।তার প্রিয় চা এর টং এ বসে আনমনে এদিকওদিক দেখছিল। দোকান থেকে কিছু দূরে একটা জটলা দেখতে পাচ্ছিল কিছু ফুল,চা,চকলেট, পেপার বিক্রেতা বাচ্চা জড় হয়ে আছে ; কে যেন খাওয়াচ্ছে তাদের,বিরিয়ানি,ঘ্রাণ ভালই আসছে !! একটু এগিয়ে যায় মানুষটাকে দেখতে, একটা মেয়ে,সাদা রঙের জামা,খোলা চুল..... মেয়েটা ফিরে তাকাতেই শুভ্রর দুনিয়া যেন থমকে যায়।। চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকে। বলা বাহুল্য, এ তার সেই শত অপেক্ষার প্রহর আর বিনিদ্র রজনী জুড়ে থাকা রমণীরত্ন, নীলা। হঠাৎ মেয়েটার ডাক, 'শুনছেন '... শুভ্র ভাবে নীলা চিনেছে তাকে! !! তার বুকে যেন প্রাণ ফিরে আসে। - শুনছেন, আমাকে একটু সাহায্য করতে পারবেন ? আমার ফ্রেন্ড গুলার এখানে আসার কথা, অথচ একটাকেও খুঁজে পাচ্ছিনা। আমি আবার আমার ফোন টা ফেলে এসেছি! আপনার মোবাইল টা একটু দেওয়া যাবে প্লিজ? শুভ্র প্রমাদ গোনে মনে মনে,আবার ফোন!তবে খুশি ই হয়,ভাবে আমাকে মনে হয় চিনেনাই,ফোন দেখলে হয়ত চিনবে! - জ্বী অবশ্যই। (৩২ দাঁত বের করা একটা হাসি দিয়ে ) নীলা একটু অবাক হয়েই ফোনটা নেয়। কিন্তু শুভ্রর আশায় গুড়েবালি! চিনতে পারেনি তাকে ! কথা বলা শেষে শুকনো মুখে বলে, - জ্যামে পড়েছে ওরা! আপনি একটু আমার সাথে থেকে যদি সাহায্য করতেন.... - জ্বী জ্বী অবশ্যই, এত ভাল একটা কাজ করছেন। প্রায় দেড় ঘন্টা খেঁটে সব শেষ করে দুজনে মিলে। নীলার স্বতঃস্ফূর্ত হাসিতে শুভ্র ভুলে যায় সব ক্লান্তি। এরপর নীলা শুরু করে পরিচয়পর্ব। যেন কস্মিনকালেও শুভ্রকে চেনেনা! - " আমি নীলাঞ্জনা । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি।চারুকলার এই জায়গাটা আমার খুব পছন্দ আর এই বাচ্চাগুলোও। আমার জন্মদিন উপলক্ষে আজকের এই প্ল্যানটা করেছি। বদমাইশ ফ্রেন্ডগুলা! আগে রওনা দিতে পারেনা! - ওহহ! শুভ জন্মদিন ।:)- থ্যাংকস।যেটা বলতেসিলাম... ক্লাস শেষে আসতে বলসিলাম! অন্য ভার্সিটি তে ওরা। আর আপনি! আপনাকে এএএএত্তওও গুলা থ্যাংকস !! এত সাহায্য করলেন! দুপুরবেলা, কেউ নাই,আর কাউকে চিনিওনা ছাই! চলুন আমার সাথে লান্চ করবেন। " একনাগাড়ে গড়্গড় করে সব বলে যায়। - " বাব্বাহ! আপনার কথা শেষ হইল তাইলে! (মুচকি হেসে) লজ্জা পেয়ে যায় নীলা। - (হেসে) সরি, আসলে আমি এতই বেশি এক্সাইটেড যে ! - হুম,ব্যাপার নাহ! তাইলে আপনার ফ্রেন্ডদের জন্যে অপেক্ষা করেন,আমি এবার যাই ? - যাই মানে কি! আমার কথা কানে কিছুই যায়নাই? এতটাই বিরক্ত আপনি ! আজকের খাবারটা আমার রান্না করা,আমি আমাদের সবার জন্যে আলাদা করে আনসি।আপনাকে দিয়ে শুভ উদ্বোধন টা করব বুঝচ্ছেন? - না নাহ! কি যে বলেন!বিরক্ত হব কেন! কিন্ত, আ-আমার উপর এত্ত বড় অত্যাচার! - অত্যাচার !!!!! - না,আসলে... মানে,জীবনে প্রথম রাঁধলেন নাকি ? - ( শয়তানিমার্কা একটা হাসি দিয়ে ) খেয়েই বুঝবেন ! খাওয়া শেষে,শুভ্রর প্রথম উক্তি, - এরপর যখনি কখনো বিরিয়ানি খাব, আপনারটার কথা পাক্কা মনে পড়বে! ভাগ্যিস এখানে এসেছিলাম! - ওহ! মেনশন নট ! ক্ষুধার্তদের খাওয়াতে আমি বড় ভালবাসি! - হা হা হা... খাবারের সাথে খোঁচাটা হজম করে নিলাম!এমন সময় হৈ -চৈ করে কারা যেন নীলাকে ডাকতে শুরু করে,ওর ফ্রেন্ডরা চলে আসছে। - দেখেছেন! সবাই খেতে হাজির! আমি আসি তাহলে। আপনার সাহায্যের জন্যে আবারো অন্নেক থ্যাংকস!" শুভ্র মনে মনে আর্তনাদ করে ওঠে! কিন্তু কিভাবে বলবে বুঝতে পারেনা। কিছু ঠিক করার আগেই — - আর শুনুন,'আপনার চেহারা বিশ্বের কমন তম চেহারা না।আমার সারাজীবন মনে থাকবে....' এটুকু বলে,এক রহস্যময় হাসি দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় নীলা।
শুভ্রকে পাগল করে দেয়ার জন্য ওটুকুই যথেষ্ট ছিল।
কাহিনীটা নাটক সিনেমার হলে হয়ত ওদের হয়ত আবার কোথাও দেখা হত,একসময় হয়ত রিলেশন টা হয়েই যেত এতদিনে...!
কিন্তু বাস্তবের নীলাঞ্জনা রা হারিয়েই যায়.... তাদের খুঁজে পেতে যে মিরাকেলের দরকার হয় , সেটা খুব কম শুভ্র দের ভাগ্যেই ঘটে... অবশ্য চেষ্টা বলতে একটা কথা আছে, শুভ্রও কম করেনি সেটা... ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকটা অনুষদ খুঁজেছে পাগলের মতন। নীলা নামের পাঁচজন কে পেয়েছিল কিন্তু আফসোস,একজনও তার নীলাঞ্জনা না.. যে বাচ্চাগুলোকে সেদিন খাওয়েছিল,তাদেরকে জিজ্ঞেস করেও কোন পাত্তা পায়নি... ফেবুতেও অনেক খোঁজ নিয়েছিল..... অবাক হয়ে মাঝেমাঝে ভাবত মেয়েটা উধাও হয়ে গেল কেমনে! নাকি আমাকে ভুল ইনফরমেশন.... না না,তা কেন.... অবশেষে নিয়তির লিখন ভেবে মেনে নিয়েছে....
এই ক'দিনে নীলাঞ্জনা র প্রতি তার আবেগ কিভাবে সংজ্ঞায়িত করবে,বুঝতে পারেনা শুভ্র। এটাকে ঠিক প্রেম ও বলা যায়না আবার ক্রাশ পর্যন্ত ও আটকে ছিলনা...... কেমন যেন একটা অদ্ভুত আকর্ষণ!
বর্তমানে,শুভ্র অবশ্য আছে আরেক চিন্তায়।ওর ছোটবেলার বেস্ট ফ্রেন্ড শ্রাবন্তী কে নিয়ে... ওর আচার-আচরণ কেমন যেন বদলায়ে গেসে শুভ্রর প্রতি.... গাধীটা সারাক্ষণ হা করে তাকায়ে থাকে ওর দিকে ইদানিং .. শুভ্র অবশ্য নীলাঞ্জনা কে রেখে দিয়েছে মনের কোন এক জায়গায় ....কখনো কখনো মনে আসলে একটা হাসি একান ওকান হয়ে যায় এই আর কি .....।
# প্রতিদিন চলার পথে,যাত্রা পথে,অথবা যেকোন স্থানে...কত মানুষের সঙ্গেই দেখা হয় আমাদের। এর মধ্যে কাউকে কাউকে হয়ত বিশেষভাবে ভাল লেগে যায়।কিন্ত পরিস্থিতির কারণে,লজ্জা পেয়ে অথবা সম্পূর্ণ অচেনা কারো সাথে কিভাবে কথা বলা যায়..এরকম নানা দ্বন্দে কখনো সেই পরিচয় আর এগোয়না।কিন্তু কোন অবসর সময়ে,অবচেতন বা চেতনাগ্রস্ত মনের মাঝে সেই ঘটনার স্মৃতিচারণ মৃদু সুখানুভূতির দোলা লাগায়না,এ কথা হয়ত কেউ বলবেননা।
এই গল্পটা, #উৎসর্গ আমার সেইসব অজানা অচেনা #crush , অথবা আমার উপর #crush খাওয়া বেচারাদের প্রতি
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন