আর কতক্ষণ মন খারাপ করে থাকবি? এত ফ্যাচফ্যাচ কাঁদুনে মার্কা ছেলে কখনো দেখিনি বাবা। আমি
মেয়ে হয়েও তো জীবনে এতবার মন খারাপ করিনি,তুই দিনে যতবার করিস!” এক নিঃশ্বাসে বকে যায় মুনা। তনয় আর মুনা,খুব ভাল বন্ধু। মেডিকালের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মুনা। তনয় কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং তৃতীয় বর্ষ। চুপচাপ শান্ত শিষ্ট ধরণের ছেলে তনয়। মায়াময় বিষণ্ণ দুটি চোখ। এই চোখ দেখেই আর ঝাড়ি দেয়া যায়না। মুনা যতই বকে। তনয় ততই মাথা নিচু করে থাকে। মায়া লাগে মুনার।
“চল তোকে চটপটি খাইয়ে নিয়ে আসি,তাহলে ওই মেয়ের ভূত বের হবে তোর মাথা থেকে “
“কোন কিছুতেই বের হবেনা। ভালবেসেছিস কখনো কাউকে? কিভাবে বুঝবি কেন এত বিষণ্ণ থাকি? খুব কাছের কেউ অবহেলা করলে বুঝতি রে মুনা অবহেলা কত কষ্টের। “
“আমার এত কিছু বোঝার দরকার নেই। এইসব ভালবাসা প্রেমের মধ্যে আমি নেই। যেমন আছি তেমনই ভাল। তোর মত বিষণ্ণতার পাল্লায় পড়ার শখ নেই আমার। চলতো, উঠ। “ তনয়কে নিয়ে চটপটি খেতে যায় মুনা। একটি মেয়েকে ভীষণ ভালবাসে তনয়। নাম দিশা। মেয়েটি তার বন্ধু,কিন্তু বন্ধুত্তের বাইরে পা বাড়াতে রাজি হয়না কখনও। তনয় বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছে মেয়েটিকে, কিন্তু সে যেন বুঝেও না বুঝার ভান করে তনয়ের অনুভূতিগুলোকে। মুনা সবসময় পাশে থাকে তনয়ের। তার সুখ,তার দুঃখ কোনকিছুই অজানা নয় মুনার। মুনার প্রতি মন থেকে কৃতজ্ঞতা বোধ করে তনয়। এই পাগলি মেয়েটা পাশে না থাকলে কে এত সামলাত তাকে? তার সব কষ্টের ঘ্যানর ঘ্যানর কে শুনত বিরক্ত না হয়ে? হাসিখুশি মেয়েটার পাশে থাকলে বেশিক্ষণ মন খারাপ করে থাকাও যায়না। মন ভাল করে তবেই ছাড়ে সে। এইভাবে দিন গড়াতে থাকে। হঠাৎ একদিন রাতে তনয়ের ফোনে ঘুম ভাঙ্গে মুনার। ভীষণ উৎফুল্ল শোনাচ্ছে তনয়ের কণ্ঠ।
“কি হয়েছে রে? রাত দুপুরে এভারেস্ট জয় করেছিস?” “তার চেয়েও বেশি। বলতো কি হয়েছে?”
“বললে বল নাইলে ফোন রাখ, ঘুমাতে দে আমাকে।“ “শুনলে আর ঘুমাতে পারবিনা খুশিতে।“
“মানে?“
“ মানে হচ্ছে দিশা বলেছে সে আমাদের বন্ধুত্বকে আরেকধাপ আগে বাড়াতে রাজি আছে!”
“ সত্যি?? অভিনন্দন দোস্ত,কালকে treat দে আমাকে”
“ পরে পরে। কালকে দিশার সাথে দেখা করতে যেতে হবে।”
“ ও আচ্ছা”
, খট করে কথা টা কানে লাগে মুনার। তার সাথে দেখা করার সময় নেই তনয়ের! তার সাথে!
“রাখি রে,দিশাকে ফোন দিব বলেছিলাম,পরে কথা হবে তর সাথে”
মুনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন রেখে দেয় তনয়। তনয় রেখে দেয়ার পর ও দীর্ঘ সময় ফোন কানে নিয়ে বসে থাকে মুনা। এমন লাগছে কেন? গলায় কি যেন দলা পেকে আছে মনে হচ্ছে। তনয় তাকে রেখে অন্য কাউকে সময় দিবে, গুরুত্ত দিবে মেনে নিতে পারছেনা সে। কিন্তু কেন? তিন বছরের দীর্ঘ বন্ধুত্তে কখনো এমন মনে হয়নি তার। আর তনয়ের বিষণ্ণতা মুক্ত কণ্ঠস্বর শুনে তার খুশি হওয়া উচিত। কিন্তু মনে হচ্ছে তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটিকে সে হারিয়ে ফেলেছে। তার সেই বিষণ্ণ চোখ জোড়াই যে মুনার সবচেয়ে প্রিয় ছিল। সারারাত জেগে কাটিয়ে দেয় মুনা। তনয় ঠিক ই বলেছিল, সারারাত মুনা ঘুমোতে পারবেনা “খুশিতে” খুব কম সময়ের ভিতরেই তনয়ের জীবনে মুনার জায়গাটা দিশার হয়ে যায়। মুনা নিরব চোখে তনয়ের বদলে যাওয়া দেখে। অনেক চুপচাপ হয়ে যেতে থাকে মুনা। ব্যাপারটা চোখ এড় ায়না তনয়ের। মুনাকে সে অনেক ভাল করে চিনে। একদিন বিকেলে মুনাকে দেখা করতে বলে তনয়। মাথা ব্যথার বাহানা দিয়ে এড়িয়ে যায় মুনা। কিন্তু তনয়ের অনুরোধে শেষমেশ রাজি হয় সে।
“কি হয়েছে তোর? এত চুপচাপ থাকিস কেন?”
“না তো ,এমনি”
“তোকে আমি চিনিনা ভেবেছিস? আমি জানি আমি তোকে সময় কম দেয়ায় খারাপ লাগছে তোর”
“কম??? হাসে মুনা।
“শেষ কবে আমাকে দরকার ছাড়া ফোন দিয়েছিস বলতো? তোর মন খারাপ থাকলেই মুনাকে লাগে। এছাড়া একবারও জিজ্ঞেস করেছিস কেমন আছি আমি? স্বার্থপর তুই।“
“আমি জানি মুনা তুই অনেক একা হয়ে গিয়েছিস। কিন্তু আমি যে অপারগ। কি করতে পারি আমি তুই বল?”
“আমি তোকে কিছু করতে বলেছি? তুই আসতে বলেছিস কেন আমাকে? আমি অনেক ভাল আছি,আমাকে নিয়ে ভাবতে হবেনা তোর।“
চলে যায় মুনা। তাকে কোনভাবেই শান্ত করতে পারেনি তনয়। তনয় কিভাবে বোঝায় মুনার জন্য তার গভীর মায়া কাজ করে। হাসিখুশি এই মেয়েটি তার সব খারাপ সময়ে তাকে আগলে রেখেছে। আসলেই স্বার্থপর সে। মুনা বুঝতে পারে সে তনয়কে অনেক ভালবাসে।তনয়ের জগত জুড়ে শুধু সেই ছিল তাই এই অনুভূতিকে আবিষ্কার করতে পারেনি আগে। তার জায়গাটায় অন্য কেউ বসে যাওয়াতে সে বুঝতে পারছে তনয় তার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মুনা ভাবে তনয়কে সব বুঝিয়ে বলে তার জীবন থেকে সরে আসবে সে। একদিন ফোন করে সব কথা খুলে বলে তনয়কে। চুপচাপ শুনে যায় তনয়। মুনার ভিতর চিৎকার করে বলতে থাকে প্লিজ তনয় আমাকে চলে যেতে দিস না, একটা বার আটকানোর চেষ্টা কর আমাকে।তুই ই যে আমার হাসির কারন ছিলি।তুই ছাড়া আমি কখন হাসতে পারবোনা রে। কিন্তু মুখে কিছুই বলেনা মুনা।শক্ত কণ্ঠে বলে
“ভাল থাকিস, আমার দূরে সরে যাওয়াটাই ভাল। কাছের মানুষের অবহেলার স্বাদ আমি পেতে চাইনা।“
তনয় বলে “আমাকে কিছু বলার সুযোগ তো ...” “না তনয়,আমি জানি কি বলবি তুই। করুণা চাইনা আমি। আমাকে সরে যেতে দে, দোহাই লাগে তোর। তুই সুখে থাক,তাতেই আমার চলবে”
ক্রমেই তাদের মধ্যকার দূরত্ব বাড়তে থাকে।তনয় মুনাকে ভালবাসার প্রতিদান দিতে পারেনি,কিন্তু তার বিষণ্ণতা টুকু পাকাপাকি ভাবে মুনার চোখে গেঁথে দিয়ে গেছে। কয়েক বছর পেরিয়ে যায়। তনয় বিয়ে করে দিশাকে, ফুটফুটে এক মেয়ে হয় তাদের। মুনার ও বিয়ে হয়ে যায়। সেই গভীর ক্ষত শুকিয়ে গেলেও তার চিহ্ন চাঁদের কলঙ্কের মত মুনার মনে ভেসে থাকে। সময় সব ঠিক করে দেয়না সব সময়। সংসার কে নিজের করে সাজাতে ব্যর্থ হয় মুনা। এক অসঙ্গায়িত ক্লান্তি তাড়া করে বেড়ায় তাকে প্রতিনিয়ত। ভালবাসা হীন সংসারের ঘানি টানতে না পেরে একসময় হাল ছাড়ে সে।ফলাফল বিচ্ছেদ।।
কয়েক বছর পরের কথা। চাইল্ড স্পেশালিষ্ট ডাঃ মুনা জামান। চেম্বারে রোগীর ভিড়। “নেক্সট রোগী পাঠাও” ছোট্ট একটা মেয়ে রুমে ঢুকে। অসম্ভব সুন্দর চোখ। পিছনে মেয়ের বাবা। কেঁপে উঠে মুনা তাকে দেখে। তনয়। কত্ত বছর পর দেখা। শুকিয়ে গেছে অনেক। চোখে আবারও সেই বিষণ্ণতার ছাপ। চিনচিনে ব্যথা করে উঠে মুনার বুকে। বসতে বলে মুনা। কিছুক্ষণ অস্বস্তিকর নীরবতা। কেমন আছ মুনা? মুনা হাসে,জবাব দেয়না।
“কি নাম তোমার বাবু?’
“আমার নাম তানজিন”
“কোনও সমস্যা ওর ?”
তনয়কে জিজ্ঞেস করে মুনা।
“হুম, জ্বর কয়েকদিন থেকে খুব”
“ওই ব্যাড এ আস,দেখি কি হয়েছে তোমার।“ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে দেখল মুনা। চোখ কেন জানি বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে। তনয়ের মেয়ে! কেমন অদ্ভুত এক শিহরণ লাগে মুনার।
“তোমার আম্মু কেমন আছে,মা?”
“মা তো কোথায় যেন চলে গেছে। বাবা বলে আকাশের তারা হয়ে গেছে মা।“
ধক করে উঠে মুনার বুকে। তনয়ের বিষণ্ণ চোখের কারন বুঝতে পারে সে। বড় একা হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। কেউ কি পাশে ছিল তার এত খারাপ সময়ে? তনয় একদম একা থাকতে পারেনা।কিভাবে সামলাল নিজেকে?
“তুমি বাবার পাশে গিয়ে বস,আমি আসছি” ওয়াশ রুমে গিয়ে অঝর ধারায় কাঁদতে থাকে মুনা। এতবছর পর ও এত বেশি কষ্ট হচ্ছে কেন তার? সব অনুভূতিকে তো সে কবেই মাটি চাপা দিয়ে দিয়েছিল। তবে কেন এত খারাপ লাগছে তনয়ের শুকনো মুখ খানা দেখে? যার জন্য এতটা বছর মরে মরে বেঁচেছে সে,তাকে বিষণ্ণ দেখে কি এক পৈচাশিক আনন্দ পাবার কথা নয় তার? নিজেকেই ধমক লাগায় মুনা। চোখ মুছে বাইরে বেরিয়ে আসে। তনয় মুনার দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারে মুনা কাঁদছিল। কান্নার পর নাকের ডগা লাল হয়ে যাওয়া এই মেয়েটিকে সে বর ভাল করে চিনে। কিন্তু সে যে বড় অসহায় ছিল। কিছুই করতে পারেনি মুনার জন্য। মুনার বিয়ে,বিচ্ছেদ সব খবর ই নিয়েছে সে। কিন্তু কি করার ছিল তার? আচ্ছা এখন কি সব আগের মত করা সম্ভব না? যে আনন্দের দেখা মুনা কখনো পায়নি,বাকি জীবনটা সেই আনন্দ দিয়ে ভরিয়ে দেয়া যায়না? মুনাকে কি বলে দেখা উচিত? নাকি আবারও স্বার্থপর ভাব্বে আমাকে? এত গভীর মমতা অনুভব করছি কেন মেয়েটার কান্না ভেজা চোখ দেখে? এতবছর পরও এত ভালবাসে আমাকে? সেদিনের মত বিদায় নেয় তনয়। রাতে ফোন করে মুনাকে।
“আমার সাথে একটু দেখা করবে মুনা?”
“কেন?”
“কিছু কথা ছিল।“
“হুম।“
যাবেনা ভেবেও নিজেকে বেঁধে রাখতে পারেনা মুনা। দেখে মনে হয় সেই আগের তনয়কে দেখছে সে। বিষণ্ণ চোখ। দেখলেই যাকে ভালবাসতে ইচ্ছা করে। মনে মনে তার প্রিয় কিছু লাইন বলে মুনা।
“হয়ত তুমি কাছেই আছ, তবু তোমায় ছুঁতে কি পাই, তোমার বুকে ব্যথা ছিল কেমন করে কথা দিয়ে সেই ব্যথাতে আঙুল বুলাই”
অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে দুইজন।
“কেমন ছিলে মুনা?”
“ভাল...”
“মিথ্যা বলছ কেন?”
“ সব যখন জানই তো জিজ্ঞেস করছ কেন?”
“তোমাকে আমি সুখী দেখতে চাই মুনা”
মানুষের সব চাওয়া পূরণ হয়না” কিন্তু তুমি চাইলেই তা হয়”
“কিভাবে?”
“মাঝখানের কয়েকটা বছর মুছে ফেলো,আমি তোমাকে ভাল রাখতে চাই।“
“কেন?”
“অনেক কষ্ট পেয়েছ তুমি, তোমার মত ভাল একটা মেয়ের এত কষ্ট প্রাপ্য না”
“করুণা করতে চাচ্ছ? করুনা চাইনা বলে আগেও সরে এসেছিলাম, এত বছর পর আবার সেই করুণার ডালি নিয়ে এসেছ?”
“করুণা নয় মুনা, বিশ্বাস কর”
“তবে কি? আমি ভাল ছিলাম না জেনে এখন করুণা করে ভাল রাখতে চাইছ আমাকে”
“কি বললে বিশ্বাস করবে বল?”
“প্লিজ তনয়, আমি আমার অনুভূতি গুলো নিয়েই বেঁচে ছিলাম,আছি। করুণার নিচে চাপা দিয়ে আমার অনুভূতির শুদ্ধতা নষ্ট করে দিওনা।“
“আমাকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখ।“
“না তনয়। তুমি কখনই দিশার জায়গা আমাকে দিতে পারবেনা মন থেকে। তুমি ই তো বলতে কাছের মানুষের অবহেলা সহ্য করা যায়না। আমাদের মাঝখানে দিশা অদৃশ্য দেয়াল হয়ে থাকবে। আমি পারবনা তোমার করুণা,তোমার অবহেলা নিয়ে বাঁচতে”
তনয়কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাঁটতে থাকে মুনা। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। মুনা হেঁটে চলে। প্রাপ্তির শেষ শেষ সীমানায় এসে কেন অপ্রাপ্তিকে বরণ করে নিল জানা নেই তার। চাইলেই পারত তনয়ের হাত টেনে নিয়ে। কিন্তু অবহেলা, করুণা মিশ্রিত জীবন থেকে তার অনুভূতি গুলোই তার কাছে দামি।
“বড় অসময়ে এসে তুমি স্মৃতি চিহ্ন রেখে যাও
বড় অসময়ে এসে বসে থাক অচেতন ভুবনে,
অসময়ে এসেছ বলে অসময় হয়েছে সময়
বেদনায় এসেছ বলে বেদনাই তীর্থ আমার”.........।।
মেয়ে হয়েও তো জীবনে এতবার মন খারাপ করিনি,তুই দিনে যতবার করিস!” এক নিঃশ্বাসে বকে যায় মুনা। তনয় আর মুনা,খুব ভাল বন্ধু। মেডিকালের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মুনা। তনয় কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং তৃতীয় বর্ষ। চুপচাপ শান্ত শিষ্ট ধরণের ছেলে তনয়। মায়াময় বিষণ্ণ দুটি চোখ। এই চোখ দেখেই আর ঝাড়ি দেয়া যায়না। মুনা যতই বকে। তনয় ততই মাথা নিচু করে থাকে। মায়া লাগে মুনার।
“চল তোকে চটপটি খাইয়ে নিয়ে আসি,তাহলে ওই মেয়ের ভূত বের হবে তোর মাথা থেকে “
“কোন কিছুতেই বের হবেনা। ভালবেসেছিস কখনো কাউকে? কিভাবে বুঝবি কেন এত বিষণ্ণ থাকি? খুব কাছের কেউ অবহেলা করলে বুঝতি রে মুনা অবহেলা কত কষ্টের। “
“আমার এত কিছু বোঝার দরকার নেই। এইসব ভালবাসা প্রেমের মধ্যে আমি নেই। যেমন আছি তেমনই ভাল। তোর মত বিষণ্ণতার পাল্লায় পড়ার শখ নেই আমার। চলতো, উঠ। “ তনয়কে নিয়ে চটপটি খেতে যায় মুনা। একটি মেয়েকে ভীষণ ভালবাসে তনয়। নাম দিশা। মেয়েটি তার বন্ধু,কিন্তু বন্ধুত্তের বাইরে পা বাড়াতে রাজি হয়না কখনও। তনয় বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছে মেয়েটিকে, কিন্তু সে যেন বুঝেও না বুঝার ভান করে তনয়ের অনুভূতিগুলোকে। মুনা সবসময় পাশে থাকে তনয়ের। তার সুখ,তার দুঃখ কোনকিছুই অজানা নয় মুনার। মুনার প্রতি মন থেকে কৃতজ্ঞতা বোধ করে তনয়। এই পাগলি মেয়েটা পাশে না থাকলে কে এত সামলাত তাকে? তার সব কষ্টের ঘ্যানর ঘ্যানর কে শুনত বিরক্ত না হয়ে? হাসিখুশি মেয়েটার পাশে থাকলে বেশিক্ষণ মন খারাপ করে থাকাও যায়না। মন ভাল করে তবেই ছাড়ে সে। এইভাবে দিন গড়াতে থাকে। হঠাৎ একদিন রাতে তনয়ের ফোনে ঘুম ভাঙ্গে মুনার। ভীষণ উৎফুল্ল শোনাচ্ছে তনয়ের কণ্ঠ।
“কি হয়েছে রে? রাত দুপুরে এভারেস্ট জয় করেছিস?” “তার চেয়েও বেশি। বলতো কি হয়েছে?”
“বললে বল নাইলে ফোন রাখ, ঘুমাতে দে আমাকে।“ “শুনলে আর ঘুমাতে পারবিনা খুশিতে।“
“মানে?“
“ মানে হচ্ছে দিশা বলেছে সে আমাদের বন্ধুত্বকে আরেকধাপ আগে বাড়াতে রাজি আছে!”
“ সত্যি?? অভিনন্দন দোস্ত,কালকে treat দে আমাকে”
“ পরে পরে। কালকে দিশার সাথে দেখা করতে যেতে হবে।”
“ ও আচ্ছা”
, খট করে কথা টা কানে লাগে মুনার। তার সাথে দেখা করার সময় নেই তনয়ের! তার সাথে!
“রাখি রে,দিশাকে ফোন দিব বলেছিলাম,পরে কথা হবে তর সাথে”
মুনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন রেখে দেয় তনয়। তনয় রেখে দেয়ার পর ও দীর্ঘ সময় ফোন কানে নিয়ে বসে থাকে মুনা। এমন লাগছে কেন? গলায় কি যেন দলা পেকে আছে মনে হচ্ছে। তনয় তাকে রেখে অন্য কাউকে সময় দিবে, গুরুত্ত দিবে মেনে নিতে পারছেনা সে। কিন্তু কেন? তিন বছরের দীর্ঘ বন্ধুত্তে কখনো এমন মনে হয়নি তার। আর তনয়ের বিষণ্ণতা মুক্ত কণ্ঠস্বর শুনে তার খুশি হওয়া উচিত। কিন্তু মনে হচ্ছে তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটিকে সে হারিয়ে ফেলেছে। তার সেই বিষণ্ণ চোখ জোড়াই যে মুনার সবচেয়ে প্রিয় ছিল। সারারাত জেগে কাটিয়ে দেয় মুনা। তনয় ঠিক ই বলেছিল, সারারাত মুনা ঘুমোতে পারবেনা “খুশিতে” খুব কম সময়ের ভিতরেই তনয়ের জীবনে মুনার জায়গাটা দিশার হয়ে যায়। মুনা নিরব চোখে তনয়ের বদলে যাওয়া দেখে। অনেক চুপচাপ হয়ে যেতে থাকে মুনা। ব্যাপারটা চোখ এড় ায়না তনয়ের। মুনাকে সে অনেক ভাল করে চিনে। একদিন বিকেলে মুনাকে দেখা করতে বলে তনয়। মাথা ব্যথার বাহানা দিয়ে এড়িয়ে যায় মুনা। কিন্তু তনয়ের অনুরোধে শেষমেশ রাজি হয় সে।
“কি হয়েছে তোর? এত চুপচাপ থাকিস কেন?”
“না তো ,এমনি”
“তোকে আমি চিনিনা ভেবেছিস? আমি জানি আমি তোকে সময় কম দেয়ায় খারাপ লাগছে তোর”
“কম??? হাসে মুনা।
“শেষ কবে আমাকে দরকার ছাড়া ফোন দিয়েছিস বলতো? তোর মন খারাপ থাকলেই মুনাকে লাগে। এছাড়া একবারও জিজ্ঞেস করেছিস কেমন আছি আমি? স্বার্থপর তুই।“
“আমি জানি মুনা তুই অনেক একা হয়ে গিয়েছিস। কিন্তু আমি যে অপারগ। কি করতে পারি আমি তুই বল?”
“আমি তোকে কিছু করতে বলেছি? তুই আসতে বলেছিস কেন আমাকে? আমি অনেক ভাল আছি,আমাকে নিয়ে ভাবতে হবেনা তোর।“
চলে যায় মুনা। তাকে কোনভাবেই শান্ত করতে পারেনি তনয়। তনয় কিভাবে বোঝায় মুনার জন্য তার গভীর মায়া কাজ করে। হাসিখুশি এই মেয়েটি তার সব খারাপ সময়ে তাকে আগলে রেখেছে। আসলেই স্বার্থপর সে। মুনা বুঝতে পারে সে তনয়কে অনেক ভালবাসে।তনয়ের জগত জুড়ে শুধু সেই ছিল তাই এই অনুভূতিকে আবিষ্কার করতে পারেনি আগে। তার জায়গাটায় অন্য কেউ বসে যাওয়াতে সে বুঝতে পারছে তনয় তার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মুনা ভাবে তনয়কে সব বুঝিয়ে বলে তার জীবন থেকে সরে আসবে সে। একদিন ফোন করে সব কথা খুলে বলে তনয়কে। চুপচাপ শুনে যায় তনয়। মুনার ভিতর চিৎকার করে বলতে থাকে প্লিজ তনয় আমাকে চলে যেতে দিস না, একটা বার আটকানোর চেষ্টা কর আমাকে।তুই ই যে আমার হাসির কারন ছিলি।তুই ছাড়া আমি কখন হাসতে পারবোনা রে। কিন্তু মুখে কিছুই বলেনা মুনা।শক্ত কণ্ঠে বলে
“ভাল থাকিস, আমার দূরে সরে যাওয়াটাই ভাল। কাছের মানুষের অবহেলার স্বাদ আমি পেতে চাইনা।“
তনয় বলে “আমাকে কিছু বলার সুযোগ তো ...” “না তনয়,আমি জানি কি বলবি তুই। করুণা চাইনা আমি। আমাকে সরে যেতে দে, দোহাই লাগে তোর। তুই সুখে থাক,তাতেই আমার চলবে”
ক্রমেই তাদের মধ্যকার দূরত্ব বাড়তে থাকে।তনয় মুনাকে ভালবাসার প্রতিদান দিতে পারেনি,কিন্তু তার বিষণ্ণতা টুকু পাকাপাকি ভাবে মুনার চোখে গেঁথে দিয়ে গেছে। কয়েক বছর পেরিয়ে যায়। তনয় বিয়ে করে দিশাকে, ফুটফুটে এক মেয়ে হয় তাদের। মুনার ও বিয়ে হয়ে যায়। সেই গভীর ক্ষত শুকিয়ে গেলেও তার চিহ্ন চাঁদের কলঙ্কের মত মুনার মনে ভেসে থাকে। সময় সব ঠিক করে দেয়না সব সময়। সংসার কে নিজের করে সাজাতে ব্যর্থ হয় মুনা। এক অসঙ্গায়িত ক্লান্তি তাড়া করে বেড়ায় তাকে প্রতিনিয়ত। ভালবাসা হীন সংসারের ঘানি টানতে না পেরে একসময় হাল ছাড়ে সে।ফলাফল বিচ্ছেদ।।
কয়েক বছর পরের কথা। চাইল্ড স্পেশালিষ্ট ডাঃ মুনা জামান। চেম্বারে রোগীর ভিড়। “নেক্সট রোগী পাঠাও” ছোট্ট একটা মেয়ে রুমে ঢুকে। অসম্ভব সুন্দর চোখ। পিছনে মেয়ের বাবা। কেঁপে উঠে মুনা তাকে দেখে। তনয়। কত্ত বছর পর দেখা। শুকিয়ে গেছে অনেক। চোখে আবারও সেই বিষণ্ণতার ছাপ। চিনচিনে ব্যথা করে উঠে মুনার বুকে। বসতে বলে মুনা। কিছুক্ষণ অস্বস্তিকর নীরবতা। কেমন আছ মুনা? মুনা হাসে,জবাব দেয়না।
“কি নাম তোমার বাবু?’
“আমার নাম তানজিন”
“কোনও সমস্যা ওর ?”
তনয়কে জিজ্ঞেস করে মুনা।
“হুম, জ্বর কয়েকদিন থেকে খুব”
“ওই ব্যাড এ আস,দেখি কি হয়েছে তোমার।“ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে দেখল মুনা। চোখ কেন জানি বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে। তনয়ের মেয়ে! কেমন অদ্ভুত এক শিহরণ লাগে মুনার।
“তোমার আম্মু কেমন আছে,মা?”
“মা তো কোথায় যেন চলে গেছে। বাবা বলে আকাশের তারা হয়ে গেছে মা।“
ধক করে উঠে মুনার বুকে। তনয়ের বিষণ্ণ চোখের কারন বুঝতে পারে সে। বড় একা হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। কেউ কি পাশে ছিল তার এত খারাপ সময়ে? তনয় একদম একা থাকতে পারেনা।কিভাবে সামলাল নিজেকে?
“তুমি বাবার পাশে গিয়ে বস,আমি আসছি” ওয়াশ রুমে গিয়ে অঝর ধারায় কাঁদতে থাকে মুনা। এতবছর পর ও এত বেশি কষ্ট হচ্ছে কেন তার? সব অনুভূতিকে তো সে কবেই মাটি চাপা দিয়ে দিয়েছিল। তবে কেন এত খারাপ লাগছে তনয়ের শুকনো মুখ খানা দেখে? যার জন্য এতটা বছর মরে মরে বেঁচেছে সে,তাকে বিষণ্ণ দেখে কি এক পৈচাশিক আনন্দ পাবার কথা নয় তার? নিজেকেই ধমক লাগায় মুনা। চোখ মুছে বাইরে বেরিয়ে আসে। তনয় মুনার দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারে মুনা কাঁদছিল। কান্নার পর নাকের ডগা লাল হয়ে যাওয়া এই মেয়েটিকে সে বর ভাল করে চিনে। কিন্তু সে যে বড় অসহায় ছিল। কিছুই করতে পারেনি মুনার জন্য। মুনার বিয়ে,বিচ্ছেদ সব খবর ই নিয়েছে সে। কিন্তু কি করার ছিল তার? আচ্ছা এখন কি সব আগের মত করা সম্ভব না? যে আনন্দের দেখা মুনা কখনো পায়নি,বাকি জীবনটা সেই আনন্দ দিয়ে ভরিয়ে দেয়া যায়না? মুনাকে কি বলে দেখা উচিত? নাকি আবারও স্বার্থপর ভাব্বে আমাকে? এত গভীর মমতা অনুভব করছি কেন মেয়েটার কান্না ভেজা চোখ দেখে? এতবছর পরও এত ভালবাসে আমাকে? সেদিনের মত বিদায় নেয় তনয়। রাতে ফোন করে মুনাকে।
“আমার সাথে একটু দেখা করবে মুনা?”
“কেন?”
“কিছু কথা ছিল।“
“হুম।“
যাবেনা ভেবেও নিজেকে বেঁধে রাখতে পারেনা মুনা। দেখে মনে হয় সেই আগের তনয়কে দেখছে সে। বিষণ্ণ চোখ। দেখলেই যাকে ভালবাসতে ইচ্ছা করে। মনে মনে তার প্রিয় কিছু লাইন বলে মুনা।
“হয়ত তুমি কাছেই আছ, তবু তোমায় ছুঁতে কি পাই, তোমার বুকে ব্যথা ছিল কেমন করে কথা দিয়ে সেই ব্যথাতে আঙুল বুলাই”
অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে দুইজন।
“কেমন ছিলে মুনা?”
“ভাল...”
“মিথ্যা বলছ কেন?”
“ সব যখন জানই তো জিজ্ঞেস করছ কেন?”
“তোমাকে আমি সুখী দেখতে চাই মুনা”
মানুষের সব চাওয়া পূরণ হয়না” কিন্তু তুমি চাইলেই তা হয়”
“কিভাবে?”
“মাঝখানের কয়েকটা বছর মুছে ফেলো,আমি তোমাকে ভাল রাখতে চাই।“
“কেন?”
“অনেক কষ্ট পেয়েছ তুমি, তোমার মত ভাল একটা মেয়ের এত কষ্ট প্রাপ্য না”
“করুণা করতে চাচ্ছ? করুনা চাইনা বলে আগেও সরে এসেছিলাম, এত বছর পর আবার সেই করুণার ডালি নিয়ে এসেছ?”
“করুণা নয় মুনা, বিশ্বাস কর”
“তবে কি? আমি ভাল ছিলাম না জেনে এখন করুণা করে ভাল রাখতে চাইছ আমাকে”
“কি বললে বিশ্বাস করবে বল?”
“প্লিজ তনয়, আমি আমার অনুভূতি গুলো নিয়েই বেঁচে ছিলাম,আছি। করুণার নিচে চাপা দিয়ে আমার অনুভূতির শুদ্ধতা নষ্ট করে দিওনা।“
“আমাকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখ।“
“না তনয়। তুমি কখনই দিশার জায়গা আমাকে দিতে পারবেনা মন থেকে। তুমি ই তো বলতে কাছের মানুষের অবহেলা সহ্য করা যায়না। আমাদের মাঝখানে দিশা অদৃশ্য দেয়াল হয়ে থাকবে। আমি পারবনা তোমার করুণা,তোমার অবহেলা নিয়ে বাঁচতে”
তনয়কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাঁটতে থাকে মুনা। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। মুনা হেঁটে চলে। প্রাপ্তির শেষ শেষ সীমানায় এসে কেন অপ্রাপ্তিকে বরণ করে নিল জানা নেই তার। চাইলেই পারত তনয়ের হাত টেনে নিয়ে। কিন্তু অবহেলা, করুণা মিশ্রিত জীবন থেকে তার অনুভূতি গুলোই তার কাছে দামি।
“বড় অসময়ে এসে তুমি স্মৃতি চিহ্ন রেখে যাও
বড় অসময়ে এসে বসে থাক অচেতন ভুবনে,
অসময়ে এসেছ বলে অসময় হয়েছে সময়
বেদনায় এসেছ বলে বেদনাই তীর্থ আমার”.........।।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন