সুন্দরী মেয়েবদ্ধ ঘরটাতে পায়চারী করছি। কিছু একটা ভাঙতে ইচ্ছে হচ্ছে। মোবাইলটা তুলে নিয়েও দ্রুত ড্রয়ারে রেখে
তালা লাগিয়ে দিলাম। মধ্যবিত্তদের এরকম ভাঙচূড় করার শখ রাখতে নেই। কিন্তু আজকে রাগটা কিছুতেই কমছে না। কিছু একটা করতেই হবে! হঠাত্ নজর পড়ল আর্মি নাইফটার দিকে। শান দিয়ে ধারাল করে নিয়েছি। খুবই কাজের জিনিস। হঠাত্ মনে পড়ল আমি চলে গেলে বাবামার কি হবে, ছোট্ট বোনটার কি হবে? নাহ! ওদের জন্য ছোট ভাইটা, ওর বউ আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে এক মুহুর্তে মনস্থির করে ফেললাম। ঝটপট ব্যাগে কাপড়চোপড় আরও টুকিটাকি জরুরি জিনিস নিয়ে নিলাম। এভাবে আর সহ্য করা যায় না! সবাই শুয়ে পড়েছে। বাবামার ঘরে একবার উঁকি দিয়ে তাদের শেষবারের মত দেখে নিলাম। ছোট পৃথা এইটুকু বয়সেই আমার মত এক থাকতে শিখে গেছে। ওর জন্য আলাদা করা ঘরটাতে নিঃশব্দে ঢুকলাম। দেবশিশুর মত চুপটি করে ঘুমিয়ে আছে আমার বোনটা। ওর ছোট হাতটা ধরে নিঃশব্দ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। আমার ছোট্ট পরীটা যেন ঘুমের ভেতরেই টের পেয়ে গেল আমার কষ্ট। আমার গলা জড়িয়ে ছোট মুখখানা আমার কাঁধে গুজে দিল। ওর হাতের কালশিটেটা দেখে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। ওর হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে বেড়িয়ে এলাম।

হেঁটেই চলে এলাম রেলস্টেশনে। জানতে পারলাম পরবর্তী ট্রেন ছাড়বে ভোর পাঁচটায়। আরও চার ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। স্টেশনের একটা খালি বেন্ঞ্চে এসে বসলাম। আমি আর্জু হাসান। আমি জন্মগতভাবে প্রতিবন্ধী। দেখে স্বাভাবিক মনে হলেও আমি স্বাভাবিক নই। সাধারণ মানুষদের মত নতুন নতুন জিনিসের সাথে আমি সখ্যতা গড়ে তুলতে পারিনা। আমি নতুন মানুষদের ভীষণ ভয় পাই। ছোটবেলা থেকেই সবসময় আড়ালে আড়ালে থেকেছি সবার থেকে। বাবামা আমি স্বাভাবিক নই জানতে পারার পর থেকে আমার প্রতি অবহেলা শুরু করে। করবে নাই বা কেন? ঘরের বড়ছেলে আমি অথচ এরকম অস্বাভাবিক! তাদের এরকম অকমর্ন্য ভীতু ছেলেকে পালার কোন ইচ্ছে নেই। আমাদের বাড়ির পাশে এক নদী ছিল, সারাদিন নদীর পাড়েই আমার কেটে যেত। নদীর সাথে কথা বলতাম। এরপর আরিফের জন্ম হল। ওকে নিয়ে বাবামার সুখের অন্ত ছিল না। আরিফের জন্ম উপলক্ষে আমাদের দূরের কাছের বেশ কয়েকজন আত্নীয়কে দাওয়াত দেয়া হল।রাবু কাকার সাথে তখনই আমার প্রথম দেখা। রাবু কাকা কোন এক অদ্ভুত কারণে আমাকে ভীষণ পছন্দ করতেন। রাবু কাকাই প্রথম আবিষ্কার করলেন আমার অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা। বাবামাকে তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে জানালেও বাবামা পাত্তা দিলেন না।

রাবু কাকা আমার অবস্থা নিমিষেই বুঝতে পারলেন। তিনি নিজে আমাকে স্কুলে নিয়ে গেলেন। হেডস্যার আমার পরীক্ষা নিয়ে বেশ অবাক হলেন। তিনি আমার অবস্থা বুঝতে পেরে আমাকে ক্লাস ছাড়া শুধুমাত্র পরীক্ষাগুলো দেবার সুযোগ দিলেন। রাবু কাকা আমার জন্য একজন টিউটর ঠিক করে দিলেন। আমি ধীরে ধীরে লেখাপড়ায় খুব ভাল ফলাফল দেখাই। প্রাইমারীতে বৃত্তি, এস.এস.সি তে গোল্ডেন এ+। আমার এত ভাল ফলাফল সত্ত্বেও বাবামা কেন যেন আমার উপর সন্তুষ্ট ছিলেন না। হয়ত আমার সেই জন্মগত অস্বাভাবিকত্বের কারণেই। বাসায় মেহমান আসলে আমি দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে থাকতাম। তারা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করত, বাবামাও যোগ দিত সেই হাসিতে। আমার ভীষণ কান্না পেত। ছুটে নদীর পাড়ে চলে যেতাম। এরই মাঝে আমি এইচএসসি তে গোল্ডেন পেয়ে পাস করলাম। সবার মুখেমুখে আমার নাম। বাহিরে সবার কাছে আমার নামে গর্ব করলেও বাবমা কখনই আমাকে একটুও অনুপ্রেরণা দেয়নি। আমি তাদের কাছে একটা বোঝা ছাড়া আর কিছুই না। বুয়েটে টিকে গেলাম আমি। রাবু কাকা এসে আমাকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে গেলেন। তবে বললেন এখন থেকে আমাকে ক্লাস করতে হবে, মানুষের সাথে মিশতে হবে। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। ভয়ে ভয়ে ক্লাস করলাম।

আমি জানতাম আমি ছাড়া পৃথিবীর আর সবাই স্বাভাবিক। তবে এই প্রথম মানুষের ভীড়ে এসে আমি উপলদ্ধি করলাম আমার চেয়েও এরা অনেক বেশী অস্বাভাবিক। আমি বুঝিনা আমার নতুন বন্ধুরা কেন শুধু আমাকে পরীক্ষার সময় হলে মামা মামা বলে খাতির করে এবং আমার নোটগুলো নিয়ে নেয় অথচ তারা যখন কোথাও যায় তখন আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে। আমি বুঝিনা আমার বন্ধু সাজিল কিভাবে এতগুলো মেয়েকে ভালবাসতে পারে! আমি বুঝিনা কেন সে সবগুলো মেয়েকে একসাথে নিয়ে ঘুরতে যেতে পারে না। আমি বুঝিনা গাড়ি করে আসা ঐ সুজানা মেয়েটি কেন ঐ ময়দাগুলো সস্তা ছেলেদের সাথে বসে নাকে টেনে নেয়। হয়ত ও জানেনা ওগুলো দিয়ে রুটি বানায়। ওকে একদিন শিখিয়ে দিতে হবে। এছাড়াও আমি বুঝি না ঐ ছেলেগুলো কেন নিজেদের বন্ধুদের সাথে এত মারামারি করে। আমি বুঝতে চাই কিন্তু বুঝতে পারি না। জিগ্যেস করার মতও কেউ নেই।

সবচেয়ে বেশী অদ্ভুত লাগে রূপা নামের মেয়েটাকে। ও সবার চেয়ে ব্যাতিক্রম হলেও দুর্বোধ্য আমার কাছে। আমি বুঝতে পারিনা কেন ও মাঝে মাঝে নিজে রান্না করে এনে আমাকে খাওয়ায়, বুঝিনা কেন কাজ আছে বলে আমাকে নিয়ে কোনও পার্কে, রেস্টুরেন্টে, সিনেমা হলে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুপচাপ বসে থেকে কিছু না বলে চলে যায়। তবে ও যেদিন আমাকে নদীর পাড়ে নিয়ে যেত সেদিন আমি ভীষণ খুশি হতাম। আমার খুশি দেখে সেও খুব খুশি হত। খালি পায়ে আমার সাথে নদীর পাড়ের ভেজা বালির উপর হাঁটত। শীতের শিশির ভেজা ঘাসের উপর হাঁটতে শুখেছি আমি ওর কাছ থেকে। একদিন ক্লাসে গিয়ে শুনি রূপার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, সেদিনের পর ও আর আসবে না। সেদিন খুব অদ্ভুত একটা কাজ করে ও। ইন্সটিটিউট থেকে বের হয়ে যাবার পূর্বমুহূর্তে সবার সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল ভীষণ। তারপর দৌড়ে গাড়িতে উঠে চলে গিয়েছিল। সবাই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। ওর সেদিনের সেই আচরণের ব্যাখ্যা আমি খুঁজে পাইনি। তবে ওর কথা মনে পড়লে বুকের কোথায় যেন ভীষণ ব্যাথা হয়।

একদিন বাসায় ফিরে শুনলাম রাবু কাকা ভীষণ অসুস্থ। ছুটে গেলাম আমি তার বাসায়। রাবু কাকা কথা বলতে পারছিলেন না। অনেক মানুষের ভীড় ওনাকে ঘিরে। আমাকে দেখে কাছে ডাকলেন ইশারায়। কানেকানে বললেন, -আমার সময় হয়ে গিয়েছে আর্জু। তোকে একা রেখেই চলে যেতে হচ্ছে। তবে তোর জন্য একটা জিনিস রেখে যাচ্ছি।

রাবু কাকা আর কিছু বলতে পারেনি। পরে শুনেছি রাবু কাকা আমার জন্য একটা বাড়ি রেখে গেছে সাগরপাড়ে। আমি বুঝিনা মানুষ কেন মারা যায়। কিছুদিন পর মা অসুঃস্থ হয়ে পড়লেন। ওনারা কেউ আমাকে পছন্দ না করলেও আমি তাদের অপছন্দ করি না। বাবা বাসায় ছিল না, আরিফও তার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বেরিয়েছে। তবে আরিফের বন্ধু যে কেবল একটা মেয়ে সেটা আমি বুঝতে পারিনি। মাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার আমাকে ডেকে নিয়ে আমার কোলে ছোট্ট একটা পুতুল তুলে দিলেন। ছোট্ট পৃথার মুখের দিকে চেয়ে আমি আমার সমস্ত কষ্ট ভূলে গেলাম। নতুন একটা জগত্ অনুভব করলাম। ডাক্তার জানালেন ও আমার বোন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবা এলেন। ছোট পৃথাকে দেখে তিনিও অনেক খুশি। পৃথার নাম রাখার সময় মিনমিনিয়ে আমি বলেছিলাম পরী রাখার জন্য, কিন্তু কেউ কেন যেন শুনল না। তাতে কি! সবাই সবার কথা শোনেনা আমি জানি। পৃথাকে দেখে আমার নতুন জীবন শুরু হল। ও সামান্য হাঁচি দিলেও আমার ভয়ে গা কেঁপে উঠত। ওর প্রতিটি মুহুর্তে বেড়ে ওঠার সাক্ষী আমি। ওও আমাকে ভীষণ ভালবাসত। বাবামা এটা পছন্দ করত না। তারা ভাবত আমার সাথে পৃথা বেশী সময় কাটালে পৃথাও আমার মত অস্বাভাবিক হয়ে যাবে।

আমাকে নিষেধ করে দেয়া হল পৃথার কাছে যাওয়ার জন্য। আমি শুনলেও পৃথা শুনত না। এরই মাঝে আমি পাস করলাম। পড়াশোনার পার্ট চুকে গেল, একটা সফটওয়্যার কোম্পানীতে চাকরি পেলাম ভাল বেতনে। বেতনটাক আমি দুভাগ করতাম সবার অজান্তে। একভাগ রাখতাম পৃথার জন্য আরেকভাগ তুলে দিতাম মার হাতে। ছোট একটা অংশ নিজের নামে রাখতাম। একদিন বাড়ি ফিরে দেখি আরিফের সেই মেয়ে বন্ধু তার মাবাবাসহ বসে আছে ঘরে। জানতে পারলাম আরিফ তাকে বিয়ে করেছে বাসায় না জানিয়ে। আমি বুঝতে পারলাম না আরিফ কেন কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করবে! ও তো আমার মতো না। মেয়েটা খুব ভাল। খুব অল্পদিনেই সবাইকে আপন করে নিল। যদিও আমাকে এড়িয়ে চলত। তাতে আমি অবাক হতাম না। এরই মাঝে বাবামা একদিন আমাকে বিয়ে করার কথা বলল। আমি বুঝতে পারলাম না বিয়ে করতে হবে কেন! আমার তো কাউকে প্রয়োজন নেই।

বেশ তো আছি। অচেনা কারও সাথে আমি থাকতে পারব না। বাবামা আমার কথায় বেশ বিরক্ত হলেন। তারা জানালেন পাড়াপড়শী নাকি বড় ভাইকে বিয়ে না দিয়ে ছোট ভাইয়ের বিয়ে করিয়ে দেয়া নিয়ে বেশ আজেবাজে কথা ছড়াচ্ছে। আমি বুঝতে পারলাম না আজেবাজে কথা কিভাবে ছড়ায়। আমি বিয়ে করতে রাজি হলাম না। প্রতিদিন বাবামা নানাভাবে আমাকে বুঝিয়ে, ভয় দেখিয়ে রাজি করাতে চায় কিন্তু আমি রাজি হইনা। আজ রাতেও আমাকে অধৈর্য্য হয়ে যাচ্ছে তাই বলে বকাবকি করছিল। এমন সময় পৃথা এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে কোলে চড়ল। তা দেখে মা ভীষণ রেগে গেল। পৃথাকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে আমার থেকে কিন্তু সে শোনে না। কাছেই হাত-পাখা ছিল। তুলে নিয়ে বাড়ি দিল পৃথাকে। আবার মারতে গেলে আমার শরীর দিয়ে ওকে আড়াল করলাম। আমাকে ইচ্ছে মত মেরে চলে গেল, বলে গেল আমাকে মরে যেতে, বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। পৃথা ভীষণ কাঁদছিল ব্যাথা পেয়ে। ব্যাথা পেয়েছে ভেবে আমি ওর হাত ম্যাসাজ করে দিতে গেলাম। ও বলল ও কাঁদছে আমাকে এত বকা দেয়ায়, মারায়। আমি বুঝতে পারলাম না ঐ কারণে ও কাঁদবে কেন? হয়ত স্বাভাবিক মানুষেরা এমনই হয়। আমিও বোধহয় স্বাভাবিক মানুষ হচ্ছিলাম একটু একটু, কারণ আমিও কাঁদছিলাম ও ব্যাথা পাওয়ায়।

চোখটা আবার ঝাপসা হয়ে এল। সময় দেখলাম চোখ মুছে। পাঁচটা। হুইসেল বাজিয়ে এসে থামল ট্রেন। চট্টগ্রামের ট্রেন। রাবু কাকার দেয়া সেই বাড়িটাতে চলে যাব। একটা চাকরি খুঁজে নিয়ে সেখানেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। উঠতে গেলাম আমি। জ্যাকেটটা তুলে নিতে গিয়ে বাঁধা পেলাম। পাশে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। আমার ছোট্ট পরীটা আমার জ্যাকেটে মাথা রেখে ঘুমিয়ে রয়েছে!

নড়াচড়ায় ঘুম ভেঙ্গে যায় ওর। আমি তাকাতেই দুহাত তুলে কোলে তুলে নেয়ার ইশারা করল। বেচারি এত রাতে আমার পিছু নিয়ে হেঁটে হেঁটে স্টেশন চলে এসেছে ভাবতেই ভীষণ অবাক লাগছে, তারচেয়েও বেশী খুশি লাগছে। আমার পৃথিবীটা আমার সাথে আছে এখন। হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিলাম ওকে। খিলখিল করে হেসে উঠল কোলে উঠে। আমিও হাসলাম। ট্রেন ছাড়ার সংকেত দিল। আমার পৃথিবীটাকে কোলে নিয়ে চড়লাম ট্রেনে। কু ঝিক ঝিক আওয়াজ তুলে রওনা হয়ে গেল ট্রেনটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দুটো মানুষকে নিয়ে।
 
Top