by প্রাঞ্জলিকা গোমেজ 
সুন্দরী মেয়েআদিত্য বরাবরই খুব এলোমেলো।ওকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম সেদিন আমি ভার্সিটিতে প্রথম এসেছিলাম।যদিও ক্লাস দুইমাস আগে থেকেই শুরু হয়েছে কিন্তু আমার টাইফয়েড ছিল তাই এতদিন আসি নি।একগাদা নতুন ছেলেমেয়ের মাঝে আমি!নিজেকে বড় খাপছাড়া মনে হচ্ছিল।ক্লাসে অন্য ইয়ারের ক্লাস চলছিল তাই আমরা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।আমি এককোনায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে সবাইকে দেখছি।অফ হোয়াইট কালারের শার্ট আর ব্ল্যাক জিন্স পড়া একটা ছেলের শাথে চোখাচোখি হয়ে গেল।আমি ভীষন অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলাম।ছেলেটার চোখজোড়া অনেক তীক্ষ্ণ।কি গভীর কালো চোখ।মনে হচ্ছিল চোখের মাঝে ডুব দেই।হ্যাঁ,প্রথম দেখাতেই ছেলেটার সম্পর্কে এই কথাটাই মনে হয়েছিল।
-আপনাকে আগে কখনো ক্লাসে দেখি নি বোধ হয়!আজ কি প্রথম এলেন?
-জী,হ্যাঁ।অসুস্থ ছিলাম তাই আসা হয় নি।
-ও,আচ্ছা।আপনার নামটা জানতে পারি কি?
-জয়ী।আপনি?
-আমি আদিত্য।আমরা যেহেতু একই ক্লাসের তাই আমরা দুজন দুজনকে তুমি বলে সম্বোধন করতে পারি।আপত্তি আছে? -না,না,আপত্তি নেই।তুমিই ঠিক আছে!
এইভাবেই ছেলেটার সাথে পরিচয়।নিজের খেয়ে বনের মহিষ তাড়ানো ওর বরাবরের অভ্যাস।সবসময় ছুটাছুটি করছে,হুরাহুড়ি করছে।কখনো শান্ত নয়।ক্লাসও ঠিকমত করত না। "জয়ী,আজ আমার প্রক্সিটা দিও তো,আজ ওখানে মিটিং আছে,আসতে বোধ হয় পারব না।" আমি ওর প্রক্সি দেওয়ার দায়িত্ব নিবিড়ভাবে পালন করতাম।মাঝে মাঝে দুই-তিন সপ্তাহ ধরে নিখোঁজ।কোন পাত্তা নেই!আচমকা একদিন আসল।কাঁধে কোন ব্যাগ নেই,কিছু নেই।হাতে একটা খাতাও নেই।
-কোথায় ছিলে এতদিন?
-রংপুর গিয়েছিলাম।
-হঠাত রংপুর কেন?
-ওখানে সভা ছিল একটা।
-কেন এসব মিটিং-সভায় যাও?
-দেশটাকে বদলাতে চাই তাই।
-এভাবে কিছু হবে না।দেশ পাল্টানো এত সহজ নয়।তুমিও ধীরে ধীরে ওদের মত হয়ে যাবে।দুর্নীতির সাথে হাত মেলাবে। -আমাকে তোমার তাই মনে হয়?
-মনে হয়না কিন্তু হতে কতক্ষন?
-আমি হবো না কক্ষনো ওরকম।তুমি দেখে নিও।আমাদের দেশটা আজ স্বাধীন কিন্তু তবুও যেন কেমন পরাধীন পরাধীন মনে হয়!আসলেই স্বাধীনতা রক্ষা করা খুব কঠিন।আমরা বোধ হয় মুক্তিযোদ্ধাদের আশা পূরনে ব্যর্থ হয়েছি।নিজেকে তখন খুব ছোট মনে হয়।মনে হয় কিছু একটা করি।
-আজও ক্লাস করবে না?
-করি আজ তোমার সাথে না' হয়।
-উরিবাপরে!চলো যাই।তার আগে তোমার আসা উপলক্ষে আমাকে এককাপ কফি খাওয়াও।

আদিত্য সারাক্ষন শুধু নানান কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকত। ওর নাগাল পাওয়াই যেত না।তার মাঝেই একদিন খুব ব্যস্ত হয়ে ছুটে এসে বলল "জয়ী,আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।কি করব বুঝতে পারছিলাম না,তাই তোমাকে বলে ফেললাম।খুব অস্থির লাগছে।" আমি লজ্জায় কি রং ধারন করলাম বুঝতে পারলাম না। যেহেতু ফর্সা নই তাই লাল বাদে অন্য কোন রং হতে পারি।আমি আর কি বলব?আমার তো পেছনে তাকানোর সাধ্য নেই।এই ছেলের গভীর চোখের মাঝে আমি অনেক আগেই যে ডুব দিয়েছি।
জাহিদ স্যারের ক্লাস চলছিল।ক্যাম্পাসেই কোথাও গোলাগুলির আওয়াজ হল।অল্প কিছুক্ষন,তারপর সব ঠাণ্ডা।আমরা তেমন গুরুত্ব দিলাম না।ক্যাম্পাসে এসব প্রায়ই হয়।ক্লাস শেষে বের হলাম।হঠাৎ কোন এক ছাত্রের লাশ নিয়ে মিছিল শুরু হল।আমি অবাক!কে মারা গেল?ডিপার্টমেন্টের সামনে লাশ রাখার পর লাশ দেখে আমি গলাকাটা মুরগীর মত কিছুক্ষন তড়পালাম।সবাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল,আমার আদিত্য লাশ হয়ে গেছে।

খোয়া বিছানো রাস্তা দিয়ে হেঁটে এসেছি খালি পায়ে।পা কেটে রক্তাত হয়েছে।আমার আর কোন কিছুতেই কষ্ট লাগেনা।সেখানে পৌঁছালাম অবশেষে যেখানে আদিত্য পাঁচ বছর ধরে ঘুমিয়ে আছে।ওর গায়ে হাত বুলালাম।আমার স্পর্শ ও নিশ্চয় বুঝবে।কে যেন আমার গায়ে হাত রাখ।তাকিয়ে দেখি আমার মা।মা'র চোখে পানি।আমার মা এই কষ্টটা পেয়েছেন।তিনি চোখের সামনে পাকিস্তানী জানোয়ারগুলোর হাতে আমার বাবাকে মারা যেতে দেখেছেন।আমার বাবা একাত্তরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা।আমার জন্মের খবর পেয়ে বাবা আমাকে দেখতে এসেছিলেন!আমাকে বাবা দেখতে পেয়েছেন,কোলে নিতে পেরেছেন কিন্তু আমি আমার বাবাকে দেখি নি!আমার বাবা দেশ স্বাধীন করেছেন,বিজয় এনেছেন তাই আমার নাম জয়ী।আদ্যিত্য এই স্বাধীন দেশটাকে মনের মত করে গড়তে চেয়েছিল,স্বাধীনতার মান রক্ষা করতে চেয়েছিল কিন্তু সেও পারে নি,সেও ঘুমিয়ে গেছে!মা আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে।মা কাঁদছে স্বামী হারানোর কান্না,মেয়ের ভালোবাসা হারিয়ে যাওয়ার কান্না।কিন্তু আমি কাঁদছি না,কাঁদতে পারছি না।কান্না আসছে না।আজ ষোলই ডিসেম্বর,বিজয় দিবস।আমি জয়ী তো তাই আমার কাঁদলে চলবে না,একদম চলবে না।
 
Top