ভালোবাসার ফটোআমি সবাইকে 'অভ্র' নামে পরিচয় দিই । যদিও এই নাম আমার বাবা-মার দেওয়া না । তাই বলে এটা নকল নাম আর তাঁদের দেওয়াটা আসল নাম, তা না । দুইটাই আসল । শুধু পার্থক্য হল, ওইটা বাবা-মা রাখছে আর এইটা আমি রাখছি । তাঁরা ওইটা রাখার সময় গরু-ছাগল জবাই করে আকিকা দিছেন আর আমি একটা পাখিও না । পাখি বেশ বড় হয়ে যাচ্ছে । বলা যায় একটা মশা-মাছিও না ।
আচ্ছা নাম নিয়ে প্যাঁচাল করার কি দরকার? থাক না যেটা আছে সেটা । মানে 'অভ্র' আরকি...
এবার আমার মনের অবস্থা বলি । সত্যি কথা বলতে সেটার অবস্থা অত্যধিক খারাপ । অধিকতর খারাপ । পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে গেছে । কারণ সে চলে গেছে আমাকে ছেড়ে । দুষ্টামি করে আগেও কয়েকবার গিয়েছিল । ফিরেও এসেছে । তবে এবার বেশ সিরিয়াস ভাবে গেছে । আমিও বুঝতে পারছি কতটা সিরিয়াস । সেজন্যেই মনের অবস্থা এতটা খারাপ । তাকে এবার আর ফেরানোর চেষ্টাও করিনি । সে আর এডজাস্ট করতে পারছেনা আমার সাথে । আমাকে সহ্য করতে পারছেনা । অবশ্য তাকেও দোষ দিতে পারছি না । আমি হয়ত আসলেই এমন অসহ্য । নিজেকে নিয়ে বেশ কনফিউজড আমি ।
এই মুহূর্তে আমি বেশ বিরক্ত । বিরক্তির মূল কারণ আমার পাশে হাঁটতে থাকা মেয়েটা । একই ভার্সিটিতে পড়ি । তবে মেয়েটা আমার জুনিয়র । মেয়েটাকে চিনি আগে থেকে । কিন্তু তেমন একটা কথা হয়নি । একটু আগে ভার্সিটি থেকে বের হওয়ার সময় দেখা হয়ে যায় মেয়েটার সাথে । সেও নাকি বাসায় যাবে । কিছুদুর একসাথে যাওয়া যাবে । তারপর দুজন দুদিকে ।
দেখা হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত একটা কাজ মেয়েটা ননস্টপ করে যাচ্ছে । সেটা হল কথা বলা । একটা সেকেন্ডের জন্যও মেয়েটার কথা বন্ধ হয়নি । মাথা ধরে গেছে আমার । তারপরও কিছু বলতে পারছিনা । আসলে কথা বলতেই ইচ্ছা হচ্ছে না । আর মেয়েটার থামার কোন লক্ষণই নেই । মেয়েটার গায়ের রং কালো । তবে চেহারায় একটা মায়া আছে । ভালো লাগার মত এই একটা জিনিসই আছে । যদিও আমার এখন ওইটাও ভালো লাগছে না ।

মেয়েটার কথার মধ্যে সব ধরনের কথা আছে । গতকাল কিভাবে হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে সেটা থেকে শুরু করে আজকে সকালে তার বাবা তার সামনে তার মাকে চোখ টিপ মারা পর্যন্ত সব । তার বাবা মায়ের রোমান্টিক লাইফ আর রোমাঞ্চ নিয়ে সে খুব এক্সাইটেড । সে নিজেও এমন একটা রোমান্টিক লাইফ চায়, এটা পর্যন্ত বলে দিল । মেয়েটার সাথে আমার আজই প্রথম কথা হচ্ছে । আগে যা হয়েছে সব হাই হ্যালো কেমন আছো টাইপের । আজই প্রথম, আর আজই মেয়েটা এসব বলে দিচ্ছে । কি মনে করে বলছে ? কে আমি ? কিছুটা অবাকই হলাম । তবে সেটা প্রকাশ করলাম না ।
আর কিছুদুর হাঁটার পর দুজন দুদিকে যাওয়ার সময় এসে গেল । আমি ভদ্রতা দেখাতে বললাম
-একা যেতে পারবে ? বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিব ?
-অনেক ধন্যবাদ । খুব পারব একা যেতে । এত সহজে আমার বাসার ঠিকানা জানতে দিচ্ছি না আপনাকে ।
মেয়েটার জবাব শুনে আমি বেকুব হয়ে গেলাম । কি বলে এই মেয়ে ??
-আমি কি বলেছি আমি তোমার ঠিকানা জানতে চাই ?
-জানতে যে চান না সেটাও তো বলেননি ।
আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য চুপ করে গেলাম । এই মেয়ের মাথায় নিশ্চিত প্রবলেম আছে ।
-আচ্ছা যাও তাইলে । তোমার ঠিকানা ভালো থাকুক, সুখে থাকুক, যত্নে থাকুক । বিদায়...
-এমন ভাবে বলতেছেন যেন আর কখনো দেখা হবে না ।
-বলা যায় না...
মেয়েটা চলে যাচ্ছে । আমারও আর দাঁড়িয়ে থাকার ইচ্ছা নাই । ঘুরে পা বাড়াতে যাব এমন সময় মেয়েটা পিছন থেকে ডাক দিল । অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফিরলাম ।
-আমার নাম তো জানেন না মনে হয় । আমার নাম সুবহা ।
-আমি কি বলছি আমি তোমার নাম জানতে চাই ?
-জানতে চান না সেটাও তো বলেননি ।
বলেই মেয়েটা হেসে ফেলল । চোখে মুখে দুষ্টুমির ছাপ স্পষ্ট মেয়েটার । আমার আর কিছু বলার নাই তখন । আমি অবাক হয়ে সুবহা নামের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলাম । মেয়েটার হাসিটা বেশ সুন্দর । দেখতে অনেক ভালো লাগছে । আমাকে ওইভাবে রেখেই মেয়েটা চলে গেল হেঁটে হেঁটে ।
পরদিন ভার্সিটিতে ক্লাসের পর দাঁড়িয়ে ছিলাম ফ্রেন্ডসদের সাথে । এমন সময় দেখলাম সুবহা নামের মেয়েটা আমাকে ডাকছে । ফ্রেন্ডসদের ঈঙ্গিতপূর্ণ চোখের চাহনি উপেক্ষা করে গেলাম ওর কাছে ।
-যাবেন না ?
-কোথায় ?
-কোথায় আবার ? বাসায় ?
-হুম যাব তো ।
-চলেন একসাথে যাই ।
আমার মোটেই ইচ্ছা নাই একসাথে যাওয়ার । তাই মিথ্যে বললাম ।
-আমার যেতে একটু দেরী হবে । তুমি চলে যাও ।
-ও...

মেয়েটা চিন্তা করছে । চোখমুখ অন্ধকার হয়ে গেছে । ভেবেছিল একসাথে যাবে । মন খারাপ হয়ে গেছে হয়ত । আমি নিজের চোখের সামনে সফলতা দেখতে পেয়ে মনে মনে খুশি । যাক একসাথে যেতে হবে না । বাঁচা গেছে । কিন্তু হঠাত মেয়েটার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠাতে শংকিত হয়ে পড়লাম ।
-আচ্ছা আমি ওই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি । আপনার যাওয়ার সময় হলে বলবেন । আমি ওই পাশটায় আছি । ঠিকাছে ?
আমি মনমরা অবস্থায় বললাম, আচ্ছা ।
মেয়েটা একটু দূরে দাঁড়ানো আরেকটা মেয়ের সাথে কথা বলা শুরু করল । আমি আবার বন্ধুদের কাছে ফিরে গেলাম । সবাই জানতে চাইছে মেয়েটা কে ? আমার সাথে কি ওর ? আমার তখন কিছু বলার মুড নাই । মেজাজটা খারাপ হয়ে গেছে, নিজের উপর । জানি না কেন হয়েছে ।
বেশীক্ষণ দাঁড়ালাম না আর । লাভ নেই কোন । আগে যাই বা পরে, মেয়েটার সাথেই যেতে হবে । শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করার দরকার নাই কোন ।
ভার্সিটি থেকে বের হয়েই আমাকে সে হুকুমের সুরে বলল, একটা রিক্সা ঠিক করেন ।
মেজাজ এমনিতেও খারাপ । তার উপর এইরকম কথা শুনে সেটা আরো বাড়লো । সরাসরি বলে দিলাম, পারবোনা । তুমি কর ।
আমার যে মেজাজ খারাপ এটা সুবহা মনে হয় খেয়ালই করেনি ।
-বলেন কি ? আপনি একটা মেয়েকে এভাবে রিক্সা ঠিক করতে বলতেছেন ?
-কেন ? মেয়েরা রিক্সা ঠিক করলে কোন সমস্যা আছে ?
-নাহ । কিন্তু যখন সাথে কোন ছেলে থাকে তখন তো করে না ।
আমার তর্ক করতে ইচ্ছা করছে না । এই মেয়ের সাথে তর্ক করে ফায়দা নাই । ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের কথাটাই সত্য প্রমাণ করতে ব্যস্ত থাকবে । সব মেয়েই কি এমন ? শিওর না ।

রিক্সা ঠিক করলাম একটা । রিক্সাওয়ালার বয়স বেশি না । রিক্সায় উঠেই আমি বললাম, মামা হুডটা তুলে দেন তো ।
তখন সুবহা বাধা দিল ।
-রোদ নাই তো । হুড তোলার কি দরকার ?
-না মানে..
-আমরা কি প্রেম করতেছি নাকি । এত ভয়ের কি আছে ? থাকুক এরকম ।
আমার এখন অধিক শোকে পাথরের মত অবস্থা । নিজেকে একটা পুতুল মনে হইতেছে । যাকে নিয়ে ইচ্ছামত যা খুশি করা যায় । ইচ্ছা হলে হাত একটা চাপ দিয়ে ভেঙ্গে ফেলা যায় । আবার চাইলেই লাগিয়ে দেয়া যায় । বড়ই শোচনীয় অবস্থা ।
এরপর বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেছে । সবকিছু পাল্টে গেছে এই কদিনে । যেই মেয়েটাকে বিরক্ত লাগত অনেক, সেই সুবহা নামের মেয়েটাকেই এখন অনেক ভালো লাগে । বেশ ভালো বন্ধু আমরা । অনেক কথা বলে সুবহা । এত কথা কোথা থেকে যে বের হয় কে জানে । তবে আমার এখন আর শুনতে খারাপ লাগে না । একবার ভালোবাসা নিয়ে ওর ইচ্ছার কথা বলেছিল ।
-জানো আমার খুব শখ কাউকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসবো । সেও মন প্রাণ দিয়ে আমাকে ভালোবাসবে ।
-তোমাকে ভালোবাসবে ? হাহ...
-কেন ? আমাকে ভালোবাসা যায় না ?
-তুমি যে কত কথা বল সেটা শুনলেই ভালোবাসার সাধ মিটে যাবে । পালাবার রাস্তা খুঁজবে তখন ।
-বলছে তোমাকে..
-বলতে হবে কেন ? আমি জানি ।
-হইছে । চুপ । আমি এখন রেগে গেছি । আমার সাথে তিন মিনিট কথা বলবা না ।
-আচ্ছা ।
বরাবর তিন মিনিট পর...
-জানো আমি যাকে ভালোবাসবো তাকে বলে দেব যে সে আমাকে 'জোনাক পোকা' ডাকতে হবে ।
-মানে কি ? জোনাক পোকা ডাকতে হবে কেন ?
-আমার ইচ্ছা । আমার ভালো লাগে ।
-বাহ । ইন্টারেস্টিং...
আমি সুবহাকে নিয়ে কখনো ভালোবাসা সম্পর্কিত কিছু চিন্তা করিনি । ইচ্ছা হয়নি কখনো । এসবে তেমন আগ্রহ নাই । কিন্তু কিছুদিন পর থেকে যখন সুবহা কোন ছেলের সম্পর্কে ভালো কিছু বলত, তখন রাগ হত । ওরে কিছু বলতেও পারতাম না । মানাও করতে পারতাম না । এসব শুনলে ও নিশ্চিত হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবে ।
আমার নিজেরই বা এমন হচ্ছে কেন ? ও কোন ছেলের সম্পর্কে ভালো কিছু বলতেই পারে, এতে আমার রাগ করার কি আছে ? নিজেকে নিজেই বুঝতে পারতেছি না । হতে পারে এতদিন একসাথে থাকার ফলে আমি চাই সুবহার সবকিছুই 'আমি' কেন্দ্রিক হোক । আমি চাই ওর সবকিছুতে শুধু আমি থাকতে ।

আরো কিছুদিন পর ব্যাপারটা পরিষ্কার হল আমার কাছে । নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম । আমি ওই সুবহা নামের মেয়েটার প্রেমে প্রচন্ড জোরে আছড়ে পড়েছি । ওঠার শক্তি নেই ।
আমি এখন এ ব্যাপারে শিওর এবং আমার উচিত যত তাড়াতাড়ি পারি ওকে এসব বলে দেয়া । এসব ব্যাপারে দেরি করা ঠিক না । মাঝখানে অন্য কেউ এসে ঢুকে পড়তে পারে ।
দিন তারিখ ঠিক করে ফেললাম । মনে মনে প্রস্তুতি নিতে থাকলাম । নির্দিষ্ট দিনে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম । কোন ফুল-টুল কিচ্ছু আনি নাই । টেনশনে এতকিছু মনে ছিল না । এখন শুধু একটাই চিন্তা, ওরে জানাতে হবে সব । এই কয়দিন ওর সাথে তেমন যোগাযোগ হয়নি । তাই আমার উপর কিছুটা রেগে আছে ও ।
-সুবহা... এই সুবহা...
-চিল্লাচ্ছ কেন ? বল..
-না মানে... আসলে...
-কি মানে ? কি আসলে ? যা বলার ঠিকভাবে বল । এইভাবে একবার এদিকে একবার ওইদিকে দুলতেছ কেন ? সোজা হয়ে দাঁড়াও... এবার বল...
-আসলে... আমি আসলে... তুমি... মানে...
-আজব তো । এইভাবে আমি তুমি করতেছ কেন ? তুমি বলবা ? নাইলে আমি যাচ্ছি... বাই...
-আরে দাঁড়াও না বলছি ।
-হুম...
-আমি... তোমাকে... মানে তোমাকে আমার জোনাক পোকা করতে চাই । তুমি কি আমার জোনাক পোকা হবে ? প্লিজ...
কথাগুলো বলেই আমি চোখ নিচের দিকে নামিয়ে ফেললাম । সুবহা কি করবে দেখার সাহস নাই । জানি না কি হবে । চুপ করে আছে ও । একবার কি ওর দিকে তাকাবো ? না থাক । রিস্ক নেওয়ার দরকার নাই ।
বেশ কিছুক্ষণ পর সুবহা স্বাভাবিক ভাবেই বলল, যাও রিক্সা ঠিক কর একটা ।

আমি বাধ্য ছেলের মত রিক্সা ডাকলাম । রিক্সায় উঠে পড়লাম আগেই ।
-তুমি বাম পাশে বসলে কেন ? বাম পাশে মেয়েরা বসে । যাও ডান পাশে যাও...
গেলাম ডানপাশে । এখনো আমি ওর চোখের দিকে তাকাতে পারিনি । জানিনা কি না কি দেখব তাকালে । সুবহা রিক্সায় উঠে রিক্সাওয়ালাকে বলল, মামা হুডটা তুলে দেন তো ।
সুবহা হঠাত আমার হাতটা ধরতেই আমি ওর দিকে তাকাবার সাহস পেলাম । সামনের দিকে তাকিয়ে আছে ও । দৃশ্যপট পাল্টে গেছে । এখন ও আমার দিকে তাকাতে পারছে না । লজ্জা পাচ্ছে । আমি ওর হাতটা শক্ত করে ধরলাম । আমার এখন পাগলের মত চিত্কার করে গাইতে ইচ্ছা করতেছে,
তোমার হাত ধরে কাটিয়ে দিব সারা জীবন এমন করে করে । 
 
Top