valobasar golpoপুকুরের ধারে নারিকেল গাছের কিছু গুঁড়ি পড়ে আছে । উপরের কিছু বালু আর ট্যাপ খাওয়া অবস্থা দেখে বুঝা যাচ্ছে গুঁড়িগুলো অনেকটা শুকিয়ে গেছে । পুকুরটা জাফর চাচার । সে হিসেবে গুঁড়িগুলোও তারই হওয়ার কথা । জাফর চাচা অনেক কিপটা মানুষ । প্রাইমারি স্কুলে বই পত্র সরকার থেকেই ফ্রি দেয়া হয় । কিন্তু খাতা আর কলম কেনার খরচের কথা চিন্তা করে সে তার একমাত্র ছেলেটিকে স্কুলে পড়ায় না । গাছের গুঁড়িগুলো দিয়ে হয়তো খড়ি বানাবে তাই এগুলো শুকাতে দিয়েছে , পাশে নারিকেল গাছের কিছু খড়ি দেখে এটাই বুঝা যাচ্ছে । তাহলে জাফর চাচার কিপটামিকে স্মরণ করে তার কিপটামিতে একটু পানি ঢেলে দেয়া যাক !!

ভাবতে একটু সময় লাগলেও কাজ করতে কখনো সময় নেয় না রাখি ।
বেস্ , গুঁড়িগুলোকে ধাক্কা দিয়ে পুকুরে ফেলে দিল । যাও চাচা , এখন তুমি গুড়িগুলো পুকুর থেকে তুলে আবার কয়েকদিন একটু শুকিয়ে তারপর খড়ি বানিও । মনে মনে খুশী হয়ে ভাবতে থাকলো রাখি ।
এই কে রে ওখানে !!

এর আগে মুন্না একবার জাফর চাচার গাছের ডাব পাড়তে গিয়ে ধরা পড়েছিল । বেচারাকে পুরো এক বেলা বাঁশের বাগানে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছিল সে । তাই কথাটি শুনেই ভেঙে চূড়ে দৌড় শুরু করলো রাখি ।
রাখির বাবা বেঁচে থাকা অবস্থায় প্রাইমারির পড়াশুনা শেষ করেছিল সে । বাবা মারা যাওয়ার পর হাই স্কুলের বারান্দা স্পর্শের সৌভাগ্য হয়নি তার । তবে রাখি বাংলা এত সুন্দর করে গুছিয়ে লিখতে পারতো যে , কেউ ওর লিখা দেখলে বিশ্বাসই করবেনা যে ওর পড়াশুনার তরীটি প্রাইমারীর নদীতে ডুবে গেছে । গ্রামের অন্য মেয়েদের তুলনায় অনেক চঞ্চল রাখি । কখনো বিলের ধারে শাক কুড়াতে গিয়ে ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে কাদাতে ঢিলা ঢিলি করে , কখনো ছাগল ছানা গুলোর সাথে দৌড়িয়ে , কখনো জাফর চাচার গাছের গুঁড়ি পানিতে ফেলে দেয়ার মত কাজ করেই ওর দিন শেষ হতো । গ্রামের এমন কোন মাটি নেই যেখানে ওর পায়ের স্পর্শ না পরেছে ।

অন্যান্য গ্রামের তুলনায় এই গ্রামটি সব দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে আছে । প্রায় সবগুলো বাড়িই মাটির আর ছনের । গ্রাম বাংলার সত্যিকারের গ্রামের উদাহরন এই গ্রামটি । আর গ্রামের মানুষগুলোও অনেক সরল মনের । সবার মাঝে আন্তরিকতা প্রবল । শহরের মানুষগুলো যেমন একজনের বুকে পারা দিয়ে অন্যজন উপরে উঠতে একটুও দ্বিধা করেনা , এখানে ঠিক তার উল্টো । একবার রাখি হঠাত্‍ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে । গ্রাম অঞ্চলে সাধারণত হাতের কাছে সচরাচর ডাক্তার পাওয়া যায়না । রাখির মা তার একমাত্র মেয়েকে নিয়ে অনেক চিন্তায় পড়ে যায় । কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে একটি ব্যবস্থা হয়ে যায় । শিমুল পাশের গ্রাম থেকে এক ডাক্তারকে নিয়ে আসে ভ্যানে করে । ডাক্তার দেখলে নাকি রোগী অর্ধেক সুস্থ হয়ে যায় । তাই হয়তো ডাক্তারকে ঘরে ঢুকতে দেখেই রাখি শুয়ে থাকা অবস্থা থেকে ওঠে বসে পড়ে । ডাক্তার ওকে দেখে মৌসুম পরিবর্তনের জ্বর বলে কিছু ঔষধ দিয়ে দেয় । রাখির মা যেন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে । ডাক্তার সাহেব বিদায় নেয়ার আগে রাখির মায়ের সাথে একটু কথা বলে নেয় ,,
- মাইয়া তো অনেক বড় হইয়া গেছে । ওর মুখে তাকাইয়া এইডা ভাবছিলা কোনদিন ?
~ না ডাক্তার সাব । বাপ মরা মাইয়া তো , দূরে দিলে আমিও একা হইয়া যামু তাই এমন কিছু অহনো ভাবি নাই ।
- মাইয়া তো সারাজীবন কাছে রাইখা দিবার পারবানা । ওরে নিয়া ভাইবা দেইখো ।
~ জে আইচ্ছা , আপনের কথা মনে থাকবো ।
ডাক্তার চলে যাবার পর রাখির মা রাখির পাশে গিয়ে বসে । রাখির বাবা মারা গিয়েছে প্রায় তিন বছর তিন বছর চলছে । দিনগুলো কিভাবে যে এত তাড়াতাড়ি যায় ভাবাই যায়না । রাখির মা রাখির দিকে খেয়াল করে দেখে , হালকা কোকড়ানো চুল , শ্যাম বর্ণের মুখ আর হালকা ভাড়ি দৈহিক গড়নের মেয়েটি সত্যিই বড় হয়ে গেছে । নিজেকে একা থাকতে হবে বলে মেয়েকে নিয়ে কখনো ভেবে দেখেনি সে । রাখির সমবয়সী সব মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে । অথচ রাখির বিয়ে নিয়ে সে কখনো ভেবেই দেখেনি । ভাবতে ভাবতেই রাখি ওর মাকে বলে ওঠে ,,
- মা , তুই কি ভাবতাছস ?
~ কিছু না মা । তোর অহন কেমুন লাগে ?
- তুই আমারে নিয়া ভাবিস না মা , আমি মেলা ভালা আছি ।
মায়ের দুশ্চিন্তা দূর করার জন্য শরীরে জ্বর রেখেই নির্দ্বিধায় বলে ফেলে সে ভাল আছে । কিন্তু সন্তানের কোন কিছুই মায়ের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনা । রাখির মা তার কথার চালাকি ধরে ফেলে রাখির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে ।

মাস খানেক পর রাখির মা সবদিক ভেবে রাখিকে বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় । যুবতী মেয়ে , কখন কোন অঘটন যদি ঘটে যায় সেই বিপদের চিন্তা সে আর করতে চাচ্ছেনা । তাই সে পাশের গ্রামের ডাক্তারের সাথে তার মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলে । ডাক্তার তার নিজের ভাইয়ের ছেলের সাথে রাখির বিয়ের প্রস্তাব দেয় ।

ছেলেটির নাম মনির । পড়াশুনা প্রাইমারি পর্যন্ত । বয়সে রাখির থেকে বড়জোর চার বছরের বড় হবে । এই বয়সের ছেলেরা খুব সঙ্গ প্রিয় হয় । মনিরও তাই বন্ধুদের সঙ্গ নিয়ে পড়ে থাকতো । সঙ্গ দোষেই প্রাইমারির পর পড়াশুনা আর এগুতে পারেনি । আর এই সঙ্গ দূর করার জন্যই মনিরের বাবা মা মনিরকে বিয়ে করিয়ে দিতে চাইছে । বিয়ে করলে নাকি সব ছেলের মধ্যেই একটা দায়িত্ব বোধ আসে । আর তখন ছেলেরা সংসারি হয়ে যায় । তাই সঙ্গ দূর করার জন্য এটাই উওম পথ ।

দিনটি ছিল শুক্রবার । রাখিদের বাড়িতে কোন আয়োজন করা হয়নি । আর আয়োজন করার মত কোন মানুষ নেই ওদের । পাড়া প্রতিবেশীরা মিলে যা আয়োজন করতে চেয়েছিল তা বর পক্ষ থেকেই নিষেধ করা হয়েছে । শুধু বরের বাড়িতে আয়োজন হবে । বর পক্ষ থেকে কয়েকজন মুরুব্বী এসে রাখিকে উঠিয়ে নিয়ে যায় । আর বিয়েটা হয় বরের বাড়িতেই । মুসলমানদের বিয়েতে সাধারণত এমনটা হয়না । কিন্তু রাখিদের অবস্থার কথা ভেবেই বর পক্ষের এই ব্যবস্থা ।

রাখিকে বিয়ে দেয়া হয়েছে আজ প্রায় পাঁচ মাস হতে চললো । রাখির মা একা বাড়িতে মন বসেনা । মেয়ের কথা মনে করে শুধু কাঁদে । শুনেছে রাখি নাকি জামাই বাড়িতে অনেক ভাল আছে , এটা শুনেই রাখির মা নিজেই নিজেকে স্বান্তনা দেয় । কিন্তু উঠানে রাখা ঐ ছোট জালটি যে এখন আর কেউ বিলে নামায় না , ঘরের সামনে লাগানো গাঁদা ফুল গাছগুলো যে জঙ্গলের মত হয়ে গেছে , এগুলো ভাবতেই রাখির মা আবার কেঁদে ওঠে । রাখির মায়ের প্রতিটা দিনই এভাবে কান্না আর স্বান্তনার মধ্যে দিয়ে পার হয় । এই দিকে রাখির অবস্থাও ওর মায়ের মতই । এমন চঞ্চল আর মুক্ত মনের মেয়েটি আজ নিয়তির এক বাস্তব নিয়মে বন্দী হয়ে গেছে । গ্রামের চারপাশের মাটিগুলো এখন আর ওর স্পর্শ পায়না । মা কে এর মধ্যে একবার দেখেছিল । ওর মা অনেক ভেঙ্গে পড়েছে । রাখি তার বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে সংসারী হতে চেষ্টা করছে । বাজারে মনিরদের একটি টিনের দোকান ছিল । গ্রামে যেমন কয়েকজন মানুষ থাকে যাদেরকে গ্রামের সবাই মানে , মনিরের বাবা তাদের মতই একজন । শুধু সঙ্গ দোষের কারনেই মনির আজ সবার কাছে হালকা ছেলে হয়ে আছে । বিয়ের পর ওদের দোকানেই ওর বাবা ওকে হিসাব নিকাশ দেখার দায়িত্ব দেয় । বিয়ের পর মনিরও অনেক সংসারি হয়ে গেছে । বন্ধুদের আড্ডায় গিয়ে অযথা সময় নষ্ট করেনা । হয়তো উপর ওয়ালার ইশারায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ফলেই ওর এই পরিবর্তন ।

এতদিনে মনির আর রাখির সংসার পুরোপুরি গুছিয়ে ওঠেছে । প্রায় দুই বছর চলছে ওদের দাম্পত্য জীবনের । একটা সাধারন গ্রামের সংসারে যা যা দরকার তার কোন কিছুর যেন অভাব নেই ওদের সংসারে । শুধু একটাই অপূর্ণতা , ওদের কোন সন্তান হচ্ছিল না । আর এর জন্য ওদের মনে অনেক কষ্ট ছিল । মনিরের বাবা , মা সহ আশে পাশের অনেক মানুষজন কানাকানি করতো এটা নিয়ে । আর এ ব্যাপারে সব দোষ দেয়া হতো রাখিকে । রাখি সব বুঝতে পারলেও ওর কিছু করার ছিলনা । স্বামীর কাছে থেকে কোনদিন এ ব্যাপারে কোন বিরক্তিবোধক কোন কথা শুনেনি । স্বামী তার পক্ষে আছে , এটা ভেবেই রাখি চারপাশের মানুষজনের কানাকানিকে গুরুত্ব দিতো না ।
কিন্তু রাখিদের মত অসহায় মেয়েদের কপালের সহায় কি সব সময় উপর ওয়ালা হয় ? সন্তানের অপূর্ণতা হঠাত্‍ মনিরের মনকেও নাড়া দেয় । সে আবার বন্ধুদের আড্ডায় মেতে ওঠতে থাকে । দোকানে ঠিকভাবে যেত না । রাতে বাসায়ও ফিরতো না মাঝে মাঝে । কেউ হয়তো মাথায় কোন কুবুদ্ধি চাপিয়ে দিয়েছে মনিরের । এক রাতে নেশা করে এসে রাখিকে অনেক মারধোর করে মনির । রাতে কান্নাটির আওয়াজ পেয়ে মনিরের বাবা মা ওঠে আসে । রাখিকে মারতে দেখে মনিরকে বকা ঝকা দেয় । মনিরও ওর বাবা মা কে অনেক বকা ঝকা করে । বকা ঝকা করতে করতে একসময় মনির ঘুমিয়ে যায় । এদিকে রাখির মা কে খুব মনে পড়ে । পরের বাড়ি না আসলে কি হতো ? যেভাবে ছিলাম ঐভাবে কি দিনগুলো পার করে দিতে পারতাম না ? এগুলো ভেবে ভেবে নিজের বাবার উপর অনেক রাগ করে রাখি । এত আগেই তার মারা যেতে হবে কেন ? সে থাকলে হয়তো তাকে পরের বাড়ি আসতে দিতো না , গ্রামের এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে নিজের বাড়িতেই সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারতো । বিছানায় শুয়ে এগুলো ভেবে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই সারা রাত পার হয়ে যায় রাখির ।

এখন মনির অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে । এভাবে মাঝে মাঝেই রাতে নেশা করে এসে যৌতুকের কথা বলে রাখিকে মারধোর করে । একরাতে মনির যৌতুকের কথা বলে বাঁশের ফাল্টা দিয়ে অনেক মারে রাখিকে । মনিরের বাবা গিয়ে না ফেরালে হয়তো মেয়েটাকে ঐদিন আধ মরা করে ছেড়ে দিত । ঐ রাতের মার খেয়ে রাখি অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ে । আর এই খবরটা রাখির মা পেয়ে যায় । রাখিদের বাড়ি থেকে মনিরদের বাড়ি পর্যন্ত পুরো রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে আসে রাখির মা । মেয়ের এই অবস্থা দেখে রাখির শ্বশুর বাড়ির মানুষদের কাছে অনেক লজ্জিত হয় রাখির মা । কান্না ভেজা চোখে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করে ,,
- তরে মেলা মারছে মা ? তর মেলা কষ্ট অইছে না মা ?
রাখির মায়ের চোখের অসহায় আর কষ্টের পানিগুলো রাখির কপালে পড়ছিল । রাখি একটু একটু হেসে উওর দিল ,,
~ তুই আমারে নিয়া ভাবিস না মা , আমি মেলা ভালা আছি ।
বিয়ের আগে যখন রাখি অসুস্থ হয়েছিল তখন মায়ের দুশ্চিন্তা দূর করার জন্য ঠিক একই কথা বলেছিল রাখি । কিন্তু মায়ের চোখ কি কখনো সন্তানের অনুভূতিকে এড়িয়ে যেতে পারে ? রাখির মা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল যে রাখি তাকে মিথ্যা স্বান্তনা দেয়ার জন্য এগুলো বলছে । বাবা হারা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে অনেক কান্না কাটি করে রাখির মা ।

মনির এখন শহরে একটা দোকান নিয়েছে । মা মারা যাওয়ার পর নিজের গ্রাম ছেড়ে একটু শহরের দিকে এসে দোকান দিয়েছে । মনিরকে এখন অনেকটা সাহেব সাহেব দেখা যায় । প্যান্ট , শার্ট পড়ে পরিপাটি হয়ে থাকে । ইনকামও ভাল করে । এখানে একটি বাসা নিয়েছে । গ্রামের বাড়িতে মনিরের অন্য ভাইদের সাথে থাকে মনিরের বাবা । ভাল ব্যবসা করার জন্য শরীকদের ছেড়ে শহরের দিকে এসেছে সে ।

গ্রামে বাবার থাকার ঘরটি ভাঙ্গা ভাঙ্গা অবস্থা । পল্লবী বেশ কিছুদিন যাবত জোরাজুরি করছে ঘরটি মেরামত করে দেয়ার জন্য । কিন্তু পল্লবীর কথা এক কানে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয় মনির । কিন্তু গতকালের ঝড়ে নাকি ঘরটির এক পাশ পড়ে গিয়েছে । অন্য ছেলেদের মধ্যে খায় বলে বাবার ভাঙ্গা ঘর নিয়ে তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই । তাই বাধ্য হয়েই ঘরটি ঠিক করতে যেতে হচ্ছে ।

ঘরটির সবকিছু বাইরে বের করা হচ্ছে । পল্লবীও সাথে সাথে কাজ করছে । ঘরটি যে পাশে ভেঙ্গে পড়েছে সে পাশে সিলিংটাও পড়ে গেছে । হঠাত্ সিলিং এর এক পাশে পল্লবী ছোট একটি প্লাস্টিকের বক্স দেখতে পায় । ভেতরে কিছু একটা আছে বুঝা যাচ্ছে । বক্সটি খুলতেই উপরে মলাট লাগানো একটি ছোট বাংলা খাতা দেখতে পায় সে । খাতাটা খুলতেই ভিতরে এক গাদা লিখা দেখতে পায় । লিখাগুলো মোটামুটি সুন্দর কিন্তু অগোছালো । লিখাগুলোতে কোন যত্নের স্পর্শ ছিলনা । বুঝা যাচ্ছে , অনেক গাদা গাদি করে এক বসাতে কেউ লিখাগুলো লিখেছে ।

বাইরে অনেক বৃষ্টি হচ্ছে । আর বৃষ্টি হলেই আকাশে বিদ্যুত্‍ চমকিয়ে বাজ পড়ে । টিনের চালের বৃষ্টির ঝুম ঝুম শব্দ বেশ ভাল লাগে পল্লবীর । কিন্তু বাজ পড়ার শব্দকে অনেক ভয় পায় সে । তাই বৃষ্টির সময় সে মনিরের পাশে গিয়ে বসে থাকে । কিন্তু আজ রাতে মনির পাশে নেই । বৃষ্টিও হচ্ছে তুমুল বেগে । আকাশের বাজও পড়ছে বিকট শব্দে । কিন্তু পল্লবীর সেদিকে কোন খেয়ালই নেই । বক্সে পাওয়া খাতাটি পড়ে সে কোথায় হারিয়ে গেছে তা সে নিজেও জানেনা । লিখাগুলো কোথাও কোথাও বুঝতে কষ্ট হলেও একজন মেয়ে হিসেবে রাখির অনুভূতিগুলোকে সে ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছিল । লিখাগুলোর মাঝে হারিয়ে চারপাশের পরিবেশের প্রতি তার কোন খেয়ালই নেই ।
আম্মু ! আম্মু !!
মেয়ের ডাকে যেন নিজের ঘরে নতুন করে জ্ঞান ফিরে পায় সে । চোখের পানিগুলো মুছে মেয়েকে ঘুম পাড়াতে চলে যায় । মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মনিরের চেহারাকে মনে করে সে । সুন্দর চেহারা আর সাহেবী ভাবের ভিতরে এত কিছু লুকিয়ে আছে ? পল্লবীর সাথেও মাঝে মাঝে ঝগড়া করে মনির । তবে রাখির সাথে যেমন সন্তান আর যৌতুকের জন্য ঝগড়া করতো আর মারধোর করতো তার কোনটাই সে পল্লবীর সাথে পারেনা । পারার কথাও না , কারন বিয়ের সময় পল্লবীর পরিবার থেকে বেশ কিছু টাকা আর আসবাব পত্র দেয়া হয়েছে । পল্লবীর পারিবারিক অবস্থা ভাল না হলেও রাখির পারিবারিক অবস্থার তুলনায় বেশ ভাল ছিল । পল্লবী এস এস সি পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে । ওদের বাড়ি দূরে হওয়াতে মনিরের এই মুখোশ সম্পর্কে আগে অবগত হতে পারেনি । মূলত গ্রামে মনিরের বাবার মোটামুটি নাম ডাক শুনেই পল্লবীর বাবা মা এখানে ওকে বিয়ে দেয় । এখন ওর চার বছর বয়সী একটি মেয়েও আছে । যৌতুক না দিতে পারলে আর মেয়েটি না থাকলে হয়তো একই অবস্থার সম্মুখীন হতে হতো পল্লবীরও ।

খাতার লিখাগুলোর কথা মনিরকে কোনদিন বলেনি পল্লবী । খাতায় হয়তো আরো কিছু লিখার কথা ছিল , কিন্তু সুযোগের অভাবে হয়তো রাখি সেগুলো লিখতে পারেনি । রাখির অসমাপ্ত লিখা রাখির শেষ পরিণতিকেও অসমাপ্ত রেখে গেছে । তাই সবার আড়ালে পল্লবী রাখিদের গ্রামে গিয়েছিল রাখি আর রাখির মায়ের খোঁজ করার জন্য । কিন্তু সেখানে বেশ কয়েকজনের কাছে থেকে জানতে পারে , রাখি আর রাখির মা প্রায় সাত বছর আগে গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে । কোথায় গেছে সেটা কেউ বলতে পারেনি । পল্লবীকে গ্রামের প্রায় সবাই চিনতো । তাই সে ইচ্ছা করেই মনির আর রাখির সম্পর্কে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি ।

" জীবনে সঙ্গীর প্রয়োজন অপরিসীম , কিন্তু এমন সঙ্গী চাই না যে জীবনকে দুর্বিষহ করে দিবে । " " উইলিয়াম মরিস " এর এই লিখাটি কোথাও পড়েছিল পল্লবী । হয়তো রাখিও পড়েছিল । আর তাই হয়তো মনিরের মত ছেলের জীবন থেকে নিজেই বিদায় নিয়ে চলে গেছে , নয়তো মনিরের নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে সব ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে । পল্লবী মোটামুটি শিক্ষিত মেয়ে । জ্ঞানের পরিধিও ভাল । তাই মনের ভেতর অসংখ্য ঘৃণা আর চাপা কষ্ট নিয়েও , মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আর সংসারের মায়ার টানে , মনিরের লুকানো মুখোশকে নিজের ভেতর মুখোশ করে রেখেই মনিরের মত ছেলের সাথে সংসার করে যাচ্ছে পল্লবী ।

কিছু কথা : মনিরের মত ছেলেদের বিভিন্ন রুপ আমাদের আশেপাশে বিদ্যমান । তাদের এসব রুপের কারনে অনেক সহজ সরল মেয়েদের জীবন অতি সহজেই দুবির্ষহ হয়ে ওঠে । এদের মত ছেলেদের হাত থেকে রক্ষার জন্য অনেকে জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করে , আবার অনেকে নিজের স্বপ্নকে উপড়ে ফেলে বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে সংসার জীবন চালিয়ে যায় । এদের মধ্যে একটি রুপ আমার আনাড়ি হাতে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি গল্পটিতে ।
 
Top