অচেনা প্রেম
ড্রইং রুমে চুপচাপ বসে আছি মার পাশে । বাবা পাশের সোফায় । এমন পরিস্থিতি আজ প্রথম ফেস করছি । একটু অস্বস্তি ও লাগছে । ড্রইং রুম টা সুন্দর । বেশ সুন্দর । আমাদের বাসার মত বড় না কিন্তু এত্ত সাজানো গুছানো । এক কর্ণারে একটা ভোটকা মাটির গামলা । তার ভিতর ২টা প্লাস্টিকের গোলাপী পদ্ম ভাসছে ।ছোট ছোট কচুরিপানা গোছের ভাসছে । সব মিলিয়ে জিনিস টা দেখার মত সুন্দর । কচুরিপানা গুলো দেখে আসল মনে হচ্ছে । কিন্তু এই ঢাকা শহরে এরা এত কচুরিপানা কোথায় পেল ?
' মা , শোনো ...'
' বল ।' ( হাসিমুখে তাকাল মা )
'ঐ কচুরিপানা গুলা কি আসল ??'
মার হাসিমুখ দ্রুতই বদলে গেল । চোখ দিয়ে যদি আগুন বের হওয়ার সিস্টেম থাকলে এখানে এখন নিঃসন্দেহে আমার কাবাব পড়ে থাকত !
'সবসময় ফাইজলামি ভাল লাগেনা দিহান । জীবনে কখনও তো সিরিয়াস হবা ! একটা সিরিয়াস কাজে আসছি । এদিকে কন্সেন্ট্রেট কর ।'
. চুপ হয়ে গেলাম । এখানে ফাইজলামির কিছু খুজে পাচ্ছিনা । আর কন্সেন্ট্রেট করার মত কিছু পাচ্ছিনা । রিয়া কে দেখতে আসলাম । দেখতে আসলাম কথাটা বলা উচিত না , রিয়ার সাথে দেখা করতে এসেছি – এইটা বলা উচিত ।
মেয়েটাকে আজ প্রথম দেখব আমি । ছবি দেখেছি অবশ্য । ভাল করে দেখতে পাইনি যদিও । মার সামনে বসে দেখতে আনইজি লাগছিল । ২৮ পেরিয়ে এই লজ্জা অবশ্য আমাকে মানায় না । তবুও লাগছিল । কি করব ?? আর মাই বা কী ? ছবিটা রেখে যেত ! না , ছবি হাতে দিয়ে সামনে বসে আছে । যত্তসব !!
দুইদিন হল মাত্র দেশে আসছি । এক মাসের জন্য । অবশ্য গত এক মাস ধরে রিয়ার গল্প শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত । কান ঝালাপালা হয়ে গেছে ! কত টাকা যে শেষ হয়েছে এই বাংলাদেশ টু টরেণ্টো ইনকামিং আর আউটগোয়িং এ ।

‘রিয়ার আজকে সকাল থেকে জ্ব্রর । ও আসছে । আপনারা আসুন না , খেতে আসুন । ’ – রিয়ার মা অর্থ্যাৎ আমার হলেও হতে পারে শাশুড়ির বিব্রতভাব দেখে মনে হচ্ছে কেন যেন সামথিং ইজ রং ...
মেয়েটার উপর রাগ লাগছে । এত ঢং কেন ? মুড দেখায় ... জ্বর তো আগে বললেই হত । আজ আসতাম না । খেতে বসেছে সবাই । এর মাঝে মা বললেন ,
' রিয়া কেও ডাকুন । ও আমাদের সাথে বসুক একটু । '
আন্টি উঠে গেলেন , আমি ও উঠে দাড়ালাম ।
'আমি একটু কথা বলি আন্টি রিয়ার সাথে ?'
অনুমতি চাইলাম কিন্তু উত্তরের অপেক্ষা না করে সোজা ঘরের দরজার নব ঘুরালাম । খুব সম্ভবত এইটা ই তার ঘর । ঘর এ ডিম লাইট জালানো , এসি ছাড়া ... একদম বরফ হয়ে আছে ফ্লোর । জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা । এটাই রিয়া ??? গালে পানি চিকচিক করছে , কাঁদছিল সে ?? অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সে । আমিও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি । আমার অবাক হওয়ার অনেক কারণ আছে । সুখের মত বাজছে বুকে দুঃখের মত ব্যথা । আহামরি কোন সুন্দর না অথচ সুন্দর , বিষাদভরা মায়াবী চোখে কাজল দেয়া । মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে ? কেন ?? মেয়েটা চমকে তাকিয়েছে পিছনে । আমি ও চমকে তাকিয়ে আছি । কিছু বলব কিন্তু কি বলব কিছু ঠিক করতে পারছিনা । সহজ হয়ে একটা কথাও বলতে পারছিনা আমি ! কি আশ্চর্য !!! .

'আমি দুঃখিত রিয়া । এইভাবে ঘরে ঢোকার জন্য । আমি কি তোমার সাথে একটু কথা বলতে পারি ? প্লিজ ? '
আমি অপরিচিত , প্রথম দেখায় আপনি বলা উচিত । মেয়েটা আমার অনেক ছোট , তুমি ছাড়া আর কিছু মুখে এলনা ! মেয়েটা স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে এল , একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে সহজ গলায় বলল ,
' বসুন ।'
' আমি কিছু বলতে চাই তোমাকে ।'
' আমার ও কিছু বলা দরকার আপনাকে । '
'বল । '
'একটু পর বলছি । আপনি বসুন । আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি ।'
' আচ্ছা ।'
একটু হেসে লাইট জ্বেলে বের হল রিয়া । হাসিতেও বিষাদ মাখা । কি হয়েছে তার ? আমি আবারো ঘরের দিকে মনোযোগ দিলাম । সুন্দর সাজানো পরিপাটি ঘর । এই বাসার সবকিছু এমন ছবির মত সুন্দর কেন ? এদিক সেদিক দেখছিলাম ...
জানালার পাশে একটা লাল মলাটের ডায়রী । অন্যের জিনিসে হাত দেয়াটা অন্যায় , জানি । তবু ধরলাম আমি , ভিতরে খোলা কলম । কেউ লিখছিল একটু আগেও , যেহেতু ঘরটা রিয়ার নিশ্চয়ই এইটাও তার । আগে পিছে না ভেবে পড়তে বসে গেলাম ... কতক্ষণ কাটল টের পাইনি । বেশ কয়েক টা পেজ পড়লাম ... হঠাৎ বাইরে কার শব্দ পেয়ে আবার জায়গামত রেখে দিলাম ...

' স্যরি । আপনাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম ।'
মেয়েটাকে এখন বেশ ফ্রেশ লাগছে ... একটু আগের সাথে অনেক পার্থক্য । একদম স্বাভাবিক সে ।
'না , ইটস ওকে । বল কি বলতে চাইছিলে ?'
'আসলে আমি বলতে চাইছিলাম I had an affair ! '
'আর এখন ?'
' চলে গেছে ..'
' কোথায় ?' (বলেই চিন্তায় পড়লাম ; এইটা কেমন প্রশ্ন হল ! )
' চলে গেছে ।'
আমি মাথা নাড়লাম । কিছু বলা উচিত । কিন্তু মাথায় কিছু আসছে না । এসব তো কিছু কিছু জেনেছি ই ডায়েরি পড়ে ! কি করব ? মেয়েটা কে স্বান্তনা দিব ? দুম করে বলে বসলাম , 'তুমি কি করতে চাও ?'
' আমি ? ? জানিনা । আমি আসলে জানিনা । '
' অপেক্ষা করবে ? ' 
কিছু বলল না । মাথা নিচু করে বসে আছে সে । আমি তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি । 
একটু পর মুখ তুলল সে , ' আপনি কিছু বলবেন বলছিলেন ...'
' তেমন কিছু না । তুমি যদি তার জন্য অপেক্ষা করতে চাও কর । কিন্তু নিজেকে কষ্ট দিয়ে না । আর আমার ব্যপারটা ভেবো না । আমি মা বাবাকে কিছু একটা বলে দিব ।'
' কি বলবেন ?'

' বলব যে আমার তোমাকে পছন্দ হয়নি ... ' বলেই হেসে ফেললাম । রিয়া ও একটু হাসল । বিষাদ হীন হাসি !
' তবে একটা কথা বলি ?' প্রশ্ন চোখে তাকাল । সেখানে সম্মতি পেয়ে আমি বলেই ফেললাম কথাটা ... ‘কিছু মনে কর না । যে থাকতে চায় না , তাকে কেন জোর করবে ? একবার ভাব তো যদি ফিরেও আসে তার প্রতি তোমার সেই সম্মান বিশ্বাস কিংবা ভালবাসাটা থাকবে ?? যার আজ তোমাকে ভাল লাগছে না বলে চলে গেল , কাল ফিরে আসলে তখন তার সারাজীবন তোমাকে ভাল লাগবে তার নিশ্চয়তা কি ??'
রিয়া খুব অবাক হয়ে উঠে দাঁড়াল ।
'আপনি কি তাকে চেনেন ?'
' না রিয়া ।'
' তাহলে??'
' তোমার ডায়রী টা এখানে ছিল , আমি ২টা পেজ পড়ে ফেলেছি । আমি সত্যিই স্যরি এইজন্য । এই কাজ টা আমার করা উচিত হয়নি ।' আমি বেরিয়ে এলাম ! হঠাৎ পিছন থেকে ডাক ।
‘শুনুন...'
' জি ?'
‘সত্যিই কি আপনার আমাকে পছন্দ হয়নি ?’

. . ২. 

রিয়ার গল্প –
ক.
“ ‘এই রিয়া শুনো , শুনো একটু ... এই রিয়াআআ , শুনছ !!’ আমি পিছন ফিরে দেখছি না । আমি ছুটছি , জোরে ছুটে যাচ্ছি ... আমি তাঁর কথা শুনতে চাইনা । কিচ্ছু শুনবনা আমি । আমি ছুটে যাচ্ছি । ছুটেই যাচ্ছি । তাঁর থেকে দূরে , একটু একটু করে দূরে । আরও দূরে ! অনেক বেশি দূরে । সব কেমন ঘোলাটে হয়ে আসছে ! কেমন যেন বদলে যাচ্ছে দৃশ্যটা !
আমি এয়ারপোর্টে ছিলাম , সেইখান থেকে দৌড়াচ্ছি ... এখন দেখি একটা বিলের পাড় । কেউ নেই আশেপাশে ! আমি একা শুধু ... বিলের দিকে একটু উঁকি দিলাম । সাথে সাথে বিলের পানিতে তাঁর প্রতিচ্ছবি !
চারদিক থেকে প্রতিধ্বনি হয়ে আসতে লাগলো, ‘রিয়া শুনছ না কেন ? প্লিজ একটু শুনো !! রিয়া !’ ‘রিয়া , আসোনা ... আসবেনা তুমি ?’
আমি সহ্য করতে পারছি না এই অসহ্য আহ্বান । কিছুতেই না। আমি শুনতে চাইনাআআআ । দুকানে হাত চেপে কাদার উপর বসে পড়লাম আমি । কেঁপে কেঁপে উঠছি আমি !!! আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম ! চোখের ভিতর অবিরাম অসংখ্য রঙের ঘূর্ণি চলছিল ! লাল, নীল, সবুজ, কালো, বেগুনী, কালো , আসমানি , মেঘ রঙ । আমার কষ্ট হচ্ছিল , চোখে অল্প অল্প পানি জমছিল, কচু পাতার উপর শিশিরবিন্দুর মত ! কিন্তু তবুও যেন কষ্টটুকু ভাল লাগছিল !!!!’’

সব যেন স্পষ্ট দেখছিলাম আমি । এত জীবন্ত ! তাহলে আবার হল ! কেন ? এই নিয়ে চার টা দিন আমি তাঁকে স্বপ্নে দেখলাম । এমন অদ্ভূত কেন স্বপ্ন গুলো ! আমি কেন তাঁকে বারবার স্বপ্নে দেখছি , আমি জানি না । ঘরে এসির শীতল হাওয়া , তার মাঝেও আমি ঘামছি রীতিমত !
প্রথম দিন স্বপ্নে দেখলাম উনি আমাকে বলছেন, বাহ রিয়া তোমার রান্না তো অসম্ভব ভাল । সরষে ইলিশ টা তোমাদের ম্যাডাম খুব পছন্দ করে । ম্যাডাম মানে বুঝেছ তো ? আমার বৌ ! হাহাহাহা ... যাও তো ওকে একটু দিয়ে আস ! ওর ধারণা পৃথিবীর সেরা রান্না অই করে !
আমিও নিয়ে তাঁর ওয়াইফ কে দিলাম আর উনি খেয়ে আমাকে একটা চড় দিলেন ! 'এই মেয়ে তোমার সাহস তো কম না । দূর হও চোখের সামনে থেকে । আর যেন আমাদের আশেপাশে না দেখি তোমাকে .....'
. ব্যস , ঐদিন এইটাই দেখেছিলাম স্বপ্নে ! প্রথমদিন দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম । এ কাকে দেখছি আমি ! খুব চেনা লাগে , কিন্তু চিনতে পারিনা ! কে সে ? কেন এভাবে আমার স্বপ্নে আসে বারবার ? তার কি মরার জায়গা নাই ? দুমাস ধরে আমার স্বপ্নে এসে জ্বালাচ্ছে কেন আমাকে ! কেমন নির্দোষ ধরণের অর্থহীণ স্বপ্ন ! কেন দেখছি আমি ! জানতাম , যা ভাবি তাই স্বপ্ন হয়ে দেখা দেয় !? তাহলে এসব স্বপ্ন কেন দেখছি ? আমি তো কখন এই লোকটিকে দেখিওনি । কেমন যে একটা অস্বস্তি কাজ করছে ভিতরে ! কারো সাথে শেয়ার ও করতে পারছিনা । বন্ধুদের বললে এই কথা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে কাহিনী বানিয়ে রাষ্ট্র করে দিবে !! যত্ত সব ! .
রাশেদ কে তো বলা অসম্ভব । কাঁচা গিলে ফেলবে আমাকে ! ওর মুখে কিচ্ছু আটকায় না । যাচ্ছেতাই আজেবাজে ইঙ্গিত করে মেজাজ টাই খারাপ করে দিবে । ফোন টা হাতে নিলাম । ভোর সাড়ে চারটা বাজে । রাশেদ রাতে বাড়ি যায়নি কাল । সারারাত না ঘুমা বেচারা ! ফোন দেয়া উচিত না । তবু দিয়ে ফেললাম । এবং যা ভেবেছিলাম তাই হল না । রিং এর পর রিং বেজে গেল না ।

আমাকে একটু অবাক করে দিয়ে উনি দু রিং এই ফোন টা ধরলেন ...
‘কী রিয়া ? ঘুম ভেঙ্গে গেল ?’
‘হুমম । তুমি কই ? বাসা , অফিস , না রাস্তায় ?’
‘এইতো অফিস ।’
‘এখনো কাজ করছ !’
‘উহু , আড্ডা দিচ্ছি । কাজ শেষ ।’
‘কাজ শেষ তো বাসায় গিয়ে ঘুমাও , আড্ডা দিচ্ছ কেন ?’
‘কাল ছুটি নিয়েছি । সারাদিন ঘুমাতে পারব । সমস্যা নাই । আচ্ছা এখন রাখি ।’
‘এই শুন । শুন । কাল তাহলে দেখা কর ।’
‘দেখি , পারলে ।’

ফোনটা কেটে দিল রাশেদ । তবু আর ও কিছুক্ষণ কানে নিয়ে বসে থাকলাম ফোনটা ! আমার কতদিনের অভ্যাস ! ও বরাবর এমনি , দিনদিন আরো অনুভূতিহীণ হয়ে যাচ্ছে ! শেষ কবে ভালোবাসি বলেছে আমাকে তাও আমার মনে নেই ! কিছু বলিনা আর ! কত বলা যায় ! একলা অনুভব করি ওর কথা বলার মাঝে না বলাটুক , যা আমি শুনতে চাই ! আমার এতেই আনন্দ !
যেমন আমি ওকে বললাম যখন , ‘কাল দেখা কর !’
ও উত্তর দিল , ‘দেখি, পারলে !’
আর আমি শুনেছি , ‘ আমিও আর পারছিনা ! কতদিন দেখিনা আমার জান টাকে ! অবশই দেখা করব কালকে ! তুমি কিন্তু জলদি চলে আসবে ! ’
ও ফোন রেখে দেয়ার পর ও আর একটু কথা বলি একলাই ! ওর উত্তর টাও নিজেই দেই । তাই ফোন টা কানের কাছে ধরে রাখি অনেকক্ষণ ! এই ছেলেমানুষি খেলায় যদি আমার ভালই লাগে কার কি ক্ষতি ! বাস্তবে যা রাশেদ দিচ্ছে না আমার আমার কল্পনার রাশেদ সেটা ঠিক ই দিয়ে দিচ্ছে ! আমি ও খুশি , রাশেদ ও ! কি সমস্যা ! লাইট টা নিভিয়ে দিলাম । ....
৫টা বেজে যাচ্ছে , ঘুমানো দরকার ! মাথার ভিতর গান বাজছে ।
রাশেদের প্রিয় গান !
“ একদিন স্বপ্নের দিন , বেদনার বর্ণ বিহীন ... .
.এ জীবনে যেন আসে এমনি স্বপ্নের দিন ! ....
সে ভাবনায় , ভাবে মন হায় ... দুটি নয়নেতে ঘোর বর্ষা নামে..
.
আসেনা ফাগুন , মনেতে আগুন... ...]
এমনও বিরহ জ্বালায় , স্মৃতির মেলায় কাটে না আর দিন ! ” . . .
.

খ.
'বৃষ্টি নামছে রিয়া ...'

বেচারা রাশেদ ! বৃষ্টিতে ভিজছে আমার রাশেদ ছোট বাচ্চাদের মতন ! চশমার কাঁচ তাঁর ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে তার ! চশমা ছাড়া ছেলেটা ভাল দেখেনা তেমন ! আমি আর রাশেদ দাঁড়িয়ে আছি যমুনা নদীর পাশে । হাইওয়ে তে ! যাচ্ছিলাম যমুনা রিসোর্ট । কত্তদিন ঘ্যানঘ্যান করার পর এক টা দিন সময় বের করেছে রাশেদ আমাকে নিয়ে ঘুরার জন্য ! ঢাকায় ঘুরার জায়গা নেই কোন ! ঘরের বাইরে যেতে হলে কোন চাইনিজ , ফাস্টফুড , লাউঞ্জ অথবা শপিং মল ! আর কিছুই নাই ! রাশেদ মোটেও পছন্দ করে না । আমিও যে করি তা না , কিন্তু মন্দের ভাল ; আর কি করব ? কিন্তু রাশেদ খোলা রাস্তা , পার্ক , লেক একদম পছন্দ করেনা , তাঁর কারণ ও আছে অবশ্য ।
একবার দুজন রমনা পার্কে ঘুরতে গেলাম , আমিই জোর করেছিলাম ... আর দুইটা মেয়ে সাপ নিয়ে যা ভয় টাই দেখাল... বাবারে বাবা । বলে কি, ‘তোরা জীবনে সুখি হবিনা ... জীবনে না ...’
যা ভয় পেয়েছিলাম । ২০/৩০ টা টাকা দিলে কি ই বা হত ! না উনি দেবেন না ... শুধু শুধু অভিশাপ পাওয়া ! যদি তাদের কোথা সত্যি হয়ে যায় ! যা ভয় লাগে আমার ... এরপর জীবনে আর এমন সব জায়গায় বের হয়নি আমাকে নিয়ে । কিন্তু দেখা তো করতে হবে । তাই সেই ফাস্টফুড শপ ! আমার তো ওর সাথে থাকা দিয়ে কথা ! হোক সে ঠাণ্ডা বাতাসের শপিং মল আর কাঠফাটা রোদে খোলা রাস্তায় ! আর যদি এমন বৃষ্টিভেজা যমুনার পাড়ে হয় , তবে তো সেইটা আমার বাড়তি পাওয়া !

যমুনা রিসোর্টে আসার প্ল্যান টা আমার ই । একটু খোলামেলা পরিবেশ , নদীর তীর , যমুনা ব্রিজ , সুইমিং পুল , একটু নীরবতা । কোন কাজের চাপ নেই । শুধু আমি আর রাশেদ । সারাদিন হাত ধরে বসে থাকব দুজন ! পরিচিত কেউ দেখে ফেলার ভয়টা তো ছিলই ! তবু জেনেশুনেও এই রিস্ক নিয়েছি শুধু একটু সময় রাশেদ কে একলা পাবার জন্য ! দেখাই পাইনা তার । কাজের চাপ দেখিয়ে কত দিন কথা হয়না । দূরে হারাতে হারাতে হারিয়ে ফেলছিলাম আমার জান টাকে ।
ভোরেই রওণা দিলাম । কে জানত , পথে এমন বৃষ্টি নামবে ? আর আমরা দুজন বৃষ্টি দেখে পাগল হয়ে যাব ! নিশিতে পাওয়া মানুষ বলে একটা কথা আছে , বৃষ্টি তে পাওয়া মানুষ ও কি আছে ?? রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে বৃষ্টিবিলাস করছি দুজন ! বিন্দু বিন্দু কাল মেঘে নেমে আসছে চোখের উপর ! বৃষ্টির পানি আমার চোখের পানি ছুঁইয়ে বড় বড় ফোঁটা হয়ে গাল বেয়ে পড়ছে ! রাশেদ কি দেখতে পাচ্ছে ? পাবার কথা না । ছেলে টা চশমা ছাড়া অতো ভাল দেখতে পায় না । আমার মাত্র এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে রাশেদ । এই ছেলেটাকে এত ভালবাসি এইটা কি সে জানে ?? অসহায়ের মত বৃষ্টিতে ভিজছে সে । আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে ! সবাই কে বলতে ইচ্ছা করছে ,

‘এইযে এই যুবক টিকে দেখছেন না ?? এর নাম রাশেদ ! চশমা ছাড়া বেশী কিছু দেখে না । চশমা পড়েও দেখে না , তার এত কাছে এই যে আমি এক তরুণী দাঁড়িয়ে আছি তাকে দেখেও দেখেনা এই ছেলেটা । আমি এই ছেলে টাকেই ভালবাসি ! অনেক অনেক অনেক ভালবাসি । এই ছেলেটা আমার , শুধু আমার ... আমাআআআআআআআর একার !! আর কারো না !!!’ ....
ইচ্ছা করছে জড়িয়ে ধরি শক্ত ধরে । খোলা রাস্তা ... মানুষ জন দেখবে । দেখুক ... কিচ্ছু যায় আসেনা আমার ... যার যা খুশি দেখুক ...
জড়িয়ে ধরা হয়না আমার । চিৎকার করেও কিছু বলিনা । শুধু বিড়বিড় করে বলতে থাকি ,
‘ভালবাসি ... ভালবাসি... ভালবাসি...’
ভেজা কাপড়ে আর ঘোরা হয়না সবুজ ঘাসে । রিসোর্টের বুক করা কটেজে চলে এলাম ভেজা কাপড় ছাড়তে । প্ল্যান ছিল সুইমিংপুলে দুজন লাফালাফি করব ! সুইমিং পুলে নামলে আমি তের বছরের কিশোরী টি হয়ে যাই । মনেই থাকে না বয়স আমার ২১ কিন্তু তা আর হল কই ?
বৃষ্টি এসে সব নতুন করে সাজিয়ে দিল । পাগলা টা আমাকে টেনে নিয়ে যমুনা নদীতেই চুবাল ! প্রবল বৃষ্টির মাঝে উত্তাল যমুনা ।ওদিকের পাড় দেখা যাচ্ছিল না । এত পানি ! ঠিক যেন সমুদ্র ! আমি তো সাঁতার ই জানিনা ! দুহাতে আগলে রাখছিল আমাকে রাশেদ ! আমায় নিয়ে কেমন সাঁতার কাটছিল মাছের মত । প্রায় এক টি ঘন্টা দাপাদাপি করার পর ই উঠেছিলাম পানি থেকে ।

তারপর সোজা ঘরে । এখন কাপড় ছেড়ে খেতে যেতে হবে । ভীষন ক্লান্ত লাগছে । ঘুম ও পাচ্ছে ।
‘এই রিয়া ! আর কতক্ষণ ! এই ভেজা কাপড়ে বসে থাকবো নাকি ?’
এইরে , এমনিতেই ওর ঠাণ্ডা । তার ওপর এতক্ষণ ভিজার পর ... নাহ , আগে ওকেই ঢুকতে দেয়া উচিত ছিল ! কোনমতে শাড়ী টা গায়ে পেঁচিয়ে দরজা খুলতেই রাশেদ ছুটে এল !
‘হল তোমার এতক্ষণে !’
এসেই আমাকে দেখে ভ্যবাচেকা খেয়ে গেলো ! কেমন করে তাকাল যেন ! গোসলের পর মেয়েদের বুঝি অন্যরকম লাগে দেখতে ??
আমি পাত্তা না দিয়ে তোয়ালে টা ওর হাতে দিয়ে বললাম – ' গোসলে যাও তো ! ৫ মিনিটে বের হবা কিন্তু । আমার ক্ষিধে পেয়েছে ... '
কিন্তু রাশেদ গেল না । জড়িয়ে ধরল আমাকে । ওর চোখের দৃষ্টি পালটে গেছে !! আর আমার ? ফিসফিস করে ও কি বলছে কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছিনা ! বাইরে বোধহয় তুফান হচ্ছে ! বিকট শব্দে বাজ পড়ল একটা কাছে পিঠে কোথাও ... আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে ... .
.

গ.
আজ ক্লাস এ যাইনি । গতকাল ও যাইনি । একলা থাকতে ইচ্ছা করছে । ঘরে একলা পড়ে থাকি । সবাই জানে আমি কেমন বদলে গেছি ! চুপচাপ হয়ে গেছি খুব । আমি শুধু সেদিনের কথাই ভাবি । আর কিচ্ছু ভাল লাগে না । কেমন কষ্ট লাগে ! নিজেকে কেমন অপরাধী লাগে ! রাশেদ এর সাথে এই নিয়ে কোন কথাই হয়নি । সেও তুলেনি , আমিও পারিনি । ঐদিন কেমন ঘোরলাগা মানুষের মত কিছু খেয়েই ঢাকায় রওনা দিয়েছিলাম ! ঠিক মত খেতে পারিনি , গলা দিয়ে ভাত ঢুকছিল না । এমনটা আমি চাই নি ! দেড় টা বছর পেরিয়ে গেছে তারপর ।
কদিন ধরে মা খুব বলছে , কারা যেন আসবে ... আমাদের বাসায় । আমি কিছু বলিনি ... এমন কত কেউ ই তো আসে । কিন্তু বিয়ে টা সেখানেই হবে যেখানে আমি চাই । রাশেদ কেই চাই আমি । আর কাউকে না , আর কিচ্ছু না ।
সকাল থেকে ঘরবাড়ি গোছানো হচ্ছে , আমি একলা পড়ে আজ ও শুধু সেদিনেই হারিয়ে আছি ।
‘রিয়া মা , ওরা এসেছে । তুমি এ ঘর থেকে না ডাকলে বের হয়োনা কিন্তু ।’

আমি ঘাড় নাড়লাম । মা নিশ্চিন্তে চলে গেল । আমি বসে রইলাম ।
রাশেদের সাথে কথা হয়না কতদিন ! কতমাস ! আমি বুঝতাম ওর আমাকে পছন্দ হচ্ছে না আর । কিন্তু এইটা নিয়ে ভাবিনি । শুধু সময়ের অপেক্ষা করেছি ... ঠিক হয়ে যাবে একদিন সব । শুধু জানি না সেই ‘একদিন’ টা কী সত্যি আসবে কখনও ? কেন আমাকে আর ভালো লাগেনি রাশেদের ?? ভালবাসা টা কি কখনই ছিলনা ওর আমার জন্য ! তাহলে এই এত টা বছরে আমি কেন বুঝিনি এত টুকুও ?
ডায়রি টা বন্ধ করে উঠিয়ে রাখলাম জাণালার পাশে । আমার চোখে আবার পানি এসে গেছে , এই ছেলেটাকে ভাবতে গেলেই সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায় !!!

. . . .
৩.
তারপরের গল্প – 
...
আর মাত্র দুদিন । তারপর আবির আবার চলে যাবে ... আজকের দিনটা শুধু বন্ধুদের জন্য । কলেজ লাইফের মত হইহই করে দলবেঁধে বেরিয়ে পড়েছে তারা । শুভর মিনি মাইক্রো তে ! হাল্কা হাল্কা বৃষ্টি পড়ছে বাইরে !! তারা সবাই ঢাকার খালি রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে , হাসছে , হেসে গড়িয়ে পড়ছে ! রাস্তায় মানুষ খুব কম !! হঠাত অনিক চেঁচিয়ে উঠল ...
''আরে অই মেয়েটাকে দেখ ! কেমন পাগলের মত বৃষ্টিতে ভিজছে !''
সবাই ঘুরে তাকাল । গাড়িটা একটু স্লো করতেই আবির মেয়েটিকে খুব ভাল করেই চিনতে পারলো ।
মেয়েটা রিয়া !!!!!
আবির লাফিয়ে উঠল ,
' গাড়ী থামা , জলদি ।'
একটু সামনে গিয়ে ব্রেক করল অন্তু । এক দৌড়ে রিয়ার সামনে চলে গেল আবির । রিয়া বেশ চমকে উঠেছে !
রিয়া ... ঠাণ্ডায় কাঁপছে ও । ধবধবে সাদা রঙের শাড়ী তার পরনে ! গাড় করে কাজল দেয়া দুচোখে । রিয়া কাঁদছে ! ব্যস্ত হল আবির , এই মেয়েটা কি আর কিছু পারে না ? ...................
....................তারপরের ২০ মিনিটে সব ওলটপালট হয়ে গেলো ! রিয়ার হাত টা একবার ধরেছিল আবির । সারা পথ কোন কথা বলেনি , মূর্তির মত রিকশায় বসে থাকল দুজন ! রিয়ার বাসার কাছে আসতেই নেমে গেল রিয়া ... পেছনে ফিরে একটু দেখল ও না ... সারাটা রাত এপাশ অপাশ করল আবির । কিছুতেই ঘুম এল না তার ...

.... পরদিন রাত ৯টায় রিয়ার বাসার নিচে চলে গেল আবির । এসেই ফোন দিল রিয়ার ফোনে , নাম্বার টা জোগাড় করতে বেশ কায়দা করা লেগেছে !
- হ্যালো রিয়া !
-কে ?
-আমি , আমি আবির ।
ও প্রান্ত নিশ্চুপ... আবারও বলে আবির ,
- রিয়া শুনছ? রিয়া ... এই রিয়া ...
রিয়া কেঁপে কেঁপে উঠে , এই গলার আওয়াজ তার খুব চেনা ... খুব চেনা ... খুব পরিচিত ! কেন মনে পড়েনা তার ??
ওদিকটা বলতেই থাকে,
- রিয়া শুনছ না কেন ? প্লিজ একটু শুনো !! রিয়া...
- শুনছি .....
কোনভাবে বলে রিয়া ।
- আমি তোমার বাসার নিচে , একটু আসবে , এক মিনিটের জন্য ?? একটু ? প্লিজ ...
... তারপর অসহ্য নীরবতা !
- রিয়া ... আসবেনা তুমি ?
- আসছি ...
রিয়া নিচে যায় । ধীর পায়ে ... নিচে নেই কেউ । বাসার গার্ড এসে শুধু একটা খাম দিয়ে যায় ! .
. বাসায় ফিরে দরজা বন্ধ করে রিয়া । তারপর খাম খোলে । টুক করে কি যেন নিচে পড়ে , নিচু হয় কুড়ায় জিনিস টা , একটা আংটি ! সোনা বা হীরার নয় ! সাধারন এক সাদা পাথক ! হাল্কা ঝিলিক দেয় ..

. চিঠিটা খোলে রিয়া ...... .

‘রিয়া ,
আট বছর আগে , আমি তখন তোমার বয়সি ... যখন কানাডা আসি , একজন আমাকে কথা দেয় , আমার জন্য সে অপেক্ষা করবে । কিন্তু কথা রাখেনি সে । কাণাডা আসার ছ মাসের মাথায় তার বিয়ের খবর পাই । আজ তুমি যে কষ্ট পাচ্ছ , তা একদিন আমি পেয়েছিলাম ... একই রকম ! অনাকাংক্ষিত এক কষ্ট ! কল্পনাও করিনি , এইটাও হয় !! কিন্তু হয়েছে ... তখন নতুন দেশে আমি ছিলাম একা ... কোন বন্ধু , আত্মীয় কেঊ নেই ... আমার কেমন লাগত ভাবো ত ? আর তোমার সাথে তোমার সবাই আছে ।এত্ত এত্ত প্রিয়জন , যারা তোমাকে নিজের চেয়েও বেশি ভালবাসে ...
কারো জন্য জীবন কখনও থেমে যায় না রিয়া । জীবন চলতেই থাকে । চাইলে তুমি থেমে যেতে পার , কিন্তু সেক্ষেত্রে তুমি শুধু হেরেই যাবে .
.. .. শুধু শুধু অপরাধবোধে ভুগে জীবনটা নষ্ট কর না , প্লিইজ । ভালবাসাটা পাপ না , ভুল ও না ! ভুল ছিল সময়টা । একটুখানি ভুল সময়ের জন্য সারা জীবনটাকে হারিয়ে ফেল না । ..

খামের মাঝে একটা আংটি পেয়েছ ? পাথর টা মুনস্টোন । লাইট অফ করে দেখ , হাল্কা আলো ছড়াবে ... মায়াবী এক স্নিগ্ধ আলো ।
আংটি টা সাতটা বছর ধরে আমার মানিব্যাগে নিয়ে ঘুরছি । ঠিক করেছিলাম , যদি কখনো আমার পাশের বালিশে কার ও মুখ টা দেখতে খুব ইচ্ছা করে তবে তাকেই দিব এইটা ...
কাল যখন তোমার হাত ধরেছিলাম , আমি চমকে গিয়েছিলাম ... গত ক মাসের স্বপ্নের সে অস্পষ্ট মুখ টা যেন তুমিই ছিলে রিয়া ... ...
আংটি তোমায় পরতে হবে না , এইটা তোমায় দিলাম এইজন্য যে আমার পাশের বালিশে আর কাউকে আমি কোনদিন চাইব না জানি , নিশ্চিতভাবেই জানি ... ...
কাল ভোরে চলে যাচ্ছি , একটু পর এয়ারপোর্ট যাব ... ফিরে আশা করি দেখব তুমি রীতিমত সুখি গৃহিনীর মত বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ । ভাল থাকবে ...
ইতি
আবির ... . .

চিঠিটা ছুড়ে ফেলে মাটিতে বসে গেলো রিয়া .. . সে কাঁদতে চায়না তবু কাঁদছে ...কেউ আছে তার , কেউ ছিল ... কেউ থাকে ... কেউ একজন থাকে ভালবেসে... তবুও রিয়া কাঁদছে....

. হুমায়ুন আহমেদ তাঁর ‘বৃষ্টিবিলাস’ বই এ লিখেছিলেন , বড় কোন সিদ্ধান্ত নেবার আগে মেয়েদের চোখে নাকি পানি আসে... রিয়া বুঝতে পারছে না এই লোক টা এত কিছু কিভাবে জানত ...
কাঁদছে রিয়া , কাঁদতে কাঁদতেই মুনস্টোনের আংটি টা বাম হাতের অনামিকায় পরল। 
 
Top