চুরমার হয়া মনদরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেতেই জলদি থালাবাসন ধোয়া রেখে দরজাটা খুলে দিল খেয়া | রাশেদ ধোকার সাথে সাথেই বলল,কিছু হল ভাইজান ?

রাশেদ নির্বিকার,এলোমেলো হয়ে বসে পড়ল ঘুনেধরা সোফাটায় | সেই বাবার কেনা সোফা | এখনো যে ভেঙে যায়নি তাইই বেশি,ধকল কম যায়নি এই জড়টার উপর দিয়ে | খেয়ার আবার প্রশ্ন,ও ভাইজান কোন ব্যবস্থা হল? হঠাৎ খেয়ার গালে ঠাস্ করে একটা চড় মেরে পাশের রুমে হাটা দিল রাশেদ,ও চায়নি এই অসভ্যতা করতে কিন্তু কেনজানি ধৈর্যটা থাকল না | খেয়ার চোখে পানি টলটল করছে,ও জানে ওর দুলাভাই কেমন তাই তেমন কষ্ট পায়নি মনে | এসময় মিছে কষ্ট পাওয়ার কোন মানে হয়না |

কেয়ার পায়ের কাছে সেই রুমে ঢোকার পর থেকে একটানা বসে আছে রাশেদ | চোখে কোন পানি নেই,কোন ভাষা নেই,কিছুই নেই..কেবল শুন্যতা ! মাঝে মাঝে ফর্সা পা জোড়ার পাতায় ধীরে হাত বুলাচ্ছে যাতে কেয়ার ঘুম না ভাঙে | জেগে গেলেই তো যন্ত্রণা শুরু হবে,কি যে কষ্ট ! রাশেদ উঠতে যাবে এমনসময় কেয়া বলে উঠল,এই কই যাও,আরেকটু বস | - জামা কাপড় খুলে নেই,গোসল করব গরম লাগছে খুব | যা রোদ বাইরে - ফ্যান বন্ধ কেন,ফ্যানটা ছাইড়া এইখানে বস | - কারেন্ট নাই,সুইচ অন করাই | - এইখানে একটু বস,তুমি তো আমার কাছে আসোইনা | - সারাদিন তোমার কাছে পড়ে থাকলে টাকা আসবে কোথ্থেকে? - কি দরকার এত টাকার,আমার জন্য খালিখালি দৌড়াইতেছ,আমি তো মইরাই যাব |

রাশেদ কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়,ভীষন কষ্ট হচ্ছে ওর | একজন পুরুষ হয়ে হাউমাউ করে কান্না কি ঠিক হবে ? রাশেদ আর ভাবে না.... কেয়ার টলটল চোখে নিরবে চেয়ে থাকে রাশেদ,ওর চোখে এখন অবাধ ভালবাসা |

ওদিকে পর্দার ফাক দিয়ে ওদের দেখে কেবল কেদে চলে খেয়া |

২. আকরাম সাহেব ভীষন উত্তেজিত ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে আছেন | বসে আছেন বললে ভুল হবে,বেশ মোচড়ামুচড়ি করছেন | প্রেশারও বেড়ে গেছে | হঠাৎ রাশেদকে ঢুকতে দেখে তিনি একটু বিরক্তির স্বরে বললেন,এখন কোন ফাইলটাইল দেখতে পারবনা,আমি ভীষন টেনশনে আছি, তুমি এখন যাও | রাশেদ সাহস করে বলেই ফেলল কথাটা,স্যার ফাইল না,আরেকটা কারণে এসেছিলাম | খুব জরুরি স্যার... - কি আবার,তাড়াতাড়ি বল ! - স্যার আমার বেতন বাড়ানোটা খুব জরুরি,স্যার না বাড়ালে আমার ভীষন সমস্যা হয়ে যাবে | আমার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য অনেক...

টেবিলে ধড়াম এক বারি দিয়ে ওকে থামিয়ে দিলেন আকরাম সাহেব,ছেলেটাকে তার প্রচন্ড চাপড়াতে ইচ্ছে করছে | টাকা টাকা আর টাকা...!

নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে তিনি বললেন,গত ২ মাস ধরে তুমি এই এক টপিক নিয়ে আমাকে অতিষ্ট করে তুলছ,বলেছি তো দেব ! - স্যার আমার আসোলে... - স্টপ এন্ড গেটলস্ট প্লীজ !

রাশেদ বেরিয়ে যাচ্ছে,ওর চোখের জমাট পানির মর্ম হয়ত কেউই বুঝবেনা |

দুপুর ২ টা... ধনেপাতা দিয়ে রান্না মুরগির তরকারিটা পরম যত্নে পাত্রে তুলতে থাকে কেয়া,ওর দুচোখে আজ অবাধ তৃপ্তি খেলা করছে | খেয়া বলে উঠল,আপা তুমি যা শুরু করছ না,ভাইজান শুনলে তোমারে তো আস্ত রাখবেনা |

কেয়া একটু মুচকি হাসে শুধু,কিছু বলেনা |

৩. রাতে খাবার টেবিলে ৩ জন খেয়ে চলেছে যার যার মত | কেয়া বারবার তাকাচ্ছে রাশেদের দিকে,মুখটা একেবারে শান্ত | কিছু বুঝতে পারছেনা,সাহস করে বলতেও পারছেনা,রান্নাটা কেমন হয়েছে | রাশেদ কি তাহলে বোঝেনি এটা কার রান্না ?ভাবতে গিয়ে দুচোখ ছলছল করে ওঠে কেয়ার,গলা দিয়ে ভাত সরছেনা একটুও | ওর বরাবর বসা খেয়া চুপচাপ খাচ্ছে,ও ঠিকই বুঝেছে সব |

রাত ১২ টার একটু বেশি... বিছানায় ২ জন চুপচাপ শোয়া,কারো মধ্যে আজ কোন কথা হয়নি | রাশেদ তো খেয়েই মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়েছে | কেয়া আর কি করবে,রাশেদকে জাগিয়ে কথা বলার মত সাহস আজ পর্যন্ত ওর হয়নি | কেয়া আসোলে ভীষন কষ্ট পাচ্ছে,রাগ হচ্ছে খুব |

আজ শরীরটা একটু ভাল লাগল তাই খুব ইচ্ছে হল রাশেদের প্রিয় তরকারিটা রাধবে | যেই কথা সেই কাজ,খেয়ার সাথে শুরু রান্নাবান্না | রান্না করার সময় রাশেদের মুখটা বারবার ভেসে উঠছিল,একবার কেদেও ফেলেছিল,খেয়া খেয়াল করেনি | ও তখন ধনেপাতা ধুচ্ছিল | কত আশা করেছিল,রাশেদ খাওয়ার সময় নিশ্চয়ই কিছু একটা বলবে অথচ...টুটা মাত্র শব্দ করলনা,মানুষটা এমনতো ছিলনা,কেন এমন হল ?

ভাবতেই ঝরঝর করে ফেলে কেয়া | অঝোরে পানি পড়ছে চোখের কোণবেয়ে,মাঝেমাঝে কেপে ওঠে গলাটা,নিজেকে যেন কোনমতে সামলাতে পারছেনা |

ওদিকে দাতেঁ দাতঁ চেপে জীবনের সবচেয়ে প্রিয়মানুষটার কান্নার শব্দ শুনে চলেছে রাশেদ,দুহাত দিয়ে শক্তভাবে খামছে আছে চাদরটা |

কেয়ার হাতের রান্না ও বুঝবেনা এটা তো চিরন্তন অসম্ভব | কে বলেছে বোঝেনি,তরকারির ঘ্রাণেই বুঝে গেছিল এটা কে রেধেছে | সবকিছু বুঝেও চুপ থাকটা এখন কর্তব্য হয়ে দাড়িয়েছে | সবসময় আবেগি হতে নেই,আবেগ দেখাতে নেই,তাতে মনটাকে শক্ত রাখা যায়না | এখন থেকে মনটা শক্ত রাখতে না পারলে কেয়ার চলে যাবার পর রাখবে কিভাবে ? হ্যা কেয়া তো চলেই যাবে,ক্যান্সার হলে কি কেউ বাচে? তার উপর আবার হচ্ছেনা ঠিকমত চিকিৎসাও | লক্ষীমেয়েটা যন্ত্রনা পেতে পেতে মরে যাবে,চিরদিনের জন্য একা করে যাবে রাশেদকে...

রাত ২ টা... বারান্দাটা একদম জোছনার আলোয় ভেসে যাচ্ছে,এতসুন্দর জোছনার স্পর্শ বহুদিন পর পেল রাশেদ | আজ বোধহয় পূর্ণিমা | ওর মনে আছে,ওদের বিয়ের রাতেও ঠিক এরকম বড় একটা চাদঁ উঠেছিল | তা দেখে রাশেদ বলেছিল,বাপরে কত্তবড় চাদঁ উঠছে | আর এইকথা শুনে কেয়ার সেকি হাসি,মিষ্টিহাসির শব্দে চারপাশ যেন আরো নেশাময় লাগছিল রাশেদের | তাইতো সারারাত জাপটে ছিল কেয়াকে | কেয়া লক্ষীমেয়ের মত কখনো ওকে গল্প শোনাচ্ছিল কিংবা গান আবার হঠাৎ হঠাৎ একটু চুল টানছিল দুষ্টুমির ছলে |

রাশেদ আর ভাবেনা | মনটা বড়বেশি অস্থির লাগছে,প্রচন্ড ইচ্ছে করছে কেয়ার বুকে মাথা জাপটে হাউমাউ করে কাদতে |
 
Top