নিতুর মনে হচ্ছে টিপটা কিছুতেই কপালের মাঝখানে হচ্ছে না।এই নিয়ে ৭ বারের চেষ্টাতেও লাভ হল না।কপালে টিপ বসানো নিয়ে নিতুর এই খুতখুতে অভ্যাস বিয়ের আগে ছিল না।আর এখন আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজ হাতে টিপ বসালেও তার মনে হয় ঠিক জায়গায় বসেনি।অথচ জাহিদ কতো সুন্দর করে কপালের ঠিক মাঝখানে টিপ পরিয়ে দেয়।নিতু এখন জাহিদকে খুব মিস করছে।একবার জাহিদকে টিপ পরানোর সমস্যাটা বলাতে সে গলা ফাটিয়ে হেসে বলেছিল এটা ওর মনের ভুল।জাহিদের কথা শুনে খুব রাগ লেগেছিল নিতুর।আচ্ছা না হয় এটা নিতুর মনের ভুল,তাই বলে কি স্বামীর হাতে টিপ পরার মধ্যে যে ভালবাসাটা লুকিয়ে থাকে সেটা কি জাহিদ বুঝেও বুঝে না?এইজন্য প্রতিবার একা একা টিপ পরতে নিতুর মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়।জাহিদের প্রতি খুব অভিমান হয়।বিয়ের পর আসলেই ছেলেরা বেরসিক হয়ে যায়।কিন্তু আজকে জাহিদের সাথে রাগ করা যাবে না,আজকে যে ওদের ৩য় মেরেজ ডে।মায়ের কাছে শুনেছে এই দিনে স্বামীর সাথে রাগ দেখাতে নেই।আজ নিতু অনেক সময় নিয়ে যত্ন করে সাজবে।সাজতে গিয়ে সবসময়ই তার বাসর রাতের কথা খুব মনে পরে।জাহিদকে দেখলে এমনিতে এতো লাজুক মনে হয় না।বিয়ের রাতে নিতুর সামনে বসে জাহিদ যেন লজ্জায় মোমের মত গলে যাচ্ছিল।নিতুর হাতটা ধরতে ধরতেই বেচারা বাসর রাতের অর্ধেকটা পার করে দিয়েছিল।
বড় বোনের কঠিন পরিনতি আর মায়ের ইচ্ছাকে পূর্ণ করতে গিয়ে কখনই প্রেমের পথে পা বাড়ায়নি নিতু।বাসর রাতেই বুঝতে পেরেছিল আল্লাহ্ তার ধৈর্যের উপযুক্ত পুরস্কার হিসেবে উপযুক্ত মানুষটাকেই মিলিয়ে দিয়েছেন।এইসব ভাবতে ভাবতে নিতু সাজছিল।ঘড়ির দিকে চমকে উঠল।আড়াই ঘণ্টা ধরে ও সেজেই যাচ্ছে!আয়নায় নিজেকে দেখে খুব লজ্জায় পরে গেল সে।নিজেকে কেমন বউ বউ লাগছে।বারোটা বাজতে আর খুব বেশি দেরি নেই।ভাবছে অন্যবারের মত জাহিদ ওকে চমকে দেবে তো?আর নিতু তখন এমন ভাব করবে যেন বিয়ের তারিখটা ও বেমালুম ভুলে গেছে।নিতু এদিক দিয়ে খুব সুখী।জাহিদ এইসব তারিখগুলো কখনই ভুলে যায় না।নিতু জানে আজকেও সেই ভুল হবে না।আজকে বিয়ের শাড়িটাই পরেছে নিতু।এই শাড়িটা পড়লে এখনো আগের মত লজ্জা লাগে।নিতু ভাবছে,জাহিদও যদি এই দিনে বিয়ের পোশাকটা পরত,তাহলে কি মজাটাই না হতো।কিন্তু ছেলেরা যে ওই পোশাকটা জীবনে একবারই পরে।
রাত বারোটা।দুবাই থেকে আনা সোনালী ঘড়িটা মিষ্টি মিষ্টি সুরে যেন মেরেজ ডের কথাই নিতুকে জানিয়ে গেল।নিজের অজান্তেই বুকের মাঝে ঢিব ঢিব শব্দটা বেড়ে গেল।নাহ... এবারো ভুল হয় নি...সবার আগে জাহিদই ফোন করলো।কিন্তু অন্যবার যেমন নিতুর খুব খুশি খুশি লাগে,কিন্তু এবার বরং জাহিদের কণ্ঠ শোনার সাথে তার বুক ফেটে কান্না আসছিলো।এখন পর্যন্ত কোন মেরেজ ডেতেই জাহিদকে কাছে পাওয়া হয়নি।প্রতিটাবারই প্রবাস থেকে ফোনে উইশ করেছে।মিতুর কথাগুলো খুব মনে পরছে।মিতু নিতুর ২ বছরের ছোট বোন।ভালবেসে বিয়ে করেছে।সেদিন নিতুকে তার বরের কথা বলছিল।স্বামীর সাথে মান,অভিমান আর ঝগড়াগুলো নিয়েই তার সব গল্প।মিতুর ছেলেমানুষী অভিমানগুলো দেখে নিতুর যেমন হাসি পায় তেমনি বুকটা শুন্য শুন্য লাগে।স্বামী মেরেজ ডেতে ছুটি নিতে পারেনি বলে মিতুর সেকি অভিমান।মাঝে মাঝে রাগ করে মিতু নিতুর বাসায় চলে আসে।নিতুর মনে মনে ভাবে...জাহিদ যদি দেশে থাকতো তাহলে যত যাই হোক কখনো ওর সাথে রাগ করে চলে আসতো না,মেরেজ ডেতে ছুটি না নিলে কখনো বকাবকি করতো না।শুধু রাতেরবেলা জাহিদের একটু স্পর্শ পেলেই চলতো।ফোনের এপাশে নিতু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না থামাতে পারছে না।আর ওদিকে জাহিদ চুপচাপ শুধু শুনে যাচ্ছে।নিতু জানে জাহিদেরও বুকটা দুমরে মুচড়ে যাচ্ছে।পুরুষ মানুষের এই এক সমস্যা,কান্না দিয়ে তারা কখনো দুঃখগুলো ধুয়ে ফেলতে পারে না।বরং পাথরের মত শক্ত করে সেগুলো জমিয়ে রাখে।জাহিদকে আর কষ্ট দেবার কোন মানে হয় না।তাই ফোনটা রেখে দিল নিতু।এখন নিতু আয়নার সামনে বসে বসে কাঁদবে।কেঁদে কেঁদে বিধাতার কাছে অভিমান করবে।বিধাতার কাছে জানতে চাইবে কেন তার স্বামী ৩ বছরে মাত্র সে ৪৩ দিন কাছে পেয়েছে।কেন তাদের সংসারে এমন অভাব দিলেন যে বাধ্য জাহিদকে ছুটে যেতে হল দেশের বাইরে।
রাত ২টা।নিতুর মোবাইলটা একটু পর পর ভাইব্রেসনের ভোঁভোঁ আওয়াজ করছে।সবাই নিতুকে বিবাহবার্ষিকীর উইশ করতে চাচ্ছে।কিন্তু নিতুর সেইদিকে কোন নজর নেই।সে এখন আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে।তাকিয়ে আছে তার কয়েকভরি গহনা আর সাজসজ্জার দিকে।তার আরাম আয়েশ,সাজ সজ্জা আর হাতখরচের কোন কমতিই জাহিদ রাখেনি।এখন নিতুর খুব ইচ্ছে হচ্ছে এইসব গয়না,সাজসজ্জা সব ছুড়ে ফেলে দেয়।গতবার ৪৩দিনের ছুটিতে জাহিদ এগুলো সব নিয়ে এসেছিল।এগুলোর চেয়ে জাহিদের সাথে কাটানো ৪৩ টা দিনই তার কাছে হানিমুনের মত মনে হয়েছিল।বিয়ের পর ২২দিনের মাথায় যখন জাহিদ চলে গিয়েছিলো তখন কিন্তু নিতুর এমন খারাপ লাগেনি।৪৩ দিন ছুটি কাটিয়ে যাবার সময় নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছিল না।দুবাই থেকে রাতের বেলা সাধারণত ১১টার দিকে জাহিদ ফোন দেয় নিতুকে।সময়মত ফোন না পেলে নিতুর খুব অভিমান হয়।কিন্তু জাহিদের কণ্ঠে ক্লান্তির আর অবসাদ ছোঁয়া কথাগুলো শুনে তার অভিমানগুলো গভীর মায়ায় পরিণত হয়।
সকাল সাড়ে ১০টা।মোবাইলে জাহিদের ২২টা মিসকল।নিতু বিছানা ছেড়ে উঠে আয়নায় নিজের ফোলা ফোলা মুখ দেখে অবাক হয়।সারারাত জুড়ে কান্না তার চোখকে এতোটা ফুলিয়ে দেবে ভাবেনি।এতো কান্নার পরও নিতুর অভিমান পুরোপুরি কমেনি।আরেকটু কাদতে পারলে ভালো হতো।এই কথা যখন ভাবছে তখন কড়া শব্দে কলিং বেল বেজে উঠলো।এই সময় কে আসতে পারে নিতুর ভালো করেই জানা আছে।রুপা ছাড়া আর কে হবে।প্রায় সকালেই রুপা নিতুর বাসায় ঢু মেরে যায়।নিতুর মতো রুপারও স্বামী দেশের বাইরে থাকে।এই রুপাই হতে পারতো নিতুর সবচেয়ে বড় সমব্যথি।গত ৫ বছরে রুপার স্বামী মাত্র একবার দেশে এসেছে।অথচ রুপাকে দেখলে সেটাতো বুঝাই যায় না,বরং মনে হবে কতো আনন্দেই না আছে।স্বামীর টাকার যে যথেচ্ছ ব্যবহার করা হয়,তা রুপার বেশভূষাতেই বোঝা যায়।নিতুর যেখানে সময় কাটে না,রুপা সেখানে সময় খুজে পায় না।কেননা রুপার ভার্চুয়াল ফ্রেন্ডের অভাব নেই।কাউকে একটু ভালো লাগলেই কথা চলে রাতের পর রাত।আর তাদের মাঝে কাউকে হয়তোবা বেছে নেয় ডেটিং পার্টনার হিসেবে।রুপা এইসব ব্যাপার নিতুকে এতো মুখরোচক করে বোঝায় যে একদিন নিতুর সত্যি সত্যি লোভ লেগে গিয়েছিলো।রুপা তাকে আগ্রহ ভরে কয়েকটা হ্যান্ডসাম ছেলের নাম্বারও দিয়ে গিয়েছিল।রূপার মতে সব স্বামীরা বিদেশে গিয়ে কমবেশী ফষ্টি নষ্টি করে। সুতারাং ওরা একাকীত্ব কাটাতে ফোনে একটুআধটু খোশগল্প করলে সমস্যা কি।কিন্তু জাহিদকে ফাকি দিয়ে অন্যায় কিছু করতে বিবেকে কুলোয়নি নিতুর।
রুপার বাসায় একদিন নিতু বেড়াতে গিয়েছিল।সেদিনটার কথা আজো ভুলতে পারে না সে।গানের ডিভিডি খুঁজতে গিয়ে এমন কিছু সিডি খুজে পেয়েছিলো যা কোন বিবাহিত মেয়ের কাছে থাকতে পারে বলে তার কল্পনাতেও ছিল না।নিতুর অবাক হয়ে যাওয়াতে রুপা বলল,যেসব মেয়ের স্বামী কাছে থাকে না তাদের কাছে এগুলা থাকা অস্বাভাবিক কিছু না।ওইদিন নিতু চলে আসার সময় হঠাৎ রুপার কি মনে হল কে জানে।নিতুকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না।গত ৫ বছর ধরে ঝগড়া করেও স্বামীকে কাছে না পেয়ে অভিমান করে এইসবে জড়িয়েছে ও।প্রথম প্রথম প্রতিটা ঘণ্টায় ওর স্বামী ফোন দিতো।আর এখন মাস পেরিয়ে গেলেও খোজ থাকে না।শুধু টাকা দিয়েই সে উদ্ধার হয়ে যায়।সেইদিন থেকে রুপাকে আর অতোটা খারাপ লাগেনি নিতুর।বরং কিছুটা মায়াই বোধ করেছে।
কলিংবেলের আওয়াজে নিতু ভেবেছিলো রুপা এসেছে।দরজাখুলে উপরতলার আসিফভাইকে দেখে চমকে উঠল।লোকটার মিষ্টি ব্যবহার আর মধুর হাসি দেখলে ভালমানুষ ভাবতে খুব ইচ্ছে হয়।লোকটা আসলে সাক্ষাত একটা নরকের কীট।তার চোখের দিকের তাকালেই বোঝা যায় তার মতলবটা কি।বিধাতা এই ক্ষমতা প্রত্যেক মেয়েকেই দান করেছেন।যে কোন মেয়ে চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারে ছেলেটা আসলে কি চায়।প্রায় সকালেই আসিফ ভাই গায়ে পরে নিতুর খোঁজখবর নেন,সাহায্য করতে চান।অথচ জাহিদ যখন এসেছিল তখন তার টিকিটারও খোঁজ মেলেনি।এইসব মধুসন্ধানী ছেলেদের ভালই চেনা আছে ওর।লোকটা দেখলেই কষে চড় লাগাতে খুব ইচ্ছা হয় নিতুর।
ফোনটা রাতে সাইলেন্ট করে রেখেছিল।তাই ভোরবেলা জাহিদের ফোনটা ধরা হয়নি।এইসময় জাহিদের ফোন সাধারণত আসেনা।কাল রাতের কান্না দেখে বোধহয় ও আবার ফোন দিয়েছে।এই কথা যখন ভাবছিল তখন আবার ফোন এল জাহিদের।কাল রাতে ১মাসের ছুটিতে দেশে ফেরার কথাটা জানিয়ে নিতুকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল জাহিদ।কিন্তু নিতুর বাঁধভাঙ্গা কান্না শুনে সে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গিয়েছিল।এখন ফোন করে জাহিদ সেই খবরটাই দিল নিতুকে।নিতুর এখন খুব ভাল লাগছে।আনন্দ তার নাচতে ইচ্ছা করছে।একটামাত্র ফোনই কিভাবে তার মন মুহূর্তের মধ্যে ভালো করে দিল।এখন নিতু জানালায় আকাশ দেখছে।আকাশের বুক চিড়ে উড়ে যাওয়া উড়োজাহাজগুলোকে সে চিনে রাখছে।পাখির মতো ডানা মেলে ওগুলোর মতো উড়ে বেড়াতে ইচ্ছা করছে।এই উড়োজাহাজগুলোর কোন একটাতে চেপেই তার জানটুসটা দেশে আসবে।এইবার নিতু মনস্থির করে ফেলেছে,দেশে আসলে কিছুতেই তার জানটুসটাকে ফিরে যেতে দিবে না।হাজারো জোরাজুরিতে যদি আটকে রাখা নাও যায়, মনের সমস্ত ভালবাসা দিয়ে আচ্ছা করে বেঁধে রাখবে জাহিদকে,যে ভালবাসার শৃঙ্খল ছিন্ন করার সাধ্য জাহিদের নেই।জাহিদ না হয় কিছু টাকা কমই উপার্জন করলো,তাতে কি।না হয় আধপেটা খেয়েই টোনাটুনির মত বাকি দিনগুলো পার করে দিবে।মনের মানুষকে পেয়ে গেলে কি খাওয়া হল,কি পরা হল তা কখনই জরুরী না।ভালবাসা যখন দুটো হৃদয়কে আপ্লুত করে রাখে তখন দুনিয়ার কোন কষ্টই আর হৃদয়দুটোকে কষ্ট দিতে পারে না। নিতু এখন দখিনের জানালায় দাড়িয়ে প্রানখুলে হাসছে।এমন হাসি সে বহুদিন হাসেনি।