হিজড়া
 ১৪ বছর বয়সে ববিকে পরিবার থেকে বের করে দেওয়া হয়। ‘হিজড়া’ হওয়ার কারণে
নিজের পরিবারই পরিত্যাগ করে তাকে।এত অল্প বয়সে পরিবার থেকে বের হয়ে ববি পরবর্তীতে ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়ের কাছেই আশ্রয় পান। কিন্তু, সমাজ, রাষ্ট্র থেকে বৈষম্যের শিকার হয়ে পদে পদে অবহেলা আর বঞ্চনা নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি।
শুধু ববিই নয়, তার মতো আরো অনেকেই ‘হিজড়া’ হওয়ার কারণে পরিবার থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। কাউকে কাউকে আবার জোর করে বের করে দেওয়া হচ্ছে। সে কারণে আজ পরিবার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ১৫ বছর পরও সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে মৌলিক অধিকারটুকু চেয়ে পাননি ববি।
দেশে বহু নাগরিক মানবাধিকার থেকে বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন। তবে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছেন সমাজের প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠী ‘হিজড়া’ কেউ কেউ এ জনগোষ্ঠীর মানুষদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ বা ‘থার্ড জেন্ডার’ বলে থাকেন। কেউ আবার ‘বৃহন্নলা’ বলেও উপাধি দেন।
তবে যে নামেই তাদের ডাকা হোক না কেন আচার-আচরণ, চালচলনের কারণে এই জনগোষ্ঠীর মানুষ সমাজে চরমভাবে নিগৃহীত। সমাজের কাছে ন্যায্য পাওনার পরিবর্তে পাচ্ছেন ঘৃণা, অবজ্ঞা ও অবহেলা; নানা ধরনের বিদ্রুপ ও হয়রানির শিকার। এ কারণে তারা কোথাও সামান্য কাজও পান না।
এ বিষয়ে ববি বলেন, “একটু কাজের জন্য কোথায় না গেছি! কিন্তু কেউ কাজ দেয় না। বিনিময়ে শুধু ঠাট্টা আর বিদ্রুপ করে। চিকিৎসার জন্য কোথাও গেলে কেউ চিকিৎসা দেয় না। জাতীয় পরিচয়পত্রও পাইনি।”
একই অবস্থা পিংকিরও। লিঙ্গীয় পরিচয় হিজড়া হওয়ায় তার অভিজ্ঞতাও অন্যদের থেকে ভিন্ন কিছু নয়। সমাজ ও পরিবার থেকে বঞ্চনা নিয়েই বেড়ে উঠেছেন তিনি।
‘হিজড়া’ হওয়ার কারণে জাতীয় পরিচয় দেয়নি নির্বাচন কমিশন। পরবর্তীতে নারী পরিচয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র পান তিনি। তবে পিংকি হিজড়া সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি চান, যে স্বীকৃতির মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রে আর সবার মতোই অধিকার পাবেন তারা।
নিজের বঞ্চনা আর অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে সাগরিকা ‘হিজড়া’ বলেন, “আমাদের মূল সমস্যা, কাজ না পাওয়া। সিটি কর্পোরেশনে রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার কাজটাও পাই না। নিজের অধিকারটাও পাই না। বয়ঃসন্ধিকালে আমাদের পরিবার থেকে বের করে দেওয়া হয়। এভাবে পারিবারিক সম্পত্তি থেকেও আমরা বঞ্চিত হচ্ছি।”
তিনি বলেন, “কেউ কেউ কাজ দিলেও যে টাকা দেওয়ার কথা, তার অর্ধেকও দেয় না।”
সাগরিকা বলেন, “যানবাহনে আমাদের নিতে চায় না। আদমশুমারিতে ‘হিজড়া’ হিসেবে গণনা করা হচ্ছে না। আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, নেই পাসপোর্টও। কাজ পেলেই তো আমাদের জীবন চালানো অনেকটা সহজ হয়ে যায়। টাকা যেদিকে, আইন চলে সেদিকে। আইনের আশ্রয় থেকেও আমরা বঞ্চিত। আমরা মানুষ হিসেবে অন্যদের মতো বাঁচতে চাই।”
‘হিজড়া’ সম্প্রদায় ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারেন না। বাসস্থান, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, তথ্য ও আইনি সহায়তাসহ সব ধরনের নাগরিক সুবিধা থেকেই বঞ্চিত এই জনগোষ্ঠী।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্য দিয়ে চলছে এ জনগোষ্ঠীর জীবন। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষ্যমের শিকার হয়ে তারা সমাজের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রান্তিক সীমায় এবং দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে বঞ্চিত হচ্ছেন মানবাধিকার থেকে।
বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির প্রোগ্রাম ম্যানেজার এএসএম রহমত উল্লাহ বলেন, “সমাজের বৈচিত্র্য বিষয়ে সবাইকে অবগত হতে হবে। নতুবা বৈষম্য দূর হবে না। অন্যকে গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি হবে না। এ জন্য মানুষের মনই বড় বাধা। তাই, মন ও সমাজের এই বাধার দেওয়াল ভাঙতে হবে। এটি ভাঙতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সবাই এগিয়ে আসলেই তবে সুন্দর একটি সমাজ তৈরি করা সম্ভব হবে।”
এ বিষয়ে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সালেহ আহমেদ বলেন, “দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে বৈচিত্র্যকে গ্রহণ করতে হবে। আর ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়ের মানুষের সমস্যা নিয়ে বেশি বেশি কথা বলতে হবে। সর্বাত্মক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে।”
বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বলেন, “স্বাভাবিকভাবে আমাদের মতের ভিন্ন কিছু হলেই আমরা তা গ্রহণ করতে পারি না। আমাদের মতো কিংবা কাজের বিরুদ্ধে গেলেই তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিই। অন্যদেরটা গ্রহণ করতে চাই না। সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদ যেমন মানুষের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, হিজড়া সম্প্রদায়ের এই বিষয়টিও একই রকমভাবে মানুষের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন, “এর বিরুদ্ধে কঠিন লড়াই করতে হবে। কারণ, ক্ষমতাবানরা এই বৈষম্য জিইয়ে রাখতে চান।”
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, “অপবাদ ও বৈষম্যের মধ্যেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের বীজ নিহিত। গণতন্ত্র এখন সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করার বদলে কাকে বাদ দেবে সেদিকে চলে গেছে। এমন সংস্কৃতিতে প্রান্তিক ব্যক্তিটির অধিকার পদে পদে লঙ্ঘিত হচ্ছে। ৪০ বছর ধরে আদমশুমারির নামে প্রতারণা করা হচ্ছে। শুমারিতে সবাই অন্তর্ভুক্ত হলে সরকার লাভবান হবে।
হ্যালো টুডে 
 
Top