পড়ন্ত বিকেলে চারুকলার সামনে থেকে জুঁইকে একগোছা চুড়ি কিনে দেয় রাহুল । জুঁইয়ের পরনে হলুদ
শাড়ি, হাতে লাল চুড়ি। গালে হালকা মিষ্টি রোদ মেখে হাত ধরাধরি করে হেঁটে এগিয়ে চলে ওরা । স্মৃতি ভাস্কর্য , টিএসসি পেরিয়ে বইমেলার মূল প্রাঙ্গনে ঢোকে ওরা । দূরে কোথা থেকে মাইকে গান ভেসে আসছে তরুন তরুনীদের কন্ঠে ।
“আজ হোক না রং ফ্যাকাশে
তোমার আমার আকাশে
চাঁদের হাসি যত-ই হোক না ক্লান্ত
বৃষ্টি নামুক নাইবা নামুক ঝড় উঠুক
নাইবা উঠুক আজ বসন্ত ।”
রাহুল সেই ভেসে আসা গানের তালে মাথা দোলাচ্ছে । রাহুলের এই পাগলামি আচরন দেখে ভীষন রাগ হয় জুঁই এর । প্রথমে কিছু বলল না সে । কিন্তু কিছুক্ষন পর রাহুলের দোলাদুলি যখন বেড়ে গেল তখন জুঁইয়ের তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ -
-ঐ শোন । একদম পাগলের মত মাথা দোলাবি না। পোলাপান তোর দিকে তাকায়ে হাসবে ।
-হাসুক গা । আমারে পাগল বললে তোর কি ?
-কিছুই না । কিন্তু আমারে ও তো পাগলী ভাববে । নইলে তোর মত পাগলের সাথে আছি কেন ?
-তোর কি মনে হয় তুই যে সাজ দিছিস তাতে তোরে সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ মনে হইতেসে ? মোটে ও না। পুরা আমাদের পাড়ার আছিয়া পাগলীর মত লাগতেছে ।
- ফালতু কথা বলবিনা একদম । তোর কেনা এই পঁচা চুড়িগুলোর জন্যই তো খেত লাগতেছে ।
-এহ ! কোথায় ভাবলাম তোকে আইসক্রীম খাওয়াব । এখন আর কিচ্ছু খাওয়াব না ।
-খাওয়াস না । আমি কি তোর মত পেটুক নাকি?
রাহুল আর কোন কথা বলার প্রয়োজন মনে না করে বইয়ের স্টলের দিকে এগিয়ে গেল । প্রিয় লেখকের বইয়ের সংগ্রহ দেখে রাহুলবই কেনাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল । রাহুলের বই কেনার প্রতি তীব্র আকর্ষন দেখে জুঁই সামান্য বিরক্ত বোধ করল কিন্তু প্রকাশ করল না । কিন্তু জুঁইয়ের বিরক্তির প্রতি রাহুলের বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই । সে আপন মনে বই বাছাইয়ে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে । বিরক্তির সীমাযখন তীব্র পর্যায়ে তখন জুঁইয়ের চোখ পড়ল স্টলের বাইরে রাস্তার ওপারে কিছুটা ভিড়ের দিকে । কৌতুহলের সমাপ্তিঘটাতে ওখান থেকে নীরবে জুঁই ওদিকটায় রওনা দিল । এত ভীড়ের কারন জানতে পেরে জুঁইয়ের আনন্দ যেন আর ধরে না ! কোন এক হারবাল কোম্পানি মেহেদি লাগানোর আয়োজন করেছে মেয়েদের । কোনো ভাবনা চিন্তা না করেই নিজের মত নকশা পছন্দ করে নিল জুঁই । দু হাতে মেহেদির নকশায় ভরে গেল ।
হঠাত জুঁই মাথার ওপরে ভারি কিছুর আঘাত অনুভব করে যার ফলে তার পুরো শরীরটা যেনশিরশির করে ওঠে । কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাহুলের চিত্কার -
-”নির্বোধ ! তুই এখানে ! একবার বলে আসবিনা ? আমি তোকে খুঁজে মরি আর তুই ! মানুষকে টেনশনে ফেলতে খুব ভাল লাগে তাইনা ?”
রাহুলের হাতের দিকে তাকায় জুঁই । বুঝতে পারে যে তিনটে মোটা বই দ্বারা আঘাত করা হয়েছে তার মাথায় । মনের অজান্তেই চোখ থেকে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে ওর গালে । পড়ন্ত বিকেলের হালকা রোদএসে পড়েছে ওর ফুটফুটে মুখে । সে আভায় ওর দু ফোটা অশ্রু মুক্তোর দানার মত ঝলমল করে উঠল । রাহুল জুঁইয়ের দিকে খেয়াল করে তাকাতেই মাথা থেকে রাগ আর তীব্র ক্ষোভ কেমন হঠাত করে কোথায় যেন পালিয়ে যায় । জুঁইয়ের অশ্রুভরা চোখের অদ্ভুত দৃষ্টি আর মায়াভরা মুখটা রাহুলের সবকিছু কেমন ওলটপালট করে দেয় ।
এতটা খেয়াল করে জুঁইকে কখনও দেখেনি রাহুল । হঠাত একটা উড়ো হাওয়ায় জুঁইয়ের ঘনকালো চুলের সামনের অংশটুকু অশ্রুভরা চোখ দুটোকে ঢেকে ফেলল । রাহুলের মনে হতে থাকে যেন স্বর্গ থেকে এক অপ্সরী নেমে এসেছে যার অপুর্ব মায়াকারা সৌন্দর্য রাহুলকে মাতাল করে তুলছে । জুঁইকান্না কান্না গলায় বলে ওঠে -
-”তা বলে এত জোরে মারবি আমাকে ? জানিস কতটা লেগেছে মাথায় ? উফ !”
জুঁইয়ের কাঁদো কাঁদো আওয়াজ রাহুলকে তার স্বপ্নীল কল্পনা থেকে ফিরিয়ে আনে আর তার চোখ পড়ে যায় জুঁইয়ের হাতে ।
-কি লাগিয়েছিস এসব হাতে ? ইয়াক !
-এটা মেহেদী । তুই বুঝবি কি এসবের ?
-কি বাজে গন্ধ ! এখন কি এই গোবরের মত জিনিসটা হাতে লাগিয়ে ঘুরবি ?
-এই শোন ! এটা গোবর না । এটা মেহেদী । ঘন্টা খানেক পর ধুয়ে ফেললে হাতে সুন্দর রঙিন
নকশা তৈরি করে ।
-এহে ! এক ঘন্টা তুই এই বাজে গন্ধ ওয়ালা জিনিস নিয়ে ঘুরবি ?
-এটা মোটে ও বাজে গন্ধ ওয়ালা জিনিস না ।এটা মেহেদী মেহেদী মেহেদী । হঠাত রাহুলের ফোনটা বেজে ওঠে । ফোনটা নিয়ে কথা বলার জন্য একটু দূরে সরে যায় রাহুল। কি কথা বলছে ,কার সাথে কথা বলছে তা জানতে জুঁই একটু এগিয়ে আসে । কিন্তু রাহুল তাকে দেখতে পেয়ে আরো দূরে সরে যায়। এবার ভীষন রাগ হয় জুঁইয়ের । রাগে গমগম করতে করতে রিক্সা ঠিক করতে রওনা দেয় জুঁই । খোপার গোলাপটা পড়ে যায় মাটিতে ।
-মামা যাবেন ? ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল গেইট ।
রিক্সায় উঠে পড়ে জুঁই । পিছন থেকে রাহুলের গলা শুনতে পায় সে -
-এই জুঁই । কই যাস ?আরে ! হলোটা কি ? দাঁড়া !কই যাইতেছিস তুই ? জুঁইয়ের রিক্সা চলতে শুরু করে তার হলের দিকে । আর রাহুলের গলাটা ধীরে ধীরে আবছা হতে হতে একসময় বাতাসের সাথে মিলিয়ে যায় । খুব রাগ হতে থাকে জুঁইয়ের ।
“কার সাথে কথা বলছিল রাহুল? আমাকে দেখেওদিকটায় সরে গেল কেন ? ও কি ওর গার্লফ্রেণ্ডের সাথে কথা বলছিল ! হুহ ! এরকম একটা পাগলকে কোন মেয়ে ভালবাসবে শুনি ? আচ্ছা আমার এত রাগ হচ্ছে কেন ?” এসব ভাবতে ভাবতেই জুঁইয়ের মনে পড়ে যায় রাহুলের সাথে প্রথম পরিচয়ের কথা । গত পহেলা বৈশাখে কলেজ ফ্রেণ্ড মিতার সাথেটি,এস,সি তে আড্ডা দিচ্ছিল সে । পরনে ছিল লাল পেড়ে সাদা শাড়ি । আর খোঁপাতে বেলী ফুলের মালা। হঠাত মিতা একটি ছেলেকে দেখেই মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে
-”কিরে রাহুল ! তুই এখানে ? একাই নাকি ?”রাহুল নামের ছেলেটির জবাব -”হুম একাই। এতক্ষন অবশ্য সৈকত ছিল । ও আবার কোথায় যেন গেল !” রাহুল মিতার সাথে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে । Physics ডিপার্টমেন্টের Student সে । অতি সাধারন,উসকোখুশকো চুল ,শ্যামলা বর্নেরচশমা পড়া ঐ রাহুলের সাথে সেদিনই প্রথম আলাপ হয় জুঁই এর । তারপর বন্ধুত্বটা ফেইসবুকের এ্যাড এক্সেপ্ট থেকে শুরু করে পৌঁছে যায় জুঁইয়ের মেডিকেল কলেজ চত্বরে । ধীরে ধীরে সেখান থেকে পৌঁছে যায় ধানমণ্ডি লেক , রবীন্দ্রসরোবরে । যেখানে একে অপরের কাঁধে মাথা রেখে হারিয়ে যায় স্বপ্নের জগতে , সেখানে ওরাদুজন একে অপরের চুল টানতে ব্যস্ত । কখনো বা সেটা পৌঁছে যায় বন্ধুত্বের মিষ্টি ঝগড়া ও মারামারিতে । এ কেমন বন্ধুত্ব জানেনা জুঁই । যে বন্ধুত্ব একদিনের নীরবতা মানেনা । সারারাত ফোনেকথা বললেও যেন কথা ফুরোতে চায়না ওদের ।জুঁই চোখ বুজে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে । চোখ বুজতেই রাহুলের সাদামাটা মুখটা ভেসে ওঠে জুঁইয়ের চোখের সামনে ।” একী ! রাহুলের মুখ কেন দেখলাম ?আচ্ছা আমার কী হয়েছে ?রাহুল ফোনে আমাকে না জানিয়ে কথা বলছিল তাতে আমার কেন এত রাগ হল ! আমি কেন এত পাগলামি করলাম ?” হঠাত জুঁইয়ের ফোনটা বেজে উঠল । স্ক্রিনে রাহুলের নাম । ফোনটা বন্ধ করে ফেলে সে । ঐ মুহুর্তেই পন করে ফেলে সে । আজ রাতে ফোনটা আর অন করবেনা । ফাল্গুনের প্রথম রাত না খেয়ে না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেয় সে । ফোনটা অন করবে কি করবে না এ নিয়ে অনেকবার ভাবনা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিল সে ফোনটা বন্ধ ই রাখবে । কে এই রাহুল ? কেন তার জন্য এত অনুভূতি তার ? এই প্রশ্নের উত্তর পায়না সে ।
একটু চোখ বুজতেই বিছানার পাশের জানালাটা থেকে ভোরের স্নিগ্ধ আলো এসে পড়ল জুঁইয়ের চোখে । ফোনটা অন করতে ই মেসেজের টোন বেজে ওঠে । রাহুলের মেসেজ-“ফাইনালি ফোনটা অন করলি । সারা রাতের ঘুম খেলি আমার ! আজকে যে ভ্যালেন্টাইন্স ডে মনে আছে ?”
জুঁইয়ের উত্তর ,”জেনে লাভটা কি ?”
রাহুলের উত্তর , “কখনোতো কিছু জানতে চাসনি ।তাইতো তোর চোখের দিকে তাকাতে পারিনা আমি । মনে হয় যেন সব বুঝে ফেলবি আমার মনের লুকানো সব কথা ।”
জুঁইয়ের ফিরতি উত্তর .”রামছাগল ! তুইকিজানিস না ? জানতে চেয়েছিস কখনো ?”
রাহুলের মেসেজ, “রামছাগল বলিসনা । তোর আগেই আমি কেমন জেনে নিলাম বলতো ?
কালকে তো তোর চোখে হিংসের আগুন দেখেই জেনেছি ।ফোনটা তো ছিল সৈকতের । আমি দূরে সরে যেতেই অমন পাগলী হয়ে গেলি যে ?হেহেহে ।”
জুঁইয়ের ফিরতি মেসেজ , “মিটমিট করে হাসবিনা একদম । গা জ্বলে আমার “!
মেসেজগুলো পড়তেই জুঁই কেমন হতবাক হয়ে যায় ।কালকের পাগলামির জন্য নিজেকে কেমন বোকা বোকা মনে হতে থাকে তার । দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে সে । আবার মেসেজের টোন বেজে ওঠে, “তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে চত্বরে আয়। আজ কিন্তু বসুন্ধরা সিটিতে যাব । তোর অনেকদিন যাওয়ার ইচ্ছে না ?” সবকিছু স্বপ্নের মত মনে হতে থাকে জুঁইয়ের ।
একছুটে আলমারি থেকে লাল শাড়িটা বের করে পড়ে নেয় । আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনেমনে ভাবতে থাকে সে – “আচ্ছা , তুই কি পড়বি আজ ? তোর ঐ লাল পান্জাবিটা পড়লে বেশ হতো আর সাথে silver colour এর ঘড়িটা । আমার চুলটা না হয় ছাড়াই থাক আজ ।চোখে কাজল আর ঠোঁটে Light gloss ছাড়া আর কিছুসাজতে পারবনা ।আজ না হয় খ্যাতই থাকলাম ।”
রাহুলের মিসকল পেয়েই নিচে নেমে পড়ে সে । চত্বরে লাল পান্জাবি পড়ে আর হাতে লালগোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাহুল । জুঁই হাতের দিকে তাকিয়ে খেয়াল করে দেখল আজই ঘড়িটা পড়তে ভুলে গেছে রাহুল । কিন্তু আজ একটু ও রাগ হলনা তার । জুঁই এগিয়ে যেতেই রাহুল আজ প্রথম কেমন নার্ভাস হয়ে যায় । হাত থেকে গোলাপটা কেড়ে নেয় জুঁই ।
“জানতাম তুই দিবিনা , আমাকেই নিতে হবে ।”
রাহুলের চোখে চোখ পড়ে যায় তার। অজানা এক আকুলতার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে জুঁই , সে দৃষ্টিতে হাজারো প্রশ্ন খুঁজে পায় রাহুল । শুধু জুঁইয়ের ঠোঁট দুটো ধীরে বলে ওঠে -
“শোন । আজ থেকে আমি তোকে তুমি বলে ডাকব?” রাহুল শক্ত করে চেপে ধরল জুঁইয়ের হাতটা । আজ প্রথম নয় । এর আগে ও রাহুল বহুবার হাত ধরেছে জুঁইয়ের । কিন্তু সেটা ছিল বন্ধুত্বের ছোঁয়া । আজকের এ স্পর্শে যেন অজানা এক অনুভূতি ,কত পাওয়া না পাওয়ার সমীকরনের সমাধান রয়েছে এ স্পর্শে । রাহুলের কাঁধে মাথা দিয়ে পায়ে পা মিলিয়ে চলতে শুরু করে জুঁই । আজ ও জুঁইয়ের দু চোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছে । কিন্তু এ অশ্রু অপেক্ষার নয় , প্রাপ্তির অশ্রু।
শাড়ি, হাতে লাল চুড়ি। গালে হালকা মিষ্টি রোদ মেখে হাত ধরাধরি করে হেঁটে এগিয়ে চলে ওরা । স্মৃতি ভাস্কর্য , টিএসসি পেরিয়ে বইমেলার মূল প্রাঙ্গনে ঢোকে ওরা । দূরে কোথা থেকে মাইকে গান ভেসে আসছে তরুন তরুনীদের কন্ঠে ।
“আজ হোক না রং ফ্যাকাশে
তোমার আমার আকাশে
চাঁদের হাসি যত-ই হোক না ক্লান্ত
বৃষ্টি নামুক নাইবা নামুক ঝড় উঠুক
নাইবা উঠুক আজ বসন্ত ।”
রাহুল সেই ভেসে আসা গানের তালে মাথা দোলাচ্ছে । রাহুলের এই পাগলামি আচরন দেখে ভীষন রাগ হয় জুঁই এর । প্রথমে কিছু বলল না সে । কিন্তু কিছুক্ষন পর রাহুলের দোলাদুলি যখন বেড়ে গেল তখন জুঁইয়ের তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ -
-ঐ শোন । একদম পাগলের মত মাথা দোলাবি না। পোলাপান তোর দিকে তাকায়ে হাসবে ।
-হাসুক গা । আমারে পাগল বললে তোর কি ?
-কিছুই না । কিন্তু আমারে ও তো পাগলী ভাববে । নইলে তোর মত পাগলের সাথে আছি কেন ?
-তোর কি মনে হয় তুই যে সাজ দিছিস তাতে তোরে সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ মনে হইতেসে ? মোটে ও না। পুরা আমাদের পাড়ার আছিয়া পাগলীর মত লাগতেছে ।
- ফালতু কথা বলবিনা একদম । তোর কেনা এই পঁচা চুড়িগুলোর জন্যই তো খেত লাগতেছে ।
-এহ ! কোথায় ভাবলাম তোকে আইসক্রীম খাওয়াব । এখন আর কিচ্ছু খাওয়াব না ।
-খাওয়াস না । আমি কি তোর মত পেটুক নাকি?
রাহুল আর কোন কথা বলার প্রয়োজন মনে না করে বইয়ের স্টলের দিকে এগিয়ে গেল । প্রিয় লেখকের বইয়ের সংগ্রহ দেখে রাহুলবই কেনাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল । রাহুলের বই কেনার প্রতি তীব্র আকর্ষন দেখে জুঁই সামান্য বিরক্ত বোধ করল কিন্তু প্রকাশ করল না । কিন্তু জুঁইয়ের বিরক্তির প্রতি রাহুলের বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই । সে আপন মনে বই বাছাইয়ে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে । বিরক্তির সীমাযখন তীব্র পর্যায়ে তখন জুঁইয়ের চোখ পড়ল স্টলের বাইরে রাস্তার ওপারে কিছুটা ভিড়ের দিকে । কৌতুহলের সমাপ্তিঘটাতে ওখান থেকে নীরবে জুঁই ওদিকটায় রওনা দিল । এত ভীড়ের কারন জানতে পেরে জুঁইয়ের আনন্দ যেন আর ধরে না ! কোন এক হারবাল কোম্পানি মেহেদি লাগানোর আয়োজন করেছে মেয়েদের । কোনো ভাবনা চিন্তা না করেই নিজের মত নকশা পছন্দ করে নিল জুঁই । দু হাতে মেহেদির নকশায় ভরে গেল ।
হঠাত জুঁই মাথার ওপরে ভারি কিছুর আঘাত অনুভব করে যার ফলে তার পুরো শরীরটা যেনশিরশির করে ওঠে । কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাহুলের চিত্কার -
-”নির্বোধ ! তুই এখানে ! একবার বলে আসবিনা ? আমি তোকে খুঁজে মরি আর তুই ! মানুষকে টেনশনে ফেলতে খুব ভাল লাগে তাইনা ?”
রাহুলের হাতের দিকে তাকায় জুঁই । বুঝতে পারে যে তিনটে মোটা বই দ্বারা আঘাত করা হয়েছে তার মাথায় । মনের অজান্তেই চোখ থেকে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে ওর গালে । পড়ন্ত বিকেলের হালকা রোদএসে পড়েছে ওর ফুটফুটে মুখে । সে আভায় ওর দু ফোটা অশ্রু মুক্তোর দানার মত ঝলমল করে উঠল । রাহুল জুঁইয়ের দিকে খেয়াল করে তাকাতেই মাথা থেকে রাগ আর তীব্র ক্ষোভ কেমন হঠাত করে কোথায় যেন পালিয়ে যায় । জুঁইয়ের অশ্রুভরা চোখের অদ্ভুত দৃষ্টি আর মায়াভরা মুখটা রাহুলের সবকিছু কেমন ওলটপালট করে দেয় ।
এতটা খেয়াল করে জুঁইকে কখনও দেখেনি রাহুল । হঠাত একটা উড়ো হাওয়ায় জুঁইয়ের ঘনকালো চুলের সামনের অংশটুকু অশ্রুভরা চোখ দুটোকে ঢেকে ফেলল । রাহুলের মনে হতে থাকে যেন স্বর্গ থেকে এক অপ্সরী নেমে এসেছে যার অপুর্ব মায়াকারা সৌন্দর্য রাহুলকে মাতাল করে তুলছে । জুঁইকান্না কান্না গলায় বলে ওঠে -
-”তা বলে এত জোরে মারবি আমাকে ? জানিস কতটা লেগেছে মাথায় ? উফ !”
জুঁইয়ের কাঁদো কাঁদো আওয়াজ রাহুলকে তার স্বপ্নীল কল্পনা থেকে ফিরিয়ে আনে আর তার চোখ পড়ে যায় জুঁইয়ের হাতে ।
-কি লাগিয়েছিস এসব হাতে ? ইয়াক !
-এটা মেহেদী । তুই বুঝবি কি এসবের ?
-কি বাজে গন্ধ ! এখন কি এই গোবরের মত জিনিসটা হাতে লাগিয়ে ঘুরবি ?
-এই শোন ! এটা গোবর না । এটা মেহেদী । ঘন্টা খানেক পর ধুয়ে ফেললে হাতে সুন্দর রঙিন
নকশা তৈরি করে ।
-এহে ! এক ঘন্টা তুই এই বাজে গন্ধ ওয়ালা জিনিস নিয়ে ঘুরবি ?
-এটা মোটে ও বাজে গন্ধ ওয়ালা জিনিস না ।এটা মেহেদী মেহেদী মেহেদী । হঠাত রাহুলের ফোনটা বেজে ওঠে । ফোনটা নিয়ে কথা বলার জন্য একটু দূরে সরে যায় রাহুল। কি কথা বলছে ,কার সাথে কথা বলছে তা জানতে জুঁই একটু এগিয়ে আসে । কিন্তু রাহুল তাকে দেখতে পেয়ে আরো দূরে সরে যায়। এবার ভীষন রাগ হয় জুঁইয়ের । রাগে গমগম করতে করতে রিক্সা ঠিক করতে রওনা দেয় জুঁই । খোপার গোলাপটা পড়ে যায় মাটিতে ।
-মামা যাবেন ? ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল গেইট ।
রিক্সায় উঠে পড়ে জুঁই । পিছন থেকে রাহুলের গলা শুনতে পায় সে -
-এই জুঁই । কই যাস ?আরে ! হলোটা কি ? দাঁড়া !কই যাইতেছিস তুই ? জুঁইয়ের রিক্সা চলতে শুরু করে তার হলের দিকে । আর রাহুলের গলাটা ধীরে ধীরে আবছা হতে হতে একসময় বাতাসের সাথে মিলিয়ে যায় । খুব রাগ হতে থাকে জুঁইয়ের ।
“কার সাথে কথা বলছিল রাহুল? আমাকে দেখেওদিকটায় সরে গেল কেন ? ও কি ওর গার্লফ্রেণ্ডের সাথে কথা বলছিল ! হুহ ! এরকম একটা পাগলকে কোন মেয়ে ভালবাসবে শুনি ? আচ্ছা আমার এত রাগ হচ্ছে কেন ?” এসব ভাবতে ভাবতেই জুঁইয়ের মনে পড়ে যায় রাহুলের সাথে প্রথম পরিচয়ের কথা । গত পহেলা বৈশাখে কলেজ ফ্রেণ্ড মিতার সাথেটি,এস,সি তে আড্ডা দিচ্ছিল সে । পরনে ছিল লাল পেড়ে সাদা শাড়ি । আর খোঁপাতে বেলী ফুলের মালা। হঠাত মিতা একটি ছেলেকে দেখেই মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে
-”কিরে রাহুল ! তুই এখানে ? একাই নাকি ?”রাহুল নামের ছেলেটির জবাব -”হুম একাই। এতক্ষন অবশ্য সৈকত ছিল । ও আবার কোথায় যেন গেল !” রাহুল মিতার সাথে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে । Physics ডিপার্টমেন্টের Student সে । অতি সাধারন,উসকোখুশকো চুল ,শ্যামলা বর্নেরচশমা পড়া ঐ রাহুলের সাথে সেদিনই প্রথম আলাপ হয় জুঁই এর । তারপর বন্ধুত্বটা ফেইসবুকের এ্যাড এক্সেপ্ট থেকে শুরু করে পৌঁছে যায় জুঁইয়ের মেডিকেল কলেজ চত্বরে । ধীরে ধীরে সেখান থেকে পৌঁছে যায় ধানমণ্ডি লেক , রবীন্দ্রসরোবরে । যেখানে একে অপরের কাঁধে মাথা রেখে হারিয়ে যায় স্বপ্নের জগতে , সেখানে ওরাদুজন একে অপরের চুল টানতে ব্যস্ত । কখনো বা সেটা পৌঁছে যায় বন্ধুত্বের মিষ্টি ঝগড়া ও মারামারিতে । এ কেমন বন্ধুত্ব জানেনা জুঁই । যে বন্ধুত্ব একদিনের নীরবতা মানেনা । সারারাত ফোনেকথা বললেও যেন কথা ফুরোতে চায়না ওদের ।জুঁই চোখ বুজে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে । চোখ বুজতেই রাহুলের সাদামাটা মুখটা ভেসে ওঠে জুঁইয়ের চোখের সামনে ।” একী ! রাহুলের মুখ কেন দেখলাম ?আচ্ছা আমার কী হয়েছে ?রাহুল ফোনে আমাকে না জানিয়ে কথা বলছিল তাতে আমার কেন এত রাগ হল ! আমি কেন এত পাগলামি করলাম ?” হঠাত জুঁইয়ের ফোনটা বেজে উঠল । স্ক্রিনে রাহুলের নাম । ফোনটা বন্ধ করে ফেলে সে । ঐ মুহুর্তেই পন করে ফেলে সে । আজ রাতে ফোনটা আর অন করবেনা । ফাল্গুনের প্রথম রাত না খেয়ে না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেয় সে । ফোনটা অন করবে কি করবে না এ নিয়ে অনেকবার ভাবনা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিল সে ফোনটা বন্ধ ই রাখবে । কে এই রাহুল ? কেন তার জন্য এত অনুভূতি তার ? এই প্রশ্নের উত্তর পায়না সে ।
একটু চোখ বুজতেই বিছানার পাশের জানালাটা থেকে ভোরের স্নিগ্ধ আলো এসে পড়ল জুঁইয়ের চোখে । ফোনটা অন করতে ই মেসেজের টোন বেজে ওঠে । রাহুলের মেসেজ-“ফাইনালি ফোনটা অন করলি । সারা রাতের ঘুম খেলি আমার ! আজকে যে ভ্যালেন্টাইন্স ডে মনে আছে ?”
জুঁইয়ের উত্তর ,”জেনে লাভটা কি ?”
রাহুলের উত্তর , “কখনোতো কিছু জানতে চাসনি ।তাইতো তোর চোখের দিকে তাকাতে পারিনা আমি । মনে হয় যেন সব বুঝে ফেলবি আমার মনের লুকানো সব কথা ।”
জুঁইয়ের ফিরতি উত্তর .”রামছাগল ! তুইকিজানিস না ? জানতে চেয়েছিস কখনো ?”
রাহুলের মেসেজ, “রামছাগল বলিসনা । তোর আগেই আমি কেমন জেনে নিলাম বলতো ?
কালকে তো তোর চোখে হিংসের আগুন দেখেই জেনেছি ।ফোনটা তো ছিল সৈকতের । আমি দূরে সরে যেতেই অমন পাগলী হয়ে গেলি যে ?হেহেহে ।”
জুঁইয়ের ফিরতি মেসেজ , “মিটমিট করে হাসবিনা একদম । গা জ্বলে আমার “!
মেসেজগুলো পড়তেই জুঁই কেমন হতবাক হয়ে যায় ।কালকের পাগলামির জন্য নিজেকে কেমন বোকা বোকা মনে হতে থাকে তার । দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে সে । আবার মেসেজের টোন বেজে ওঠে, “তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে চত্বরে আয়। আজ কিন্তু বসুন্ধরা সিটিতে যাব । তোর অনেকদিন যাওয়ার ইচ্ছে না ?” সবকিছু স্বপ্নের মত মনে হতে থাকে জুঁইয়ের ।
একছুটে আলমারি থেকে লাল শাড়িটা বের করে পড়ে নেয় । আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনেমনে ভাবতে থাকে সে – “আচ্ছা , তুই কি পড়বি আজ ? তোর ঐ লাল পান্জাবিটা পড়লে বেশ হতো আর সাথে silver colour এর ঘড়িটা । আমার চুলটা না হয় ছাড়াই থাক আজ ।চোখে কাজল আর ঠোঁটে Light gloss ছাড়া আর কিছুসাজতে পারবনা ।আজ না হয় খ্যাতই থাকলাম ।”
রাহুলের মিসকল পেয়েই নিচে নেমে পড়ে সে । চত্বরে লাল পান্জাবি পড়ে আর হাতে লালগোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাহুল । জুঁই হাতের দিকে তাকিয়ে খেয়াল করে দেখল আজই ঘড়িটা পড়তে ভুলে গেছে রাহুল । কিন্তু আজ একটু ও রাগ হলনা তার । জুঁই এগিয়ে যেতেই রাহুল আজ প্রথম কেমন নার্ভাস হয়ে যায় । হাত থেকে গোলাপটা কেড়ে নেয় জুঁই ।
“জানতাম তুই দিবিনা , আমাকেই নিতে হবে ।”
রাহুলের চোখে চোখ পড়ে যায় তার। অজানা এক আকুলতার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে জুঁই , সে দৃষ্টিতে হাজারো প্রশ্ন খুঁজে পায় রাহুল । শুধু জুঁইয়ের ঠোঁট দুটো ধীরে বলে ওঠে -
“শোন । আজ থেকে আমি তোকে তুমি বলে ডাকব?” রাহুল শক্ত করে চেপে ধরল জুঁইয়ের হাতটা । আজ প্রথম নয় । এর আগে ও রাহুল বহুবার হাত ধরেছে জুঁইয়ের । কিন্তু সেটা ছিল বন্ধুত্বের ছোঁয়া । আজকের এ স্পর্শে যেন অজানা এক অনুভূতি ,কত পাওয়া না পাওয়ার সমীকরনের সমাধান রয়েছে এ স্পর্শে । রাহুলের কাঁধে মাথা দিয়ে পায়ে পা মিলিয়ে চলতে শুরু করে জুঁই । আজ ও জুঁইয়ের দু চোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছে । কিন্তু এ অশ্রু অপেক্ষার নয় , প্রাপ্তির অশ্রু।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন