এতটা ভালোবাসি ছেলেটার এত ভাব কেন?এ এত ভাব সে কোথায় থেকে পায়?এর ভাবের জ্বালায় তো ডিপার্টমেন্ট জ্বলে-
পুড়ে ছারখার হয়ে যাওয়ার অবস্থা!বুঝতে পেরেছি তো ছেলে যে তুমি কোপায়ে পড়ালেখা করো,তাই ফাটাফাটি রেজাল্ট করো,স্যার-ম্যাডামরা তোমাকে নিয়ে লাফায়,তোমার ওই গরুর চোখের মত ইয়া বড় বড় চোখ দেখে আর তোমার ভারী গলার আবৃত্তি শুনে অনেক মেয়ে হোঁচট খেয়ে তোমার প্রেমে পড়ে যায়!তো হয়েছেটা কি?এর জন্য তোমার এত ফুটানি!!আমি পড়ি না তাই,পড়ালেখা করলে ওইসব রেজাল্ট আমার কাছে পান্তাভাত!আমি না পড়ে যা রেজাল্ট করি তুমি না পড়ে আমার সেই রেজাল্টের ধার-কাছ দিয়েও যেতে পারবা না।তোমার ওইসব পুঁথিগত বিদ্যার আমি থোড়াই কেয়ার করি।খালি আমার চোখের সামনে এইসব ভাব মেরে ঘুরবা না।মনে হয় থাপ্পড় দিয়ে তোমার কানসা-নাকসা ফাটায়ে দেই।
-ওই,কি বিড়বিড় করিস তুই?
-কিছু বিড়বিড়াই না।এমনি।
-অনেকক্ষন থেকেই দেখছি সায়নের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে আছিস আর কি সব বলছিস যেন!কি হইছে?
-তুই তোর ইনভেস্টিগেশনের চোখ দিয়ে অনেক কিছু দেখে ফেলেছিস ভাই,এইবার অফ যা।তোদের ওই ভাবিস্ট বন্ধুরে দেখার আমার অত খায়েশ নাই!
-ওরে নিয়ে তোর প্রবলেমটা কি?
-ওই ছেলে নিজেই একটা জলজ্যান্ত প্রবলেম।তোরে আমি এখন বুঝাতে পারব না।
-ছেলেটা কিন্তু অনেক ভালো!কেন যেন তুইই শুধু দেখতে পারিস না।
- হইছে তোর ওই ভাবিস্ট পোলাকে নিয়ে সাফাই গাওয়া?
-সাফাই গাই নি তো।সত্যিটা তোকে বললাম।
-বুঝতে পারছি।আমাদের হিমেল ভাই সত্যবাদী যুধিষ্ঠির।তা বাবা সত্যব্রত পুরুষ আপনি আজ্ঞা দিলে এবার আমি বাসার দিকে রওনা দেই!!
আসছে একজন তাকে নিয়ে ওকালতি করতে।আমি তাকে হাড়ে হাড়ে চিনি।আমাদের একই বিল্ডিং এ বাসা কি'না।সারাদিন আমার চোখের সামনেই থাকে।ক্যাম্পাস এবং বাসায় সব জায়গায় তার সমানভাবে বিচরণ।বাসায় ঢুকতে,বের হতে,লিফটে,ছাদে,রিক্সা খুঁজতে সবসময়ই এই ভাবিস্টের সাথে আমার দেখা হয়।এমনকি আমার মা এই ছেলেকে আমার ছোট ভাইয়ের প্রাইভেট টিচার বানিয়েছে।বানাবে না'ই বা কেন?হাতের কাছে এমন বিল্লু টাইপ ছেলে পেলে মা তো খপ করে ধরবেই।আমারই ক্লাসের ছেলে আমারই ভাইকে পড়াতে আসে!আমার ভাই আমার কাছে না পড়ে পড়ছে ওই অসহ্যকর ছেলেটার কাছে।আমি তো দেখতে পারবই না।অবশ্য দেখতে পারার মত আমি তো এই ছেলেটার মাঝে কিছু দেখি না।আমাকে দেখলেই বিটকেল মার্কা হাসি দেয়।সাহস কত আমাকেও পর্যন্ত তার কাছে পড়তে বলে! "স্বাতী,তোমার সিজিপিএ তো তেমন একটা ভালো না,আন্টি বলেছে তুমি পড়ালেখাই করো না বাসায়,ক্লাসেও তো দেখি ঠিকমত যাও না,প্রক্সি পড়ে।তুমি এক কাজ করো,আমি তোমাকে পড়া দেখিয়ে দিই,স্যারদের লেকচার বুঝিয়ে দেই।দেখবে রেজাল্ট ভালো হবে।" বলার পর আবার সেই ফিচলে টাইপ হাসি।রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিল একদম।আমার তো খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই ভার্সিটিতে পড়ে আমি প্রাইভেট পড়বো তাও আবার সায়নে কাছে! আমার সিজিপিএ নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে বলেছে কে?আমি তোমার মত তো না যে চব্বিশ ঘণ্টা চোখের সামনে বই দোলাতে থাকব।
-মামা,দাঁড়ান,দাঁড়ান।আমিও যাব।
-তুমি যাবা মানে কি?
-স্বাতী,একটাও রিক্সা পাচ্ছি না।তুমি তো বাসায়ই যাচ্ছ।একসাথেই যাই।
সায়ন আবার তার বিটকেল মার্কা হাসি দিয়ে আমার হ্যাঁ এর তোয়াক্কা না করে রিক্সায় উঠে মামাকে বললো, "আগান,মামা।" যেন নিজেই রিক্সা ঠিক করেছে আর আমাকেই দয়া করে রিক্সায় নিয়েছে।আচ্ছা,অন্য সবার সাথে তো এই ছেলে খুব সুন্দর করে হাসে।একদিন সিমিনের সাথে গল্প করার সময় দেখেছি,হাসি ভালোই আছে।তাহলে আমাকে দেখলে এমন হাসি কেন দেয়?আমাকেও বোধ হয় এই ছেলে পছন্দ করে না।আসলেই,আমি যাকে পছন্দ করি না সে আমাকে পছন্দ করবে এমন ভাবাটাই তো অস্বাভাবিক এবং হাস্যকর।সত্যিই অপছন্দ করি কি?
-কি ভাবছো স্বাতী?
-কিছু না।
-তাহলে মুখ ভোঁতা করে রেখেছ কেন এভাবে?
-আমার মুখ ভোঁতাই।
-হা হা হা হা।আমার কিন্তু কুষ্ঠ নেই স্বাতী।
-মানে কি?
-আমার গায়ের সাথে ছোঁয়া লাগলে তোমার কুষ্ঠ হবার চান্স নেই।তাই তুমি আরাম করে বসতে পারো।তুমি যেভাবে ধারে সরে যাচ্ছো কখন না আবার রিক্সা থেকে বাইরে চলে যাও।
-আমি ঠিক আছি।তুমিই আরাম করে বসো।
-হা হা হা হা......
দাঁত বের করে সায়ন ননস্টপ ফিচলে হাসি দিয়েই যাচ্ছে।কেন?আমি কি জোকার নাকি?সমস্যাটা কি?উফফ!রাস্তা শেষ হয় না কেন?আর কতক্ষণ এর সাথে আমার থাকতে হবে?
"একটা ছেলে মনের আঙ্গিনাতে ধীরপায়েতে এক্কা-দোক্কা খেলে,
বন-পাহাড়-ঝরণা খুঁজে, বৃষ্টিজলে একলা ভেজে ।।
সেই ছেলেটা আমায় ছুঁয়ে ফেলে ..।
আমি তো বেশ ছিলাম চুপিসারে,
ছোট্ট মেয়ে সেজে একটা কোনে,
সবুজ বনে নিলচে আলো জ্বেলে, স্বপ্নভেজা, মাটিতে পা ফেলে।
সেই ছেলেটা হঠাৎ এলো মনে।"
গান শুনতে শুনতে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছি।"স্বাতী,আমাকে এত অপছন্দ কেন করো?তোমার মুখ ভোঁতা না।আমাকে দেখলেই তোমার মুখ ভোঁতা হয়,কিন্তু কেন?আমি কি করেছি?হিমেল,সিমিন ওদের কাছে শুনেছি তুমি আমাকে মোটেই পছন্দ করো না,কি সমস্যা বলবে প্লীজ?" সায়নের এইসব প্রশ্নের উত্তর আমি দেই নি,দিতে পারি নি।ততক্ষনে বাসায় চলে এসেছিলাম।রিক্সা থেকে নেমেই হুড়মুড় করে বাসায় ঢুকে পড়েছি,সায়নের মুখোমুখি পড়ার ভয়ে লিফটের জন্য অপেক্ষা না করে চারতলা সিঁড়ি দিয়েই উঠেছি।আমার ঘরের দরজা বন্ধ,গান চলছে।পাশের ঘরেই সায়ন সুপ্তকে পড়াচ্ছে।এই সময়টা আমি ড্রয়িং রুমে টিভির সামনে বসে চ্যানেল পাল্টাতে থাকি।আজ যাই নি,আবার সায়নের সামনে পড়তে হবে তাই।সায়নের সামনে পড়তে আজ এত নার্ভাস হচ্ছি কেন?বলে দিলেই হয় যে "তোমার এসব ঢং-ভাব আমার ভালো লাগে না,সবাই তোমাকে নিয়ে এত নাচে তাই তোমাকে আমার বিরক্ত লাগে।" বললাম না কেন?সায়নের চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যা আসছিল না একদম।ওই চোখ একেবারে মনের গভীর পর্যন্ত দেখে নেয়।ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে বলি নি। "তুমি সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলো,আমার সাথে কথা বলার সময় কেন তুমি কিম্ভুত হাসি দাও?এই জন্য তোমার উপর আমার অনেক রাগ।সেইবার কবিতা আবৃত্তির সময় তুমি নিতুর দিকে কেন তাকিয়ে ছিলে পুরোটা সময়?আমি তোমার দিকে নিস্পলক তাকিয়ে ছিলাম,একবারও তোমার চোখে পড়ে নি,নিতুর পেছনেই ছিলাম আমি,তুমি তাকাও নি।তাই তোমার উপর আমার এত অভিমান।কে যেন একবার বলেছিল নীল রং তোমার পছন্দ,বর্ষা বরনে তাই নীল শাড়ি পড়েছিলাম।তুমি সেই কিম্ভুত হাসি দিয়ে বলেছিলে "স্বাতী,তোমার শাড়ির নীল রংটা এমন কেন?নীলটা খুব এলোমেলো তোমার শাড়িতে।" তাই আমি তোমার সাথে ঝগড়া করতে চাই সায়ন।" এই সত্যি কথাগুলো সায়নকে বলে দিতাম?তা বোধহয় পারব না কখনো।আজ শীত এত বেশি কেন?ছাদে এসে মনে হচ্ছে জমে যাচ্ছি।বোকামি করেছি!একমগ কফি আনতাম।
-নিন,ম্যাডাম কফি নিন।অনেকক্ষন থেকে ছাদে দাঁড়িয়ে আছেন এই ঠান্ডায়।জমে যান নি এই অনেক।
-তুমি আমার জন্য কফি এনেছ?
-না,না।তোমার জন্য কেন আনব?দুই মগ কফি আমার নিজের জন্যই আমি এনেছি।এইবার খুশি?
-থ্যাংকস।
-হুম।স্বাতী,তোমার হাতটা দাও তো।দেখব তোমার হাত বেশি ঠান্ডা না আমারটা?
-কি করবো?
-এটা বোধ হয় ভালো লাগল না?তাহলে সত্যিটা বলি!হাতটা দাও।আমার হাতের মাঝে নিয়ে গরম করে দেই।বরফের মত ঠাণ্ডা হাত বানিয়ে রাখা কোন কাজের কথা না।
-কি হয়েছে সায়ন?
-এটাই হয়েছে যে কালচারার প্রোগ্রামে যখন কবিতা আবৃত্তি করছিলাম তখন ওভাবে তাকিয়ে কি দেখছিলে আমার দিকে?এমনভাবে তাকিয়ে ছিলে যে আমি যে তোমার দিকে তাকাবো তাও পারছিলাম না।কি ভীষন ইচ্ছা ছিল তোমার দিকে তাকিয়ে কবিতা পড়বো!এমনভাবে আমাকে দেখছিলে তুমি যে আমার ভয় হচ্ছিল।তাই তোমার দিকে তাকাই নি।নির্ঘাত তোমার চোখে চোখ পড়লে আমার কবিতার লাইন সব গুলিয়ে যেত।মেয়ে,সেদিন নীলে তোমায় মনে হচ্ছিল আমার নীলাবতী পরী!তোমার শাড়ির নীল এলোমেলো না,তোমায় নীলে দেখে আমিই এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলাম।লুকিয়ে লুকিয়ে তোমায় যে আমি কতবার দেখেছি সে খেয়াল তোমার ছিল?আমার নীলাবতী তো তখন এই গাধার কথায় গাল ফুলিয়ে বসে ছিল।স্বাতী,আজ ইচ্ছে করে তোমার রিক্সায় উঠেছি।মনে হচ্ছিল রাস্তাটা যেন শেষ না হয়।কিন্তু বেরসিক রাস্তাটা এত দ্রুত ফুরিয়ে গেল!কি করবো বলো তো আমি?তোমার ভীষন ভালোবাসি যে।
চোখটা কেন যেন জ্বলছে।চোখের কোনায় পানি জমেছে কি?এই ভাবওয়ালা ছেলে আমার জন্য এত ভালোবাসা নিয়ে আছে?
-এই মেয়ে,কাঁদ কেন?
-হাতটাতে কোন সাড় পাচ্ছি না ছেলে।তোমার হাতের মাঝে নাও।
-সারাজীবন এভাবে রাখতে পারি তোমার হাতটা?
-এইভাবে না রাখলে তোমার কানসা আমি ফাটিয়ে দেব।
-হা হা হা হা হা...।
বাহ।এই ছেলেটার হাসি কি সুন্দর।মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি।সায়ন আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
 
Top