প্রেমের কলি
কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন গতানুগতিক ধারা ভাঙার মানুষ। কী কবিতায়, কী গানে, কী ভাষার পরাক্রম ব্যবহারে। তাই বিশ শতকে, বিশ-ত্রিশের দশকেও বাংলা কাব্যসাহিত্যের জগতে রবীন্দ্রকিরণের বাইরে আসার ব্যর্থ চেষ্টায় বহু গুণী কবি যখন পরিশ্রান্ত, তখন হৈহৈ রৈরৈ করে (বুদ্ধদেব বসু) মহা তোলপার তুলে বাংলার কাব্য আসরে এলেন নজরুল। বিদ্রোহী কবিতার রণদামামা শুনে যুবক কবির দিকে বিস্ময়ে তাকানোটা অনিবার্য হল। রবীন্দ্র কাব্যের ব্যাপক মোহন ব্যঞ্জনার বিনোদ তয়তা ভেঙেচুরে গেল বিদ্রোহী কবিতার মৌলিক উচ্চরোলে। রফিকুল ইসলামের মতে, আধুনিক বাংলা কবিতাকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলামের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে ফলপ্রসূ। সেই দিক থেকে তিনি বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রোত্তর আধুনিকতার পথিকৃৎ।, বিশ ও ত্রিশের দশকে উপমহাদেশের অবিভক্ত বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে সবচেয়ে বর্র্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। নজরুল তার গান, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে পরাধীন ভারতে, বিশেষত অবিভক্ত বাংলাদেশে পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং দেশী-বিদেশী শোষণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও সোচ্চারকণ্ঠ ছিলেন। উদ্ধৃতিটি বড় হলেও তুলে দিলাম এ কারণে, নজরুল সমীক্ষার সারমর্ম ওইটুকু সংহত বক্তব্যে অসাধারণ নৈপুণ্যে এক নিশ্বাসে তিনি বলে দিয়েছেন।
উত্তম সাঁতার জানা মানুষও সমুদ্রে পড়লে প্রথমে দিশেহারা হয়ে যায়। হাবুডুবু খায়। নজরুল সাহিত্য সাগরে পড়লে বোদ্ধাবিদগ্ধ পাঠলিপ্সু জ্ঞানচারণলুব্ধ পাঠকের সেই রকম অবস্থা হয় প্রথমে। সাগরের কোনদিকে তাকাবে, কোন ভেলাটা ধরে ভাসবে, বাঁচবে, ডুব দেবেই বা কোথায়, সেটা বুঝে উঠতেই বন্ধ হয়ে যেতে চায় শ্বাস-প্রশ্বাস। নজরুলের বাক-প্রতিমার কোন তরঙ্গে রবির কিরণ কেমন বিভায় আছড়ে পড়ছে, সাগর তলে হƒদয়হরণ মুক্তোসম্ভারের পরিমাণ কত, তার রূপানুভবের বিভাজনে কত যে বৈচিত্র্য, তার হিসাব করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তাই বেছে নিতে হয় কূলহারা দিকহারা সমুদ্রের কোন একটা সমৃদ্ধ বন্দর। এরকম একটা মন নিয়ে কেউ বোঝার চেষ্টা করেন নজরুলের বিদ্রোহী রূপ, কেউ মানুষ নজরুল, কেউ নজরুল সাহিত্যে নারী, কেউ নজরুলের সঙ্গীত সত্তা। সেও কি সহজ কাজ? গান ভালোবাসি বলেই কিছুটা বুঝতে পারি। সঙ্গীতের বন্দরেও অসংখ্য গীতের সাম্পান। সুর, লয় ও বাণীতে উছলে ওঠা তরঙ্গ বিভঙ্গে সেগুলো দুলছে। নৃত্যপটীয়সীর চপল চরণের নূপুর নিক্বণ, সহস্র কিন্ন্রকণ্ঠে সুরলহরীর অমিয়ধ্বনি বাণীর অনুপম ঐশী আবেদন, মানুষকে ভুলিয়ে দেয় বস্তুজীবনের মোটা দাগের হিসাব-নিকাশ। ডুবে যায় দিলওয়ালা মানুষেরা। যতক্ষণ দিল চায়। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাটাও এমনই। তবু আমি পড়ে থাকি নজরুল সঙ্গীতের বন্দরে। কখনও সেখানে রাগাশ্রয়ী গান, কখনও মিশ্রিত রাগের গান, কখনও নবসৃজিত রাগের গান। অন্যদিকে আছে লেটোগান, কখনও অভিনব বাংলা গজল, কখনও আধ্যাÍচিন্তায় ডুবে যাওয়া হামদ-নাত, কখনও শ্যামাসঙ্গীত, কখনও জাগার গান, কখনও ভাঙার গান, কখনও হিন্দি গান, কখনও ব্যঙ্গ গান বা মার্চ সঙ্গীত, আবার হƒদয় দোলানো প্রেমের গান। তেমনি সুরের অসাধারণ বৈচিত্র্য, মোহন আবেদন, বিনোদ সুর এবং বিলোল গায়কী।
বিশ শতকের ত্রিশের দশক ছিল রতœগর্ভা সময়। আধুনিক কথাসাহিত্য এবং কাব্যসাহিত্যে নতুনের প্লাবন বয়ে গিয়েছিল। নতুনের হাওয়া বয়েছিল সঙ্গীতের জগতেও। অবিভক্ত ভারতে ওই সময় ব্রিটিশ তাড়ানোর আন্দোলন প্রবলরূপে প্রকাশ পায়। যারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও আন্দোলনে অংশ নিলেন, তারা জীবন বাঁধা রাখলেন দেশমাতার মুক্তি আন্দোলনে। আর যারা মনে মনে শুদ্ধ দেশচেতনা নিয়ে নীরবে সাহসী কর্মীদের সমর্থন জানাতেন, তারা নিজেদের নিবেদন করলেন দেশ বন্দনা তথা জাগার গান রচনায়। নজরুল ছিলেন রাজনীতি সচেতন। তিনি লেখলেন ভাঙার গান, সংগ্রামের গান। গাইলেন কারার ঐ লোহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল, কররে লোপাট, রক্ত জমাট, শিকল পুজোর পাষাণ বেদী; পরাক্রম শোষণের প্রতিবাদে জলদ গম্ভীর কণ্ঠে গাইলেন, শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল, শিকল পরেই শিকল তোদের করবো রে বিকল। প্রতিবাদ নয়, প্রতিকারের হুংকার। যুবসমাজের রক্ত গরম হয়ে উঠত ওসব গানের ভাষা শুনে। গান তো নয়, যেন হাতুড়ি শাবল গাঁইতি কোদাল বাজে ঝনঝন ঠনঠন করে।
বলা হয়, আধুনিক বাংলা গানে পঞ্চপ্রদীপের আবির্ভাব ছিল দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের জন্য মহাকল্যাণের। তারা হলেনÑ অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। তাদের মধ্যে কালের প্রবাহে ঝড় তোলা গুণী গানের মানুষ ছিলেন অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় আর রজনীকান্ত। ওদের গানের নেশাটা কেমন ধরে গেল দুতিন দশক পর। অন্যদিকে কাল কালান্তরব্যাপী ঝড়ের জীবন্ত প্রবাহ নিয়ে দীপ্ত শিখার মতো জ্বলতে থাকল রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের গান। এই দুজনের গানের সুরেলা রথ চলতেই থাকল প্রজš§ থেকে প্রজš§ান্তরে। চির নতুনের আবেদনে তাদের গান হƒদপদ্মের আসনে স্থিত হয়ে রইল পরমের অনুভবের মতো।
নজরুলের ভালোবাসার গান নিয়েই আমার আলোচনা। এবার সেই প্রসঙ্গে আসা যাক। যে গানে পরমের নিপাট নিখাঁদ বন্দনা আছে। যে গান গাইলে বুক ভেঙে যেতে চায় আনন্দ বেদনার তীব্র অনুভবে। যে গান শুনলে বাধা মানে না অশ্র“।, এক,স্বর্গীয় অপাপবিদ্ধ চেতনায় গায়ক-গায়কী শ্রোতা ডুবে যায় পরম চিন্তার গভীরে। নিঃসংকোচ নির্ভয় নির্ভার চিত্তে বিশ্বজুড়ে তখন বাজতে থাকেÑ তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সেকি মোর অপরাধ? চাদেরে হেরিয়া কাঁদে চকোরিণী বলে না তো কিছু চাঁদ।
নজরুলের গানে সুন্দর শব্দটা প্রেম, প্রেমিক আর পরমের সমার্থক। একই গানে আছে, চেয়ে চেয়ে দেখি ফোটে যবে ফুল/ফুল বলে নাতো সে আমার ভুল। আমরা মনে করতেই পারি, ফুল ফোটার প্রাকৃতিক বিকাশ আর হƒদয় উৎসারিত প্রেমের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশে কোন পার্থক্য নেই, কোন ভুল বা পাপ নেই, এ কথাই বলতে চেয়েছেন কবি।
নজরুলের ভালোবাসার গানের ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য হল, প্রেমকে ধারণ করার সচেতন প্রয়াস প্রেমিকের কাছে নিঃশর্ত নিবেদন। তার প্রেমানুভবে মানুষ প্রেমিক, দেবতা তথা পরম সুন্দর একাকার হয়ে গেছে বারবার। হƒদপদ্ম ছাড়িয়ে সে প্রেম খুঁজেছে অখণ্ড সুন্দরের প্রসূন পরাগ। তাই নজরুল গাইতে পারেন :
আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন
খুঁজি তাকে আমি আপনায়।
আমি শুনি যেনো তার চরণের ধ্বনি
আমারি তিয়াসি বাসনায়।
ভালোবাসার অবস্তু চেতনাকে কবি শব্দের ব্যঞ্জনায় এমনভাবে প্রকাশ করেছেন, যা ভুলোক দুলোক গোলক ভেদিয়া খোদার আসন আরশ ছেদিয়া কোন মহাশূন্যে ভাসতে থাকে, যা সাধারণ প্রেমিকের চেতনায় ধরা পড়ে না। অথচ মহাআনন্দের অনিন্দ্যলোকে ধ্যানমগ্ন কবির সেখানে নিশ্চিন্ত প্রেমের নিত্য শুচিগান। প্রেমানুভবের গভীরে ডুব দিয়ে আপনার চেয়ে আপন-কে খোঁজার এই চৈতন্যবোধে প্রেম ও প্রেমিক হয়ে যায় অভিন্ন। রূপ অরূপকে আর বিচ্ছিন্ন ভাবা যায় না।
নজরুল যখন বলেন, তুমি সুন্দর হতে সুন্দর মম মুগ্ধ মানস মাঝে/ধ্যানে জ্ঞানে মম হিয়ার মাঝেরে তোমারি মুরতি রাজে, হƒদয়ের অন্তর্গত গোপন গভীরে কেমন সে মুগ্ধতা, তা আমরা সহজে বুঝতেই পারি না। সেই প্রগাঢ় অনুভবের অতল দহে ডুব না দিলে আÍ হিয়ার দর্শন যে সম্ভব নয়, তা আমরা বুঝি। এটাও বুঝি, যে সেই পর্যায়ে পৌঁছতে পারে, পরম প্রেমের শুচিগান তারই তো হবে। হিয়ার মাঝারে সুন্দরের মুরতি প্রতিষ্ঠা তার দ্বারাই সম্ভব। এমন অসম্ভব অকল্পনীয় প্রেমানুভবের শুচিতায় কবির অনায়াস অধিকার। তাই বলতে পারেন, আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া/হাসি পুষ্পের হাসি।
আÍশক্তির এমন প্রবল দার্ঢ্য বাংলা কাব্যসাহিত্যে শুধু নতুন নয়, চমক সৃষ্টিকারী ও অনন্য।
নজরুল ছিলেন প্রকৃতির সন্তান। বিশ্বের রূপ রস গন্ধ বর্ণ, নদী, পাখি, ফুল-ফল, ষড় ঋতুর বৈচিত্র্য, খরতাপ বর্ষা, মসজিদ-মন্দির, অবতার, নির্যাতিত মানুষ, বঞ্চিত লাঞ্ছিত নারী, আদিবাসীদের জীবন ইত্যাদি তিনি দেখেছেন অপার মমতার দৃষ্টিতে। সবই তুলে এনেছেন কবি তার সৃষ্টির বর্ণালি ক্যানভাসে। দেশের আদিবাসী ও নিুবিত্ত মানুষদের নিয়ে তিনি যেসব গান রচনা করেছেন, তার বয়ানে শব্দ চয়নের যে চটকদার সারল্য, তার তুলনা পাওয়া যায়। যেমনÑ
ক. চুড়ির তালে নুড়ির মালা রিনি ঝিনি বাজে লো,
খোঁপায় দোলে বনফুলের কুঁড়ি।
খ. পরনে শাড়ি লিবো না, না লিবো গয়না।
সোনার ও গয়না, আমার গায়েথে সয় না।।
গ. হলুদ গাঁদার ফুল, রাঙা পলাশ ফুল
এনে দে এনে দে নইলে রাঁধবো না বাঁধবো না চুল।
এসব গানে মাটি ঘেঁষা মানুষদের সহজ সুখী জীবনের নিপাট চিত্র ফুটে উঠেছে। মহুয়া মদের নেশায় বুঁদ হয়ে কালো প্রেমিক প্রেমিকা কাঁকাল ধরে নাচে পরমানন্দে। জীবনচারিতায়, তেলের বাটি আর গামছা এবং প্রসাধনে বনফুল, গাঁদা ফুল, পলাশ ফুলই তাদের ভালোবাসার মোহন উপকরণ। বর্ণালি প্রকৃতির স্বতঃস্ফূর্ত সৌন্দর্য ওদের প্রেম। আধুনিক বাংলা গানে এই ধরনের গানও নতুন সংযোজন।
নজরুলের সৃষ্টি সাগরে সঙ্গীত বন্দরের উচ্ছ্বলতমো সম্পদ হল বাংলা গজল। আধুনিক বাংলা গানের যা একেবারেই নতুন। ফার্সি গজলের অনুকরণে সৃষ্ট বাংলা গজল নিমেষেই ভাবসাগরে ডুবিয়ে দিয়েছে শ্রোতাদের। বাংলা গানের আঙ্গিক ও গায়কী শুধু নয়, রাগাশ্রিত সুরের মোহনীয়তায় বিহ্বল হয়ে গেল সুর রসজ্ঞ মানুষেরা। গানের ভুবনে এ কোন মদিরতার আমেজ? যেমনÑ
ক. দাঁড়ালে দুয়ারে মোর কে তুমি ভিখারিনী।
চাহিয়া সজল চোখে বেলা শেষের রাগিণী।।
খ. বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল।
আজো তার ফুলকলিদের ঘুম টুটেনি, তন্দ্রাতে বিলোল।।
প্রকৃতপক্ষে নজরুলের বাংলা গজলগুলো সুর সোহাগে ঢলোঢলো করে। তৃপ্তিতে আনন্দে ফুল্ল হƒদয় উপচে ওঠে। উছলে ওঠে মনের সুকুমার বৃত্তির অরূপ বোধন। আবেগে তন্দ্রাপ্লুত হয় মানুষ।
ভেবেছিলাম অনেক কথা বলতে পারব। কিন্তু কিছুই বলা হল না। আটকে রইলাম নজরুল সঙ্গীত বন্দরের ছোট্ট একটা সাম্পানে। বিশ্বপ্রেমিক নজরুলের গানে আমি প্রেমানুভবের যে আকাশ দেখতে পাই, সেখানে হারিয়ে যাই সীমাহীন বিভোরতায়। বাকহারা হই আনন্দের কষ্টে। ডুবে যাই নন্দন সাগরে। সেই তো আমার শুচগান। এ কথা বোঝা সহজ। বর্ণনা অসম্ভব।
ড. বেগম জাহান আরা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, গবেষক 
 
Top