অনেকক্ষণ ধরে মোবাইলটায় রিংটোন বেজে যাচ্ছে। ফোনটা তুলে বোনের দিকে বিরক্তি নিয়ে
"অন্ধকার রাত্রি
তাকাল তিথি,
-- এই আপু ফোন ধরিস না কেন? কখন থেকে রিং হচ্ছে।
আয়নার দিকে ঘুরে চুল থেকে ক্লিপ দিয়ে আটকিয়ে রাখা হলুদ রঙের গাঁদাফুল গুলো খুলতে খুলতে নিরুত্তাপ গলায় উত্তর দিল তরু,
- বাজতে থাকুক
ফোনটা তরুর চোখের সামনে ধরল তিথি,
-- একটা আনসেভড নাম্বার। দেখে তো মনে হচ্ছে সজল ভাইয়ার নাম্বার
মোবাইল স্ক্রিনটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার ফুল খোলায় মনোযোগ দিল তরু।
- হতে পারে
-- হতে পারে আবার কেমন কথা! ভাইয়ার নাম্বার তুই সেইভ করে রাখিসনি?
ফুল খোলা শেষ করে মোবাইলটা তিথির কাছ থেকে নিতে নিতে উত্তর দিল তরু,
- না
ফোনটা হাতে নিয়ে কি যেন ভাবল তরু কতক্ষণ। এরপর খুব ইতস্তত করে একটা নাম্বারে ডায়াল করল। তরুকে দেখে তিথি হাসতে লাগল,
-- কাকে ফোন করছিস? সজল ভাইয়াকে, তাই না?
তরু কোন উত্তর দিল না। হঠাত্ হাসি থামিয়ে স্ক্রিনে উঠা নামটা দেখে কিছুটা অবাক হয়ে বোনের দিকে তাকালো তিথি।
-- এই মৃন্ময়ী কে রে আপু?
এইবার হেসে দিল তরু,
- আমার মেয়ে।
-- তোর মেয়ে মানে?
তিথিকে মানে বোঝানোর আগেই ওপাশ থেকে কেউ একজন কলটা রিসিভ করল। তিথি অবাক হয়ে লক্ষ্য করল তরুর হাতটা অল্প অল্প কাঁপছে।
- হ্যালো
-- কি ব্যাপার তরু? এতরাতে?
লোকটার এই একটা ব্যাপারই তরুর ভালো লাগে না। কথায় কথায় জেরা করে। সে কি এমনি ফোন দিতে পারে না? এত প্রশ্ন করার কি আছে! বিরক্তিটা দ্রুত চেপে নিয়ে বলল তরু,
-- কোন ব্যাপার না স্যার। আজকের পর তো আর কোনদিন কথা হবে না, তাই শেষবারের মতআপনাকে ফোন দিলাম দোয়া চাওয়ার জন্য
- দোয়া চাইছ?
-- অন্যকিছু তো চাওয়ার নেই
- হুম সজল অনেক ভাল ছেলে। তুমি সুখি হবে তরু।
তরু হাসল,
-- আমি জানি। বাবা মা খুব খুশি। সবার ধারণা সজল হাজারে একটা ছেলে
- হুম
-- আপনার হুম বলার স্বভাবটা গেল না!
- তুমি খুশি তো তরু?
-- কিইবা এসে যায় তাতে..
ফোনের ঐপ্রান্ত নিশ্চুপ। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বলল তরু,
-- একটা কথা বলার ছিল..
- বল তরু
-- আপনার যদি কোনদিন একটা মেয়ে হয়, তাহলে তার নাম রাখবেন মৃন্ময়ী। মুহিবের সাথে মিলিয়ে মৃন্ময়ী
মুহিবের হঠাত্ করেই মন খারাপ লাগছে। মেয়েটার কন্ঠে কেমন যেন একটা বিষাদ আছে। শুনলে কেমন যেন একটা চাপা কষ্ট হয় বুকের মধ্যে। নিজের দীর্ঘশ্বাসটা গোপন করে বলল সে,
- রাখব তরু, অবশ্যই রাখব।
-- আরেকটা কথা... আমি আপনাকে একটা মিথ্যা বলেছি
- মিথ্যা?
-- আমার কিছু চাওয়ার ছিল
- বল তুমি কি চাও?
শোনা যায় না প্রায় এতটাই আস্তে বলল তরু,
-- আপনি এসে আমার হাতটা একটাবারের জন্য ধরবেন স্যার? আমার
আপনার হাত ধরে বহুদুরে কোথাও পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে..

মুহিব জানে, তরু মজা করছে। কথায় কথায় মজা করা এই মেয়ের বাজে একটা অভ্যাস। এই মেয়েটাকে সে কোনদিনও বুঝতে পারেনি। আজও বুঝতে পারছে না।
- তুমি এখন ফোনটা রাখো তরু। এত রাতে কথা বলাটা ঠিক হচ্ছে না
-- এত ভয় পান কেন আপনি বলুন তো? যেই মেয়ের রাত পাড় হলেই বিয়ে, সেই মেয়ে বিয়ের আগের রাতে নিশ্চয়ই অন্য ছেলের সাথে পালিয়ে যাবে না
কথাটা বলেই জোরে জোরে হাসতে লাগল তরু।মুহিব বিব্রত বোধ করছে। কি বলবে বুঝতেপারছে না।
- তরু...
-- হুম
- আর কিছু বলবে?
-- একটা প্রশ্ন ছিল...
- বল
-- আপনি প্রায় রাতেই আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন... কেন বলুন তো?
মুহিব চুপ করে আছে। বেশ কিছুক্ষণ দুজনই চুপ করে থাকল। তারপর মুহিব আস্তে করে বলল,
- এর উত্তর আমার জানা নেই তরু
মুহিবের কন্ঠটা খুব ক্লান্ত শোনাল। হয়ত আরো কিছু বলতে চেয়েছিল... কিন্তু ও বুঝতে পারল, তরু ফোন কেটে দিয়েছে।
ঘরের বাতি নেভানো। দুজনের কেউই কোন কথা বলছে না। অনেকক্ষণপর তিথি আস্তে করে তরুর গায়ে একটা হাত রাখল। তরু একটু পর পরই কেঁপে কেঁপে উঠছে। তিথি বোনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তারপর ফিসফিস করে বলল,
- আমার যদি ক্ষমতা থাকত তাহলে আমি বিয়েটা আটকে দিতাম রে আপু। সত্যি আমি বিয়েটা আটকে দিতাম...

_____২
-- ছেলেটা নিচে দাঁড়িয়ে আছে।
চমকে মায়ের দিকে তাকালো সৌম। চোখের পানি দিয়ে ওর গাঢ় করে কাজল লেপ্টে গেছে। আস্তে করে মেয়ের পাশে যেয়ে বসল তরু। গভীর মমতা নিয়ে তাকালো সে মেয়ের দিকে। মেয়েটা ওর মতই বোকা হয়েছে। সব কথা চেপে রাখে। শাড়ির আচঁল দিয়ে লেপ্টে যাওয়া কাজলটুকু মুছে দিতে দিতে আবার বলল তরু,
-- ছেলেটা বিকেল থেকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।

সজলের সাথে সম্পর্কটা টেকেনি তরুর। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই তরু সজলের প্রথম স্ত্রীর কথা জানতে পারে। অন্য একটি মেয়ের সাজানো স্বপ্নকে সে ভাঙতে পারেনি। ভালোবাসা হারাবার কষ্ট তারচেয়ে বেশি আর কেইবা জানত! নীরবে সরে এসেছিল তরু। আর পিছু ফিরে তাকায়নি। দীর্ঘ ক্লান্তিকর এই পথ সে একাই হেঁটে পাড়ি দিয়েছে। জীবনের প্রতি আকষর্ণটা হারিয়ে গিয়েছিল। তবুও মাঝে মাঝে যখন খুব একলা মনে হত নিজেকে তখন ভাবত, সেই রাতে সত্যিই যদি সেই লোকটা তার হাতটা এসে ধরত, তাহলে আজ হয়ত তার জীবনটা অন্যরকম হত।
জীবন একটা চক্রের মত। জীবন পুনরাবৃত্তি করতে ভালোবাসে।
পঁচিশ বছর পর আবার সেই রাত্রি ফিরে এসেছে। পঁচিশ বছর আগে এমনি একরাতে সে ঐ হাতটাকে আঁকড়ে ধরতে পারেনি, যেই হাতটা ধরে সে জীবনের পথে হাঁটতে চেয়েছিল। হয়তবা হাতটাই ধরা দিতে চায়নি।
আজ সে কিছুতেই সেই রাত্রির পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেবে না। তরু মেয়ের হাত ধরে বাড়ির পেছনের গেটে নিয়ে আসল। সে জানে না কাল কি হবে। সে শুধু এতটুকু জানে যে কালকের কথা ভেবে সে তার মেয়ের আজটাকে নষ্ট হতে দেবে না। সে জানে, তার মেয়ে সুখী হবে।
খুব ক্লান্ত লাগছে তরুর। তবুও লোহার গেটটার একপ্রান্ত ধরে সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে সে। রাস্তার সোডিয়াম বাতির রহস্যময় আলোয় একজোড়া ছেলেমেয়ে পাশাপাশি হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে।
হঠাত্ মনে হল তরুর, জীবন কখনো কাওকে অপূর্ণ রাখে না। কোন না কোন ভাবে সে মানুষকে পূর্ণ করে দেয়।

হাঁটতে হাঁটতে একসময় ছেলে মেয়ে দুটি রাস্তার মোড়ের আড়ালে হারিয়ে যায়... রাত বাড়তে থাকে। রাস্তা ক্রমেই ফাঁকা হয়ে যায়।
...তবুও তরু তাকিয়েই থাকে।
 
Top