ছেড়া শাড়ি পরে লিপস্টিক ঠোঁটে ছোঁয়ালেইআকাশ বৃষ্টিতে ভেঙে পড়ে।
তোমার চিঠির খাম খুললেই সূর্য ডুবে যায়। (পূর্ণেন্দু পত্রী)
তোমার চিঠির খাম খুললেই সূর্য ডুবে যায়। (পূর্ণেন্দু পত্রী)
একের পর এক পাতিয়ালা পেগ তুলে সর্বস্ব বেশ নড়ে উঠেছে। ঝন ঝন ভিতরের দালান-কোঠা! স্যামিলটনের নিভৃত নীলের ভিতর উসখুস নেশাটাও এখন ফূর্তিতে দিব্য গড়ের মাঠ। ভিতরমহলে, থেকে থেকে যেন ঝাউবনে হাওয়ার হল্লা শোনা যাচ্ছে। ভিতরমহলে গুটিয়ে থাকা ইচ্ছেপাখির ডানার পালকগুলো ছিঁড়ে তছনছ হবে বুঝি। ঠিক উড়ে যাবে। উড়বেই, এইবার না উড়লে, মরণ!
অথচ, ফুরফুরে উড়ন্ত শাড়ির মতো মনের মন্দরে ভেসে আসছে, মাটির গহনে সারারাত টেলিফোন বাজার বিষাদরঙা চিত্রকল্প। রঞ্জা একটু আগে বলল, এসব ফকিরের দারুণ ছলচাতুরি। কে জানে, হবে বা ছল! চেনা বেয়ারা ঘুরে ঘুরে ফিরছে নতুন পেগের ফরমাস নিতে।
- রিপিট, দুটো লার্জ!
- না, রঞ্জা। একদম না। এরপর বেহেড হয়ে যাবি। দুটো থার্টি!
- সমস্ত রাত/ নিজের বুকের পাথর খুঁড়ে বইয়েছে/ কাল ক্ষতিকারক/ জলপ্রপাত। বুঝলে ফকির… সমস্ত রাত!
- বুঝলাম! কিন্তু আর না। অন্তত এখানে না।
বেসমেন্টে বেশ ভিড় জমেছে এরই মধ্যে। চারপাশের দেওয়ালে ইটের সতর্ক গ্রাফিতি। চারধারে সুখ-বিলাসের ছড়ানো সোফার কেত, বার-কাউন্টারের সামনে হাই-টুল, ছিমছাম যুবকের সঙ্গে মধ্য কুড়ির চিনে দুহিতার দোলনমায়ায় হেঁটে চলা- সবের মিলমিশ প্রগাঢ় করে তুলেছে নিশিঠেকের রাত্রির দ্যোতনা। এবং রঞ্জাবতী! সুভদ্র ওয়েটার সরে যেতেই উড়ুক মেয়ে বাঁ-হাত দিয়ে বেশরম শাড়িকে শাসন করতে করতে ফিসফিসিয়ে বলল,
- কিস্যু বুঝিসনি। কিস্যু না! নেশায় চুরমার হয়ে যেতে হবে এবার। ফকির, এখন নেশার মধ্যেও কেন জানি না মনে হয় সব মিথ্যে। মনে হয় মানে, এখনও হচ্ছে। সব কিছু খুব মিথ্যে। মিথ্যে তুমি।
মিথ্যে তোমার রঞ্জাবতী। মিথ্যে রঞ্জার সঙ্গে তোমার সাজানো সংসার! ফুল-পাখি-চাঁদ-তারার সকাল-সাঁঝ।
- কথাটা তেমন নয়। বহুদিন বাইরে যাইনি দু’জন। কোথাও না! চৌকাঠে, কার্নিশে, ভাঙা থামের পাঁজর ছুঁয়ে এই কলকাতায় পড়ে আছি!
- সেই টুকলি! পূর্ণেন্দু বেঁচে থাকলে তোর নামে মোকদ্দমা করত সুনিশ্চিত!
- মোটেই না। বলতাম ‘নিরূপায়’ বস! আচ্ছা, তুমি এমন কিছু খাওনি, মিথ্যে ছড়িও না তো। একটু খেয়াল করে বলো দেখি, বলো কী গাইছে দীপান্বিতা? নাকি সেটাও…!
- রাজস্থান ফোক, এর আগে? তুমি বলো? বলো… খুব তো সোফায় তাল দিচ্ছিলে। যদিও কয়েকবার ভুল। খালি-তালি গুলিয়ে লাট!
- উফ! তুই জানিস ফকির সুরপাগলা, বেতালা চিরদিন। তবু ঠিক সেই হাটের মাঝে বললি কথাটা? শোন, এর আগের গান ছিল কবীর… কবীরের দোঁহা! মিলেছে উত্তর? কী রে মিলল তো?
- জিও! লেবেল বস, লেবেল!
লাল পাড় টাঙ্গাইল পড়েছে রঞ্জাবতী। পাড়ে হাতে বোনা ফুলের মোটিফ, চওড়া লাল পাইপিং বর্ডার! আঁচলেও একই ফুলের মোটিফ। জমিতে পেজলি প্যাটার্ন। লাল! বুকের বসত-বাটি জুড়ে, দুঃসাহসী লো-কাট লালি ব্লাউজ। এ মেয়ে জানে, কীসে কী হয়! কেমন করে জ্বালতে হয় নিকুঞ্জবনে প্রদীপ। নিভৃত যতনে একেলা কেমন করেই বা নেভাতে হয় সেই দীপালোক! নইলে, এমনতর শাড়ি-ব্লাউজের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে রক্তচন্দনের টিপ ওঠে কপালে! জুঁই স্মৃতির পরত ছুঁয়ে বুকের গোপনে নামে সুবর্ণ চন্দ্রহার! রঞ্জা কি এখন চোখের হাসিতে একটু বেশি বেপরোয়া? অন্তত আজ? যেমত যোগিনী পারা!
হুলা-বিলা করতে করতে সেই যাদবপুর থানা থেকে ৩৫ এ শরৎ বসু রোডে এসেছি দু’জন। তেমন করে খেয়াল করিনি তো ওকে। সেই জন্যই হয়তো এই নতুন করে চাওয়া-পাওয়া। বিহ্বল পুজো-পাঠ!
যদুবাবুর বাজারের কাছে স্যামিলটনের এই নিশিনিলয় একটু একটু করে বেশি লাউড হচ্ছে। হ্যাং-আউট আর ডিনারের জন্য বেসমেন্ট হলেও শহরের এই থ্রি স্টার হোটেলে চার-চারটে রেস্তোরাঁ। প্রতিটার আলাদা করে বিশেষত রয়েছে। চাইনিজ ও থাই খাবারের জন্য যেমন পেপার চায়না রেস্টোরেন্ট, মোঘলাই খাবার জন্য ছোটে নবাব এবং আন্তর্জাতিক ও কন্টিনেন্টাল খাবার নিয়ে খোলা আকাশের নিচে রয়েছে স্কাই হাই। এই শেষের ঠেকটিতে রয়েছে হুকাবার!
- জানো ফকির, বেসমেন্টের ককটেলগুলোর দারুণ সুখ্যাতি?
- খুব শুনেছি। কিন্তু রঞ্জা, কলকাতা শহরে যে শীত নামছে গুটি গুটি পায়ে। হিমঝুরি নভেম্বর-ডিসেম্বরের সন্ধেয়, একলা তোকে নিয়ে চুপি চুপি বেসমেন্ট নয়, দু’জন স্কাই হাই-তে এসে বসব।
- হুকাবার?
- একদম। তবে অন্য কারণটা হল, শীত সন্ধেয় শিশির ভিজে হয়ে তোর যে ফুঁকতে দারুণ লাগে, সেটা জানি। ফকির না হয়, সঙ্গে দু’ পাত্তর রেড ওয়াইন গিলবে চুকচুকিয়ে!
- না, না। হবে না! যা হবে দু’জনে। রঞ্জাও খাবে! কী দেখছ অমন করে? দেখোনি যেন আগে! সেই লাল চোখের তল্লাশি! কী খোঁজো? কী চাও!
- তোকে! তোর চোখ-চিবুক-চিবুকের তিল, কানের পাশে নেমে আসা চুল ঠেলে ঠোঁট! স্যামিলটনের বেসমেন্টের এই নীল মায়া-মন্দরে, দীপান্বিতার ময়মনসিংহ গীতিকার সুরে তোকে দেখতে বেশ লাগছে রঞ্জা। এমনি করেই চেয়ে চেয়ে, দেখিস, শ্বেতমল্লিকার বনে পৌঁছে যাব একদিন। এই একটু কাছে আসবি? একটু… উঁহু! এতটুকুন না! আরও একটু… কানে কানে কথা ছিল… খুব জরুরি কথা ছিল এখন! এক্ষুনি!
- তুমি সত্যিই ডোবাবে আমাকে একদিন।/ লাল ঠোঁট নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোলে/ লাল ঠোঁট নিয়েই বাড়ি ফেরা উচিত!
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন