চল্লিশ বছরের ফেলে আসা জীবনকে খুলে দেখাল সুপ্তি। অন্ধকারের ঘেরাটোপে ভালবাসার উত্তরণের কথা বলে তার জীবন। আমাকে সে ভাবে কোনও প্রশ্ন করে কিছু জানতেও চাইতে হয়নি। ওর নিজের হাতে গড়া এক্সপোর্ট-ইম্পোর্টের অফিসে সোজাসুজি মন খুলল সুপ্তি।
‘সম্পর্কে কাকা হলেও জীবনের লম্বা, খারাপ সময়ে ওর কাছ থেকেই বেঁচে থাকার মন্ত্রটা নিতে পেরেছিলাম। মফস্বলের সুন্দরী মেয়ে হলেও আমার শ্যামলা রঙের চিন্তায় বাবা আমাকে খুব দ্রুত ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলার বন্দোবস্ত করেছিলেন।ঝেড়ে-বেছে পাওয়া গেল শহুরে, উচ্চ ঘরের, সুপুরুষ, ধনী যুবক- যার চেয়ে ভাল পাত্র পৃথিবী খুঁজলেও আর নাকি পাওয়া যেতো না। হোক না তার দ্বিতীয় বিয়ে! তাতে ‘এমন কি আর মন্দ ছেলে?’ আর বাবা, মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো শিক্ষা আমার সেই সময়ে জোটেনি। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর পিছিয়ে গিয়ে আমার কথা বুঝতে হবে। আমিও কিছু না ভেবেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলাম।
বিয়ের পর বুঝলাম দ্বিতীয় বিয়ের আসল কারণ। বিয়ের পর আমি চলে গেলেও অশোক-এর বাবা আবার হয়তো তাঁর ছেলের বিয়ে দিতেন। কারণ ছেলে যে নপুংসক, সমাজের সামনে সেটা যে কোনও পরিস্থিতিতেই আড়াল করে রাখাই তাঁর শেষ বয়সের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। আমি থেকে গেলাম। তখনও নিজের চাওয়া বুঝে কিছু করে ওঠার মতো মানসিকতা আমার তৈরি হয়নি। আমার মতো সাধারণ মেয়ের শুরুতেই সব ফুরিয়ে গিয়েছিল। প্রেম নেই, যৌনতা নেই, সন্তান নেই, সংসার নেই, সে ভাবে দেখতে গেলে কোনও বন্ধুতার সম্পর্ক পর্যন্ত নেই। আজ যদি জানতে চাও তখন কেমন করে কাটত আমার দিনরাত্রির বেলা? আমি বলব- ‘একদিন বমি করেছিলাম, একদিন ঢোঁক গিলেছিলাম,/ একদিন আমি ছোঁয়া মাত্র জল/ রুপান্তরিত হয়েছিল দুধে,’।
আমার পোড়া সময়ের, কিছুই ভাল না লাগা সময়ের, সব হারানোর দিনে একদিন দীপু এসে হাজির হল। আর সকলের মতো ও বলেনি আমায় বড়লোক, ভাল মানুষ বড়, দেবতুল্য শ্বশুর আর রাজরানির বিলাসিতায় সবকিছুকে ভুলে থাকতে।
তখন ‘আমার শরীর ছিল তরুণ পাতায় ভরা/ আর আমার আঙুল ছিল লম্বা সাদা বকফুল/ আমার চুল ছিল একঝাঁক ধূসর রঙের মেঘ/ হাওয়া এলেই যেখানে খুশি উড়ে যাবে, কেবল সেইজন্য। সেই জন্যেই দীপু এসেছিল, তার শরীর ঢেলে দিয়েছিল আমার ওপর। আমি ভিজতে চেয়েছিলাম, সমস্ত বঞ্চনার খোলসে আমার রোমাঞ্চিত যমুনার ঢেউ আছড়ে পড়ল আমার দীপুর জীবনে। আমার জীবন দিয়ে আমি জেনেছি মানুষের এক দিক অন্ধকারে মিশে যাওয়ার পর অন্যদিকের আলো যখন আসে তখন তার তীব্রতায় সবকিছুকে ছাপিয়ে যাওয়ার সর্বনাশ কাজ করে। আমি বিবাহিত নিঃসন্তান মহিলা কেমন করে আমার কাকার সঙ্গে শরীরে মনে জড়িয়ে পরতে পারি? এ তো অন্যায়-ই। আমার মা-ই বলেছিল ‘এত কিসের খিদে তোমার’?
দীপু আমার শ্বশুর বাড়িতেই আসত। ওর দগ্ধ ডানায় আমার মৃত শয্যার ওপরে ফুল ফুটতে লাগল। অশোক আর আমার শ্বশুরমশাই দুজনেই এটা মেনে নিয়েছিল।এটাই সবচাইতে অবাক করে আমায়! আজ-ও। অথচ আমার বাবা, মা, কোনওদিনই আর সেভাবে আমায় মেনে নিতে পারেনি। দীপুর বিবাহিত জীবনে আমি যে অভিশাপ হয়ে এসেছিলাম। কিন্তু আমি বা কি করি? তখন তো আমি আমার যৌবনের ব্যাধি ঘর থেকে মুক্তি অথবা মৃত্যু চেয়ে ফিরছি! আর কিছুই আমি বুঝি না তখন।
এর পর থেকেই আমি জীবনে ফিরি। দীপু চাইলেও, সন্তান পাগল হয়েও আমি তা কখনও চাই নি।
আসলে দীপু আর আমার সম্পর্ককে সহজে নেওয়ায়, অশোক আর আমার সম্পর্কটাও সহজ হয়, নির্ভরতা আসে, একে অপরের প্রতি যত্ন আসে, ভাললাগার জন্ম হয়। সমাজ সর্বদাই বাঁধা ছকের বাইরের যে কোনও সম্পর্ককেই দূরছাই করে এসেছে। কিন্তু মানুষের মন ম্যাজিক জানে, এক সম্পর্ক দিয়ে পুরোনও অবস্থানকে উজ্জ্বল করে, নতুন করে পেতে শেখায়। যারা এটার মধ্যে দিয়ে যায় তারাই জানে।
আজ আমি একজন সফল নারী। অশোকের থেকে টাকা ধার করে ব্যবসায় নামি আমি। সেই ব্যবসার দেখভালের জন্যে সারা ভারতবর্ষ আমায় এখন ঘুরে বেড়াতে হয়। আমি আর অশোক নয়নীকে একটা হোম থেকে নিয়ে এসেছিলাম। ও আমাদের সব। কিছুদিন বাদেই ওর বিয়ে। দীপু আমায় ছেড়ে চলে গেছে। দীপুর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমাদের সম্পর্কটা একইরকম ছিল। এখন আর তাই, ‘নদী আমার বয় না পাশে/ স্রোতের দেখা নেই,/ আটকে রাখে গেরস্থালির লেই। কিন্তু ওর দেওয়া জীবন-ই আমার কাছে সূর্য, দিগন্তের খোলা মাঠ’।
লেখক : স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
কবিতা : জয় গোস্বামী আর রুদ্র মহম্মদ শহিদুল্লাহ
ছবি : ইলোরা গওহর
‘সম্পর্কে কাকা হলেও জীবনের লম্বা, খারাপ সময়ে ওর কাছ থেকেই বেঁচে থাকার মন্ত্রটা নিতে পেরেছিলাম। মফস্বলের সুন্দরী মেয়ে হলেও আমার শ্যামলা রঙের চিন্তায় বাবা আমাকে খুব দ্রুত ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলার বন্দোবস্ত করেছিলেন।ঝেড়ে-বেছে পাওয়া গেল শহুরে, উচ্চ ঘরের, সুপুরুষ, ধনী যুবক- যার চেয়ে ভাল পাত্র পৃথিবী খুঁজলেও আর নাকি পাওয়া যেতো না। হোক না তার দ্বিতীয় বিয়ে! তাতে ‘এমন কি আর মন্দ ছেলে?’ আর বাবা, মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো শিক্ষা আমার সেই সময়ে জোটেনি। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর পিছিয়ে গিয়ে আমার কথা বুঝতে হবে। আমিও কিছু না ভেবেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলাম।
বিয়ের পর বুঝলাম দ্বিতীয় বিয়ের আসল কারণ। বিয়ের পর আমি চলে গেলেও অশোক-এর বাবা আবার হয়তো তাঁর ছেলের বিয়ে দিতেন। কারণ ছেলে যে নপুংসক, সমাজের সামনে সেটা যে কোনও পরিস্থিতিতেই আড়াল করে রাখাই তাঁর শেষ বয়সের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। আমি থেকে গেলাম। তখনও নিজের চাওয়া বুঝে কিছু করে ওঠার মতো মানসিকতা আমার তৈরি হয়নি। আমার মতো সাধারণ মেয়ের শুরুতেই সব ফুরিয়ে গিয়েছিল। প্রেম নেই, যৌনতা নেই, সন্তান নেই, সংসার নেই, সে ভাবে দেখতে গেলে কোনও বন্ধুতার সম্পর্ক পর্যন্ত নেই। আজ যদি জানতে চাও তখন কেমন করে কাটত আমার দিনরাত্রির বেলা? আমি বলব- ‘একদিন বমি করেছিলাম, একদিন ঢোঁক গিলেছিলাম,/ একদিন আমি ছোঁয়া মাত্র জল/ রুপান্তরিত হয়েছিল দুধে,’।
আমার পোড়া সময়ের, কিছুই ভাল না লাগা সময়ের, সব হারানোর দিনে একদিন দীপু এসে হাজির হল। আর সকলের মতো ও বলেনি আমায় বড়লোক, ভাল মানুষ বড়, দেবতুল্য শ্বশুর আর রাজরানির বিলাসিতায় সবকিছুকে ভুলে থাকতে।
তখন ‘আমার শরীর ছিল তরুণ পাতায় ভরা/ আর আমার আঙুল ছিল লম্বা সাদা বকফুল/ আমার চুল ছিল একঝাঁক ধূসর রঙের মেঘ/ হাওয়া এলেই যেখানে খুশি উড়ে যাবে, কেবল সেইজন্য। সেই জন্যেই দীপু এসেছিল, তার শরীর ঢেলে দিয়েছিল আমার ওপর। আমি ভিজতে চেয়েছিলাম, সমস্ত বঞ্চনার খোলসে আমার রোমাঞ্চিত যমুনার ঢেউ আছড়ে পড়ল আমার দীপুর জীবনে। আমার জীবন দিয়ে আমি জেনেছি মানুষের এক দিক অন্ধকারে মিশে যাওয়ার পর অন্যদিকের আলো যখন আসে তখন তার তীব্রতায় সবকিছুকে ছাপিয়ে যাওয়ার সর্বনাশ কাজ করে। আমি বিবাহিত নিঃসন্তান মহিলা কেমন করে আমার কাকার সঙ্গে শরীরে মনে জড়িয়ে পরতে পারি? এ তো অন্যায়-ই। আমার মা-ই বলেছিল ‘এত কিসের খিদে তোমার’?
দীপু আমার শ্বশুর বাড়িতেই আসত। ওর দগ্ধ ডানায় আমার মৃত শয্যার ওপরে ফুল ফুটতে লাগল। অশোক আর আমার শ্বশুরমশাই দুজনেই এটা মেনে নিয়েছিল।এটাই সবচাইতে অবাক করে আমায়! আজ-ও। অথচ আমার বাবা, মা, কোনওদিনই আর সেভাবে আমায় মেনে নিতে পারেনি। দীপুর বিবাহিত জীবনে আমি যে অভিশাপ হয়ে এসেছিলাম। কিন্তু আমি বা কি করি? তখন তো আমি আমার যৌবনের ব্যাধি ঘর থেকে মুক্তি অথবা মৃত্যু চেয়ে ফিরছি! আর কিছুই আমি বুঝি না তখন।
এর পর থেকেই আমি জীবনে ফিরি। দীপু চাইলেও, সন্তান পাগল হয়েও আমি তা কখনও চাই নি।
আসলে দীপু আর আমার সম্পর্ককে সহজে নেওয়ায়, অশোক আর আমার সম্পর্কটাও সহজ হয়, নির্ভরতা আসে, একে অপরের প্রতি যত্ন আসে, ভাললাগার জন্ম হয়। সমাজ সর্বদাই বাঁধা ছকের বাইরের যে কোনও সম্পর্ককেই দূরছাই করে এসেছে। কিন্তু মানুষের মন ম্যাজিক জানে, এক সম্পর্ক দিয়ে পুরোনও অবস্থানকে উজ্জ্বল করে, নতুন করে পেতে শেখায়। যারা এটার মধ্যে দিয়ে যায় তারাই জানে।
আজ আমি একজন সফল নারী। অশোকের থেকে টাকা ধার করে ব্যবসায় নামি আমি। সেই ব্যবসার দেখভালের জন্যে সারা ভারতবর্ষ আমায় এখন ঘুরে বেড়াতে হয়। আমি আর অশোক নয়নীকে একটা হোম থেকে নিয়ে এসেছিলাম। ও আমাদের সব। কিছুদিন বাদেই ওর বিয়ে। দীপু আমায় ছেড়ে চলে গেছে। দীপুর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমাদের সম্পর্কটা একইরকম ছিল। এখন আর তাই, ‘নদী আমার বয় না পাশে/ স্রোতের দেখা নেই,/ আটকে রাখে গেরস্থালির লেই। কিন্তু ওর দেওয়া জীবন-ই আমার কাছে সূর্য, দিগন্তের খোলা মাঠ’।
লেখক : স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
কবিতা : জয় গোস্বামী আর রুদ্র মহম্মদ শহিদুল্লাহ
ছবি : ইলোরা গওহর
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন