ঝুম বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের সামনের সবুজে মোড়ানো মাঠটা । বৃষ্টিটা উপেক্ষা করেই মাঠের পাশের রাস্তাটা দিয়ে দ্রুত গতিতে সাইকেল ছুটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে একটি ছেলে । ছেলেটার নাম অভিক । এই কলেজেরই ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ।
বৃষ্টির পানিতে ঝাপসা হয়ে যাওয়া চারপাশের পরিবেশটা দেখতে দেখতে সাবধানী গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছিলো অভিক । কিন্তু , সমস্যাটা তৈরি হল আরেকটু সামনে এগোতেই । হঠাৎ করে রাস্তা পার হতে যাওয়া একটা মেয়ে অভিকের সাইকেলের সাথে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে যায় । সাইকেলটা কোনরকমে নিয়ন্ত্রণ করে দাঁড়িয়ে যায় অভিক । একটু ভীতু টাইপের ছেলেরা যা করে , অভিকও ঠিক সেই কাজটাই করলো । চারপাশের পরিবেশটা ভালো করে দেখে নিলো ।
নাহ , আশেপাশে কেউ নেই । মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো অভিক । আশেপাশে মানুষ থাকলে নিশ্চয় এতক্ষণে ভিড় লাগিয়ে মেয়েটার প্রতি সহানুভূতি দেখাতে এগিয়ে আসতো আর অভিককে এই সুযোগে কিছু গালিগালাজ শুনতে হতো । কে জানে , হয়তোবা থাপ্পড়ও খাওয়া হয়ে যেত ।
সাইকেল থেকে নেমে একটু ভয়ে ভয়ে অভিক মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলো ।
-সরি । বৃষ্টির কারণে সবকিছু একটু অস্পষ্ট লাগছিলো । তাই , আপনার রাস্তা পার হওয়াটা ভালোভাবে খেয়াল করতে পারিনি । আমি সত্যিই অনেক দুঃখিত ।
-নাহ । ঠিক আছে । আসলে দোষটা আমারই । এভাবে হঠাৎ করে রাস্তা পার হওয়াটা উচিত হয়নি ।
অভিক মনে মনে একটা কঠিন ধাক্কা খেল । সে চিন্তা করেছিল , হয়তো মেয়েটার কাছ থেকে তাকে কঠিন ঝাড়ি শুনতে হবে । কিন্তু , হল ঠিক উল্টো ।
-আপনি কি বেশি ব্যথা পেয়েছেন ? আমার হাতটা ধরে উঠে দাঁড়ান ।
মেয়েটা অভিকের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলো ।
অভিক মেয়েটাকে দাড় করিয়ে রাস্তার অপর পাশ থেকে মেয়েটার হাত থেকে ছিটকে যাওয়া ছাতাটা তুলে এনে দিলো ।
-আপনি কি এই কলেজেই পড়েন ?
-হ্যাঁ । ফার্স্ট ইয়ারে ।
-আমি অভিক । সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি । আপনার নামটা কি জানতে পারি ?
-আমি নূপুর ।
নূপুরকে কিছুদূর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসে আবার সাইকেলে চেপে বসলো অভিক । কিন্তু , নূপুরের মায়াবী চেহারার সূক্ষ্ম ভাবনাটা গেঁথে গেলো অভিকের মনে ।
পরদিন সকালে কলেজে যাওয়ার পর থেকেই নূপুরের সাথে দেখা করার চিন্তাটা ঘুরপাক খাচ্ছিলো অভিকের মাথায় ।
টিফিন পিরিয়ডে ২য় তলায় মেয়েদের সেকশনের সামনে কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটি করার পরও যখন নূপুরের দেখা পাওয়া গেলো না , তখন কিছুটা হতাশ হয়েই ফিরে আসছিলো অভিক । হঠাৎ সিঁড়ির দিকের একটা কোণে চোখ আঁটকে যায় অভিকের । হাতে একটা কাগজ আর একটা কলম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নূপুর । আনমনা হয়ে কি যেন লিখছে কাগজটাতে । কিন্তু , ক্লাসের ঘণ্টা বেজে ওঠার কারণে কাগজটা ওইখানে রেখেই দৌড়ে চলে যায় মায়াবী চেহারার মেয়েটা ।
কিছুটা কৌতূহলী মন নিয়ে কাগজটার দিয়ে এগিয়ে যায় অভিক । তারপর কাগজটা হাতে তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করলো :
তুমি লহ নাই ভালবাসিবার দায়,
দু'হাতে শুধুই কুড়িয়েছ ঝরা ফুল।
-(নির্মলেন্দু গুন)
মেয়েটা কি তাহলে কবিতা পড়তে অনেক বেশি পছন্দ করে ? আপন মনেই নিজেকে প্রশ্নটা করে বসলো অভিক ......
সেদিনের পর থেকে অভিকের মনে শুধুমাত্র একটি চিন্তাই খেলা করতো । আর তা হল , কীভাবে কবিতা লেখা যায় ......
অভিক প্রতিদিনই টিফিন পিরিয়ডে আড়াল থেকে নূপুরকে দেখতো আর ওকে দেখে কবিতা লিখতে চেষ্টা করতো । কিন্তু , কবি হওয়া তো আর সহজ কোন কাজ না । তবুও , মেয়েটাকে ইমপ্রেস করার জন্য কবি হওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো অভিক । প্রতিদিনই ‘নূপুর’ নামের সাথে ছন্দ মিলিয়ে ২-৩ লাইনের কবিতা লিখে ফেলতো অভিক । শেষপর্যন্ত যা হবার তাই হয় । মানে ফলাফল জিরো । মন মতো না হওয়ার কারণে নিজের হাতেই কলেজের ময়লা ফেলার ঝুড়িতে কবিতাগুলো বিসর্জন দিতে হতো অভিককে ।
এভাবেই দেখতে দেখতে কেটে যায় ১টি বছর । মায়াবী চেহারার নূপুরের প্রতি অভিকের মনের আকুলতা মনের মাঝেই থেকে যায় । আকুলতাটা চেপে রেখেই কলেজ লাইফ কমপ্লিট করে সিলেট মেডিকেল কলেজে চলে যায় অভিক ।
কেটে যায় আরও একটি বছর । অভিক তখন মেডিকেল কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে । একদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার এক পর্যায়ে হঠাৎ একটা মেয়েকে দেখে চমকে ওঠে অভিক । মেয়েটিকে দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস কিছুতেই করাতে পারছিলো না । কারণ , মেয়েটি ছিল নূপুর । একমুহূর্ত দেরী না করে পুরনো আকুলতা আর কিছু সাহসকে সঙ্গী করে নূপুরের দিকে এগিয়ে যায় অভিক ।
-তুমি এইখানে ? আমাকে চিনতে পেরেছ ?
-হ্যাঁ । চিনতে পেরেছি । আপনার সাথে আমার কলেজে থাকতে একবার দেখা হয়েছিলো । সাইকেল এক্সিডেন্ট ......
অভিক মনে মনে আবারও একটা ধাক্কা খেল । সে ভেবেছিল , মেয়েটার হয়তো কিছুই মনে নাই ......
-তুমি কি এই কলেজেই ভর্তি হয়েছ ?
-আপনার কি মনে হয় , আমি ঘুরতে এসেছি ?
-নাহ । তা হবে কেন ...... এমনি জিজ্ঞেস করলাম । ( একটু লজ্জিত কণ্ঠস্বরে )
নূপুর চলে যাওয়ার পর অভিক মনে মনে একটা আনন্দের দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল । চিন্তা করলো , এইবার যেভাবেই হোক মেয়েটাকে তার ভালোবাসার ফাঁদে আটকাতে হবে ......
৩ মাস যাওয়ার পর আবারও বাঁধার সম্মুখীন হল অভিক । ভেবেছিলো নূপুরকে তার মনের সব আকুলতা খুলে বলবে । কিন্তু , সেই আশায় গুড়ে-বালি । শুভ্র নামের একটা ছেলের সাথে নূপুর সবসময় ঘুরে বেড়াতো । ব্যাপারটা একদমই সহ্য করতে পারছিলো না অভিক । শেষে কোন উপায় না পেয়ে একদিন সরাসরি নূপুরকে ডেকে বসলো :
-তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে ।
-বলেন ।
-এইখানে না । আজ বিকালে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্কেটবল মাঠের পাশে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো । তুমি আসবে ।
-আপনি বললেই আমাকে কেন যেতে হবে ?
-একদম কথা বলবে না । আমি তোমার সিনিয়র । যা বলছি , তাই করবা ।
কথাগুলো বলে অভিক দ্রুত চলে গেলো ।
বিকাল ৪ টা ।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্কেটবল মাঠের পাশে বসে আছে অভিক । গায়ে লাল রঙের একটা পাঞ্জাবী । এই শীতের মাঝে পাঞ্জাবী পড়ে আসার ব্যাপারটা অভিকের নিজের কাছেই অচেনা ।
আস্তে আস্তে হেঁটে আসছে নূপুর । এসে অভিকের সামনে দাঁড়ালো ।
-বলেন । কি বলবেন ......
-ওই ছাগলটার সাথে তোমাকে মোটেই মানায় না ।
-ছাগল মানে ?
-যার সাথে প্রতিদিন ঘুরে বেড়াও , আমি তার কথাই বলছি ।
-তাহলে কার সাথে মানায় ? আপনার সাথে ?
-হ্যাঁ । আমার সাথেই তোমাকে মানায় । ( একটু রাগী ভাষায় )
-কিন্তু , আপনি নিজেও তো একটা ছাগল ।
-মানে ?
-একটা মেয়েকে ভালোবাসেন । কিন্তু , কখনও সেটা বলতে পারেন নাই । তাহলে আপনাকে ছাগল বলব না তো কি বলব ......
-আমিতো তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না ।
-টিফিন পিরিয়ডে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা , কবিতা লেখা এইগুলার মানে কি ?
-তু তু তুমি জানো কীভাবে ?
নূপুর তার হ্যান্ড ব্যাগ থেকে প্রায় ১৫-২০টা কাগজ বের করে আনল । এই কাগজগুলোর লেখা চিনতে পারছেন ?
-হ্যাঁ । আমার লেখা । তুমি পেলে কীভাবে ?
-আপনি আসলেই একটা ছাগল । কলেজে থাকাকালীন প্রতিদিন আপনি আমার ক্লাসরুমের সামনে ঘুরঘুর করতেন । একদিন দেখলাম , কাগজে কি লিখে আমার ক্লাসরুমের সামনের ঝুড়িটাতে তা ফেলে দিচ্ছেন । তারপর থেকে প্রতিদিনই একই কাজ করতেন । আর আমি কাগজগুলো তুলে নিয়ে লেখাগুলো পড়তাম । কিন্তু , লেখাগুলো পড়ে চরম বিরক্ত হতাম । কারণ , আমার নাম ব্যাবহার করে আপনি এত ফাউল ফাউল কবিতা লিখতেন যা বলার মতো না । যেমন , আপনার ২ লাইনের একটা কবিতা পড়ে শোনাই :
‘নূপুর বাজে ,
মনের কোণে’ ......
এইটা কোন কবিতা হল ?
তবুও , আমার নাম দিয়ে লিখতে চেষ্টা করেছেন । তাই ,আমি ধন্য । ও , আরেকটা কথা । আমি রাজশাহী মেডিকেলে চান্স পেয়েছিলাম । কিন্তু , কোন এক ছাগলের কথা চিন্তা করে মাইগ্রেশন করে সিলেটে চলে আসছি । ছাগলটার কবিতাগুলো কমপ্লিট করে দেয়ার জন্যই এই প্রচেষ্টা ।
-তাহলে , ওই ছাগল মার্কা ছেলেটার সাথে ঘোরাঘুরি করো কেন ?
-আপনাকে রাগানোর জন্য । যদি না রাগাতাম তাহলে তো আর আজকের মতো সাহস করে আমাকে ডাকতে পারতেন না ...... তাই না ?
বোকার মতো কিছুক্ষন নূপুরের দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর নিজের হাতটা সামনের দিকে বাড়িয়ে দিলো অভিক ।
-আমি কি তোমার হাতটা ধরতে পারি ?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির স্পর্শে কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসলো অভিক । সে বসে আছে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্কেটবল মাঠের পাশে । পরনে লাল রঙের একটা পাঞ্জাবী ।
৮ বছর আগে ঠিক এই জায়গাটাতেই নূপুরকে প্রপোজ করেছিলো অভিক । সেই স্মৃতিটা মনে হলে এখনও শিহরণ জেগে ওঠে । পুরনো স্মৃতিগুলো মনে করে এতক্ষন অপেক্ষার প্রহরগুলো গুনে যাচ্ছিলো অভিক ।
আজ নূপুর আর অভিকের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী ।
৮ বছর আগে এই জায়গাতে অভিক যখন নূপুরকে প্রপোজ করেছিলো , তখন ওরা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো । সিদ্ধান্তটা ছিল , ওদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী এই বাস্কেটবল মাঠের পাশেই সেলিব্রেট করতে হবে ।
গুটি গুটি পায়ে হেঁটে আসছে নূপুর । এসে বসলো অভিকের পাশের জায়গাটাতে । তারপর অভিকের হাতটা আন্তরিকভাবে জড়িয়ে ধরে বললো :
-তোমাকে আমি কত ভালোবাসি , সেটা কি তুমি জানো ?
মুগ্ধ চোখে নূপুরের দিকে তাকায় অভিক ।
-হুম । জানি ।
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিটা তখনও অবিরাম ঝরেই যাচ্ছে । আর সেই বৃষ্টিটাতে ভিজে একাকার হচ্ছে লাল পাঞ্জাবী পরা একটি ছেলে আর লাল শাড়ি পরা একটি মেয়ে ।
হঠাৎ মেয়েটা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে :
-তোমাকে যে একটা কবিতা লিখতে বলেছিলাম , লিখেছ ?
-হ্যাঁ । লিখেছি তো ।
-তাহলে পড়ে শোনাও ।
-‘নূপুর বাজে ,
মনের কোণে’ ।
ছেলেটার এই দুই লাইনের কবিতাটা শুনে শব্দ করে হেসে ওঠে মেয়েটা । গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির শব্দের সাথে মেয়েটার হাসির শব্দ মিশে একাকার হয়ে ভেসে বেড়ায় শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্কেটবল মাঠে।
বৃষ্টির পানিতে ঝাপসা হয়ে যাওয়া চারপাশের পরিবেশটা দেখতে দেখতে সাবধানী গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছিলো অভিক । কিন্তু , সমস্যাটা তৈরি হল আরেকটু সামনে এগোতেই । হঠাৎ করে রাস্তা পার হতে যাওয়া একটা মেয়ে অভিকের সাইকেলের সাথে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে যায় । সাইকেলটা কোনরকমে নিয়ন্ত্রণ করে দাঁড়িয়ে যায় অভিক । একটু ভীতু টাইপের ছেলেরা যা করে , অভিকও ঠিক সেই কাজটাই করলো । চারপাশের পরিবেশটা ভালো করে দেখে নিলো ।
নাহ , আশেপাশে কেউ নেই । মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো অভিক । আশেপাশে মানুষ থাকলে নিশ্চয় এতক্ষণে ভিড় লাগিয়ে মেয়েটার প্রতি সহানুভূতি দেখাতে এগিয়ে আসতো আর অভিককে এই সুযোগে কিছু গালিগালাজ শুনতে হতো । কে জানে , হয়তোবা থাপ্পড়ও খাওয়া হয়ে যেত ।
সাইকেল থেকে নেমে একটু ভয়ে ভয়ে অভিক মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলো ।
-সরি । বৃষ্টির কারণে সবকিছু একটু অস্পষ্ট লাগছিলো । তাই , আপনার রাস্তা পার হওয়াটা ভালোভাবে খেয়াল করতে পারিনি । আমি সত্যিই অনেক দুঃখিত ।
-নাহ । ঠিক আছে । আসলে দোষটা আমারই । এভাবে হঠাৎ করে রাস্তা পার হওয়াটা উচিত হয়নি ।
অভিক মনে মনে একটা কঠিন ধাক্কা খেল । সে চিন্তা করেছিল , হয়তো মেয়েটার কাছ থেকে তাকে কঠিন ঝাড়ি শুনতে হবে । কিন্তু , হল ঠিক উল্টো ।
-আপনি কি বেশি ব্যথা পেয়েছেন ? আমার হাতটা ধরে উঠে দাঁড়ান ।
মেয়েটা অভিকের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলো ।
অভিক মেয়েটাকে দাড় করিয়ে রাস্তার অপর পাশ থেকে মেয়েটার হাত থেকে ছিটকে যাওয়া ছাতাটা তুলে এনে দিলো ।
-আপনি কি এই কলেজেই পড়েন ?
-হ্যাঁ । ফার্স্ট ইয়ারে ।
-আমি অভিক । সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি । আপনার নামটা কি জানতে পারি ?
-আমি নূপুর ।
নূপুরকে কিছুদূর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসে আবার সাইকেলে চেপে বসলো অভিক । কিন্তু , নূপুরের মায়াবী চেহারার সূক্ষ্ম ভাবনাটা গেঁথে গেলো অভিকের মনে ।
পরদিন সকালে কলেজে যাওয়ার পর থেকেই নূপুরের সাথে দেখা করার চিন্তাটা ঘুরপাক খাচ্ছিলো অভিকের মাথায় ।
টিফিন পিরিয়ডে ২য় তলায় মেয়েদের সেকশনের সামনে কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটি করার পরও যখন নূপুরের দেখা পাওয়া গেলো না , তখন কিছুটা হতাশ হয়েই ফিরে আসছিলো অভিক । হঠাৎ সিঁড়ির দিকের একটা কোণে চোখ আঁটকে যায় অভিকের । হাতে একটা কাগজ আর একটা কলম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নূপুর । আনমনা হয়ে কি যেন লিখছে কাগজটাতে । কিন্তু , ক্লাসের ঘণ্টা বেজে ওঠার কারণে কাগজটা ওইখানে রেখেই দৌড়ে চলে যায় মায়াবী চেহারার মেয়েটা ।
কিছুটা কৌতূহলী মন নিয়ে কাগজটার দিয়ে এগিয়ে যায় অভিক । তারপর কাগজটা হাতে তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করলো :
তুমি লহ নাই ভালবাসিবার দায়,
দু'হাতে শুধুই কুড়িয়েছ ঝরা ফুল।
-(নির্মলেন্দু গুন)
মেয়েটা কি তাহলে কবিতা পড়তে অনেক বেশি পছন্দ করে ? আপন মনেই নিজেকে প্রশ্নটা করে বসলো অভিক ......
সেদিনের পর থেকে অভিকের মনে শুধুমাত্র একটি চিন্তাই খেলা করতো । আর তা হল , কীভাবে কবিতা লেখা যায় ......
অভিক প্রতিদিনই টিফিন পিরিয়ডে আড়াল থেকে নূপুরকে দেখতো আর ওকে দেখে কবিতা লিখতে চেষ্টা করতো । কিন্তু , কবি হওয়া তো আর সহজ কোন কাজ না । তবুও , মেয়েটাকে ইমপ্রেস করার জন্য কবি হওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো অভিক । প্রতিদিনই ‘নূপুর’ নামের সাথে ছন্দ মিলিয়ে ২-৩ লাইনের কবিতা লিখে ফেলতো অভিক । শেষপর্যন্ত যা হবার তাই হয় । মানে ফলাফল জিরো । মন মতো না হওয়ার কারণে নিজের হাতেই কলেজের ময়লা ফেলার ঝুড়িতে কবিতাগুলো বিসর্জন দিতে হতো অভিককে ।
এভাবেই দেখতে দেখতে কেটে যায় ১টি বছর । মায়াবী চেহারার নূপুরের প্রতি অভিকের মনের আকুলতা মনের মাঝেই থেকে যায় । আকুলতাটা চেপে রেখেই কলেজ লাইফ কমপ্লিট করে সিলেট মেডিকেল কলেজে চলে যায় অভিক ।
কেটে যায় আরও একটি বছর । অভিক তখন মেডিকেল কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে । একদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার এক পর্যায়ে হঠাৎ একটা মেয়েকে দেখে চমকে ওঠে অভিক । মেয়েটিকে দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস কিছুতেই করাতে পারছিলো না । কারণ , মেয়েটি ছিল নূপুর । একমুহূর্ত দেরী না করে পুরনো আকুলতা আর কিছু সাহসকে সঙ্গী করে নূপুরের দিকে এগিয়ে যায় অভিক ।
-তুমি এইখানে ? আমাকে চিনতে পেরেছ ?
-হ্যাঁ । চিনতে পেরেছি । আপনার সাথে আমার কলেজে থাকতে একবার দেখা হয়েছিলো । সাইকেল এক্সিডেন্ট ......
অভিক মনে মনে আবারও একটা ধাক্কা খেল । সে ভেবেছিল , মেয়েটার হয়তো কিছুই মনে নাই ......
-তুমি কি এই কলেজেই ভর্তি হয়েছ ?
-আপনার কি মনে হয় , আমি ঘুরতে এসেছি ?
-নাহ । তা হবে কেন ...... এমনি জিজ্ঞেস করলাম । ( একটু লজ্জিত কণ্ঠস্বরে )
নূপুর চলে যাওয়ার পর অভিক মনে মনে একটা আনন্দের দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল । চিন্তা করলো , এইবার যেভাবেই হোক মেয়েটাকে তার ভালোবাসার ফাঁদে আটকাতে হবে ......
৩ মাস যাওয়ার পর আবারও বাঁধার সম্মুখীন হল অভিক । ভেবেছিলো নূপুরকে তার মনের সব আকুলতা খুলে বলবে । কিন্তু , সেই আশায় গুড়ে-বালি । শুভ্র নামের একটা ছেলের সাথে নূপুর সবসময় ঘুরে বেড়াতো । ব্যাপারটা একদমই সহ্য করতে পারছিলো না অভিক । শেষে কোন উপায় না পেয়ে একদিন সরাসরি নূপুরকে ডেকে বসলো :
-তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে ।
-বলেন ।
-এইখানে না । আজ বিকালে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্কেটবল মাঠের পাশে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো । তুমি আসবে ।
-আপনি বললেই আমাকে কেন যেতে হবে ?
-একদম কথা বলবে না । আমি তোমার সিনিয়র । যা বলছি , তাই করবা ।
কথাগুলো বলে অভিক দ্রুত চলে গেলো ।
বিকাল ৪ টা ।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্কেটবল মাঠের পাশে বসে আছে অভিক । গায়ে লাল রঙের একটা পাঞ্জাবী । এই শীতের মাঝে পাঞ্জাবী পড়ে আসার ব্যাপারটা অভিকের নিজের কাছেই অচেনা ।
আস্তে আস্তে হেঁটে আসছে নূপুর । এসে অভিকের সামনে দাঁড়ালো ।
-বলেন । কি বলবেন ......
-ওই ছাগলটার সাথে তোমাকে মোটেই মানায় না ।
-ছাগল মানে ?
-যার সাথে প্রতিদিন ঘুরে বেড়াও , আমি তার কথাই বলছি ।
-তাহলে কার সাথে মানায় ? আপনার সাথে ?
-হ্যাঁ । আমার সাথেই তোমাকে মানায় । ( একটু রাগী ভাষায় )
-কিন্তু , আপনি নিজেও তো একটা ছাগল ।
-মানে ?
-একটা মেয়েকে ভালোবাসেন । কিন্তু , কখনও সেটা বলতে পারেন নাই । তাহলে আপনাকে ছাগল বলব না তো কি বলব ......
-আমিতো তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না ।
-টিফিন পিরিয়ডে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা , কবিতা লেখা এইগুলার মানে কি ?
-তু তু তুমি জানো কীভাবে ?
নূপুর তার হ্যান্ড ব্যাগ থেকে প্রায় ১৫-২০টা কাগজ বের করে আনল । এই কাগজগুলোর লেখা চিনতে পারছেন ?
-হ্যাঁ । আমার লেখা । তুমি পেলে কীভাবে ?
-আপনি আসলেই একটা ছাগল । কলেজে থাকাকালীন প্রতিদিন আপনি আমার ক্লাসরুমের সামনে ঘুরঘুর করতেন । একদিন দেখলাম , কাগজে কি লিখে আমার ক্লাসরুমের সামনের ঝুড়িটাতে তা ফেলে দিচ্ছেন । তারপর থেকে প্রতিদিনই একই কাজ করতেন । আর আমি কাগজগুলো তুলে নিয়ে লেখাগুলো পড়তাম । কিন্তু , লেখাগুলো পড়ে চরম বিরক্ত হতাম । কারণ , আমার নাম ব্যাবহার করে আপনি এত ফাউল ফাউল কবিতা লিখতেন যা বলার মতো না । যেমন , আপনার ২ লাইনের একটা কবিতা পড়ে শোনাই :
‘নূপুর বাজে ,
মনের কোণে’ ......
এইটা কোন কবিতা হল ?
তবুও , আমার নাম দিয়ে লিখতে চেষ্টা করেছেন । তাই ,আমি ধন্য । ও , আরেকটা কথা । আমি রাজশাহী মেডিকেলে চান্স পেয়েছিলাম । কিন্তু , কোন এক ছাগলের কথা চিন্তা করে মাইগ্রেশন করে সিলেটে চলে আসছি । ছাগলটার কবিতাগুলো কমপ্লিট করে দেয়ার জন্যই এই প্রচেষ্টা ।
-তাহলে , ওই ছাগল মার্কা ছেলেটার সাথে ঘোরাঘুরি করো কেন ?
-আপনাকে রাগানোর জন্য । যদি না রাগাতাম তাহলে তো আর আজকের মতো সাহস করে আমাকে ডাকতে পারতেন না ...... তাই না ?
বোকার মতো কিছুক্ষন নূপুরের দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর নিজের হাতটা সামনের দিকে বাড়িয়ে দিলো অভিক ।
-আমি কি তোমার হাতটা ধরতে পারি ?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির স্পর্শে কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসলো অভিক । সে বসে আছে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্কেটবল মাঠের পাশে । পরনে লাল রঙের একটা পাঞ্জাবী ।
৮ বছর আগে ঠিক এই জায়গাটাতেই নূপুরকে প্রপোজ করেছিলো অভিক । সেই স্মৃতিটা মনে হলে এখনও শিহরণ জেগে ওঠে । পুরনো স্মৃতিগুলো মনে করে এতক্ষন অপেক্ষার প্রহরগুলো গুনে যাচ্ছিলো অভিক ।
আজ নূপুর আর অভিকের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী ।
৮ বছর আগে এই জায়গাতে অভিক যখন নূপুরকে প্রপোজ করেছিলো , তখন ওরা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো । সিদ্ধান্তটা ছিল , ওদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী এই বাস্কেটবল মাঠের পাশেই সেলিব্রেট করতে হবে ।
গুটি গুটি পায়ে হেঁটে আসছে নূপুর । এসে বসলো অভিকের পাশের জায়গাটাতে । তারপর অভিকের হাতটা আন্তরিকভাবে জড়িয়ে ধরে বললো :
-তোমাকে আমি কত ভালোবাসি , সেটা কি তুমি জানো ?
মুগ্ধ চোখে নূপুরের দিকে তাকায় অভিক ।
-হুম । জানি ।
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিটা তখনও অবিরাম ঝরেই যাচ্ছে । আর সেই বৃষ্টিটাতে ভিজে একাকার হচ্ছে লাল পাঞ্জাবী পরা একটি ছেলে আর লাল শাড়ি পরা একটি মেয়ে ।
হঠাৎ মেয়েটা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে :
-তোমাকে যে একটা কবিতা লিখতে বলেছিলাম , লিখেছ ?
-হ্যাঁ । লিখেছি তো ।
-তাহলে পড়ে শোনাও ।
-‘নূপুর বাজে ,
মনের কোণে’ ।
ছেলেটার এই দুই লাইনের কবিতাটা শুনে শব্দ করে হেসে ওঠে মেয়েটা । গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির শব্দের সাথে মেয়েটার হাসির শব্দ মিশে একাকার হয়ে ভেসে বেড়ায় শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্কেটবল মাঠে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন