একটা মেয়ে যখন ভর দুপুর বেলায় রাস্তার একপাশে একা একা দাঁড়িয়ে থাকে , কোন একটা কারণে দৃশ্যটা চলতি পথের মানুষদের মনে ব্যপক কৌতূহল জাগায় । তারা খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে , তাড়িয়ে তাড়িয়ে মেয়েটার অসহায় বিরক্তি উপভোগ করার চেষ্টা করে । যে কোন মেয়ের জন্যে ব্যাপারটা অনেক বেশি অসস্তির । আর ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি রকমের অস্বস্তির যখন ঘটনাটা আমাদের গল্পের জয়িতার সাথে ঘটে । ব্যাপারটা মোটামুটি অবিচারের পর্যায়ে চলে যায় যখন ওর দাঁড়িয়ে থাকার কারণে যে ব্যক্তি , সেই ব্যক্তি সবে মাত্র ঘুম থেকে উঠে হাই তুলতে তুলতে ফোন রিসিভ করে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে , " তুই আর আধঘণ্টা মোড়ের দোকানগুলার সামনে দাঁড়া । আমি গোসল করে আসতেছি । "
এবং এই চরিত্র দুইটির সবচেয়ে আশ্চর্যের জায়গা হচ্ছে , জয়িতা আসলেই দাঁড়িয়ে থাকে ।
ঘড়ি ধরে আধা ঘণ্টার একটু কম সময় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ের জোড়া গুলো যখন খুলে আসতে চাইছে , ঠিক তখনই বাইক নিয়ে ফিল্মি স্টাইলে ছেলেটার আগমন , আপাতত আমাদের গল্পের নায়ক এই ছেলেটাই , দিব্য ।
জয়িতাঃ দিব্য ...
দিব্যঃ কথা পড়ে । আগে রিকশা ডাক ।
জয়িতাঃ রিকশা কেন ?
দিব্যঃ হাঁটতে পারবো না । রিকশা ডাক ।
জয়িতা জানে বাইকটা দিব্যের না । তাড়াহুড়া করার জন্যে কাজিনের বাইক নিয়ে টান দিয়ে চলে এসেছে । জয়িতা এটাও জানে , ও এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো , ও এখন হাঁটতে পারবে না শুধু এই কারণেই এখন দিব্য রিকশা ডাকতে বলছে । নাহলে সাইন্স ল্যাব থেকে নীলক্ষেত হেঁটেই যাওয়া যায় ।
আমাদের গল্পে দিব্য এবং জয়িতা অনেক বড় একটা জায়গা জুড়ে আছে । ওদের পরিচয় হয়েছিল কলেজ লাইফে । এখন ভার্সিটি লাইফের প্রায় শেষ দিকেও ওরা অনেক ভাল বন্ধু । বন্ধুত্বের (!) নমুনা উপরেই পাওয়া যায় ! জয়িতা , দিব্যের একমাত্র কাছের বন্ধু । আর দিব্য , জয়িতার বন্ধুদের মাঝে সবচেয়ে কাছের ।
দিব্য থাকে ঢাকায় ওর কাজিনের বাসায় । বাবার সাথে সম্পর্ক খারাপ হওয়ায় মা মারা যাওয়ার পর থেকে হোস্টেলে অথবা যাতায়াতের সুবিধার অজুহাতে কাজিনের বাসায় থেকেছে ও কলেজ লাইফ থেকেই । অন্যদিকে জয়িতা , কলেজের ভার্সিটির অনেক ছেলের দীর্ঘশ্বাসের কারণ হয়েছিল স্টুডেন্ট লাইফটাতে । বাবা নেই , মা ভার্সিটি লেকচারার । প্রতাপশালী উচ্চবিত্ত নানাভাইয়ের কারণে খুব একটা খারাপ অবস্থায় থাকতে হয় নি ওদেরকে । এই হচ্ছে মোটামুটি দিব্য আর জয়িতা ।
সেইদিন দুপুরের পর আজকে দুই দিন ধরে জয়িতার সাথে কথা হয়নি দিব্যের । বিকালে ওকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে এসে ও গিয়েছিল স্টুডেন্ট পড়াতে । রাতে এসে জয়িতাকে ফোন করে পায়নি । ভেবেছিলো হয়তো টায়ার্ড হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে । ফেসবুকেও অনলাইন পায়নি ওকে সেদিন রাতে । পরদিন সারাদিন খুব দৌড়াদৌড়িতে ছিল দিব্য । তারপরেও গুনে গুনে তিনবার ফোন করেছে জয়িতাকে । ধরেনি । দিব্যের কিছু সমস্যা আছে জয়িতা জানে । ও একবার চেয়ে যা পায়নি , ও সেটা দ্বিতীয়বার চাইবে না । দিব্য জানে , জয়িতা ওর তিনটা মিসড কল পেলে বুঝতে পারবে মন খারাপ হয়েছে ওর । ভীষণ মন খারাপ । সেইদিন সারাদিন জয়িতা ফোন দেয়নি ওকে । আজকে সন্ধ্যা বেলায় আটচল্লিশ ঘণ্টা হয়ে যাচ্ছে কথা হয়নি ওর জয়িতার সাথে । কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে দিব্যের । অসহায় , বিপর্যস্ত মুখ নিয়ে ছাদের এ মাথা থেকে ও মাথা পায়চারি করছে ও । একটু পরে ভীষণ মেজাজ খারাপ হওয়া শুরু হলো ওর । নিজের উপরে , জয়িতার উপরেও । মুখের ভেতরটা কেমন তেতো তেতো লাগছে ওর । তাকিয়ে দেখলো ওর কফির মগটার মাঝে একটা পোকা ভাসছে । মেজাজ খারাপের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেলো ওর । জয়িতার নিষেধে গত ছয় মাসে একটা সিগারেটও খায়নি দিব্য । আজকে কেন যেন হঠাত্ সিগারেটের নেশাটা জাকিয়ে বসেছে ওর । মন খারাপের সাথে সিগারেটের একটা মিল খুঁজে পায় ও । সিগারেট একটু একটু করে পোড়ে , ছাই হয় , তারপর হারিয়ে যায় । মন খারাপ আস্তে আস্তে একটা মানুষের ভেতরটাকে পুড়িয়ে ফেলে , তারপর একসময় মন খারাপের অনুভূতিটা হারিয়ে যায় । কিন্তু সিগারেট শেষ করার পর একটা জিনিস হয় না যেটা মন খারাপ থাকলে হয় । মন খারাপের অনুভূতিটা যখন চলে যায় তখন একটা ভয়ংকর শূন্যতা কাজ করে ।
'আউ !!' হাতে জ্বলতে থাকা সিগারেটটা পুড়ে শেষ হয়ে কখন ফিল্টার পর্যন্ত চলে এসেছে খেয়ালই করেনি ও । মেজাজ খারাপ করে আরেকটা সিগারেট ধরালো ও । ' শাআআলা !! ' মুখ থেকে থুতু ফেললো ও ছাদ থেকে ।
"তোরে না বলছি , যেখানে সেখানে থুতু ফেলবি না ?" কণ্ঠটা শোনার সাথে সাথে এতো চমকে উঠলো দিব্য যে হাত থেকে সিগারেটটা পড়ে গেলো রেলিং দিয়ে বাইরে । ঘুরে তাকিয়ে দেখে জয়িতা দাঁড়িয়ে আছে । দিব্য একবার চিন্তা করলো , ঘটনাটা কি ঘটছে । " আর সিগারেট খাইতে পারবি না এইটা জানার পরেও কেন সিগারেট কিনতে গেছিস ?" দিব্য এক মুহূর্ত চিন্তা করার পরেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করলো । ও জানে যে চোখ খোলার পরে দেখবে ওর সামনে কেউ নেই । পুরোটাই ওর কল্পনা । 'হুহ ! জয়িতা বাসার ছাদে চলে আসছে আমার !! সাধ তো কম না আমার !!! ' ভাবতে ভাবতেই চোখ খুলে তাকালো ও ।
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো খুব গোপনে । কেউ নেই ওর সামনে ।
অথচ দিব্য খুব খুব করে চাইছিলো ওর এই চিন্তাটা মিথ্যে হোক , ওর সামনে সত্যি সত্যিই জয়িতা দাঁড়িয়ে থাকুক ।
"অই ! ভ্যাবদার মত চোখ বন্ধ করে মুখ কান্না কান্না বানায়ে রাখছিস কেন ? " জয়িতার কণ্ঠ শুনতে পায় এবার পাশ থেকে । দিব্যের মাথায় এখন পুরাপুরি উল্টাপাল্টা সিক্সটি নাইন অবস্থা ! ও এখনো বোঝার চেষ্টা করছে জয়িতা আসলেই আছে নাকি নেই । মাথায় চাটি খেয়ে বুঝতে পারলো আসলেই জয়িতা ওর পাশে দাড়িয়েছে । ও চোখ বন্ধ করে ছিল দেখে টের পায়নি ।
জয়িতাঃ এই নে । ধর বক্সটা ।
দিব্যঃ কিসের বক্স ?
জয়িতাঃ আমার গিফট ।
দিব্যঃ মানে কি ? আমারে দিলি ?
জয়িতাঃ না । গিফটটা তুই এখন আমারে দিবি ।
দিব্যঃ তোর মাথা খারাপ ।
জয়িতাঃ না । তোর মেমরি খারাপ ।
দিব্যঃ ঠিক ঠাক মত কথা বল ।
জয়িতাঃ মিস্টার , আমার জন্মদিন আজকে । আমি জানি আপনি ভুলে গেছেন । তাই আমিই সাধাসাধি করে উইশ নিতে আসছি , সাথে গিফট নিতে আসছি ।
দিব্য জয়িতার দিকে তাকাতে পারে না , জয়িতার হাসিটা শুনতে অসহ্য লাগছিলো ওর । নিজের মাথার চুল নিজে টেনে ছিড়তে ইচ্ছা করছিলো ওর । চোখ ঘুরিয়ে প্রায় লাল হয়ে যাওয়া সূর্যের দিকে তাকায় দিব্য । সূর্যের লাল রং ওর চোখ রাঙায় , উড়ে যাওয়া মেঘ তরল হয়ে আশ্রয় খুঁজে নেয় চোখের পাতায় । জয়িতা অবাক হয়ে যায় দিব্যের এই প্রতিক্রিয়াতে । ধরে আসা গলায় দিব্য একমনে বলে যায় , " তুই ফোন ধরিস নাই , ফোন করিস নাই । আটচল্লিশ ঘণ্টা বাইশ মিনিট পর তোর সাথে কথা হইতেছে আমার । আমি একটা মিনিটের জন্যে পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারি নাই । আর তোর জন্মদিনটাও ভুলে গেছিলাম আমি ... হ্যাহ ! এই আমি বলি , তুই আমার একমাত্র কাছের বন্ধু ? আমি নয় খারাপ , ভুলে যাই । তুই কেন ফোন করলিনা একবার ? "
জয়িতা আক্ষরিক অর্থেই বোবা হয়ে যায় । ওর বলা হয় না , সেদিন রোদের মাঝে দাঁড়িয়ে থেকে জ্বর উঠে গিয়েছিল ওর । বলা হয় না , জন্মদিনে শুধু ওর সাথে দেখা করার জন্যে ও খুঁজে খুঁজে চলে এসেছে এখানে ।
"আচ্ছা , ঠিক আছে তো । সমস্যা নাই । প্লিজ , তুই এখন কান্নাকাটি করিস না । জয়িতা জানে , দিব্য মানুষটা অনেক বেশি শক্ত মনের । শুধু জয়িতার ব্যাপারেই ওর সব কিছু আলাদা । সব কিছু ।
পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক হওয়ার পর দিব্য জিজ্ঞাসা করে বাক্সের ভেতর কি আছে । জয়িতা হাসতে হাসতে বলে , ' একটা কলম । লিখার একটু পরেই কালি হাওয়ায় মিলায়ে যাবে । কোনদিন খুঁজে পাবি না ! হিহিহি ! ' দিব্য হাসতে হাসতে বলে , 'খুঁজে না পাইলে আবার লিখে দিবি ! '
হাসিতে ভাঙে বিষণ্ন সন্ধ্যার নীরবতা । স্নিগ্ধ উচ্ছ্বাসে বোঝার উপায় থাকে না , একটু আগেই এখানে চিত্রায়িত হয়েছে এমন এক দৃশ্য , যে দৃশ্যটা নায়ক নায়িকা কারোর জীবনের সাথেই মেলে না ।
ঘটনা মোটামুটি একই ভাবে চলতে থাকে ততদিন পর্যন্ত যতদিন না আমাদের গল্পের মাঝে কয়েকটা ছোট্ট ঘটনার মোড় দেখা না দেয় ।
চিরাচরিত নিয়মে প্রায় আধঘণ্টা দেরি করে আসার পরে , আইসক্রিম পার্লারের সামনে এসে একটা দৃশ্য দেখে দিব্যের কপালে ভাঁজ পড়ে । দিব্য স্পষ্ট দেখতে পায় বাইকের ওপরে বসে থাকা একটা ছেলে জয়িতার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে । জয়িতার চেহারা দেখে বোঝাই যাচ্ছে , জয়িতার কথা বলতে আড়ষ্টতা কাজ করছে । একটু জোরে পা ফেলে দিব্য এগিয়ে যায়।
ছেলেটার দিকে জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টি নিয়ে দিব্য জয়িতাকে জিজ্ঞাসা করে , 'কাহিনী কি ? ঝামেলা কোন ?'
"না । তেমন কিছু না ।"
দিব্য কিছু না বলে একটু দূরে সরে দাঁড়ায় । কথাগুলো আবছা আবছা কানে আসে ।
ছেলেটাঃ আপনি চাইলে আপনাকে বাসায় ড্রপ করে যেতে পারি । আমি ঐদিক দিয়েই যাবো ।
জয়িতাঃ না মানে ...
ছেলেটাঃ বাইকে তিনজন বসা যায় । আপনি না হয় মাঝের জনের জায়গা খালি রেখে পেছনের জনের জায়গাতেই বসবেন ... বিরাট এক রসিকতা করে ফেলেছে এভাবে হাহা করে হাসতে থাকে ছেলেটা ।
জয়িতা দিব্যের দিকে তাকানোর সাথে সাথে দেখতে পায় ওর চোখ মুখ শক্ত হয়ে আছে । যা বোঝার বুঝে নিয়ে ছেলেটাকে কিছু একটা বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিয়ে দিব্যকে নিয়ে পার্লারের ভেতরে একটা কোণায় গিয়ে বসে ।
দিব্যঃ শালা কি চায় ?
জয়িতাঃ কি আর চাবে ? সুন্দরী মেয়েকে বাইকের পেছনে নিয়ে ঘুরতে চায় ।
দিব্যঃ তুই যাইতি ?
জয়িতাঃ যাওয়াই তো যায় , না ? তুই তো আর আমারে বাইকের পিছনে উঠাবি না ।
দিব্যঃ আমার সাথে বাইকে ঘুরবি তুই ?
জয়িতাঃ যদি তোর বাইক হয় । ধার দেনা করা বাইকে জয়িতা ওঠে না । হুহ!
ঠাট্টা ছলে কথাটা বলার সময় জয়িতা চিন্তাও করেনি সেইদিন সন্ধ্যা বেলা কি ঘটতে যাচ্ছে । দিব্য যখন ওকে ফোন করে পার্লারের সামনে আসতে বললো , জয়িতা চিন্তা করার চেষ্টা করছিলো আসলে ঘটনাটা কি হতে পারে । কোন কূল কিনারা করতে না পেরে তাড়াহুড়া করে পার্লারে গেল । পার্লারের সামনে গিয়ে দেখে দিব্য বসে আছে গেটের বাইরে সিঁড়িতে ।
জয়িতাঃ কি ব্যাপার ? জনাবের জরুরি তলব ?
দিব্যঃ তোরে ঘুরতে নিয়ে যাবো ।
জয়িতাঃ রিকশা ডাকবো ?
দিব্যঃ না । বাইকে ।
জয়িতাঃ কার বাইকে ? আমি তো তোর ধার দে....
জয়িতা অবাক হয়ে দেখে ওর সামনে জা চকচকে একটা বাইক দাড়িয়ে আছে । জয়িতা যতটা অবাক হয়ে গেছিলো , তারচেয়ে বেশি মেজাজ খারাপ হয় ওর । দিব্যকে ঝাড়ি দেওয়া শুরু করে । ' তোরে কে বলছে টাকা খরচ করতে ? আমি ফাজলামি করে একটা কথা বললাম আর তুই কেন সিরিয়াসলি নিলি ...'
দিব্য বাইকে উঠে স্টার্ট দিয়ে জয়িতাকে উঠতে বলে । জয়িতা গজগজ করতে করতে বাইকে ওঠার পরে গিয়ার চেঞ্জ করার ঠিক আগ মুহুর্তে জয়িতাকে বলে , 'তুই আমি ছাড়া আর কারো বাইকে উঠবি না ।'
বাইকের ইগনিশনের আড়ালে চাপা পড়ে যায় জয়িতার অবাক বিস্ময় , দিব্যের ঘাড়ের উপর আঁকড়ে থাকা জয়িতার হাতের আঁকড়ে ধরার তীব্রতায় লীন হয়ে লাজুক উচ্ছ্বাস ।
এবং এই চরিত্র দুইটির সবচেয়ে আশ্চর্যের জায়গা হচ্ছে , জয়িতা আসলেই দাঁড়িয়ে থাকে ।
ঘড়ি ধরে আধা ঘণ্টার একটু কম সময় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ের জোড়া গুলো যখন খুলে আসতে চাইছে , ঠিক তখনই বাইক নিয়ে ফিল্মি স্টাইলে ছেলেটার আগমন , আপাতত আমাদের গল্পের নায়ক এই ছেলেটাই , দিব্য ।
জয়িতাঃ দিব্য ...
দিব্যঃ কথা পড়ে । আগে রিকশা ডাক ।
জয়িতাঃ রিকশা কেন ?
দিব্যঃ হাঁটতে পারবো না । রিকশা ডাক ।
জয়িতা জানে বাইকটা দিব্যের না । তাড়াহুড়া করার জন্যে কাজিনের বাইক নিয়ে টান দিয়ে চলে এসেছে । জয়িতা এটাও জানে , ও এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো , ও এখন হাঁটতে পারবে না শুধু এই কারণেই এখন দিব্য রিকশা ডাকতে বলছে । নাহলে সাইন্স ল্যাব থেকে নীলক্ষেত হেঁটেই যাওয়া যায় ।
আমাদের গল্পে দিব্য এবং জয়িতা অনেক বড় একটা জায়গা জুড়ে আছে । ওদের পরিচয় হয়েছিল কলেজ লাইফে । এখন ভার্সিটি লাইফের প্রায় শেষ দিকেও ওরা অনেক ভাল বন্ধু । বন্ধুত্বের (!) নমুনা উপরেই পাওয়া যায় ! জয়িতা , দিব্যের একমাত্র কাছের বন্ধু । আর দিব্য , জয়িতার বন্ধুদের মাঝে সবচেয়ে কাছের ।
দিব্য থাকে ঢাকায় ওর কাজিনের বাসায় । বাবার সাথে সম্পর্ক খারাপ হওয়ায় মা মারা যাওয়ার পর থেকে হোস্টেলে অথবা যাতায়াতের সুবিধার অজুহাতে কাজিনের বাসায় থেকেছে ও কলেজ লাইফ থেকেই । অন্যদিকে জয়িতা , কলেজের ভার্সিটির অনেক ছেলের দীর্ঘশ্বাসের কারণ হয়েছিল স্টুডেন্ট লাইফটাতে । বাবা নেই , মা ভার্সিটি লেকচারার । প্রতাপশালী উচ্চবিত্ত নানাভাইয়ের কারণে খুব একটা খারাপ অবস্থায় থাকতে হয় নি ওদেরকে । এই হচ্ছে মোটামুটি দিব্য আর জয়িতা ।
সেইদিন দুপুরের পর আজকে দুই দিন ধরে জয়িতার সাথে কথা হয়নি দিব্যের । বিকালে ওকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে এসে ও গিয়েছিল স্টুডেন্ট পড়াতে । রাতে এসে জয়িতাকে ফোন করে পায়নি । ভেবেছিলো হয়তো টায়ার্ড হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে । ফেসবুকেও অনলাইন পায়নি ওকে সেদিন রাতে । পরদিন সারাদিন খুব দৌড়াদৌড়িতে ছিল দিব্য । তারপরেও গুনে গুনে তিনবার ফোন করেছে জয়িতাকে । ধরেনি । দিব্যের কিছু সমস্যা আছে জয়িতা জানে । ও একবার চেয়ে যা পায়নি , ও সেটা দ্বিতীয়বার চাইবে না । দিব্য জানে , জয়িতা ওর তিনটা মিসড কল পেলে বুঝতে পারবে মন খারাপ হয়েছে ওর । ভীষণ মন খারাপ । সেইদিন সারাদিন জয়িতা ফোন দেয়নি ওকে । আজকে সন্ধ্যা বেলায় আটচল্লিশ ঘণ্টা হয়ে যাচ্ছে কথা হয়নি ওর জয়িতার সাথে । কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে দিব্যের । অসহায় , বিপর্যস্ত মুখ নিয়ে ছাদের এ মাথা থেকে ও মাথা পায়চারি করছে ও । একটু পরে ভীষণ মেজাজ খারাপ হওয়া শুরু হলো ওর । নিজের উপরে , জয়িতার উপরেও । মুখের ভেতরটা কেমন তেতো তেতো লাগছে ওর । তাকিয়ে দেখলো ওর কফির মগটার মাঝে একটা পোকা ভাসছে । মেজাজ খারাপের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেলো ওর । জয়িতার নিষেধে গত ছয় মাসে একটা সিগারেটও খায়নি দিব্য । আজকে কেন যেন হঠাত্ সিগারেটের নেশাটা জাকিয়ে বসেছে ওর । মন খারাপের সাথে সিগারেটের একটা মিল খুঁজে পায় ও । সিগারেট একটু একটু করে পোড়ে , ছাই হয় , তারপর হারিয়ে যায় । মন খারাপ আস্তে আস্তে একটা মানুষের ভেতরটাকে পুড়িয়ে ফেলে , তারপর একসময় মন খারাপের অনুভূতিটা হারিয়ে যায় । কিন্তু সিগারেট শেষ করার পর একটা জিনিস হয় না যেটা মন খারাপ থাকলে হয় । মন খারাপের অনুভূতিটা যখন চলে যায় তখন একটা ভয়ংকর শূন্যতা কাজ করে ।
'আউ !!' হাতে জ্বলতে থাকা সিগারেটটা পুড়ে শেষ হয়ে কখন ফিল্টার পর্যন্ত চলে এসেছে খেয়ালই করেনি ও । মেজাজ খারাপ করে আরেকটা সিগারেট ধরালো ও । ' শাআআলা !! ' মুখ থেকে থুতু ফেললো ও ছাদ থেকে ।
"তোরে না বলছি , যেখানে সেখানে থুতু ফেলবি না ?" কণ্ঠটা শোনার সাথে সাথে এতো চমকে উঠলো দিব্য যে হাত থেকে সিগারেটটা পড়ে গেলো রেলিং দিয়ে বাইরে । ঘুরে তাকিয়ে দেখে জয়িতা দাঁড়িয়ে আছে । দিব্য একবার চিন্তা করলো , ঘটনাটা কি ঘটছে । " আর সিগারেট খাইতে পারবি না এইটা জানার পরেও কেন সিগারেট কিনতে গেছিস ?" দিব্য এক মুহূর্ত চিন্তা করার পরেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করলো । ও জানে যে চোখ খোলার পরে দেখবে ওর সামনে কেউ নেই । পুরোটাই ওর কল্পনা । 'হুহ ! জয়িতা বাসার ছাদে চলে আসছে আমার !! সাধ তো কম না আমার !!! ' ভাবতে ভাবতেই চোখ খুলে তাকালো ও ।
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো খুব গোপনে । কেউ নেই ওর সামনে ।
অথচ দিব্য খুব খুব করে চাইছিলো ওর এই চিন্তাটা মিথ্যে হোক , ওর সামনে সত্যি সত্যিই জয়িতা দাঁড়িয়ে থাকুক ।
"অই ! ভ্যাবদার মত চোখ বন্ধ করে মুখ কান্না কান্না বানায়ে রাখছিস কেন ? " জয়িতার কণ্ঠ শুনতে পায় এবার পাশ থেকে । দিব্যের মাথায় এখন পুরাপুরি উল্টাপাল্টা সিক্সটি নাইন অবস্থা ! ও এখনো বোঝার চেষ্টা করছে জয়িতা আসলেই আছে নাকি নেই । মাথায় চাটি খেয়ে বুঝতে পারলো আসলেই জয়িতা ওর পাশে দাড়িয়েছে । ও চোখ বন্ধ করে ছিল দেখে টের পায়নি ।
জয়িতাঃ এই নে । ধর বক্সটা ।
দিব্যঃ কিসের বক্স ?
জয়িতাঃ আমার গিফট ।
দিব্যঃ মানে কি ? আমারে দিলি ?
জয়িতাঃ না । গিফটটা তুই এখন আমারে দিবি ।
দিব্যঃ তোর মাথা খারাপ ।
জয়িতাঃ না । তোর মেমরি খারাপ ।
দিব্যঃ ঠিক ঠাক মত কথা বল ।
জয়িতাঃ মিস্টার , আমার জন্মদিন আজকে । আমি জানি আপনি ভুলে গেছেন । তাই আমিই সাধাসাধি করে উইশ নিতে আসছি , সাথে গিফট নিতে আসছি ।
দিব্য জয়িতার দিকে তাকাতে পারে না , জয়িতার হাসিটা শুনতে অসহ্য লাগছিলো ওর । নিজের মাথার চুল নিজে টেনে ছিড়তে ইচ্ছা করছিলো ওর । চোখ ঘুরিয়ে প্রায় লাল হয়ে যাওয়া সূর্যের দিকে তাকায় দিব্য । সূর্যের লাল রং ওর চোখ রাঙায় , উড়ে যাওয়া মেঘ তরল হয়ে আশ্রয় খুঁজে নেয় চোখের পাতায় । জয়িতা অবাক হয়ে যায় দিব্যের এই প্রতিক্রিয়াতে । ধরে আসা গলায় দিব্য একমনে বলে যায় , " তুই ফোন ধরিস নাই , ফোন করিস নাই । আটচল্লিশ ঘণ্টা বাইশ মিনিট পর তোর সাথে কথা হইতেছে আমার । আমি একটা মিনিটের জন্যে পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারি নাই । আর তোর জন্মদিনটাও ভুলে গেছিলাম আমি ... হ্যাহ ! এই আমি বলি , তুই আমার একমাত্র কাছের বন্ধু ? আমি নয় খারাপ , ভুলে যাই । তুই কেন ফোন করলিনা একবার ? "
জয়িতা আক্ষরিক অর্থেই বোবা হয়ে যায় । ওর বলা হয় না , সেদিন রোদের মাঝে দাঁড়িয়ে থেকে জ্বর উঠে গিয়েছিল ওর । বলা হয় না , জন্মদিনে শুধু ওর সাথে দেখা করার জন্যে ও খুঁজে খুঁজে চলে এসেছে এখানে ।
"আচ্ছা , ঠিক আছে তো । সমস্যা নাই । প্লিজ , তুই এখন কান্নাকাটি করিস না । জয়িতা জানে , দিব্য মানুষটা অনেক বেশি শক্ত মনের । শুধু জয়িতার ব্যাপারেই ওর সব কিছু আলাদা । সব কিছু ।
পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক হওয়ার পর দিব্য জিজ্ঞাসা করে বাক্সের ভেতর কি আছে । জয়িতা হাসতে হাসতে বলে , ' একটা কলম । লিখার একটু পরেই কালি হাওয়ায় মিলায়ে যাবে । কোনদিন খুঁজে পাবি না ! হিহিহি ! ' দিব্য হাসতে হাসতে বলে , 'খুঁজে না পাইলে আবার লিখে দিবি ! '
হাসিতে ভাঙে বিষণ্ন সন্ধ্যার নীরবতা । স্নিগ্ধ উচ্ছ্বাসে বোঝার উপায় থাকে না , একটু আগেই এখানে চিত্রায়িত হয়েছে এমন এক দৃশ্য , যে দৃশ্যটা নায়ক নায়িকা কারোর জীবনের সাথেই মেলে না ।
ঘটনা মোটামুটি একই ভাবে চলতে থাকে ততদিন পর্যন্ত যতদিন না আমাদের গল্পের মাঝে কয়েকটা ছোট্ট ঘটনার মোড় দেখা না দেয় ।
চিরাচরিত নিয়মে প্রায় আধঘণ্টা দেরি করে আসার পরে , আইসক্রিম পার্লারের সামনে এসে একটা দৃশ্য দেখে দিব্যের কপালে ভাঁজ পড়ে । দিব্য স্পষ্ট দেখতে পায় বাইকের ওপরে বসে থাকা একটা ছেলে জয়িতার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে । জয়িতার চেহারা দেখে বোঝাই যাচ্ছে , জয়িতার কথা বলতে আড়ষ্টতা কাজ করছে । একটু জোরে পা ফেলে দিব্য এগিয়ে যায়।
ছেলেটার দিকে জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টি নিয়ে দিব্য জয়িতাকে জিজ্ঞাসা করে , 'কাহিনী কি ? ঝামেলা কোন ?'
"না । তেমন কিছু না ।"
দিব্য কিছু না বলে একটু দূরে সরে দাঁড়ায় । কথাগুলো আবছা আবছা কানে আসে ।
ছেলেটাঃ আপনি চাইলে আপনাকে বাসায় ড্রপ করে যেতে পারি । আমি ঐদিক দিয়েই যাবো ।
জয়িতাঃ না মানে ...
ছেলেটাঃ বাইকে তিনজন বসা যায় । আপনি না হয় মাঝের জনের জায়গা খালি রেখে পেছনের জনের জায়গাতেই বসবেন ... বিরাট এক রসিকতা করে ফেলেছে এভাবে হাহা করে হাসতে থাকে ছেলেটা ।
জয়িতা দিব্যের দিকে তাকানোর সাথে সাথে দেখতে পায় ওর চোখ মুখ শক্ত হয়ে আছে । যা বোঝার বুঝে নিয়ে ছেলেটাকে কিছু একটা বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিয়ে দিব্যকে নিয়ে পার্লারের ভেতরে একটা কোণায় গিয়ে বসে ।
দিব্যঃ শালা কি চায় ?
জয়িতাঃ কি আর চাবে ? সুন্দরী মেয়েকে বাইকের পেছনে নিয়ে ঘুরতে চায় ।
দিব্যঃ তুই যাইতি ?
জয়িতাঃ যাওয়াই তো যায় , না ? তুই তো আর আমারে বাইকের পিছনে উঠাবি না ।
দিব্যঃ আমার সাথে বাইকে ঘুরবি তুই ?
জয়িতাঃ যদি তোর বাইক হয় । ধার দেনা করা বাইকে জয়িতা ওঠে না । হুহ!
ঠাট্টা ছলে কথাটা বলার সময় জয়িতা চিন্তাও করেনি সেইদিন সন্ধ্যা বেলা কি ঘটতে যাচ্ছে । দিব্য যখন ওকে ফোন করে পার্লারের সামনে আসতে বললো , জয়িতা চিন্তা করার চেষ্টা করছিলো আসলে ঘটনাটা কি হতে পারে । কোন কূল কিনারা করতে না পেরে তাড়াহুড়া করে পার্লারে গেল । পার্লারের সামনে গিয়ে দেখে দিব্য বসে আছে গেটের বাইরে সিঁড়িতে ।
জয়িতাঃ কি ব্যাপার ? জনাবের জরুরি তলব ?
দিব্যঃ তোরে ঘুরতে নিয়ে যাবো ।
জয়িতাঃ রিকশা ডাকবো ?
দিব্যঃ না । বাইকে ।
জয়িতাঃ কার বাইকে ? আমি তো তোর ধার দে....
জয়িতা অবাক হয়ে দেখে ওর সামনে জা চকচকে একটা বাইক দাড়িয়ে আছে । জয়িতা যতটা অবাক হয়ে গেছিলো , তারচেয়ে বেশি মেজাজ খারাপ হয় ওর । দিব্যকে ঝাড়ি দেওয়া শুরু করে । ' তোরে কে বলছে টাকা খরচ করতে ? আমি ফাজলামি করে একটা কথা বললাম আর তুই কেন সিরিয়াসলি নিলি ...'
দিব্য বাইকে উঠে স্টার্ট দিয়ে জয়িতাকে উঠতে বলে । জয়িতা গজগজ করতে করতে বাইকে ওঠার পরে গিয়ার চেঞ্জ করার ঠিক আগ মুহুর্তে জয়িতাকে বলে , 'তুই আমি ছাড়া আর কারো বাইকে উঠবি না ।'
বাইকের ইগনিশনের আড়ালে চাপা পড়ে যায় জয়িতার অবাক বিস্ময় , দিব্যের ঘাড়ের উপর আঁকড়ে থাকা জয়িতার হাতের আঁকড়ে ধরার তীব্রতায় লীন হয়ে লাজুক উচ্ছ্বাস ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন