এলাটিং বেলাটিং সই লো/ কিসের খবর আইল/ রাজামশাই একটি বালিকা চাইল/ বালিকা দিয়ে কী হবে?/ বালিকা দিয়ে যুদ্ধ হবে…আশ্চর্য, বালিকারাও যুদ্ধে যায় নাকি? বালক বলে তা-ও না হয় মানা যেত, তা বলে বালিকা! তাদের জন্য তো পুতুল খেলা আর ঘরকন্না। যুদ্ধ করতে গেলে যা যা লাগে, সে সব কোথায় বালিকাদের মধ্যে? রণরক্ত সব পুরুষদের কাজ, পুরুষালি কাজ, তাতে ভাগ বসায় সাধ্য কী বালিকাদের? তবে যুদ্ধ করে ক্লান্ত শরীরে, পুরুষেরা, সৈনিকেরা যখন ঘরে ফেরে, তখন যদি সেখানে বালিকা থাকে, তা হলে সেই সব বেচারা পুরুষপুঙ্গবেরা একটু আরাম পায়।
স্রেফ মুখোমুখি বসিবার নয়, আরও ঘনিষ্ঠ, আরও তপ্ত এবং আরও হিংস্র আরাম- শরীর যখন শরীর চায়, সেই উষ্ণ আরাম। মুশকিল, যত বার এই ‘আরাম’ শব্দটা লিখছি, ততবারই কলম থেকে রক্তের সরু একটা রেখা বেরিয়ে আসছে, আর সেই যে বেরোচ্ছে, থামছে না, কোনও মতেই না, মাথার মধ্যে পরের পর পর সব চিন্তাভাবনা জট পাকিয়ে যাচ্ছে, এবং তার মধ্যেও রক্তের ছিটে লেগে এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড। সেই বেয়াড়া রক্তের রেখা, জানি, এখন এই খবরের কাগজে নেই, রবিবারের সকালে নেই, বেশ কয়েকটা মেগা সিরিয়ালে ঠাসা সন্ধ্যেবেলাতেও নেই, অথচ ইতিহাসের দিকে মুখটি করে একটু নজর রাখলেই ধরা পড়বে সেই রক্ত- আর কান পাতলে শোনা যাবে সমস্বরে, তবু চাপা একটি চিৎকার। চিৎকার, নাকি গোঙানি!
মানচিত্রে এশিয়া মহাদেশের যে বিশেষ জায়গাগুলি থেকে শূন্যে ছিটকে যাচ্ছে ওই চিৎকার, বা গোঙানি, সেই সব জায়গা আরাম-নিবাস হিসাবেই ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছে। আরাম নিবাস, বা ইতিহাস-খ্যাত পরিভাষায়, ‘কমফর্ট স্টেশন’।
যারা গোঙাচ্ছে, তারাও তো পোশাকি ভাষায় ‘কমফর্ট উইমেন। ফুর্তিমেয়ে। সৈন্যদের যে খিদে থাকে, শিরায় শিরায়, লুকনো, তবে প্রথম রিপু বলেই আদিম ও অনিবার্য, এই সব মেয়েরা সারা শরীর দিয়ে তাদের সেই ক্ষুধা মেটায়। কাজেই, তারাও তো সেনাবাহিনীর সেবিকা। সর্বক্ষণের সেবিকা। হোল টাইমার। অসহায় হোল টাইমার।
বালাই ষাট, কে বলে অসহায়? যত্ত সব নিন্দুকের কথা! এই সেবাধর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ওদের বেতন দেওয়া হয় না বুঝি? ওদের যেন আলাদা ঘর দেওয়া হয়নি। যেন বড় যত্নে, কড়া পাহারায়, নিরাপদে রাখা হয়নি ওদের! যেন খাবার-দাবার, পোশাক-পরিচ্ছদের কোনও অভাব আছে!
রাজামশাই তো এসবের ঢালাও প্রতিশ্রুতি দিয়েই ওদের এনেছেন, থুড়ি নিয়োগ করেছেন সেনাবাহিনীর কাজে। দেশের কাজে একটুও কষ্ট সইবে না এরা? ছেলেরা যে বড়বড় দেশ জয় করে, লুঠপাট করে, খুনজখম চালিয়ে দেশের সেবা করছে রাতদিন, তার বেলা?
বিনিময়ে যদি একটু আরাম-ই চায় তারা, সেটুকুও কি বরাতে মিলবে না?
এই আরাম শব্দটা ফের এসে গিয়েই ঝামেলা পাকাল, কারণ বেশ বুঝতে পারছি ওই বেয়াড়া রক্তের দাগ আর গোঙানি সর্বনাশ করে ছাড়বে এই লেখার। সর্বনাশই, কেননা তিনের দশকের গোড়ায় কোরিয়ার মানচিত্রের দিকে তাকালে তো সর্বনাশ ছাড়া আর কিছু চোখেই পড়ে না।
তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে জাপানি সেনা। দুর্বার গতিতে তারা ঝাঁপিয়েছে অধিকৃত অঞ্চলের দিকে মেয়েদের দিকে। ফল, ঠিক মড়ক না হলেও অগণিত ধর্ষণ। তার সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকায় কর্তৃপক্ষ প্রমাদ গুনলেন। অথচ, কে না জানে, কোথাও যুদ্ধ হলে তার অঙ্গ হিসাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে এমন ছোটোখাটো সব কাণ্ড হয়েই থাকে। সর্বত্র, সর্বকালে। তবে এ বার বাড়াবাড়িটা ঈষৎ বেশি হয়ে যাওয়ায় কর্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। তা হলে উপায়?
উপায়, কমফর্ট স্টেশন।
ধরা যাক, সেনাদের প্রথম রিপুর তাড়না মেটাতে আলাদা একটা জায়গাই তৈরি করা হল। সেখানে থাকবে রিপু নিবৃত্তির উপাদান। অর্থাৎ কিনা, মেয়ের দল। তা হলে বেশ রীতিসম্মত ভাবে গোটা ব্যাপারটাকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দেওয়া যাবে। যথেষ্ট ভদ্র বন্দোবস্ত, যৌনসেবা প্রদানের নির্দিষ্ট সময় আছে, যথাযোগ্য পারিশ্রমিক আছে, অতিথি সৈনিকদের মদ্যপান এবং হিংস্রতা বারণ, মেয়েদের নিয়মিত স্বাস্থ্যকর খাদ্য-পানীয় দেওয়া হবে, এমন আরও কত! তা হলে আর কষ্ট কীসের? আরামের সব রকম আয়োজনই যখন সম্পূর্ণ, তাকে কি আদৌ সর্বনাশ বলা যায়? বরং যুদ্ধজয় করে, ছটফটে ছেলেরা যাতে আরও বড় কোনও সর্বনাশ না বাধায়, সে জন্যই তো এত সব কাণ্ড। জনতার প্রতি সবিশেষ দায়বদ্ধতাবশতই তাই, আরাম-নিবাসের সূচনা হল।
যত দূর জানা যায়, ১৯৩১-এ জাপ সেনা মাঞ্চুরিয়া দখলের পরে প্রথম সেখানে এই জাতীয় কমফর্ট স্টেশন গড়া হয়। তারপর নানইয়েনে জাপানি সেনার বাড়াবাড়ির পর জাপান সরকার আর কোনও ঝুঁকি নিতে চাইল না। যেখানে যেখানে জাপানি সেনা, তার প্রতিটি অঞ্চলেই ছড়িয়ে দেওয়া হল কমফর্ট স্টেশন। সৈনিকদের পৌরুষকে তো আর অস্বীকার করা চলে না, তবে দেখতে হবে তার তাড়না যেন বিপথগামী হয়ে ঝামেলা না পাকায়। তাই বিশেষ ভাবে নির্মিত ঘেরাটোপে এসো পুরুষপ্রবরেরা, ফুর্তি করো, মৌজ করো, ফিরে যাও ফের রণক্ষেত্রে। ইহাই মোক্ষ, জীবনের সারাৎসার।
এ ভাবে বোর্নিও, ফিলিপাইনস, চিন, তাইওয়ান। এ ভাবে প্রশান্ত মহাসাগরের বেশ কয়েকটি দ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া। এ ভাবে মালয়, বর্মা (অধুনা মায়ানমার), সিঙ্গাপুর… জাপানি সৈন্য থাকলেই তাদের মনোরঞ্জনের জন্য গড়ে উঠল একের পর এক আরাম নিবাস।
আর এই আরামের উল্টো দিকে?
‘‘আমি ১৯২০-র ২৮ ডিসেম্বর উত্তর কোরিয়ার দক্ষিণ হ্যামগং প্রদেশের পুংসান গ্রামের ফাবাল-রিতে জন্মেছিলাম। তেরো বছর বয়সে জুন মাসে দুপুরের খাবার তৈরির জন্য আমি গ্রামের নলকূপ থেকে জল আনতে যাই। একজন জাপানি সেনা আমাকে তুলে নিয়ে যায়। বাবা-মা জানতেও পারেন না আমার কী হল। আমাকে একটি পুলিশ চৌকিতে নিয়ে যাওয়া হলে বেশ কয়েকজন পুলিশ আমাকে ধর্ষণ করে। আমি চিৎকার করলে আমার মুখে রুমাল গুঁজে দেয়। আমি কাঁদছিলাম বলে ওই চৌকির কর্তা আমার বাঁ চোখে আঘাত করে। ফলে আমি বাঁ চোখের দৃষ্টি হারাই।
দশ দিন পরে আমাকে হেইসান নগরের জাপানি সেনা ছাউনিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আরও ৪০০ জন কোরিয় তরুণী ছিল। আমাদের দৈনিক চল্লিশ জন পর্যন্ত সেনাকে যৌন ক্রীতদাসী হিসাবে সেবা দিতে হত। আমি প্রতিবাদ করলে আমাকে মারত।
এক জন মেয়ে জানতে চেয়েছিল, তাকে কেন এক এক দিনে চল্লিশ জন পর্যন্ত পুরুষকে সেবা দিতে হবে। এই অপরাধে জাপানি সৈনাধ্যক্ষ ইয়ামা মোতো তাকে অস্ত্র দিয়ে পেটানোর আদেশ দেয়। তার কাপড় খুলে পেরেক পোঁতা এক কাঠের উপরে হাত-পা বেঁধে গড়ানো হয় এবং শেষে তার মাথা কেটে নেওয়া হয়।”
ছোট্ট একটি পত্রিকা, নাম ‘খোঁজ এখন’, জানাচ্ছে চং ওক সুন নামে এক ফুর্তি-মেয়ের এই বৃত্তান্ত। আর ই ইয়ংইয়ো কী বলছেন?
‘‘পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে আমি দ্বিতীয় সন্তান, মেয়েদের মধ্যে সব চেয়ে বড়। বাবার ছিল জুয়ার নেশা, জমি-বাড়ি সব ওই সর্বনাশা জুয়াতেই গিয়েছিল। স্কুলে যাওয়ার সুযোগই পাইনি, সোলের রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করতাম, দু’মুঠো চাল কোনও মতে জোগাড় হলে সেটুকুই সম্বল। বছর চোদ্দো বয়েস হলে চাকরি জুটল এক কেক-বিস্কুট তৈরির কারখানায়।
‘‘বেশ মনে পড়ে, কারখানায় গিয়েছি, ভাই দৌড়তে দৌড়তে এল, বলল বাবা ডাকছে, এখুনি বাড়ি যেতে হবে। গিয়ে দেখি, জমকালো পোশাক-পরা, তাতে আবার সোনার কাজ, এক মহিলা বসে আছেন। বললেন, আমি যদি ওঁর সঙ্গে কাজ করতে যাই, তা হলে আমি তো ভালো থাকবই, পরিবারটাও বাঁচবে। কী জবাব দেব, বুঝতে পারছিলান না। মা দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে, আমার দিকে তাকাচ্ছেই না। বাবা চুপ, নির্বিকার।
‘‘চলে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। তখন আহিওন জেলায় সব গরিবদের বাড়ি তৈরির জমি বরাদ্দ করছিল সরকার। জমি তো মিলল, বাড়ি মানে, সামান্য একটা কাঠটাঠ দিয়ে কাঠামো মতো, সেটুকুও করার মতো কাঠ ছিল না বাড়িতে। জোগাড় করব, সে পয়সাও নেই। নতুন কাঠ কিনতেই হবে। এমন একটা অবস্থায় মহিলার ওই প্রস্তাব। বাবা মনে মনে ঠিকই করে ফেলেছিলেন, আমাকে স্রেফ জানানোর দরকার ছিল, আর আমিও পরিবারের মুখের দিকে চেয়ে না বলতে পারিনি।”
একটি মেয়ে ঘর হারাল, তার বিনিময়ে ঘর বানাল একটি পরিবার। কিন্তু ‘ঘর হারাল’টাই আবার কী রকম কথা? ঘর তো পেলও বটে।
ঘর না বিছানা? একটি ছোট্ট চৌখুপির মধ্যে একটি বিছানা। সেই ঘরে সারাক্ষণ ঝুলে থাকে রমণের ঘ্রাণ। বাড়িটা দোতলা, চারদিকে পাহারা। সেখানে বন্দি মেয়েরা দিনরাত যৌনসেবা প্রদানের ফাঁকে বাইরে খোলা হাওয়ায় গিয়ে শ্বাস নেওয়ারও ফুরসত পেত না। সেই হুকুমই ছিল না। কাঁটাতারের বাইরে গেলেই নিশ্চিত মৃত্যু। আর কাঁটাতারের মধ্যে?
‘‘সৈন্যরা যখনই আসত, আমাদের একটা করে টিকিট দিত। রোজ আমার ঘরে অন্তত দশটা থেকে কুড়িটা টিকিট জমা হত। কারও কারও ঘরে তিরিশ-চল্লিশটাও জমে যেত। সপ্তাহে এক দিন, আমরা সেই সব টিকিট তুলে দিতাম অফিসবাবুর হাতে। টিকিট গোনা হত, কিন্তু আমরা কোনও দিন কোনও টাকার মুখ দেখিনি। বলা হত, হাতে দিলে খরচা হয়ে যাবে, তাই আমাদের প্রাপ্য টাকা নাকি নিয়মিত আমাদের নামে ব্যাঙ্কে জমা হচ্ছে। জানতাম, সব মিথ্যে কথা।
স্রেফ মুখোমুখি বসিবার নয়, আরও ঘনিষ্ঠ, আরও তপ্ত এবং আরও হিংস্র আরাম- শরীর যখন শরীর চায়, সেই উষ্ণ আরাম। মুশকিল, যত বার এই ‘আরাম’ শব্দটা লিখছি, ততবারই কলম থেকে রক্তের সরু একটা রেখা বেরিয়ে আসছে, আর সেই যে বেরোচ্ছে, থামছে না, কোনও মতেই না, মাথার মধ্যে পরের পর পর সব চিন্তাভাবনা জট পাকিয়ে যাচ্ছে, এবং তার মধ্যেও রক্তের ছিটে লেগে এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড। সেই বেয়াড়া রক্তের রেখা, জানি, এখন এই খবরের কাগজে নেই, রবিবারের সকালে নেই, বেশ কয়েকটা মেগা সিরিয়ালে ঠাসা সন্ধ্যেবেলাতেও নেই, অথচ ইতিহাসের দিকে মুখটি করে একটু নজর রাখলেই ধরা পড়বে সেই রক্ত- আর কান পাতলে শোনা যাবে সমস্বরে, তবু চাপা একটি চিৎকার। চিৎকার, নাকি গোঙানি!
মানচিত্রে এশিয়া মহাদেশের যে বিশেষ জায়গাগুলি থেকে শূন্যে ছিটকে যাচ্ছে ওই চিৎকার, বা গোঙানি, সেই সব জায়গা আরাম-নিবাস হিসাবেই ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছে। আরাম নিবাস, বা ইতিহাস-খ্যাত পরিভাষায়, ‘কমফর্ট স্টেশন’।
যারা গোঙাচ্ছে, তারাও তো পোশাকি ভাষায় ‘কমফর্ট উইমেন। ফুর্তিমেয়ে। সৈন্যদের যে খিদে থাকে, শিরায় শিরায়, লুকনো, তবে প্রথম রিপু বলেই আদিম ও অনিবার্য, এই সব মেয়েরা সারা শরীর দিয়ে তাদের সেই ক্ষুধা মেটায়। কাজেই, তারাও তো সেনাবাহিনীর সেবিকা। সর্বক্ষণের সেবিকা। হোল টাইমার। অসহায় হোল টাইমার।
বালাই ষাট, কে বলে অসহায়? যত্ত সব নিন্দুকের কথা! এই সেবাধর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ওদের বেতন দেওয়া হয় না বুঝি? ওদের যেন আলাদা ঘর দেওয়া হয়নি। যেন বড় যত্নে, কড়া পাহারায়, নিরাপদে রাখা হয়নি ওদের! যেন খাবার-দাবার, পোশাক-পরিচ্ছদের কোনও অভাব আছে!
রাজামশাই তো এসবের ঢালাও প্রতিশ্রুতি দিয়েই ওদের এনেছেন, থুড়ি নিয়োগ করেছেন সেনাবাহিনীর কাজে। দেশের কাজে একটুও কষ্ট সইবে না এরা? ছেলেরা যে বড়বড় দেশ জয় করে, লুঠপাট করে, খুনজখম চালিয়ে দেশের সেবা করছে রাতদিন, তার বেলা?
বিনিময়ে যদি একটু আরাম-ই চায় তারা, সেটুকুও কি বরাতে মিলবে না?
এই আরাম শব্দটা ফের এসে গিয়েই ঝামেলা পাকাল, কারণ বেশ বুঝতে পারছি ওই বেয়াড়া রক্তের দাগ আর গোঙানি সর্বনাশ করে ছাড়বে এই লেখার। সর্বনাশই, কেননা তিনের দশকের গোড়ায় কোরিয়ার মানচিত্রের দিকে তাকালে তো সর্বনাশ ছাড়া আর কিছু চোখেই পড়ে না।
তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে জাপানি সেনা। দুর্বার গতিতে তারা ঝাঁপিয়েছে অধিকৃত অঞ্চলের দিকে মেয়েদের দিকে। ফল, ঠিক মড়ক না হলেও অগণিত ধর্ষণ। তার সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকায় কর্তৃপক্ষ প্রমাদ গুনলেন। অথচ, কে না জানে, কোথাও যুদ্ধ হলে তার অঙ্গ হিসাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে এমন ছোটোখাটো সব কাণ্ড হয়েই থাকে। সর্বত্র, সর্বকালে। তবে এ বার বাড়াবাড়িটা ঈষৎ বেশি হয়ে যাওয়ায় কর্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। তা হলে উপায়?
উপায়, কমফর্ট স্টেশন।
ধরা যাক, সেনাদের প্রথম রিপুর তাড়না মেটাতে আলাদা একটা জায়গাই তৈরি করা হল। সেখানে থাকবে রিপু নিবৃত্তির উপাদান। অর্থাৎ কিনা, মেয়ের দল। তা হলে বেশ রীতিসম্মত ভাবে গোটা ব্যাপারটাকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দেওয়া যাবে। যথেষ্ট ভদ্র বন্দোবস্ত, যৌনসেবা প্রদানের নির্দিষ্ট সময় আছে, যথাযোগ্য পারিশ্রমিক আছে, অতিথি সৈনিকদের মদ্যপান এবং হিংস্রতা বারণ, মেয়েদের নিয়মিত স্বাস্থ্যকর খাদ্য-পানীয় দেওয়া হবে, এমন আরও কত! তা হলে আর কষ্ট কীসের? আরামের সব রকম আয়োজনই যখন সম্পূর্ণ, তাকে কি আদৌ সর্বনাশ বলা যায়? বরং যুদ্ধজয় করে, ছটফটে ছেলেরা যাতে আরও বড় কোনও সর্বনাশ না বাধায়, সে জন্যই তো এত সব কাণ্ড। জনতার প্রতি সবিশেষ দায়বদ্ধতাবশতই তাই, আরাম-নিবাসের সূচনা হল।
যত দূর জানা যায়, ১৯৩১-এ জাপ সেনা মাঞ্চুরিয়া দখলের পরে প্রথম সেখানে এই জাতীয় কমফর্ট স্টেশন গড়া হয়। তারপর নানইয়েনে জাপানি সেনার বাড়াবাড়ির পর জাপান সরকার আর কোনও ঝুঁকি নিতে চাইল না। যেখানে যেখানে জাপানি সেনা, তার প্রতিটি অঞ্চলেই ছড়িয়ে দেওয়া হল কমফর্ট স্টেশন। সৈনিকদের পৌরুষকে তো আর অস্বীকার করা চলে না, তবে দেখতে হবে তার তাড়না যেন বিপথগামী হয়ে ঝামেলা না পাকায়। তাই বিশেষ ভাবে নির্মিত ঘেরাটোপে এসো পুরুষপ্রবরেরা, ফুর্তি করো, মৌজ করো, ফিরে যাও ফের রণক্ষেত্রে। ইহাই মোক্ষ, জীবনের সারাৎসার।
এ ভাবে বোর্নিও, ফিলিপাইনস, চিন, তাইওয়ান। এ ভাবে প্রশান্ত মহাসাগরের বেশ কয়েকটি দ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া। এ ভাবে মালয়, বর্মা (অধুনা মায়ানমার), সিঙ্গাপুর… জাপানি সৈন্য থাকলেই তাদের মনোরঞ্জনের জন্য গড়ে উঠল একের পর এক আরাম নিবাস।
আর এই আরামের উল্টো দিকে?
‘‘আমি ১৯২০-র ২৮ ডিসেম্বর উত্তর কোরিয়ার দক্ষিণ হ্যামগং প্রদেশের পুংসান গ্রামের ফাবাল-রিতে জন্মেছিলাম। তেরো বছর বয়সে জুন মাসে দুপুরের খাবার তৈরির জন্য আমি গ্রামের নলকূপ থেকে জল আনতে যাই। একজন জাপানি সেনা আমাকে তুলে নিয়ে যায়। বাবা-মা জানতেও পারেন না আমার কী হল। আমাকে একটি পুলিশ চৌকিতে নিয়ে যাওয়া হলে বেশ কয়েকজন পুলিশ আমাকে ধর্ষণ করে। আমি চিৎকার করলে আমার মুখে রুমাল গুঁজে দেয়। আমি কাঁদছিলাম বলে ওই চৌকির কর্তা আমার বাঁ চোখে আঘাত করে। ফলে আমি বাঁ চোখের দৃষ্টি হারাই।
দশ দিন পরে আমাকে হেইসান নগরের জাপানি সেনা ছাউনিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আরও ৪০০ জন কোরিয় তরুণী ছিল। আমাদের দৈনিক চল্লিশ জন পর্যন্ত সেনাকে যৌন ক্রীতদাসী হিসাবে সেবা দিতে হত। আমি প্রতিবাদ করলে আমাকে মারত।
এক জন মেয়ে জানতে চেয়েছিল, তাকে কেন এক এক দিনে চল্লিশ জন পর্যন্ত পুরুষকে সেবা দিতে হবে। এই অপরাধে জাপানি সৈনাধ্যক্ষ ইয়ামা মোতো তাকে অস্ত্র দিয়ে পেটানোর আদেশ দেয়। তার কাপড় খুলে পেরেক পোঁতা এক কাঠের উপরে হাত-পা বেঁধে গড়ানো হয় এবং শেষে তার মাথা কেটে নেওয়া হয়।”
ছোট্ট একটি পত্রিকা, নাম ‘খোঁজ এখন’, জানাচ্ছে চং ওক সুন নামে এক ফুর্তি-মেয়ের এই বৃত্তান্ত। আর ই ইয়ংইয়ো কী বলছেন?
‘‘পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে আমি দ্বিতীয় সন্তান, মেয়েদের মধ্যে সব চেয়ে বড়। বাবার ছিল জুয়ার নেশা, জমি-বাড়ি সব ওই সর্বনাশা জুয়াতেই গিয়েছিল। স্কুলে যাওয়ার সুযোগই পাইনি, সোলের রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করতাম, দু’মুঠো চাল কোনও মতে জোগাড় হলে সেটুকুই সম্বল। বছর চোদ্দো বয়েস হলে চাকরি জুটল এক কেক-বিস্কুট তৈরির কারখানায়।
‘‘বেশ মনে পড়ে, কারখানায় গিয়েছি, ভাই দৌড়তে দৌড়তে এল, বলল বাবা ডাকছে, এখুনি বাড়ি যেতে হবে। গিয়ে দেখি, জমকালো পোশাক-পরা, তাতে আবার সোনার কাজ, এক মহিলা বসে আছেন। বললেন, আমি যদি ওঁর সঙ্গে কাজ করতে যাই, তা হলে আমি তো ভালো থাকবই, পরিবারটাও বাঁচবে। কী জবাব দেব, বুঝতে পারছিলান না। মা দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে, আমার দিকে তাকাচ্ছেই না। বাবা চুপ, নির্বিকার।
‘‘চলে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। তখন আহিওন জেলায় সব গরিবদের বাড়ি তৈরির জমি বরাদ্দ করছিল সরকার। জমি তো মিলল, বাড়ি মানে, সামান্য একটা কাঠটাঠ দিয়ে কাঠামো মতো, সেটুকুও করার মতো কাঠ ছিল না বাড়িতে। জোগাড় করব, সে পয়সাও নেই। নতুন কাঠ কিনতেই হবে। এমন একটা অবস্থায় মহিলার ওই প্রস্তাব। বাবা মনে মনে ঠিকই করে ফেলেছিলেন, আমাকে স্রেফ জানানোর দরকার ছিল, আর আমিও পরিবারের মুখের দিকে চেয়ে না বলতে পারিনি।”
একটি মেয়ে ঘর হারাল, তার বিনিময়ে ঘর বানাল একটি পরিবার। কিন্তু ‘ঘর হারাল’টাই আবার কী রকম কথা? ঘর তো পেলও বটে।
ঘর না বিছানা? একটি ছোট্ট চৌখুপির মধ্যে একটি বিছানা। সেই ঘরে সারাক্ষণ ঝুলে থাকে রমণের ঘ্রাণ। বাড়িটা দোতলা, চারদিকে পাহারা। সেখানে বন্দি মেয়েরা দিনরাত যৌনসেবা প্রদানের ফাঁকে বাইরে খোলা হাওয়ায় গিয়ে শ্বাস নেওয়ারও ফুরসত পেত না। সেই হুকুমই ছিল না। কাঁটাতারের বাইরে গেলেই নিশ্চিত মৃত্যু। আর কাঁটাতারের মধ্যে?
‘‘সৈন্যরা যখনই আসত, আমাদের একটা করে টিকিট দিত। রোজ আমার ঘরে অন্তত দশটা থেকে কুড়িটা টিকিট জমা হত। কারও কারও ঘরে তিরিশ-চল্লিশটাও জমে যেত। সপ্তাহে এক দিন, আমরা সেই সব টিকিট তুলে দিতাম অফিসবাবুর হাতে। টিকিট গোনা হত, কিন্তু আমরা কোনও দিন কোনও টাকার মুখ দেখিনি। বলা হত, হাতে দিলে খরচা হয়ে যাবে, তাই আমাদের প্রাপ্য টাকা নাকি নিয়মিত আমাদের নামে ব্যাঙ্কে জমা হচ্ছে। জানতাম, সব মিথ্যে কথা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন