ভালোবাসার গল্প বনানীতে আমরা আছি প্রায় পাঁচ বছর। এই যান্ত্রিক নগরীর, যান্ত্রিক জীবনে প্রতিবেশী বলতে আমি শুধু বুঝি আমাদের পাশের বাসা। এছাড়া নিজেদের বা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা বিল্ডিং এর অনেকের চেহারা চিনলেও জানাশোনা নেই কার সাথে। আমার রুমটা এবং তাঁর একটি মাত্র জানালা ঐ বিল্ডিংটার দিকে। দু'বিল্ডিং এর মাঝখানে বিশ ফুট চওড়া রাস্তা ও রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছপালা ভেদ করে ২ বছর ধরেই মনে হয় মুখোমুখি বাসার কেউ আমার উপর নজর রাখছে। কিন্তু আমার ভাইয়ের মন্তব্য এই ডালপালার মধ্য দিয়ে দেখা অসম্ভব, তাছাড়া আমদের বাসা থেকেও ঐ বাসা দেখা যায় না। ভাইয়ার কথা আমি অন্ধভাবে বিশ্বাস করি। তবু মনের মধ্যে কোন কল্পিত দৃষ্টি জোড়া যেন রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটাতে থাকে। এখন আর আমি কাউকে বিদায় দেয়ার জন্য ছাড়া জানালায় দাঁড়াই না, সন্ধ্যা হলেই পর্দা টেনে দেই।

ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে সবে ভর্তি হয়েছি, রুটিন মাফিকই আমাদের প্রায় সকল ক্লাস হয়। ০২ ফেব্রুয়ারি আমার জন্মদিন ছিল। ক্লাস শেষে ফিরে দেখলাম একটা ছেলে কিছু লাল গোলাপ হাতে আমাদের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, সাথে একটি কাগজের ব্যাগ। ছেলেটির চেহারা আমার খুবই পরিচিত। আগে আমি যখন জানালায় দাঁড়িয়ে এই বন্দী কারাগারেও নিজেকে মুক্ত ভাবার চেষ্টা করতাম তখন প্রায়ই দেখতাম উনি গিটার কাঁধে উনাদের বিল্ডিং-এ ঢুকছেন বা বেড়চ্ছেন নয়তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে গল্প করছেন। দুরন্ত বিকেলে, নির্ঘুম রাতে ভেসে আসা গিটারের সাথে উনার সুমধুর কণ্ঠের গান আমাকে মুগ্ধ করত। উনার উজ্জ্বল মলিন চেহারা, কথা বলার বুদ্ধিদীপ্ত ভাবভঙ্গি, চপলতা আবার মেয়েদের দেখলে দৃষ্টি এড়ানোর ভঙ্গি কোন কিছুই বাদ পরেনি আমার চোখের আড়াল থেকে। ঘুমের মধ্যে আমার সপ্নেও তিনি এসেছেন অনেকবার কিন্তু পড়াশোনায় মনকে টিকিয়ে রাখার জন্য আমি আমার অনুভূতি গুলো ঢেকে রেখেছি। উনার নাম কি, কোন ফ্লাটেই বা থাকেন কোন দিন জানতে চেষ্টা করিনি।

জানালায় আগের মতো দাঁড়ানো হয় না বলে প্রায় ৬ মাস পড়ে উনাকে দেখলাম। মুখে হালকা দাঁড়ি হয়েছে, চুলগুলোও বড় হয়ে গেছে কিন্তু চেহারার বুদ্ধিদীপ্ত ভাব ঢাকা পড়েনি এবং সমস্ত মুখমন্ডল কিছু বলার চেষ্টা করছে। আমার আত্মা রামও তখন খাঁচা ছাড়া, তবুও পরিচিত মার্কা হাসি দিয়ে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে জিজ্ঞাসা করলাম, "কিছু বলবেন?" অনেক কষ্ট করে আওয়াজ বের করে বললেন, "শুভ জন্মদিন নুপূর।" বলে গিফট গুলো এগিয়ে দিলেন। আমি উনার গিফট নিতে চাই নি। কিন্তু এই প্রথম উনার রোদেলা চোখ দেখলাম মেঘে টইটুম্বুর এবং যেকোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। উনার চোখ থেকে বৃষ্টি পড়লে আমার মনে প্রলয় কান্ড ঘটে যাবে জানি, তাই গিফট নিতে হল। গিফট গুলো ধরিয়ে দিয়েই উনি দৌড় দিলেন, যাওয়ার সময় শুধু অভিমানী কণ্ঠে বললেন, "জানালায় দাঁড়াও না কেনো!" গিফটগুলো অনেক লুকিয়ে লুকিয়ে বাসায় আনতে হয়েছিল, গিফটগুলোর মধ্যে ছিল একগুচ্ছ গোলাপ ফুল, একটা নীল শাড়ী, নীল কাঁচের কিছু চুড়ি আর একটা চিঠি। হ্যা, এই চিঠিতেই আমার সকল কৌতূহল পুর্ণ হয়েছিল। এর মাধ্যমেই জানতে পেরেছিলাম উনি অর্ণব, ডি.ইউ, কম্পিউটার সাইন্স ডিপার্টমেন্ট, ২য় বর্ষ। আমি না বুঝলেও আমাকে দেখাবার জন্যই তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে গল্প করতেন, আমাকে শোনাতেই গান গাইতেন। এই চিঠিতেই জানতে পেরেছিলাম যে রাসায়নিক বিক্রিয়াকারক চোখ জোড়া উনার। ঐ চোখ জোড়ার জন্যই আজ আমি নীল শাড়ী, নীল কাঁচের চুড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছি। তবে হাতে কদম ফুল কারণ আজ যে উনি আমাকে এটাই দিয়েছেন। জানালায় দাঁড়িয়ে আমি উনাকে দেখটে পাচ্ছি না কিন্তু উনি নাকি আমাকে দেখতে পাচ্ছেন। আমি শুধু উনার কণ্ঠে শুনতে পাচ্ছি আমার খুব প্রিয় একটা গান,
"কেন যে মনে হয় বোঝনা আমাকে,
তোমারই কারণে ফিরিয়ে দিলাম পৃথিবীকে।
 
Top