গভীর রাত,চারিদিকে সুনসান নীরবতা। কানে হেডফোন সাটিয়ে উচ্চশব্দে গান শুনছে রোমন। সর্বোচ্চ লেভেলে গান বাজছে তবুও আর একটু বাড়ানোর ব্যার্থ চেষ্টা করলো। মানুষের চাহিদা একটা গণ্ডীর মধ্যে আটকে থাকলে সে স্বাধীনতা চাই, সীমা নির্ধারণ করে দিলে তা অতিক্রম করতে চাই।রোমন তাই করার চেষ্টা করলো,কিন্তু সম্ভব হলোনা।
হঠাৎ গুমোট ভাব লাগার কারন বুঝতে, গান বন্ধ করে ফ্যানের শব্দ শুনার চেষ্টা করে রোমন। না ফ্যান চলছে, শব্দ শুনার পর গুমোট ভাবটাও চলে গেছে খেয়াল করলো রোমন। তাহলে হঠাৎ করে এমন গরম লাগলো কেন?
হতে পারে ব্যাপারটা স্নায়ুবিক, কিন্তু শব্দ শোনার সাথে গুমোট ভাব চলে যাওয়া বা আবহাওয়া স্বাভাবিক হয়ে যাবার কারন বুঝতে পারছেনা রোমন।
আজকাল কি ইন্দ্রিয়গুলোও ফাকি দিচ্ছে ভাবতে থকে রোমন। নাহ, এটা নিয়ে ভাবা যাবেনা।কার্যকরণ না পেলে হয়তো আজ রাতটা অনিন্দ্রায় কেটে যাবে। কি লাভ ভেবে, কার্যকরণ নিয়ে চিন্তা করে।
পৃথিবীতে যার কৌতূহল যত কম, সে ততো বেশি সুখী। রাস্তার বদ্ধপাগলদের কৌতূহল মোটেও নেই বলেই তারা এতো সুখী,এতোটা নিশ্চন্ত।
চিত্র প্রদর্শনীতে কৌতূহলহীন কোন হকার,পথশিশু কিংবা কৃষককে সদা হাস্যজ্জল দেখায়। কিন্তু কোন বিজ্ঞানী বা চিন্তাবিদকে কখনো হাসি মুখে দেখা যায়না। ক্যারিকেচার এঁকে হাসি ফুটিয়ে তুলতে হয়।অধিক কৌতূহল মানুষকে অনুভূতিহীন করে দেয়।
কৌতূহল না থাকার কারনে কি তাহলে ওরা পাগল হয়ে যায়? রোমনও
কি তাহলে পাগল হয়ে যাবে, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে? এমন হাজারো প্রশ্ন এসে ভীড় করে রোমনের মাথায়।ভাবতে ভাবতে সিদ্ধান্ত নেয়, আজ সে ঘুমাবেনা।
এখন ভাবতে বসবে কার্যকরণ নিয়ে। তানিয়ার ব্যাপারটা কেন স্নায়ুবিক হয়না? হঠাৎ করে তানিয়ার উপস্থিতি টের পাবে, তার স্পর্শ অনুভব করবে, কিংবা সিনেমা, নাটকে হ্যালুসিনেট হয় অন্যের সাথে কথা বলে। বাস্তবে এমন হয়না কেন।বাস্তবে কিছু দেখলে কেন সেটাকে অদ্ভুত দেখায়, ভুতুরে মনে হয়। ভাবতে ভাবতে পরক্ষনেই ঘুমানোর সিধান্ত নেই। এইসব ভাবতে থাকলে সেও পাগল হয়ে যাবে।তার চেয়ে কৌতূহল দমিয়ে পাগল হওয়ায় ভালো।
২
সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চলেছে।সময় ১১টা। রোমন পার্শ্ববর্তী একাটা হোটেলে এসেছে। উদ্দেশ্য সকালের নাস্তা করা, অভিজাত শ্রেনীরদের ভাষায় যেটাকে লাঞ্চ বলা হয়। তবে সময়টা লাঞ্চ গ্রহণের নয়। সকাল আর দুপুরের মাঝামাঝি সময়ে যা খাওয়া হয় সেটাকে ব্রাঞ্চ বলা হয়।
রোমনের পাশের টেবিলে দুটো উটকো লোক বসে আছে।কেমন তাদের ভাবভঙ্গি। কথাবার্তার স্টাইল কেমন একটু আলাদা। কিছু একটা বলার পরেই দুজনে আট্টহাসি জুড়ে দিচ্ছে।
রোমন কোন প্রকার ভ্রুক্ষেপ না করেই খেতে থাকে। হোটেল বয়ের পাশের টেবিলে এগিয়ে আসা দেখে আবারও সেদিকে তাকাই রোমন।
হঠাৎ উটকো লোক দুটোর একজন ছেলেটার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো।
গ্লাস থেকে লোকটার গায়ে পানি ছিটকে পড়তে দেরি, কিন্তু থাপ্পড় বসাতে দেরি করেনি সে।
আবারও মারতে উদ্দত হলে ছেলেটিকে সরিয়ে নেয় রোমন। ছেলেটি ভয়ে রোমনকে জড়িয়ে ধরেছে। ভীতুরা সাহসীদের সঙ্গ খুব পছন্দ করে।এই মুহূর্তে ছেলেটি রোমনকে খুব সাহসী ভাবছে।একাকিত্বের সময় রাস্তার কুকুরকেও মাথার আকাশ মনে হয়। ছেলেটি রোমনকে তাই ভেবে থাকতে পারে। রোমনের সামর্থের কথা চিন্তা করার সময় পায়নি সে, তার প্রয়োজনের সময় এগিয়ে এসেছে সেটাই বড় কথা।
ফুঁসতে ফুঁসতে হোটেল থেকে বের হয়ে যায় লোকদুটো। তবে যাবার আগে রোমনকে তারা বেশ অবাক করে যায়।রোমন ভেবেছিলো তারা বিল পরিশোধ না করেই বের হবে। নিজের বিল পরিশোধের পর আবারও আবাক হয়ে যায় রোমন। যখন জানতে পারে, তারা ছেলেটির জন্য বিলের সাথে চারশ টাকা রেখে গেছে, ভাঙতি ফেরত নেয়নি। লোকগুলোর
সম্পর্কে রোমন যে খারাপ ধরনা করেছিলো এবার টা পুরোপুরি বদলে গেলো। তাদের নিয়ে আর কিছু ভাবতে পারলো না রোমন। ভাবলে পাগল হয়ে যাবে। সবকিছুই কেমন বদলে যাচ্ছে। বদলায়না শুধু তানিয়া সে আর ফিরে আসেনা।
৩
রোমন, এই রোমন!
চমকে গিয়ে পিছনে তাকায় রোমন। চমকানোর কারন আছে। রোমনের এই নামে কেউ তাকে ডাকে না। ছোট্ট একটা নাম আছে রোমনের, সবাই তাকে সেই নামে ডাকে। বিশেষ কয়েকজন ছাড়া সবাই তাকে রনি বলে ডাকে।
যে বিশেষ কয়েকজন তাকে রোমন বলে ডাকে তারা তাকে খুব ভালবাসে, ভালজানে। তবে খুব কম মানুষই তাকে এই নামে ডাকে।
মানুষ আলোচিত না হলে তাকে কেউ চিনেনা। রোমনকে না চেনার কারনও এটি। এমনকি মা ও তাকে চিনেনা পরিবারে আলোচিত হতে পারেনি বলেই। তাই হয়তো মা রনি বলে ডাকে। যার বিশ্বাসের দালানকোঠা ভেঙ্গে পড়েছে খড়ের ঘরের মত, যে শোকে সন্তপে,বেদনায় বিষাদে কুঁকড়ে থেকেছে, চরম লজ্জা আর লাঞ্ছনা যাকে আত্মহত্যা করার মত একটি ভয়ংকর পথে নিয়ে যেতে চেয়েছে সে কখনো পরিবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনা।তার পারিবারিক জীবন কখনো স্বাভাবিক হয়না।
নাম মানুষের ভালমন্দ বিচার করে না। তবে রোমন তার নাম নিয়ে করে, তার পাশের মানুষগুলো করে।
রোমনের বিশ্বাস সে যদি ইতিহাস গড়তে পারে তবে মীরজাফর কিংবা ঘসেটি বেগমের মতো তার নামটি অনেকে ঘৃণিতভাবে উচ্চারন করবে। তবে সে তার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানে একজন সাধারন মানুষ কখনো ইতিহাস গড়তে পারেনা। ইতিহাস গড়তে হলে সাধারন থেকে অসাধারন হতে হয়। রোমন তা হতে পারবে না। অসাধারণ হলে তাকে মানুষকে ঘৃণা করতে বাধ্য হতে হবে। কিন্তু মানুষকে ঘৃণা করতে পারেনা রোমন, তাই হয়তো তানিয়াকে নিয়ে আজও ভাবে ।
একাকিত্বের সময় যাদের সঙ্গ আশা করেছিলো রোমন, তাদের কাউকে পাশে পায়নি। কিন্তু আজও তাদের অপেক্ষায় আছে।
শেষ কবে রোমন নামে তাকে ডাকা হয়েছে আজ ভুলে গেছে। সম্ভবত তানিয়া শেষ এই নামে ডেকেছিল,কিন্তু সেও চলে গেছে। বদলানর কথা বলে যে এসেছিলো সেই চলে গেলো।
আজও মনে পড়ে সেই দিনের কথা, কলেজের প্রথম দিন অনুসন্ধিৎসু দুটি চোখ, খুঁজে চলেছে কাউকে, কিন্তু বারবার দৃষ্টি আছড়ে পড়ছে একজনের উপর,চেয়ে থাকতে চাইছে অনন্তকাল, অমর হওয়ার ইচ্ছা জাগিয়ে দিচ্ছে বারবার।
সে আজ নেই চলে গেছে অনেক দূরে। তানিয়া চলে গেছে। সে এসেছিলো পূব আকাশের সূর্যের মতো হয়ে কিন্তু হারিয়ে গেছে পশ্চিম আকাশে আর কখনো পূব আকাশে দেখা দেয়নি।
পেছনে দাড়িয়ে আছে কাফি।কিন্তু কাফির রোমন বলে ডাকার কারন খুঁজে পায়না সে, কিছুটা অবাক হয়। রোমন আবার ভাবতে থাকে, সবাই কি তাহলে ফিরে আসছে। তানিয়া তাহলে কি ফিরে আসবে।কিন্তু চলে যাবার যে কারন সে দেখিয়ে গেছে সে কারনগুলো আজও তার মাঝে বিদ্যামান। তানিয়া তো বদলে যাবার কথা বলেই এসেছিলো তবে তাকে কেন এভাবে ছেড়ে গেলো, এভাবেই কি তাহলে বদলাতে চেয়েছিলো!
কাফি খুব ধীরে হেঁটে এসে রোমনের ঘারে হাত রাখে। দূরে ঠেলে দেয়ার অভ্যাস অনিরামেয়। জীবনের বড় একটা সময় কেটে গেলো একাকিত্বে। পরিচিতদের ভিড় এড়িয়ে চলতে ইচ্ছা হয় এখন। তবে কাফিকে দেখে খুশি হয় রোমন। এখন সামান্য ভালবাসা পেতে ইচ্ছা করছে কারো থেকে।
ভীষণ অসহায়ত্বের সময় কেউ সামান্য সহানুভূতি দেখালে নিজেকে কুকুরের মতো মনে হয়, গা ঘেঁষে থাকতে ইচ্ছা করে।
রোমন চাই কেউ তাকে আগলে রাখুক এইসময়। তার আকাশ হয়ে থাকুক,বিদ্যুতের মতো হাতছিনি দিক, শঙ্খ শোনাক সেও তো তীর হারা ঢেউ এর সাগর পাড়ি দিতে চাই।
৪
বিকেলের মেঘ মুক্ত আকাশ যা কারনে সূর্যের তাপ প্রখর। পশ্চিমের আকাশে ঢলে পড়েও ঠিক যেন মাথার উপর থেকে তাপ বিকিরণ করছে হিংসুটে সূর্যটা।
প্রতিদিনের ন্যায় আজও একটা বটগাছের নিচে এসে বসে রোমন।
প্রকৃতির দানের এই বটগাছতাই শুধু তার অনুকূলে ভাবে রোমন। বসে
থেকে মানুষ দেখে, বিহঙ্গের নীড়ে ফেরা দেখে আকাশের রঙ বদলানো দেখে প্রতিদিন।
আজ হঠাৎ করে পশ্চিমের আকাশ আবীর মেখে লাল হয়ে উঠে। রোমন চমকে যায়। পরক্ষনে আবার পুরো আকাশ কালো হতে শুরু করে। রোমন জানে এসব তার কারনেই হচ্ছে। প্রকৃতির সবকিছুই এখন তার প্রতিকূলে। হিংসুটে আকাশটা রোমনের ভালোলাগা সহ্য করতে না পেরেই নিজেকে কুৎসিত ভাবে প্রকাশ করছে। আকাশটা এখন আগের মতো নেই,আগের মতো এখন নুয়ে এসে তার গা ছুয়ে দেয়না, বৃষ্টি দেয়না ধুয়ে।
সবাই শুধু চলে যায়, হারিয়ে যায় ফিরে আসে না।
আকাশের হঠাৎ করে রঙ বদলানো দেখে অজানা শঙ্খায় চমকিত হয় রোমন।
তানিয়ার আসাটাও ছিলো এমন, গোধুলির মতো যা নিমিষেই চমকে দিয়েছিল।কিন্তু আজকের মতো করেই রোমনের আকাশ কালো করে চলে যায় সে।
হঠাৎ মাথায় কয়েক ফোটা তরলের উপস্থিতি টের পায় রোমন। নিশ্চিত হয়ে বসে থাকে তার প্রতিকুলে থাকা পাখিগুলো প্রতিদিনের ন্যায় আজও সেই মহৎকর্ম করেছে ভেবে। আজ ভীষণ দেখতে ইচ্ছা করছে হিংসুটে পাখিগুলোকে দেখতে। ওপরের দিকে তাকায় রোমন। পাতার ফাক দিয়ে কয়েক ফোটা পানি এসে পড়ে রোমনের মুখে অবাক হয় রোমন। পড়ে সেটা ঝুম বৃষ্টির রুপ নিতে শুরু করে। পাখির বদলে আজ আকাশ তার দিকে চোখ দিয়েছে, বৃষ্টি এভাবে তাকে এসে ধুয়ে দিবে, ভাবেনি রোমন। অবাক হওয়াটা স্বাভাবিক সে অবাক হয় সে।
বর্ষার নবধারা জলে স্নান করতে পারলে ভালো হতো। মনের সব গ্লানি ধুয়ে যেত। কিন্তু তা সম্ভব না গ্লানির সাথে মিশে আছে তানিয়ার চলে যাওয়ার স্মৃতি, চাইলেই তা ধুয়ে ফেলা যাইনা।
নিরাপদ আশ্রয়ে দৌড়ে এসে দাড়ায় রোমন। দাড়িয়ে বৃষ্টি দেখে, লাল কৃষ্ণচুড়া দেখে, দেখে ভেজা শালিক, দুটো হাসের ডানা ঝাপটানো।
ধীর গতিতে চলে যাওয়া এক রিক্সা দেখে।কাকাভেজা সে রিক্সাচালকের দিকে দৃষ্টি রাখা যায়না। দৃষ্টি চলে যায় রিক্সায় বসে থাকা তানিয়ার দিকে। মুগ্ধ হয়ে তানিয়ার দুই হাত দিয়ে বৃষ্টি ধরা দেখে রোমন। চুড়ি বেয়ে পানি বেয়ে পড়ছে তানিয়ার। ভেজা শাড়িটি আঁকড়ে ধরেছে তানিয়াকে অন্য পাশ থেকে সযত্নে ধরে আছে একজন।
দৃষ্টি ক্রমাগত নিচের দিকে নামতে থাকে রোমনের।বৃষ্টি সিক্ত পিচঢালা পথ দেখতে থাকে রোমন। বড় আপন মনে হয় সেই পথ। সেই পথে পা বাড়ায়। পথ তাকে ডাকছে, বহু দিনের চেনা সে পথ।
রোমন হাঁটতে থাকে পথ ধরে। খুব ইচ্ছা করছে পিচধালা পথে গা এলিয়ে দিয়ে ভিজতে। ভীষণ ইচ্ছা করছে রাস্তায় মিশে যেতে,সব গ্লানি ধুয়ে ফেলতে।
হঠাৎ গুমোট ভাব লাগার কারন বুঝতে, গান বন্ধ করে ফ্যানের শব্দ শুনার চেষ্টা করে রোমন। না ফ্যান চলছে, শব্দ শুনার পর গুমোট ভাবটাও চলে গেছে খেয়াল করলো রোমন। তাহলে হঠাৎ করে এমন গরম লাগলো কেন?
হতে পারে ব্যাপারটা স্নায়ুবিক, কিন্তু শব্দ শোনার সাথে গুমোট ভাব চলে যাওয়া বা আবহাওয়া স্বাভাবিক হয়ে যাবার কারন বুঝতে পারছেনা রোমন।
আজকাল কি ইন্দ্রিয়গুলোও ফাকি দিচ্ছে ভাবতে থকে রোমন। নাহ, এটা নিয়ে ভাবা যাবেনা।কার্যকরণ না পেলে হয়তো আজ রাতটা অনিন্দ্রায় কেটে যাবে। কি লাভ ভেবে, কার্যকরণ নিয়ে চিন্তা করে।
পৃথিবীতে যার কৌতূহল যত কম, সে ততো বেশি সুখী। রাস্তার বদ্ধপাগলদের কৌতূহল মোটেও নেই বলেই তারা এতো সুখী,এতোটা নিশ্চন্ত।
চিত্র প্রদর্শনীতে কৌতূহলহীন কোন হকার,পথশিশু কিংবা কৃষককে সদা হাস্যজ্জল দেখায়। কিন্তু কোন বিজ্ঞানী বা চিন্তাবিদকে কখনো হাসি মুখে দেখা যায়না। ক্যারিকেচার এঁকে হাসি ফুটিয়ে তুলতে হয়।অধিক কৌতূহল মানুষকে অনুভূতিহীন করে দেয়।
কৌতূহল না থাকার কারনে কি তাহলে ওরা পাগল হয়ে যায়? রোমনও
কি তাহলে পাগল হয়ে যাবে, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে? এমন হাজারো প্রশ্ন এসে ভীড় করে রোমনের মাথায়।ভাবতে ভাবতে সিদ্ধান্ত নেয়, আজ সে ঘুমাবেনা।
এখন ভাবতে বসবে কার্যকরণ নিয়ে। তানিয়ার ব্যাপারটা কেন স্নায়ুবিক হয়না? হঠাৎ করে তানিয়ার উপস্থিতি টের পাবে, তার স্পর্শ অনুভব করবে, কিংবা সিনেমা, নাটকে হ্যালুসিনেট হয় অন্যের সাথে কথা বলে। বাস্তবে এমন হয়না কেন।বাস্তবে কিছু দেখলে কেন সেটাকে অদ্ভুত দেখায়, ভুতুরে মনে হয়। ভাবতে ভাবতে পরক্ষনেই ঘুমানোর সিধান্ত নেই। এইসব ভাবতে থাকলে সেও পাগল হয়ে যাবে।তার চেয়ে কৌতূহল দমিয়ে পাগল হওয়ায় ভালো।
২
সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চলেছে।সময় ১১টা। রোমন পার্শ্ববর্তী একাটা হোটেলে এসেছে। উদ্দেশ্য সকালের নাস্তা করা, অভিজাত শ্রেনীরদের ভাষায় যেটাকে লাঞ্চ বলা হয়। তবে সময়টা লাঞ্চ গ্রহণের নয়। সকাল আর দুপুরের মাঝামাঝি সময়ে যা খাওয়া হয় সেটাকে ব্রাঞ্চ বলা হয়।
রোমনের পাশের টেবিলে দুটো উটকো লোক বসে আছে।কেমন তাদের ভাবভঙ্গি। কথাবার্তার স্টাইল কেমন একটু আলাদা। কিছু একটা বলার পরেই দুজনে আট্টহাসি জুড়ে দিচ্ছে।
রোমন কোন প্রকার ভ্রুক্ষেপ না করেই খেতে থাকে। হোটেল বয়ের পাশের টেবিলে এগিয়ে আসা দেখে আবারও সেদিকে তাকাই রোমন।
হঠাৎ উটকো লোক দুটোর একজন ছেলেটার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো।
গ্লাস থেকে লোকটার গায়ে পানি ছিটকে পড়তে দেরি, কিন্তু থাপ্পড় বসাতে দেরি করেনি সে।
আবারও মারতে উদ্দত হলে ছেলেটিকে সরিয়ে নেয় রোমন। ছেলেটি ভয়ে রোমনকে জড়িয়ে ধরেছে। ভীতুরা সাহসীদের সঙ্গ খুব পছন্দ করে।এই মুহূর্তে ছেলেটি রোমনকে খুব সাহসী ভাবছে।একাকিত্বের সময় রাস্তার কুকুরকেও মাথার আকাশ মনে হয়। ছেলেটি রোমনকে তাই ভেবে থাকতে পারে। রোমনের সামর্থের কথা চিন্তা করার সময় পায়নি সে, তার প্রয়োজনের সময় এগিয়ে এসেছে সেটাই বড় কথা।
ফুঁসতে ফুঁসতে হোটেল থেকে বের হয়ে যায় লোকদুটো। তবে যাবার আগে রোমনকে তারা বেশ অবাক করে যায়।রোমন ভেবেছিলো তারা বিল পরিশোধ না করেই বের হবে। নিজের বিল পরিশোধের পর আবারও আবাক হয়ে যায় রোমন। যখন জানতে পারে, তারা ছেলেটির জন্য বিলের সাথে চারশ টাকা রেখে গেছে, ভাঙতি ফেরত নেয়নি। লোকগুলোর
সম্পর্কে রোমন যে খারাপ ধরনা করেছিলো এবার টা পুরোপুরি বদলে গেলো। তাদের নিয়ে আর কিছু ভাবতে পারলো না রোমন। ভাবলে পাগল হয়ে যাবে। সবকিছুই কেমন বদলে যাচ্ছে। বদলায়না শুধু তানিয়া সে আর ফিরে আসেনা।
৩
রোমন, এই রোমন!
চমকে গিয়ে পিছনে তাকায় রোমন। চমকানোর কারন আছে। রোমনের এই নামে কেউ তাকে ডাকে না। ছোট্ট একটা নাম আছে রোমনের, সবাই তাকে সেই নামে ডাকে। বিশেষ কয়েকজন ছাড়া সবাই তাকে রনি বলে ডাকে।
যে বিশেষ কয়েকজন তাকে রোমন বলে ডাকে তারা তাকে খুব ভালবাসে, ভালজানে। তবে খুব কম মানুষই তাকে এই নামে ডাকে।
মানুষ আলোচিত না হলে তাকে কেউ চিনেনা। রোমনকে না চেনার কারনও এটি। এমনকি মা ও তাকে চিনেনা পরিবারে আলোচিত হতে পারেনি বলেই। তাই হয়তো মা রনি বলে ডাকে। যার বিশ্বাসের দালানকোঠা ভেঙ্গে পড়েছে খড়ের ঘরের মত, যে শোকে সন্তপে,বেদনায় বিষাদে কুঁকড়ে থেকেছে, চরম লজ্জা আর লাঞ্ছনা যাকে আত্মহত্যা করার মত একটি ভয়ংকর পথে নিয়ে যেতে চেয়েছে সে কখনো পরিবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনা।তার পারিবারিক জীবন কখনো স্বাভাবিক হয়না।
নাম মানুষের ভালমন্দ বিচার করে না। তবে রোমন তার নাম নিয়ে করে, তার পাশের মানুষগুলো করে।
রোমনের বিশ্বাস সে যদি ইতিহাস গড়তে পারে তবে মীরজাফর কিংবা ঘসেটি বেগমের মতো তার নামটি অনেকে ঘৃণিতভাবে উচ্চারন করবে। তবে সে তার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানে একজন সাধারন মানুষ কখনো ইতিহাস গড়তে পারেনা। ইতিহাস গড়তে হলে সাধারন থেকে অসাধারন হতে হয়। রোমন তা হতে পারবে না। অসাধারণ হলে তাকে মানুষকে ঘৃণা করতে বাধ্য হতে হবে। কিন্তু মানুষকে ঘৃণা করতে পারেনা রোমন, তাই হয়তো তানিয়াকে নিয়ে আজও ভাবে ।
একাকিত্বের সময় যাদের সঙ্গ আশা করেছিলো রোমন, তাদের কাউকে পাশে পায়নি। কিন্তু আজও তাদের অপেক্ষায় আছে।
শেষ কবে রোমন নামে তাকে ডাকা হয়েছে আজ ভুলে গেছে। সম্ভবত তানিয়া শেষ এই নামে ডেকেছিল,কিন্তু সেও চলে গেছে। বদলানর কথা বলে যে এসেছিলো সেই চলে গেলো।
আজও মনে পড়ে সেই দিনের কথা, কলেজের প্রথম দিন অনুসন্ধিৎসু দুটি চোখ, খুঁজে চলেছে কাউকে, কিন্তু বারবার দৃষ্টি আছড়ে পড়ছে একজনের উপর,চেয়ে থাকতে চাইছে অনন্তকাল, অমর হওয়ার ইচ্ছা জাগিয়ে দিচ্ছে বারবার।
সে আজ নেই চলে গেছে অনেক দূরে। তানিয়া চলে গেছে। সে এসেছিলো পূব আকাশের সূর্যের মতো হয়ে কিন্তু হারিয়ে গেছে পশ্চিম আকাশে আর কখনো পূব আকাশে দেখা দেয়নি।
পেছনে দাড়িয়ে আছে কাফি।কিন্তু কাফির রোমন বলে ডাকার কারন খুঁজে পায়না সে, কিছুটা অবাক হয়। রোমন আবার ভাবতে থাকে, সবাই কি তাহলে ফিরে আসছে। তানিয়া তাহলে কি ফিরে আসবে।কিন্তু চলে যাবার যে কারন সে দেখিয়ে গেছে সে কারনগুলো আজও তার মাঝে বিদ্যামান। তানিয়া তো বদলে যাবার কথা বলেই এসেছিলো তবে তাকে কেন এভাবে ছেড়ে গেলো, এভাবেই কি তাহলে বদলাতে চেয়েছিলো!
কাফি খুব ধীরে হেঁটে এসে রোমনের ঘারে হাত রাখে। দূরে ঠেলে দেয়ার অভ্যাস অনিরামেয়। জীবনের বড় একটা সময় কেটে গেলো একাকিত্বে। পরিচিতদের ভিড় এড়িয়ে চলতে ইচ্ছা হয় এখন। তবে কাফিকে দেখে খুশি হয় রোমন। এখন সামান্য ভালবাসা পেতে ইচ্ছা করছে কারো থেকে।
ভীষণ অসহায়ত্বের সময় কেউ সামান্য সহানুভূতি দেখালে নিজেকে কুকুরের মতো মনে হয়, গা ঘেঁষে থাকতে ইচ্ছা করে।
রোমন চাই কেউ তাকে আগলে রাখুক এইসময়। তার আকাশ হয়ে থাকুক,বিদ্যুতের মতো হাতছিনি দিক, শঙ্খ শোনাক সেও তো তীর হারা ঢেউ এর সাগর পাড়ি দিতে চাই।
৪
বিকেলের মেঘ মুক্ত আকাশ যা কারনে সূর্যের তাপ প্রখর। পশ্চিমের আকাশে ঢলে পড়েও ঠিক যেন মাথার উপর থেকে তাপ বিকিরণ করছে হিংসুটে সূর্যটা।
প্রতিদিনের ন্যায় আজও একটা বটগাছের নিচে এসে বসে রোমন।
প্রকৃতির দানের এই বটগাছতাই শুধু তার অনুকূলে ভাবে রোমন। বসে
থেকে মানুষ দেখে, বিহঙ্গের নীড়ে ফেরা দেখে আকাশের রঙ বদলানো দেখে প্রতিদিন।
আজ হঠাৎ করে পশ্চিমের আকাশ আবীর মেখে লাল হয়ে উঠে। রোমন চমকে যায়। পরক্ষনে আবার পুরো আকাশ কালো হতে শুরু করে। রোমন জানে এসব তার কারনেই হচ্ছে। প্রকৃতির সবকিছুই এখন তার প্রতিকূলে। হিংসুটে আকাশটা রোমনের ভালোলাগা সহ্য করতে না পেরেই নিজেকে কুৎসিত ভাবে প্রকাশ করছে। আকাশটা এখন আগের মতো নেই,আগের মতো এখন নুয়ে এসে তার গা ছুয়ে দেয়না, বৃষ্টি দেয়না ধুয়ে।
সবাই শুধু চলে যায়, হারিয়ে যায় ফিরে আসে না।
আকাশের হঠাৎ করে রঙ বদলানো দেখে অজানা শঙ্খায় চমকিত হয় রোমন।
তানিয়ার আসাটাও ছিলো এমন, গোধুলির মতো যা নিমিষেই চমকে দিয়েছিল।কিন্তু আজকের মতো করেই রোমনের আকাশ কালো করে চলে যায় সে।
হঠাৎ মাথায় কয়েক ফোটা তরলের উপস্থিতি টের পায় রোমন। নিশ্চিত হয়ে বসে থাকে তার প্রতিকুলে থাকা পাখিগুলো প্রতিদিনের ন্যায় আজও সেই মহৎকর্ম করেছে ভেবে। আজ ভীষণ দেখতে ইচ্ছা করছে হিংসুটে পাখিগুলোকে দেখতে। ওপরের দিকে তাকায় রোমন। পাতার ফাক দিয়ে কয়েক ফোটা পানি এসে পড়ে রোমনের মুখে অবাক হয় রোমন। পড়ে সেটা ঝুম বৃষ্টির রুপ নিতে শুরু করে। পাখির বদলে আজ আকাশ তার দিকে চোখ দিয়েছে, বৃষ্টি এভাবে তাকে এসে ধুয়ে দিবে, ভাবেনি রোমন। অবাক হওয়াটা স্বাভাবিক সে অবাক হয় সে।
বর্ষার নবধারা জলে স্নান করতে পারলে ভালো হতো। মনের সব গ্লানি ধুয়ে যেত। কিন্তু তা সম্ভব না গ্লানির সাথে মিশে আছে তানিয়ার চলে যাওয়ার স্মৃতি, চাইলেই তা ধুয়ে ফেলা যাইনা।
নিরাপদ আশ্রয়ে দৌড়ে এসে দাড়ায় রোমন। দাড়িয়ে বৃষ্টি দেখে, লাল কৃষ্ণচুড়া দেখে, দেখে ভেজা শালিক, দুটো হাসের ডানা ঝাপটানো।
ধীর গতিতে চলে যাওয়া এক রিক্সা দেখে।কাকাভেজা সে রিক্সাচালকের দিকে দৃষ্টি রাখা যায়না। দৃষ্টি চলে যায় রিক্সায় বসে থাকা তানিয়ার দিকে। মুগ্ধ হয়ে তানিয়ার দুই হাত দিয়ে বৃষ্টি ধরা দেখে রোমন। চুড়ি বেয়ে পানি বেয়ে পড়ছে তানিয়ার। ভেজা শাড়িটি আঁকড়ে ধরেছে তানিয়াকে অন্য পাশ থেকে সযত্নে ধরে আছে একজন।
দৃষ্টি ক্রমাগত নিচের দিকে নামতে থাকে রোমনের।বৃষ্টি সিক্ত পিচঢালা পথ দেখতে থাকে রোমন। বড় আপন মনে হয় সেই পথ। সেই পথে পা বাড়ায়। পথ তাকে ডাকছে, বহু দিনের চেনা সে পথ।
রোমন হাঁটতে থাকে পথ ধরে। খুব ইচ্ছা করছে পিচধালা পথে গা এলিয়ে দিয়ে ভিজতে। ভীষণ ইচ্ছা করছে রাস্তায় মিশে যেতে,সব গ্লানি ধুয়ে ফেলতে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন