আচ্ছা একটা না দেখা ছেলের কথা শুনে তার জন্য কান্না আসে কেন! নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে ইসরাত। গত কয়েকদিন ধরে বেজায় মন খারাপ ওর। রাতের বেলা কষ্টটা আরো বেড়ে যায়। একটা ছেলের এত দু:খ থাকবে কেন।
valobasar inboxএমন অবস্থা যে লুকিয়ে কাঁদতে হয়। বাসার কেউ দেখলে জিজ্ঞেস করে বসবে, কান্নার কারণ কি। মা-টা সব বুঝে যায়। তাই কান্নার সময়ও সাবধানে থাকতে হয়। যাতে আশে পাশে কেউ না থাকে। এজন্য বাথরুমে ঢুকে অনেকটা সময় থাকে ইসরাত।
সেদিন মা জিজ্ঞেস করছিল, তোর কি কোন সমস্যা হচ্ছে?
: কই নাতো, কেন মা?
: বাথরুম থেকে সহজে বের হতে চাস নাই। কোন সমস্যা হলে বল।
: আরে নাহ, যে হারে গরম পড়ছে তাতে এথন বাথরুমটাকে এসি মনে হয়। আমাদের তো আর এসি নাই। তাই বাথরুম এসি ভাবে সেখানে থাকি।
মা হাসেন মেয়ের বলার ভঙ্গি দেখে।
: তোর কি এসির খুব শখ? তোর বাবা-কে বলবো ঘরে এসিতে লাগাতে?
: আরে নাহ মা, যে পরিমাণ বিদ্যুত বিল আসবে। আর তাছাড়া দিনের বেশিরভাগ সময়ই বিদ্যুত থাকে না। এসি লাগিয়েও লাভ নেই। বিদ্যুত না থাকলে তো আর এসি চলবে না। ঠিকই গরম পড়বে।
মায়ের সাথে সহজে মিথ্যা কথা বলে না ইসরাত। খারাপ লাগছে বিষয়টা লুকানোয়। কিছু বললেই মা অন্য কিছু ভাববেন। টেনশন করবেন। মোবাইলের কি টিপাটিপি করতে দেখলেই অনেক কথা জানতে চাইবেন। এখন তো ভাবেন মোবাইলে গেমস খেলা হয়।
রুদ্রের সাথে পরিচয় ফেসবুকেই। তার এক ফ্রেন্ডের লিস্টে ছিল। ওই ফ্রেন্ড লাইক দেয়ায় তার স্ট্যাটাস নিজ ওয়ালে এসেছিল। বেশ দু:খের কথা লেখা ছিল স্ট্যাটাসে। স্ট্যাটাসটা দেখে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছিল।
স্ট্যাটাসগুলো দেখে খারাপই লাগতো ইসরাতের। এত মন খারাপের স্ট্যাটাস দেয়। মেয়েরা নাহয় দিনের অনেকটা সময় ঘরে থাকতে হয়। তাদের দু:খ থাকবে। কিন্তু ছেলেরা তো অবাধে বাহিরে ঘোরাঘুরি করতে পারে। তাদের অনেক সীমাবদ্ধতা নেই। তারপরও এত দু:খ থাকবে কেন।
একদিন নক করে ইনবক্সে, আচ্ছা আপনি এত দু:খের স্ট্যাটাস দেন কেন?
ওই পাশ থেকে কিছুক্ষণ পরই উত্তর আসে, আমার জীবনটাই দু:খের সেজন্য।

: ওহ! কি বলবে ভেবে পায় না ইসরাত। হুট করে অপরিচিত একজনকে প্রশ্ন করা যায় না আপনার দু:খগুলো কি। তাই আর কিছু বলে না।
ওইপাশ থেকে টেক্সট আসে, আচ্ছা ধরেন, কোন ছেলে জানলো তার চোখের আলো কিছুদিনের মধ্যে নিভে যাবে। পুরা পৃথিবী তার জন্য অন্ধকার হয়ে আসছে। একসময় সে কিছু দেখবে না। অথচ সব কিছু ঠিকই স্বাভাবিক থাকবে। শুধু তার জন্যই সবকিছু আড়াল হয়ে যাবে। কেমন লাগবে?
: মানে কি? এসব বলছেন কেন?
: কারণ ওই ছেলেটি আমি। আমার চোখে সমস্যা। আমি রুম থেকে বের হই না। সারাদিনই বাসায় থাকি। বের হতে ইচ্ছা করে না। যে পৃথিবী কিছুদিন পর এম্নেতেই অন্ধ হয়ে যাবে এখন বের হয়ে কি লাভ। আগে থেকেই না হয় প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম।
: এসব কি বলছেন! এগুলো সত্য?
: হা সত্য। আমার ডান চোখ একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। যা দেখার এখন বাম চোখে দেখি। তবে তাও সংকীর্ণ। সেখানে সিলিকা জেল লাগানো।
ইসরাতের মন খারাপ হয়ে যায় এসব শুনে। বলে, দুশ্চিন্তা করবেন না। দেখবেন আপনার চোখ আবার ভাল হয়ে যাবে। আপনি আবার সব কিছু দেখবেন।

: মিথ্যা আশ্বাসগুলো শুনতে খারাপ লাগে না। ভালই। পৃথিবীটা বড়ই স্বার্থপর।
: হা তা সত্যিই। কিন্তু সবাই অবশ্যই স্বার্থপর না।
: হয়তবা। কিন্তু আমার জীবনের ঘটনা অন্যরকম। সেখানে স্বার্থের জয় জয়জয়কার। ভালোবাসার না।
: একটু বলবেন?
: আজ বলতে ইচ্ছা করছে না। অন্য একদিন বলবো।
: ঠিক আছে। আর আপনি যে এভাবে সারাদিন ফেসবুকে বসে থাকেন। চোখের ওপর প্রেসার পড়বে তো।
: কি আর প্রেসার পড়বে। নষ্টই তো হয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ পর্যন্ত কাজে লাগিয়ে নিই। কি হবে এম্নে রেখে দিয়ে।
: প্লিজ এভাবে বলবেন না। অবশ্যই ঠিক হবে। আপনি দেখিয়েন আবার ঠিক হবে। চোখের নিশ্চয় ভাল চিকিৎসা আছে।
এরপর দুই দিন কথা হয় না। তিনমাস পরেই এইচ এস সি পরীক্ষা ইসরাতের। যে কোচিংয়ে পড়ে সেখানে শুধু পরীক্ষা আর পরীক্ষা। দিনে দুইটা করে পরীক্ষা। তাই ফেসবুকে বসার সুযোগ হয় না। তার ওপর সুন্দর হওয়ায় আরেক বিপদ। কোচিংয়ের অন্য কলেজের ছেলে মেয়েরাও আছে। কয়েকজন তাকিয়ে থাকে। এটা ওইটা দেয়ার চেষ্টা করে। কয়েক ছেলে তো ফেসবুক আইডি খুঁজে বসে আছে।এই আইডি খোঁজার তালিকায় কোচিংয়ের এক শিক্ষকও আছেন, ফিজিক্স পড়ান। তবে তিনি খুঁজেছেন একটু অন্যভাবে। ক্লাস শেষে ডাকলেন।
“তোমার প্রস্তুতি কেমন চলছে?
: এইতো স্যার ভাল।
: হা ভালভাবে প্রস্তুতি নাও। বিশেষ করে ফিজিক্সটা গুরুত্ব দিবে বেশি।
: জ্বী স্যার দিচ্ছি।
: আচ্ছা তোমার ফেসবুক আইডি আছে না? আমাকে দিয়ো তো। পড়ালেখা বিষয়ে যেকোন সমস্যায় ফেসবুকে নক করলেই হবে। আমি হেল্প করবো। ফেসবুক ভাল একটা জিনিস। ধরো কোন সমস্যা হয়েছে। হুট করে ফেসবুকে জানিয়ে দিতে পারছো, তাই না?
: হা স্যার ঠিক বলছেন। তবে এখন তো ফেসবুকে সেভাবে ঢোকা হয় না। অনেকটা সময় ডিএকটিভ করে রাখি। আবার একটিভ করলে আপনাকে জানাবো।
সাধারণত রাতের বেলায় খাবারের পর মোবাইল নিয়ে বসে ইসরাত। মোবাইল বলতে ফেসবুকে ঢোকা। নিজের মোবাইল না, মায়ের। রাতের খাবার খেয়ে পড়তে ইচ্ছা করে না। তখন ফেসবুকে কিছুক্ষণ সময় কাটায়।
পরিচয়ের তৃতীয় দিন ফেসবুকে বসলে কয়েকটা আনরিড মেসেজের মধ্যে রুদ্রের মেসেজও পায় ইসরাত। একটা লাইন লেখা: হারায় গেলেন যে! সবাই এভাবে হারিয়ে যায়।
সে লিখে পাঠায়, হারাইনি। আসলে কোচিং পরীক্ষার চাপ ছিল তো, তাই ফেবুতে বসা হয়নি। আপনার চোখের খবর কি?
: যে জিনিসটা

খারাপ সেটার খবর না নেওয়াই ভাল। চোখের প্রসঙ্গ এখন থাক। ফ্রি আছেন?
: হা। আপনি আমার চেয়ে বয়সে বড় হবেন। আমাকে তুমি করে বলবেন।
: ঠিক আছে তুমি করে বলবো। সেদিন বলেছিলাম না স্বার্থপর। কারণটা বলি?
: জ্বী বলুন।
: একটা মেয়ে আমার অনেক ভাল বন্ধু ছিল। ও যখন মেডিকেল ফাস্ট ইয়ারে তখনই পরিচয় হয়। মেডিকেলে তো পড়ার অনেক চাপ। যখনই মন খারাপ হতো ফোন দিতো। কথা বলতাম। চেষ্টা করতাম ওকে রিলাক্স করতে। ওর জন্মদিনে হলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। সকালে বের হলে সে সারপ্রাইজড হতো। ওকে সারপ্রাইজড করার জন্য অনেক কিছু করতাম।
একসময় আমাদের বন্ধুত্ব আরো গভীর হতে থাকে। আমরা স্বপ্ন দেখতে থাকি সারাটি জীবন একসাথে কাটাবো। কিন্তু আমার সাথে স্বার্থপর খেলা করতে মজা পায়। আমার চোখের অবস্থা জেনে মেয়েটি আমার কাছ থেকে সরে যায়। তার ইন্টার্নি শেষ। শুনেছি এক ডাক্তারের সাথে বিয়ে করেছে। ভালই করেছে কানাকে বিয়ে না করে। ওর সাথে কাটানো অনেক সুন্দর স্মৃতি আছে। সেগুলো নিয়েই ভাল আছি। অন্ধ হয়ে যাচ্ছি এটা একদিকে ভালই। ও যে অন্য একটা লোকের সাথে ঘুরছে, হাতধরাধরি করে আছে এ অসহনীয় দৃশ্য আমাকে দেখতে হবে না। বেঁচে গেলাম তাই না? পৃথিবী আমাদের অদ্ভূত ভাবে বাঁচিয়ে দেয়।
: আপনি এভাবে বলবেন না তো। আমার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অন্য কিছু বলেন। মন খারাপের কথা বলবেন না। ভাল লাগে না।
: আমি আসলে মন খারাপের ডিপো। আমার সাথে কথা বললে তোমারও মন খারাপ হয়ে যাবে। আমি ফেসবুক আইডি থেকে বিদায় নেবো। আর আসবো না। আর কারো মন খারাপের কারণ হবো না। তখন ভাল হবে তাই না?
: ধ্যাৎ! আপনি ফেসবুক ছাড়বেন না।ফেসবুকেই থাকবেন। বুঝছেন? আপনি পালাতে পারবেন না।
: আচ্ছা আচ্ছা।
আরো অনেক কথা হয়।
ছেলেটার প্রতি অদ্ভূত মায়া জন্মে যায় ইসরাতের। রুদ্রের বয়সের ব্যবধান কম হবে না। তারপরও কেন জানি মনে হয় এ ছেলেটা যদি পাশে থাকতো! এ ছেলেটার মন যদি সারাজীবনের জন্য ভাল করে দেয়া যেত। ইসরাত সিদ্ধান্ত নেয় তার একটা চোখের কার্ণিয়া সে রুদ্রকে দিবে। লুকিয়ে দিতে হবে, যাতে বাসার কেউ না বুঝে। রুদ্রের পৃথিবীটা আবার আলোকিত হয়ে উঠবে। ও হাসবে। আর সে হাসি দেখে মন ভাল হয়ে যাবে।
কার্ণিয়া দেয়ার সিস্টেম কি! কথা বলে দেখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠলে নিশ্চয় বাসা থেকে আরো স্বাধীনতা দেয়া হবে। তখন এ বিষয়ে কথা বলা যাবে আই সেন্টারগুলোতে।

++++++++++++++++++++
এইচ এস সি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। ইসরাতদের কলেজ থেকে ছয়জন গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। ইসরাতও আছে সে লিস্টে, মা-বাবা ব্যাপক খুশী। তবে ইসরাতের মন ব্যাপক খারাপ। রেজাল্টের আনন্দ উপভোগ করতে পারছে না। সে জেনেছে রুদ্রের কথাগুলো মিথ্যা। বানিয়ে বানিয়ে নিজের সম্পর্কে এসব কথা বলেছে। অন্য আরো অনেকের কাছে সে এমনভাবে বলে। এটা ওর একটা নেশা।

আবেগ এভাবে প্রতারিত হয়েছে দেখে অনেক বেশি খারাপ লাগে। মিথ্যুক রুদ্রের জন্য কত চোখের পানি ফেলেছে। সে পানিগুলো তুলে নিবে কিভাবে! ইসরাতের মনে হয় দুনিয়াতে আবেগ জিনিসটা না থাকলেই ভাল হতো, তাহলে অন্তত কেউ আবেগ নিয়ে প্রতারণা করতে পারতো না।
 
Top