অনেকক্ষণ ধরে ল্যাপটপের কীবোর্ডে আঙ্গুল নাচাচ্ছে আনিকা। চোখ স্থির হয়ে আছে একটা নামের উপর, শোভন আহমেদ। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন তার নামের পা
"হৃদয়ে
শেরসবুজ বাতিটা জ্বলে উঠবে আর আনিকার কথার ট্রেন ভাঙা ভাঙা গতিতে শুরু হবে। 'ধুর!
গাধাটা আজকে আসবে না মনে হচ্ছে। কিন্তু গতকাল তো বলল আসবে। কোন সমস্যা হয়নি তো।' মাথার মধ্যে অযথাই হাজারটা চিন্তা ফ্যানের মত ঘুরপাক খাচ্ছে। লগ আউটের দিকে হাত যাচ্ছে তখনই, সবুজ বাত্তি!

- শোভন, ভন ভন।
- তোর মশকারি কবে কমবে!
- জন্মের সময় আম্মায় মশা দিয়ে বিশেষ কাড়ি রান্না করে খাওয়াইসিল। তাই কমে না। হেহেহেহে।
- আনিকা, কা কা। মেজাজ খারাপ করবি না।
- জানিস ছোট বেলা থেকেই আমার পাখি হওয়ার খুব ইচ্ছা। তুইই পারলি আমাকে পাখি বানাতে। হোক না সেটা কাউয়া।
আনিকাকে রাগানোর জন্য শোভন তাকে 'কা কা' বলে ডাকতো। কিন্তু রাগাতে পারতো না। সে এই ছেলেটার উপর রাগ করতেই পারে না। না না এটা ভালবাসা নয়, নয় কোন স্বর্গীয় অনুভূতি। শোভনের সাথে তার পরিচয় এই ফেসবুকেই। ভার্চুয়াল বন্ধুত্তের ভার্চুয়াল ভাললাগা, হয়তো? আনিকা স্বীকার করে না সে এই ছেলেকে ভালবাসে। কেনই বা বাসবে? ভালবাসা অন্ধ হতে পারে কিন্তু শোভনের প্রোফাইলের "ইন এ রিলেশনশিপ উথ ব্লা ব্লা" না দেখার মত অন্ধ না।

ভার্চুয়াল ছেঁকা খেয়ে আনিকা এখন নিজেকে পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবির নায়িকা ভাবে। সারাদিন বালিশের উপর লুকিয়ে কাঁদে। তবুও শোভনের সাথে বন্ধুত্তের অভিনয় করেই যাচ্ছে। প্রতিদিন চ্যাট করতেই হয়।
- আনিকা, মন ভাল নাই রে।
- কেন? আজ ডেটিং এ বিল বেশি দিয়েছিস নাকি?
- লল।
- এত লাত্থির উপর লাত্থি দিতে হবে না। মন কেন খারাপ?
- তোর সাথে কথা বললেই মন ভাল হয়ে যায়। তাই আর নাই বললাম মন কেন খারাপ।
- ভাবির আইডি দে তো।
- কেন?
- বলবো, তোমার জামাইর নাকি আমার সাথে কথা বললে মন ভাল হইয়া যায়। কার সাথে
প্রেম করো তুমি?
- যা বল গিয়ে। ও আমাকে অনেক ভালবাসে তোকে পাত্তাও দিবে না।
কথাটা আনিকার এতক্ষণের বন্ধুত্তের শুটিং-এ প্যাক আপ করে দিল। আর থাকতে পারলো না সে।
-শোভন, গেলাম।
- ওকে বায়।
আনিকার এই 'গেলাম' এর অর্থ শোভন বুঝতে পেরেছিল কিনা মেয়েটা কখনো জানার চেষ্টা করেনি। শোভনকে অনেক বারই বুঝাতে চেয়েছিল কিন্তু সে বুঝেনি। শোভনকে দেখলেই আনিকার হৃদয়টা শেয়ার বাজারের মত উঠা নামা করে, তার সাথে কথা বলতে আনিকা মডেম কোম্পানির মুনাফা কতটা বৃদ্ধি করছে সেটা জানে না শোভন। শোভনের একটা জিনিস আনিকা একদম পছন্দ করতো না আর তা হল শোভন তার সম্পর্ক নিয়ে 'তুমি-আমি আমি-তুমি' একটা ভাব করতো। তবুও ভালবাসা, ভাললাগা। কানে হেডফোন লাগিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায় আনিকা। আজ বিকেলটা তার বিষণ্ণতায় কাটবে।


টঙ এর দোকানে বসে একটার পর একটা সিগারেট খেয়েই যাচ্ছে নিলয়। কখন যে আসবে। একা বারান্দাটা দেখতে তার একদম ভাল লাগছে না। আজ কি তবে বিকেলের রোদ্দুর একাই খেলবে? এমন সময় আনিকা কানে হেডফোন লাগিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায়। প্রায় বিকেলে নিলয় আনিকার বাসার সামনের দোকান থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে আনিকার
খোলা চুলের সাথে বিকেলের রোদ্দুরের খেলা দেখে। আনিকা কখনো জানতেও পারেনি কারো বাঁকা চোখের চাহনিতে তার জন্য কত ভালবাসা লুকিয়ে আছে। নিলয়ও সাহস করে কখনো আনিকার সামনে এসে দাঁড়াতে পারেনি। আনিকা নিলয় একই ভার্সিটিতে পড়ে। আনিকার হাসিতেই সে কুপকাত হয়ে গিয়েছিল নিলয়। ভার্সিটির প্রথম দিন থেকেই। কিভাবে যেন তার মোবাইল নাম্বারটাও পেয়ে যায়। কল দেয় কিন্তু কথা বলতে পারে না। সেদিনও দিয়েছিল।

' যখনই নিবিড় করে পেতে চাই তোমাকে কে কে কে..........." গানের মাঝখানে মোবাইলটা বেজে উঠলো। 'উফ আবার এই নাম্বার!' প্রায় কে যেন কল করে কথা বলে না।" বিরক্ত হয়ে লাইনটা কেটে দিতেই আনিকার চোখ পরল নিচের দোকানটায়। 'কি ব্যাপার এই ছেলেকে তো চেনা চেনা লাগে। কোথায় যেন দেখেছি। আরে নিলয়! এই ছেলে এখানে কি করে। হয়তো কোন কাজে এসেছে' আর মাথা না ঘামিয়ে ঘরে ঢুকে গেল সে। আজ মন খারাপ করে আর ফেসবুকে যাওয়া হয়নি। ওখানে গেলেই শোভনের ভালবাসা দেখতে হয়যেখানে অন্য কারও নাম জড়িয়ে আছে, আনিকার ভাল লাগে না।

পরদিন বারান্দায় গিয়ে আবার নিলয়কে দেখলো সে। এভাবে একদিন, দুইদিন। একদিন ভার্সিটি গিয়ে নিলয়কে সামনে পেয়ে জিজ্ঞেসই করে বসলো,
-এই শোন।
- বল।
- তোমাকে প্রায়ই আমার বাসার ওখানে দেখি। কি করো ওখানে।
- কিছু না।
- কিছু না মানে! প্রতিদিন দাঁড়িয়ে বারান্দার দিকে তাকিয়ে থাকো আবার বল কিছু না।
- জায়গাটা কি তোমার?
- মানে!
- জায়গা যেহেতু তোমার না হলে সমস্যা হওয়ার কথা না।
- তুমি কি আমার সাথে তর্ক করতেস!
- তুমি যা ভাবো।
- ওকে ফাইন! বারান্দাটা আমার ওখানে তাকাবে না।
- চোখটা কি তোমার?
- আজবতো চোখ আমার হবে কেন?
- চোখ যেহেতু আমার তবে আমি যেদিকেই তাকাই না কেন আমার ব্যাপার।
রাগে গর গর করতে করতে সেখান থেকে চলে এল আনিকা। নিলয় দুষ্ট প্রকৃতির ছেলে, হঠাৎ আনিকা সামনে এসে এভাবে কথা বলায় সে অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। "নাহ একদম ঠিক হয়নি। মেয়েটাকে সরি বলতে হবে।" সেদিন এক বন্ধুর মাধ্যমে নিলয় সরি বলল। সরির সাথে কিভাবে যেন বন্ধুত্বটাও হয়ে গেল। ওদের ছোট খাটো একটা গ্রুপ হয়ে গেল।
- আনিকা, আমার নাম্বার নিবি না?
- হুম দে না।
নাম্বার নিয়ে কল দিতেই "বোবা" উঠলো।
- শয়তান! এটা তুই ছিলি!
- হুম হেহেহেহেহে।
- আচ্ছা তুই আমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতি কেন?
- তুই বুঝিস না?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আনিকা বলল-
- নিলয়, আমাকে এই জিনিসটা কখনো বুঝানোর চেষ্টা করিস না।
- বন্ধুত্ব তো বুঝানো যায়, না?
- হুম তা যায়।
আনিকা নিলয়কে শোভনের কথা বলে। নিলয় ব্যাপারটা বুঝে। আর বোঝার পর থেকে এটা নিয়ে প্রশ্ন না করলেও মজা করত আর তাকে খেপাত। পুরোই পাগল সে। আনিকার একেকটা বিধ্বস্ত দিন নিলয় কিভাবে যেন গুছিয়ে দিত। সাধারণত একটা মেয়ে একটা ছেলের জীবন গুছিয়ে দেয় কিন্তু আনিকার বেলায় উল্টো হয়েছে। নিলয় কখনো ভালবাসার দাবি নিয়ে আনিকার কাছে আসেনি। আনিকা জানতো যতদিন সে নিজে কিছু বলবে না নিলয় তাকে জোর করবে না। এমন একটা ভালবাসাই তো চেয়েছিল আনিকা এতদিন। তবে কেন এত হাহাকার।
নিলয় মুখে কিছু না বললেও ভিশন কষ্ট পেত।


আজকাল শোভনকে এড়িয়ে চলে আনিকা। আগের মত আবেগটা নেই তার। কেন নেই প্রায়ই জানার চেষ্টা করে সে। কিন্তু উত্তর খুঁজে পায় না। কিন্তু কষ্টটা আটকে আছে গলায়। সব ভুলে মন নিশ্চয়তা দেয়, 'ভাল আছি তো। ভালবাসার প্যাঁচে আর পেঁচাবো না।' হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠে। সাথে আনিকার একটা মিষ্টি হাসি।
- বারান্দায় আয় ট্যাংকি মারি।
- বখাটের মত লাগে তোকে।
- হুম আমি বখাটে আর ওই আহাম্মক রাজপুত্র।
- ধুর! আমার রাজ্যে আর কোন রাজপুত্র নেই।
- তুই কি আর কাউকে ভালবাসবি না?
- জানি না।
- জানবা কেমনে। কানে তো শোভন ভন ভন করে।
- নিলয়, আমি তোর ভালবাসার যোগ্য না।
- কথা সত্য। যারা আহাম্মকের ভালবাসার লাইগা কান্দে ওরা ওইটারই যোগ্য।
- আমি রাখি।
কথাটা একদম পছন্দ হয়নি আনিকার। নিলয়ের উপর রাগ করেই লাইন কেটে দিল।
'বদ ছেলে! এই ছেলে নাকি আমাকে ভালবাসে। ভালবাসলে কেউ এভাবে অপমান করে!শয়তান কোথাকার। উফ! ওর কথায় এত রেগে যাই কেন আমি শোভনের বেলায় তো এমনহত না।'
সেদিন নিলয়ের খুব অভিমান হয়েছে আনিকার উপর।

অনেকদিন কথা হয়নি আনিকা নিলয়ের। আনিকা ভিশন ভাবে মিস করতে থাকে নিলয়কে। কিন্তু তার খবর নেই। ভার্সিটি গিয়ে নিলয়কে খুঁজে পেল না সে। কয়েকদিন কথা হয়নি বিধায় অস্থির লাগছে আনিকার। আজ সরি বলতে হবে। নিজেকে নিজে বকা দিচ্ছে আনিকা। "ধুর! দোষ তো আমারই। ওইদিন ওভাবে লাইন কাটা উচিৎ হয়নি। কিন্তু এত রাগ যে কল তো ধরছেই না ভার্সিটিও আসলো না!'
- এই সুমন, নিলয় কোথায় রে?
- কেন তোর সাথে কথা হয়নি?
- আরে একটু ঝগড়া হইসিল। আমার সাথে রাগ করে কথা বলে না।
- বলস কি! সে যে জ্বরে আক্রান্ত তার মানে এটা তুই জানস না!
- না তো।
মনের অস্থিরতা আরো বেড়ে গেল আনিকার। আনিকা কাঁদছে। " না না। ও আমার বন্ধু। ওর জন্য কান্না আসতেই পারে। তাই বলে এটা ওটা না। আমি আর এসবে নেই।" এসব ভাবতে ভাবতেই গেটের দিকে যাচ্ছে আনিকা, নিলয়কে দেখতে যাবে সে।
কিছুক্ষণ পর দেখে নিলয় ওর দিকেই আসছে।
- কিরে ভার্সিটি এলি কেন। তুই না সিক? আমি তো তোকে দেখতেই আসছিলাম।
- বাসায় বসে থাকলে আরও খারাপ লাগতো।
- তাই বলে এভাবে বের হওয়া ঠিক হয়নি।
-আমি বের না হলে তরে জালাবে কে? এমনিতেই অনেকদিন হইসে জ্বালায় নি।
- এত রাগ কেন তোর যে ফোন ধরস না!
-ওমা ভালবাসবো আমি। আর রাগ করবা খালি তুমি! থাপ্পর চিনস!
- আচ্ছা ওইদিনের জন্য সরি।
- সরিতে কাজ হবে না।
- তো?
- ভালবাসতে হবে হেহেহেহেহে।
- হুম বাসি তো।
এই কথা শুনে নিলয় বোকা হাসিটা বন্ধ হয়ে গেল। আর মুখ দিয়ে কি বের হল বুঝতেই পারেনি আনিকা। যে কথা সে এতদিন শোভনকে বলতে পারেনি আজ তা নিলয়কে এত সহজে বলে দিল! এত দ্রুত বলল যেন এখন না বললে সে নিলয়কে আজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলবে।
- কি বললি?
- কানে শুনস নাই। শুনবি কি করে তুই তো বোবা।
- সত্যি তো। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
- বিশ্বাস না হলে ছেঁকা দিতে পারস।
- না রে আমার গায়ে এত তাপ নাই যে তোকে ছেঁকা দিব। অসুস্থ হয়ে তোর ভালবাসা পাব জানলে আরও দুই বছর আগেই অসুস্থ হইতাম।


আজ আনিকা-নিলয়ের বিয়ে। দুইজনই স্টেজে হেসে হেসে ছবি তুলছে। নিলয় কিছক্ষণ পর বিরক্ত হয়ে বলল,
-আর কত ছবি তুলবি?
-জামাইটা কি তোর?
- এটা কেমন কথা!
- জামাই যেহেতু তোর না তাহলে সমস্যা হওয়ার কথা না। হিহিহিহিহিহি।
- ওহ আমার লাইন আমাকেই শুনানো হচ্ছে, না?
- অনেক জালাইসস! নাও ইটস মাই টার্ন।

আনিকা তো এতদিন এই স্বপ্নটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। মেঘ প্রতিনিয়ত কেঁদে কেঁদে যে স্বপ্নকে ছুঁতে বলেছিল।

[ভালবাসা? সংজ্ঞাটা একেক জনের কাছে একেক রকম। কিন্তু ব্যাখ্যাটা সব সময় একই রকম থাকে। তুমি আছো বলেই স্বপ্ন এসে বাস্তবে ধরা দেয়। আমাদের সবার জীবনেই কেউ না কেউ আছে। অবশ্যই আছে, শুধু তাকে উপলব্ধি করার সুযোগটাকে কাজে লাগাতে হয়।কেউ পারে আর কেউ পথের দিকে তাকিয়ে ঢুলে পরে। ]
 
Top