।।এক।।
ক্লান্ত দুপুর। ভ্যাপসা গরমে সবাই অস্থির, তার উপর লোডশেডিংয়ের তাণ্ডবলীলা। সূর্য তার দেহের সমস্ত উত্তাপ যেন বিল্ডিংয়ের ছাদ ভেদ করে রুমের ভিতরেও ছড়িয়ে দিচ্ছে। ভার্সিটি থেকে ফিরে রনি রুমের
ভিতর সূর্যের তাপের সাথে যুদ্ধ করে ঠিকতে না পেরে বাসার বেল-কনিতে আসে একটু স্বস্তির আশায়। আজ যেন বাতাসগুলোও ধর্মঘট ডেকেছে। গাছের সবকটি পাতা নড়াচড়া বন্ধ করে স্থির হয়ে রয়েছে। “না এভাবে থাকা যায় না, এর চেয়ে গ্রামই ভাল বিদ্যুৎ না থাকলেও গাছের শীতল বাতাস পাওয়া যায়।” ভাবতে থাকে রনি।

রনি গ্রামের ছেলে। মাত্রই গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে। সে উঠেছে তার খালার বাসায়। সপ্তাহে পাঁচদিন ক্লাস আর দুইদিন ছুটি। যে দিনগুলোয় ক্লাস থাকে সেদিন ভার্সিটির নতুন বন্ধুদের সাথে কেটে যায় কিন্তু যেদিন ক্লাস থাকেনা সেই দিনগুলো যেন আর কাটতেই চায় না। নি:সঙ্গতা এসে জাপটে ধরে। মনের আয়নায় ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভেসে আসে। পুরনো বন্ধুদের খুব মিস করে রনি। যাদের সাথে অল্প মনোমালিন্য ছিল তাদেরকেউ যেন আজ অনেক আপন মনে হয়। এটাই হয়ত জগতের নিয়ম কাছে থাকলে গভীরতা বুঝা যায় না যা দুর থেকে অনুভব করা যায়।
ঢাকায় বাড়িগুলো যেমন হয়, একদম গায়ে গায়ে লাগানো এক ইন্চি জায়গাও কেউ প্রকৃতির জন্য ছাড় দিতে চায় না। ইট সিমেন্টের আস্তর দিয়ে মাটিকে ঢেকে দিতে চায়। বাসায় জানালা থাকে কিন্তু জানালা দিয়ে বাতাস প্রবেশ করতে পারেনা। ঢাকার জীবন যেন চারদেয়ালে বন্ধি। রনির খালার বাসাটিও ঠিক তেমনই।

।দুই।।
কারেন্ট চলে আসায় রনি বেল-কনি থেকে তার রুমে চলে আসে। ফ্যানের সুইচ অন করাই ছিল তাই ফ্যান ঘুরছিল মাথার উপর। ফ্যানের বাতাসে জানালার পর্দা দোল খাচ্ছিল, ঝড়ে লম্বা বাশগুলো যেভাবে দুল খায় ঠিক সেভাবে। পর্দাটি বারবার নিজের স্থান থেকে সরে আবার ফিরে আসছিল। নিঃসঙ্গতা কাটাতে রনি বই নিয়ে বসল। কিন্তু আজ বইয়ের মাঝেও তার মন ঠায় নিচ্ছে না। হঠাৎ সে লক্ষ্য করল সামনের বাসার জানালাটি খোলা ও পর্দাটি সরানো। ঐ জানালাটি সে কখনোই খোলা থাকতে দেখেনি, আজ কি কারনে জানালাটি খোলা এবং জানালার পর্দাটিও সরানো তা ভাবতে থাকে সে। কিছুক্ষন পর সে আবিষ্কার করে জানালার পাশেই একটি মেয়ে বসে আছে মেয়েটির হাতেও একটি বই। মেয়েটির দিকে সে অনেকক্ষন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। তার মনে হলো এটি কোন মেয়ে নয়, স্বর্গ থেকে কোন অপ্সরী এসে ঐ জানালায় বসে আছে। তার চোখ যেন পলক ফেলতেও ভুলে গেছে। রনির এই চাহনী মেয়েটি খেয়াল করে তাই সে জানালার পর্দা অল্প টেনে দেয়। তাতে রনি লজ্জা পেয়ে আবার বইয়ের দিকে মনোযোগ দিতে চেষ্ঠা করে। কিন্তু তার মন পরে রয়েছে ঐ মেয়েটির কাছেই।

রনি লক্ষ্য করছে জানালাটি এখন খোলাই থাকে আর জানালার পর্দাটি সরানোই থাকে এবং কিছুক্ষণ পর পর একটি মেয়ে সেখানে এসে বসে।এভাবে কিছুদিন চলার পর রনি নিজের মাঝে পরিবর্তন লক্ষ্য করল। পরিবর্তনগুলো হয়েছিল মেয়েটিকে দেখার পর থেকেই কিন্তু এতদিন তা তার মনে ধরা দেয়নি। সে যেন আনমনেই জানালার পাশে চলে আসে, অদ্ভুত এক টান অনুভব করে মেয়েটির প্রতি। মেয়েটিকে না দেখলে তার যেন কিছুই ভালো লাগেনা। রনি কখনো প্রেমে পড়েনি তাই প্রেমে পরার অনুভুতি সে জানেনা। কিন্তু এই মেয়েটিকে দেখার পর সে ভাবল এটাই হয়ত প্রেম। একদিন বুকে অনেক সাহস সঞ্চার করে সে মেয়েটিকে ইশারায় ডাক দেয় কিন্তু মেয়েটি কোন উত্তর না দেওয়ায় সে মনে মনে ভেঙে পরে। কিন্তু মেয়েটির প্রতি তার টান না কমে যেন প্রতিদিন বাড়তে থাকে। তারপর মেয়েটিও একদিন তাকে ইশারায় ডাকে এবং কথা বলে। রনি তার হাতে আকাশের চাঁদ পেলে যেমন আনন্দিত হতো এখন যেন তার চেয়েও বেশী আনন্দিত হয়।

।তিন।।
তারপর ইশারায় তাদের মাঝে কথা হতে থাকে। কিন্তু কেউ কারো নাম জানে না।একদিন মেয়েটি ইশারায় জানায় আজ বিকালে তারা দেখা করবে। প্রতিদিন বিকাল ৩ টায় সে কোচিং করতে যায়। কোচিংয়ে যাওয়ার পথে তারা দেখা করবে ঠিক করে।

রনির সময় যেন আর কাটছে না। বারবার ঘড়ি দেখছে, কখন তিনটা বাজবে। ঘড়ির প্রতিটি সেকেন্ড যেন এক একটি যুগের সমান। বুকে তার ঝড় তুলছে অস্থিরতা । আজই প্রথম কোন মেয়ের সাথে সে কথা বলবে, দেখা করবে হয়ত বলতে পারবে মনের অব্যক্ত সব কথা । যেদিনটির জন্য সে অনেকদিন যাবত অপেক্ষা করছিল। কখনো কোন মেয়ের প্রতি সে এতটুকু আকর্ষণ অনুভব করেনি যা এই মেয়েটির জন্য করছে। যদিও সে জানেনা মেয়েটির কি নাম, কিসে পড়ে তাও জানা হয়নি। তাই সে একটি নাম ঠিক করে নেয় মেয়েটির জন্য, ঐ নামেই তাকে ডাকবে।

ঘড়িতে যখন ২টা বেজে ৩৫, তখনই সে ঘর থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় অপেক্ষা করতে থাকে আর ঘড়ির সেকেন্ডের সাথে তর্ক জুড়ে দেয় আরো তাড়াতাড়ি সময়টুকু এগিয়ে নেয়ার জন্য। অবশেষে আসে কাংখিত সময়টুকু এবং ঠিক সময়েই তার কাংখিত মানুষটির মুখ দেখা যায় বাসার গেটে। তাদের বাসার গেটটি খোলার সাথে সাথে রনির মনের সব পর্দা যেন খুলে যায়। সে কিভাবে যেন মেয়েটির সামনে এলো তা তার কল্পনাতেও আসেনা। দুজনকেই মৌনতা গ্রাস করেছ কারো মুখে কথা নেই। মেয়েটিই নীরবতা ভাঙে বলে, "চলুন হাটি"। তারা হাটতে হাটতে কোচিং সেন্টারের গেট পর্যন্ত চলে আসে কিন্তু তেমন কোন কথা হয়নি তাদের মাঝে। জানা হয়নি কারো নাম। মেয়েটি রনিকে জানায় পাঁচটা তার ক্লাস শেষ তখন যেন সে তার মোবাইল নম্বরটি একটি কাগজে লিখে দেয়, তারপর ভিতরে চলে যায়।
রনির মনে খেলা করে এক অজানা অনুভূতি। জানালার মেয়েটির চেয়ে বাস্তবে যেন সে আরো সুন্দর। সে সত্যিই মেয়েটির প্রেমে পরে গেছে। তার পৃথিবী হঠাৎ করেই আলো ঝলমল করে উঠে। সে তার ঘরে ফিরে আসে এবং ডায়রি খুলে মনের মাধুরী মিশিয়ে কি লেখা যায় তার খসড়া করে তাতে মোবাইল নম্বরটি লিখে দেয়। তারপর খসড়াটি ভালো করে সুন্দর একটি কাগজে লিখে তা শার্টের বুক পকেটে রাখে । খসড়াটিকে রাখে প্যান্টের পকেটে।

।।৪।।
পাঁচটা বেজে সাত মিনিট, কিন্তু এখনো সে বের হচ্ছেনা। রনির হৃদপিণ্ড সজোরে আঘাত করছে বক্ষপিঞ্চরে, যেন সে বেড়িয়ে আসতে চায়। কিন্তু হৃদপিণ্ডকে বেড়িয়ে আসার সুযোগ না দিয়েই মেয়েটি বেরিয়ে আসে কোচিং সেন্টারের গেট মাড়িয়ে। রনির পাশে এসে বলে চলুন। তারা হাটতে থাকে পূর্বের রাস্তা ধরেই হাটার ফাকে মেয়েটির হাতে গুজে দেয় সেই চিঠিটি। তাদের পথ যেন হঠাৎ করেই ফুরিয়ে যায়, চোখের নিমিষেই যেন পথটুকু শেষ হয়ে যায়। আবার দেখা হবে বলে মেয়েটি তাদের বাসায় চলে যায়। যাওয়ার বেলায় সে রনিকে যাওয়ার দিয়ে যায় আলতো ছোঁয়া। যা রনিকে দেয় এক অদ্ভুত শিহরন।

বাসায় এসে শার্টের পকেটে হাত দিয়েই বুঝে ভুল হয়েছে। আসল চিঠি না দিয়ে খসড়া চিঠিটি দিয়ে দিয়েছে সে তার প্রাণের মানুষটিকে। কিন্তু তাতে সে একটুও বিমর্ষ হয়না কারন সে জানে মেয়েটিও যদি তাকে ভালোবাসে তাহলে সে শিন্চয় তাকে ফোন দিবে।

তারপর প্রতিদিন রনি তার মোবাইলে সব সময় যথেষ্ট পরিমানের ব্যালান্স রেখে চলে যেন মেয়েটির মোবাইল নম্বর পেলে কথা বলার সময় লাইন না কেটে যায়। কিন্তু আসেনা প্রিয় মানুষের কাংখিত সেই কলটি। মেয়েটিকেও আর দেখা যায়নি জানালার ধারে। জানালা এখন আগের মতোই আটকানো থাকে। কি কারনে মেয়েটি কাছে আসতে চেয়েও হারিয়ে গেল তা বলে যায়নি কেউ। ইট পাথরের তৈরী বিল্ডিংয়ের জানালার পর্দা আটকানোর সাথে সাথে ভালবাসায় নির্মিত মনের জানালায় পর্দা আটকানো হলো কিনা তা আর জানা হয়না রনির। তবুও সে অপেক্ষায় থাকে পর্দা সরার, জানালার পর্দা না সরলেও মনের পর্দাটি সরে যাক এই প্রত্যাশায় দিন কাটায় জানালায় পাওয়া প্রথম প্রেম হারানোর ব্যাথায় বিবর্ণ রনি। মুঠোফোনের অপেক্ষাটুকু অন্তত ফুরাক এই তার কামনা।
 
Top