আজমল সাহেব বারান্দায় বসে আছেন।তার মনটা খুব খারাপ।যদিও সেটা তিনি কারও সামনে প্রকাশ
করছেন না।মন খারাপের কারণটা মধ্যবিত্ত
পরিবারের সাধারণ চিত্রের মতই সাধারণ।
তার ছেলেটা অনেকদিন ধরেই একটা কম্পিউটার
কিনে চাইছে।এই টানাটানির সংসারে হঠাৎ
একটা কম্পিউটারের টাকা তিনি কোথা থেকে যোগাড় করবেন ভেবে পান না।বোকা ছেলেটা তা বুঝছে না। তার বন্ধুদের সবার কম্পিউটার আছে,তারও একটা থাকা চাই।এটা তার মান সম্মানের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।তাই আজ সে জেদ ধরেছে,কম্পিউটার কিনে না দিলে নাকি একটা দানা পানিও মুখে দেবে না।
আজমল সাহেব খুব রাগারাগি করেছেন তার সাথে।এখন নিজেরই খারাপ লাগছে।মধ্যবিত্ত পরিবার
হিসেবে হয়্ত একটু বেশিই চেয়ে ফেলেছে ছেলেটা।
কিন্তু খুব একটা অন্যায় আবদার তো করে নি।আজকাল কার বাসায় কম্পিউটার নেই!
জলিল সাহেবের নাতি পড়ে সবে ক্লাস টুতে।তারও
একটা নিজস্ব কম্পিউটার আছে।সে জায়্গায় তার
ছেলে রবিন তো পড়ে ক্লাস সেভেনে।কম্পিউটার
সে চাইতেই পারে।
মাঝে মাঝে রবিন গিয়ে জলিল সাহেবের নাতির কম্পিউটারে গেম খেলে।এ নিয়ে জলিল সাহেব সেদিন বেশ টিটকারী করেছেন।
আজমল সাহেবই বা কি করবেন!
সরকারী চাকুরীজীবী তিনি।বেতন খুব একটা বেশি নয়। মাস শেষে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে।কোন মাসে একটু বেশি খরচ হলেই ধার করে চলতে হয়।
চাইলেই অবশ্য একটু এদিক ওদিক করে বাড়তি টাকা আয় করতে পারেন।অনেকেই করে তার চোখের সামনে।কিন্তু তিনি করেন না।নিজের কাছেই একটা শপথ করেছেন তিনি সারাজীবন সৎপথে থাকার।এই শপথ তিনি ভাঙবেন না।
মেয়েটারও বিয়ে দিতে পারছেন না টাকার অভাবে।
মেয়েটা তার হয়েছে যথেষ্ঠ রূপবতী।নামটাও
সুন্দর,রূপা।মেয়ের মা রেখেছে এই নাম।কিন্তু
রূপবতী,গুণবতী হওয়া সত্ত্বেও ছেলেপক্ষের টাকার
চাহিদা কমছে না।অত টাকা তো আজমল সাহেবের কাছে নেই।মেয়েটার বয়সও বাড়ছে।মাঝে মধ্যেই মন খারাপ করে থাকে,কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয় না।
এদিকে আবার অসুস্থ মা।তার অষুধপত্রের যোগান
দিতেই সংসার খরচের অনেকটা টাকা চলে যায়।
কোনদিকে যাবেন তিনি!
মাঝে মাঝে সবকিছু ছেড়েছুড়ে দূরে কোথাও
চলে যেতে ইচ্ছে করে তার।কিন্তু এখনও
যে তিনি ভেঙে পড়েন নি তার একমাত্র কারণ তার
স্ত্রী। কি যত্নে আর মায়ায়
পুরো সংসারটাকে আগলে রেখেছে। বিয়ের পর
থেকে বেচারিকে মনে হয় একটা দামী শাড়িও কিনে দেয়া হয় নি।তবুও তার কোন অভিযোগ নেই।একটা মানুষ এত ভালো হয় কি করে তিনি ভেবে পান না।
অবশেষে রবিন হার মেনেছে।খুব ক্ষিদে পেয়েছে তার।
এরকম অবস্থায় রাগ করে থেকে লাভ নেই।তার
চেয়ে খেয়ে নেয়াই ভালো।কম্পিউটারের
ব্যাপারে আরেকদিন আলাপ করা যাবে।
দাদির শরীরটা ভালো যাচ্ছে না কদিন ধরে।রবিন
রোজ গিয়ে কিছুটা সময় তার দাদির পাশে বসে থাকে।দাদি তাকে খুব আদর করে।রূপার চেয়েও
বেশি তাকে আদর করে।রবিনের খুব খারাপ
লাগে দাদির জন্য।
বড় হয়ে সে অনেক টাকা উপার্জন করবে।আর তার
দাদিকে বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে সারিয়ে তুলবে।আচ্ছা,ততদিন পর্যন্ত দাদি থাকবে তো?
কেন থাকবে না,একশোবার থাকবে।দাদি আবার কোথায় যাবে।
রূপার মনটা আজ ভীষণ খারাপ।এ অবশ্য নতুন কিছু না। প্রায়ই তার মন খারাপ থাকে।তার
বিয়ে হচ্ছে না,একারণে নয়।বাসায় এত সমস্যা,অথচ
সে কোনরকম সাহায্য করতে পারছে না উল্টো বাবা-মার বাড়তি টেনশনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একারণেই তার মন খারাপ।
কাল আবার এক ছেলেপক্ষ তাকে দেখতে আসবে।
উত্তরটা আবারও নিশ্চয়ই বাবা-মাকে নিরাশ করবে।
বারবার এ মানুষদুটির হতাশ মুখ দেখতে তার আর
ভালো লাগে না।
পরদিন সকাল সকাল উঠেই আজমল সাহেব
বেরিয়ে পড়লেন।শুক্রবার,তবুও
ঘরে বসে থাকলে চলবে না।আজ রূপাকে দেখতে আসবে।অনেক খরচাপাতির ব্যাপার আছে।মাসের শেষ।হাতটাও এসময় খালি।কি করা যায়।
কারও কাছে ধার করবেন?আগেরগুলোই তো শোধ করা হয় নি।
ঘন্টাকয়েক পরই আজমল সাহেবকে দেখা গেল বড় বড় দুটি বাজারের ব্যাগ হাতে বাসায় ফিরছেন।
ছেলেপক্ষ রূপাকে দেখে গেল ঠিকই,কিন্তু হ্যাঁ,না কিছুই বললো না।তাদের হাবভাবেও কিছু
বোঝা গেল না।রূপা অবশ্য হাল ছেড়েই দিয়েছে।
তবে আজমল সাহেব এখনও আশা ছাড়েন নি।
কিংবা রূপাকে ভরসা দেয়ার জন্যই হয়্ত শুধু শুধু
আশাবাদী হওয়ার অভিনয় করছেন।
সেদিন রাতেই হঠাৎ আজমল সাহেবের মা খুব
বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লেন।ডাক্তার ডেকে আনা হল
বাসায়।একটা ইনজেকশন দিয়ে দিলেন আর কিছু ওষুধের নাম লেখা একটা প্রেসক্রিপশন
ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন তিনি।
পরদিন সকালে অফিসে গিয়েই আজমল সাহেব কারো কাছ থেকে কিছু টাকা ধার পাওয়া যায়
কিনা সে চেষ্টা করলেন।কিন্তু কেউই তাকে ধার
দিতে রাজি নয়।বরং আগেরগুলো শোধ করার জন্য সবাই তাকে তাগাদা দিতে লাগলো।
কি করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না আজমল সাহেব।তার সামনে একজন বসে আছে ফাইলের জন্য।
তিনি কি ফাইলটা আটকে দিবেন?টাকা চাইবেন?সবাই তো চায়।কিছু টাকা হাতে আসলেই তার অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।শপথটা আজ ভেঙেই ফেলবেন তিনি।
রবিন ফার্মেসীর দিকে যাচ্ছে।যেদিন
থেকে কম্পিউটার কেনার শখ হয়েছে তার,সেদিন
থেকেই অল্প অল্প করে টাকা জমাচ্ছে সে।বেশকিছু
টাকা জমেও গেছে।বড় হলে সে হয়্ত
হাজারটা কম্পিউটার কিনতে পারবে।কিন্তু
দাদি তো তার একটাই।চলে গেলে আর ফিরে আসবে না।
ফোন হাতে নিয়ে মূর্তির মত বসে আছে রূপা।এখনই
যা শুনলো তা সে বিশ্বাস করতে পারছে না।ছেলেপক্ষ
তাকে পছন্দ করেছে এবং কোনরূপ শর্ত ছাড়াই
তাকে তাদের ঘরে তুলে নিতে চায়।
টপ টপ করে পানি পড়ছে রূপার চোখ দিয়ে।
আজমল সাহেব মাথা নিচু করে বাড়ি ফিরছেন।আজও শপথটা ভাঙতে পারেন নি তিনি।নিজেকে কাপুরুষ মনে হচ্ছে তার।তিনি জানেন না তার জন্য কতগুলো সুখবর অপেক্ষা করছে।
ছেলেটা তার হঠাৎ করেই অনেক বড় হয়ে গেছে।কম্পিউটারের আর প্রয়োজন নেই তার।সে বুঝতে শিখেছে,একটা যন্ত্রের চেয়ে আপন মানুষগুলোর মূল্য অনেক বেশি।
মেয়েটাকে নিয়ে তার চিন্তার অবসান ঘটতে চলেছে।উপরওয়ালা মুখ তুলে তাকিয়েছেন তাদের দিকে।বাড়ি ফিরেই আনন্দ অশ্রুর বন্যা হয়ে যাবে হয়্ত।
কারণ,মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে সুখের জন্য খুব বড় কোন উপলক্ষের প্রয়োজন হয় না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন