মন হাওয়ায় পেয়েছি তোর নাম
মন হাওয়ায় হারিয়ে ফেললাম
আজকাল তুমি বড্ড অপ্রতিরোধ্য হয়ে যাচ্ছ। কিছুতেই তোমাকে প্রতিহত করতে পারছি না। আমার মগজের প্রতিটি কোনায় কোনায় এখন তোমার অবাধ যাতায়ত। চব্বিশ ঘন্টার ছত্রিশ রকম কাজে বারবার তুমি এসে ভীষণ গোল বাঁধিয়ে ফেলছ।
আমি পালাব বলে, মনস্থির করেছি। তুমি আমাকে তোমার কথার চাতুর্যে বেঁধে কিছুতেই পালাতে দিতে চাইবে না আমি জানি। কিন্তু পণ্ডিত অজয়ের একটা গান আছে, শুনেছ কি? "যত পাহারাই দাও মন পালাবেই"।
আমি জানি, তোমাকে ছাড়া আমি এক মুহূর্ত থাকতে পারব না। আমি জানি তোমাকে আমার করে পাবও না-তাই ঠিক করেছি, তোমাকে নিয়েই পালাব। যাবে আফ্রোদিতি আমার সাথে সাথে?
ঢাকা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে, আমরা টাঙ্গাইলে একটু থামব। ওখানে পথের ধারে ধারে অদ্ভূত সব দোকান আছে, জান। বাঁশের খুঁটি বেয়ে বেয়ে উঠে গেছে ছোট ছোট দোকান। খুব ভালো করে দেখলে, মনে হবে ওগুলো ট্রী হাউজ। ওখানটায় ধুলো ময়লায় সামান্য খেয়ে নিয়ে আমরা ঢুকে যাব সিরাজগঞ্জ।
এলিয়ট ব্রীজের সিঁড়ির ধাপ গুলোতে বসে, তোমার আঙ্গুলগুলো এই প্রথম স্পর্শ করব। তারপর তোমাকে যমুনা দেখাতে নিয়ে যাব। এ নদী কিন্তু নারীর মত, মানে তোমার মত। অযথাই ভাসায়। যমুনা বাঁধের ওপর সারি সারি গাছগুলোর ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে আমরা অনেকটা হারিয়ে যাব। খুব কষ্ট হবে সোনা তোমার? যাও তোমাকে নৌকায় করে মাঝ যমুনায় ভাসিয়ে নেব। তখন আমি ছাড়া কেউ থাকবে না, তোমার কাছে। কি করে লুকোবে তোমাকে? ওমন জলের ভেতর তোমার ভয় করবে না? আমি যদি পুরুষ হয়ে উঠি?
আচ্ছা যাও অমন ছলছল চোখে আর তাকাতে হবে না।
তারপর তোমাকে নিয়ে বগুড়ায় পাড়ি জমাব। বগুড়া থেকে তোমার জন্য এক খিলি মোহাররমের পান কিনে দেব। নানান মশলায়, তার বাহারী স্বাদ। পান মোড়া রূপোর রাংতা কাগজটাও তোমার মিহিন দাঁতের ভাঁজে অনায়াসে আত্মহুতি দেবে। তোমার ঐ কমলার কোয়ার মত লাল টকটকে ঠোঁট জোড়াকে পাহারায় রেখে তোমাকে নিয়ে নাটোরে থামব।
তুমি নাটোরে রানীর বাড়ি গিয়েছ কখনও?
রানী ভবানির বাড়িতে শ্বেত পাথরের সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে এক হাত ভাঙ্গা কালো মূর্তিটাকে পেছনে ফেলে, ছোট্ট গোপন ঘরটায় ঢুকে যাব। যেখানে রাখা আছে সিংহাসন। জান, সিংহাসনের হাতলে মিনা করা সিংহের মূর্তি আছে। এবার তোমাকে আমি সিংহাসনে বসিয়ে দেব দেবী।
এবার আর কোন কথা শুনতে রাজী নই। তোমার ঐ রক্তজবার মত লাল ঠোঁটে একটা প্রগাঢ় চুম্বন এঁকে দিতে চাই।
কেন এত ছটফট করছ? সিংহকে ভয়? না? শুধু পুরুষে তোমার এত ভয়? তোমার কাছে সিংহ পুরুষ হতে পারলাম কই?
আচ্ছা চল, তোমাকে সঙ্গে নিয়ে কানাইখালির বাবুর পুকুর পাড়ে বসব।
শ্যাঁওলার গন্ধের সাথে তুমি খুঁজে নিও পুরোন ফেলে আসা অতীত। আমি তোমাকে আমার শৈশবের গল্প শোনাব।
নাটোর থেকে বেরুবার পথে তোমাকে কালীবাড়ির কাঁচা গোল্লা খাওয়াব। অপূর্ব তার স্বাদ।
তারপর রেল গাড়িতে তোমাকে নিয়ে দুদিন ঘুরব। অনেক ছোট বড় জংশন তোমাকে দেখাব। রেলের জানালা তোমার কাছে হয়ে যাবে বায়োস্কোপ। সেই বায়োস্কোপের পেটের ভেতর তোমাকে শোনাব, অন্ধ ভিখিরির গান। দেখাব, জীবিকার তাগিদে হকারের কথার চাতুর্য। ড্যাব ড্যাব বলে কেউ হেঁকে যাবে।
তোমাকে নিয়ে শান্তাহার কিম্বা ঈশ্বরদীতে নেমে পড়ব।
ঈশ্বরদী জংশনটা দেখতে অদ্ভূত সুন্দর, খুব স্মৃতি গন্ধের মত। মন কেমনিয়া।
বাড়ির জন্য তোমার বুঝি মন কেমন করছে...
বেশ তোমাকে আমি গাইবান্ধায় নিয়ে যাব। নশরতপুরে একটা দারুণ থাকার জায়গা আছে কিন্তু। একটা রাত আমরা ওখানেই কাটিয়ে দেব। মাঝ রাতে ভয় পেয়ে আমার কাছে চলে আসার পুরস্কার হিসেবে তোমাকে পরদিন সকালে চমৎকার রস মালাই খাওয়াব। তারপর নদী দেখতে বেরিয়ে পড়ব। শহর ছেড়ে একটু দূরে একটা নদী আছে, নদীর ওপাড়ের মানুষেরা বড্ড সরল। ওদের সাথে কথা বলে, ওদের অতিথি হয়ে কাটিয়ে দেব একটা বেলা।
এবার কুড়িগ্রাম যাব। পথে ক্লান্ত হলে, আমার কাঁধে তোমার এলোমেলো খোঁপার বিস্তার খুলে দিয়ে একটু জিরিয়ে নিও।
কুড়িগ্রামে ঐ ছোট্ট শহরটায় আমার প্রথম দেখা বিষ্ময় হল, লাল ভাই আর শাহানা আপা। জান, লাল ভাইয়ের দুবার স্ট্রোক করে ওর শরীরের একটা অংশ প্যারালাইজড আর শাহানা আপার ক্যানসার। স্বামী-স্ত্রী দুজন মানুষই জানেন তাদের হাতে আর সময় নেই, যে কোন মুহূর্তে চলে যাবেন, তবুও ওরা কি যে হাসি-খুশী। ওদের কাছে থেকে শিখে নিও, যণ্ত্রনাকে কি করে জয় করতে হয়!!!
ওমা, বোকা মেয়ে এত অল্পতে কেউ কাঁদে? এই যে দেখ, দুহাত প্রসারিত করেছি, খুব কাছাকাছি এস, আমি তোমার নির্ভরতা হব।
চল, তোমাকে নিয়ে এবার পঞ্চগড় যাব। আমরা দুজন একটা পুরোন বাড়িতে একটা রাত কাটিয়ে দেব। খুব সকালে তোমাকে আদর দিয়ে দিয়ে তোমার ঘুম ভাঙ্গাব।
তারপর দুচোখ বন্ধ করে, তুমি আমার হাত ধরে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসবে। চোখ খুললেই দেখতে পাবে, কাঞ্চন জংঘাকে। কি যে অপরূপ না দেখলে বিশ্বাস করবে না। তারপর তোমাকে নিয়ে চলে যাব তেঁতুলিয়ায়। ওখানে মহানন্দায় তোমার সাথে অনেক ভিজব।
জল তোমাকে কতটা অপরূপ করে, সেটাই একবার পরখ করে নিতে চাই। তোমার অমন উদ্ধত পায়রা যুগলকে সিক্ত লাজুক শাড়ি সামলাতে কতটা হিসশিম খায়, সেটা ভেবে আমার দারুণ হিংসা হচ্ছে। কি অমন হিংস্র চোখে তাকিও না। আমি নিশ্চিত খুন হয়ে যাব।
আচ্ছা আর রাগ দেখাতে হবে না। চল, আমরা রাজশাহী চলে যাই। ওখানে সাহেব বাজারের মোড়ের বইয়ের দোকানগুলো থেকে, একগুচ্ছ কবিতার বই কিনে নেব।
এবার রেলে চড়ে আমরা দক্ষিণে পালাব। সারা পথ তোমায় কবিতা শুনিয়ে শুনিয়ে জাগিয়ে রাখব কিম্বা ঘুম পাড়িয়ে দেব।
খিদা পেলে ট্রেনের বুফেতে কিছু খেয়ে নেব। চপ-কাটলেট কিম্বা চা’'টা খুব একটা খারাপ নয় কিন্তু!!! খুলনায় দারুণ পূজা হয় কিন্তু। তোমার গায়ে গা লাগিয়ে, তোমার চুলের গন্ধ ছুঁয়ে ছুঁয়ে, পুজোটা মনে মনে সেরে নেব দেবী। তুমি ছাড়া আর কে আছে বল- যাকে অর্ঘ্য দেব?
ওরা দেবী বিসর্জন দেয় বলে, আমার সে পূজা ভালো লাগেনা। তোমাকে কি আমি বিসর্জন দিতে পারি? বিসর্জনের কথা শুনে আবার চোখের কোলে মেঘের ছায়া জমল কেন দেবী?
ঠিক আছে চল, যশোর যাই। পুরোন যশোর শহরের কোন এক বাড়ী থেকে তোমাকে একটা মেঘ রঙ এর যশোর স্টিচ এর শাড়ি কিনে দেব। তাতে থাকবে অসংখ্য কারূকাজ আর তাতে থাকবে আমাদের ভালোবাসা খোদাই করা।
যশোরে ভালো লাগছে না। যশোর এলে কেবল যশোর রোডের কথা মনে পড়ে যায়। আজ সমস্ত বেদনার গল্প তোলা থাক। আজ ভালোবাসার গল্পগুলো দখল করে নিক চরাচর।
চলো আমরা নড়াইলে চলে যাই। ওখানে গিয়ে সোজা তোমাকে নিয়ে যাব লাল ভাইয়ের বাসায়। ও লাল ভাইকে চিনতে পারছ না। হ্যাঁ গো আমি শিল্পি এস এম সুলতানের কথা বলছি। তাঁর তুলিতে তুমি কেমন শক্তিশালী চাষী বউ হয়ে ওঠ আমি সেটাই দেখতে চাই। শিল্পি সুলতান শিশুদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছেন। তিনি ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের নিয়ে সমুদ্রে ভাসবেন বলে, এক বিশাল নৌকা বানানো শুরু করেছেন।
ছোট্ট দূরন্ত শিশুর কথা শুনে, গোলাপের সব রঙ তোমার মুখে জমল কেন বুঝতে পারছি না। চলো চিত্রায় তোমাকে নিয়ে একটা বেলা ভাসব।
আচ্ছা এবার চলো, তোমাকে নিয়ে আরেকটু সরে যাই। আসলে ভরা জোৎস্নায় তোমাকে একবার খুব কাছে পাবার শখ আমার। তোমাকে নিয়ে আমার এবাররে গন্তব্য মাদারীপুর। ওখানে বৃটিশদের রেখে যাওয়া বাংলোগুলোর সামনে একটা চমৎকার দীঘি আছে। সেই দীঘিতে এক জোৎস্নায় তোমাকে নিয়ে ভাসব। জোৎস্নার আগুনে পুড়ে যখন তোমার সারা শরীরের রঙ মধুর মত হয়ে যাবে। আমি নিরাপদ দূরত্বে বসে সেই সুধা আকণ্ঠ পান করে নিতে চাই। দীঘি থেকে উঠে এলে কিছু দূরে আছে একটা কূঁচ ফলের দীর্ঘ গাছ। সেই কূঁচ ফল দিয়ে তোমার গহণা গড়ে দেব।
এবার চলো, সাতক্ষিরা যাই। তোমাকে সোজা নিয়ে যাব, কপোতাক্ষ নদের তীরে। সেখানে তোমার জন্য লিখে ফেলব, বেশ কিছু সনেট। কবি মাইকেল জানুক আমার প্রিয়াও আমার চোখে কতটা!!!!
ওভাবে তাচ্ছিল্য দেখিও না। আচ্ছা বেশ তবে চলো পিরোজপুর যাই। ওখানে বলেশ্বর নদীতে খোলা স্পিডবোটে যাব কুয়াকাটা। আহা দূর্দান্ত গতি নিয়ে খোলা জলে উড়ে যাবার মজা তুমি কখনই জানলে না।
না না, ভয় পেও না। কুয়াকাটায় তোমাকে আর বাঘ দেখাব না।
তোমার হাতের কাছে আস্ত একটা বাঘ থাকতে কে আর জঙ্গল ঘেঁটে হরিণ দেখতে যায় বলো।
একটা বাঘ আর হরিণের গল্প শেষে আমরা মাঝ সমুদ্রে দুজন মিলে খুব ঘুমিয়ে নেব।
এবার চট্টগ্রাম যাব। দুদিন ঘুরেফিরে কাটিয়ে দেব বন্দরে। দুজন হাত ধরাধরি করে দূরের জাহাজ দেখব। সন্ধ্যার ম্লান আলোতে হারিয়ে যাওয়া জাহাজের বিষন্ন বাঁশি শুনব।
মন খারাপ করো না দেবী, চলো কাল অন্য কোথাও যাই। ফয়েস লেকে ঢোকার মুখে তোমাকে অনেক মাটির খেলনা কিনে দেব। পুরো লেকটায় যতটা পারা যায় তোমাকে নিয়ে একটা চক্কর খাব। তোমাকে চট্টগ্রামের বেলা বিস্কুট খাওয়াবো। তুমি চায়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে কুট কুট করে সেই বিস্কুট খাবে, আর আমি
ব্যাকুল নয়নে সেটা দেখব।
সময় ফুরিয়ে আসছে দেবী। এ জন্মের মত ছাড়াছাড়ি হয়ে যেতে পারে।
কেঁদ না, দেবী। চলো। তোমায় সমুদ্রে স্নান করাব কাল। সমুদ্র স্নান সেরে তোমাকে নিয়ে ছুটব রাঙ্গামাটি। পাহাড়ি রাস্তায় বাঁকে বাঁকে বিপদ তবুও রোজ রোজ কত মানুষ যাচ্ছে।
রাঙ্গামাটিতে আদিবাসী বাঙ্গালি ভাই-বোনদের সাথে কাটাব ক’দিন। ওদের পাহাড় কেটে পাহাড়ের গায়ে গায়ে গড়ে তোলা যে কোন একটা বাড়ি বেছে নেব।
তারপর খোলা জানালা দিয়ে মেঘেদের আমন্ত্রণ জানাবো। মেঘ তোমাকে ছুঁয়ে পালিয়ে যাবে, আর আমি সে দৃশ্য দেখব। ওখানে শহরে ঢোকার মুখে একটা মোটেল আছে সেখানে প্রচুর ঝাল ঝাল ঝোল দিয়ে কাঁকড়ার মাংস খাব। খাব চিংড়ির মজার মজার সব প্রিপারেশন। তার সাথে ভীষণ ঝাল আঁচার।
দেবী তোমাকে বিদায় দিতে ভালো লাগছে না। আর একটু থাক না আমার সাথে। চলো তোমাকে এবার ভোলা নিয়ে যাই। তুমি কি কখনো চর তজুমিদ্দিনে গেছ? ওখানে তোমাকে মেঘনা দেখাব।
মেঘনার পারে দাঁড়ালে তুমি বুঝবে, মানুষের ছোট্ট একটা জীবন কতটা শুণ্যতায় ভরা। ওখানে দিনমান ছলাৎ ছল ছলাৎ ছল ঘাটের কাছে গল্প বলে নদীর জল।
তোমাকে মেঘনার অপরূপ সৌন্দর্যের কাছে দাঁড় করিয়ে দিয়ে জেলেদের এক বিশাল ডিঙ্গি নৌকায় চেপে হারিয়ে যাব মাঝ গাঙ্গে। যেখানে পদ্মা আর মেঘনা মিলেছে। ওরা মিলে গেলেও ওদের সঙ্গমের বাঁকটা বড় বিপদ সংকুল। ঠিক ওখানে ঐ বাঁকে আমি হারিয়ে যাব।
আমি হারালে কি তুমি খুব কাঁদবে? সন্ধ্যা তারার মত?
মন হাওয়ায় হারিয়ে ফেললাম
আজকাল তুমি বড্ড অপ্রতিরোধ্য হয়ে যাচ্ছ। কিছুতেই তোমাকে প্রতিহত করতে পারছি না। আমার মগজের প্রতিটি কোনায় কোনায় এখন তোমার অবাধ যাতায়ত। চব্বিশ ঘন্টার ছত্রিশ রকম কাজে বারবার তুমি এসে ভীষণ গোল বাঁধিয়ে ফেলছ।
আমি পালাব বলে, মনস্থির করেছি। তুমি আমাকে তোমার কথার চাতুর্যে বেঁধে কিছুতেই পালাতে দিতে চাইবে না আমি জানি। কিন্তু পণ্ডিত অজয়ের একটা গান আছে, শুনেছ কি? "যত পাহারাই দাও মন পালাবেই"।
আমি জানি, তোমাকে ছাড়া আমি এক মুহূর্ত থাকতে পারব না। আমি জানি তোমাকে আমার করে পাবও না-তাই ঠিক করেছি, তোমাকে নিয়েই পালাব। যাবে আফ্রোদিতি আমার সাথে সাথে?
ঢাকা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে, আমরা টাঙ্গাইলে একটু থামব। ওখানে পথের ধারে ধারে অদ্ভূত সব দোকান আছে, জান। বাঁশের খুঁটি বেয়ে বেয়ে উঠে গেছে ছোট ছোট দোকান। খুব ভালো করে দেখলে, মনে হবে ওগুলো ট্রী হাউজ। ওখানটায় ধুলো ময়লায় সামান্য খেয়ে নিয়ে আমরা ঢুকে যাব সিরাজগঞ্জ।
এলিয়ট ব্রীজের সিঁড়ির ধাপ গুলোতে বসে, তোমার আঙ্গুলগুলো এই প্রথম স্পর্শ করব। তারপর তোমাকে যমুনা দেখাতে নিয়ে যাব। এ নদী কিন্তু নারীর মত, মানে তোমার মত। অযথাই ভাসায়। যমুনা বাঁধের ওপর সারি সারি গাছগুলোর ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে আমরা অনেকটা হারিয়ে যাব। খুব কষ্ট হবে সোনা তোমার? যাও তোমাকে নৌকায় করে মাঝ যমুনায় ভাসিয়ে নেব। তখন আমি ছাড়া কেউ থাকবে না, তোমার কাছে। কি করে লুকোবে তোমাকে? ওমন জলের ভেতর তোমার ভয় করবে না? আমি যদি পুরুষ হয়ে উঠি?
আচ্ছা যাও অমন ছলছল চোখে আর তাকাতে হবে না।
তারপর তোমাকে নিয়ে বগুড়ায় পাড়ি জমাব। বগুড়া থেকে তোমার জন্য এক খিলি মোহাররমের পান কিনে দেব। নানান মশলায়, তার বাহারী স্বাদ। পান মোড়া রূপোর রাংতা কাগজটাও তোমার মিহিন দাঁতের ভাঁজে অনায়াসে আত্মহুতি দেবে। তোমার ঐ কমলার কোয়ার মত লাল টকটকে ঠোঁট জোড়াকে পাহারায় রেখে তোমাকে নিয়ে নাটোরে থামব।
তুমি নাটোরে রানীর বাড়ি গিয়েছ কখনও?
রানী ভবানির বাড়িতে শ্বেত পাথরের সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে এক হাত ভাঙ্গা কালো মূর্তিটাকে পেছনে ফেলে, ছোট্ট গোপন ঘরটায় ঢুকে যাব। যেখানে রাখা আছে সিংহাসন। জান, সিংহাসনের হাতলে মিনা করা সিংহের মূর্তি আছে। এবার তোমাকে আমি সিংহাসনে বসিয়ে দেব দেবী।
এবার আর কোন কথা শুনতে রাজী নই। তোমার ঐ রক্তজবার মত লাল ঠোঁটে একটা প্রগাঢ় চুম্বন এঁকে দিতে চাই।
কেন এত ছটফট করছ? সিংহকে ভয়? না? শুধু পুরুষে তোমার এত ভয়? তোমার কাছে সিংহ পুরুষ হতে পারলাম কই?
আচ্ছা চল, তোমাকে সঙ্গে নিয়ে কানাইখালির বাবুর পুকুর পাড়ে বসব।
শ্যাঁওলার গন্ধের সাথে তুমি খুঁজে নিও পুরোন ফেলে আসা অতীত। আমি তোমাকে আমার শৈশবের গল্প শোনাব।
নাটোর থেকে বেরুবার পথে তোমাকে কালীবাড়ির কাঁচা গোল্লা খাওয়াব। অপূর্ব তার স্বাদ।
তারপর রেল গাড়িতে তোমাকে নিয়ে দুদিন ঘুরব। অনেক ছোট বড় জংশন তোমাকে দেখাব। রেলের জানালা তোমার কাছে হয়ে যাবে বায়োস্কোপ। সেই বায়োস্কোপের পেটের ভেতর তোমাকে শোনাব, অন্ধ ভিখিরির গান। দেখাব, জীবিকার তাগিদে হকারের কথার চাতুর্য। ড্যাব ড্যাব বলে কেউ হেঁকে যাবে।
তোমাকে নিয়ে শান্তাহার কিম্বা ঈশ্বরদীতে নেমে পড়ব।
ঈশ্বরদী জংশনটা দেখতে অদ্ভূত সুন্দর, খুব স্মৃতি গন্ধের মত। মন কেমনিয়া।
বাড়ির জন্য তোমার বুঝি মন কেমন করছে...
বেশ তোমাকে আমি গাইবান্ধায় নিয়ে যাব। নশরতপুরে একটা দারুণ থাকার জায়গা আছে কিন্তু। একটা রাত আমরা ওখানেই কাটিয়ে দেব। মাঝ রাতে ভয় পেয়ে আমার কাছে চলে আসার পুরস্কার হিসেবে তোমাকে পরদিন সকালে চমৎকার রস মালাই খাওয়াব। তারপর নদী দেখতে বেরিয়ে পড়ব। শহর ছেড়ে একটু দূরে একটা নদী আছে, নদীর ওপাড়ের মানুষেরা বড্ড সরল। ওদের সাথে কথা বলে, ওদের অতিথি হয়ে কাটিয়ে দেব একটা বেলা।
এবার কুড়িগ্রাম যাব। পথে ক্লান্ত হলে, আমার কাঁধে তোমার এলোমেলো খোঁপার বিস্তার খুলে দিয়ে একটু জিরিয়ে নিও।
কুড়িগ্রামে ঐ ছোট্ট শহরটায় আমার প্রথম দেখা বিষ্ময় হল, লাল ভাই আর শাহানা আপা। জান, লাল ভাইয়ের দুবার স্ট্রোক করে ওর শরীরের একটা অংশ প্যারালাইজড আর শাহানা আপার ক্যানসার। স্বামী-স্ত্রী দুজন মানুষই জানেন তাদের হাতে আর সময় নেই, যে কোন মুহূর্তে চলে যাবেন, তবুও ওরা কি যে হাসি-খুশী। ওদের কাছে থেকে শিখে নিও, যণ্ত্রনাকে কি করে জয় করতে হয়!!!
ওমা, বোকা মেয়ে এত অল্পতে কেউ কাঁদে? এই যে দেখ, দুহাত প্রসারিত করেছি, খুব কাছাকাছি এস, আমি তোমার নির্ভরতা হব।
চল, তোমাকে নিয়ে এবার পঞ্চগড় যাব। আমরা দুজন একটা পুরোন বাড়িতে একটা রাত কাটিয়ে দেব। খুব সকালে তোমাকে আদর দিয়ে দিয়ে তোমার ঘুম ভাঙ্গাব।
তারপর দুচোখ বন্ধ করে, তুমি আমার হাত ধরে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসবে। চোখ খুললেই দেখতে পাবে, কাঞ্চন জংঘাকে। কি যে অপরূপ না দেখলে বিশ্বাস করবে না। তারপর তোমাকে নিয়ে চলে যাব তেঁতুলিয়ায়। ওখানে মহানন্দায় তোমার সাথে অনেক ভিজব।
জল তোমাকে কতটা অপরূপ করে, সেটাই একবার পরখ করে নিতে চাই। তোমার অমন উদ্ধত পায়রা যুগলকে সিক্ত লাজুক শাড়ি সামলাতে কতটা হিসশিম খায়, সেটা ভেবে আমার দারুণ হিংসা হচ্ছে। কি অমন হিংস্র চোখে তাকিও না। আমি নিশ্চিত খুন হয়ে যাব।
আচ্ছা আর রাগ দেখাতে হবে না। চল, আমরা রাজশাহী চলে যাই। ওখানে সাহেব বাজারের মোড়ের বইয়ের দোকানগুলো থেকে, একগুচ্ছ কবিতার বই কিনে নেব।
এবার রেলে চড়ে আমরা দক্ষিণে পালাব। সারা পথ তোমায় কবিতা শুনিয়ে শুনিয়ে জাগিয়ে রাখব কিম্বা ঘুম পাড়িয়ে দেব।
খিদা পেলে ট্রেনের বুফেতে কিছু খেয়ে নেব। চপ-কাটলেট কিম্বা চা’'টা খুব একটা খারাপ নয় কিন্তু!!! খুলনায় দারুণ পূজা হয় কিন্তু। তোমার গায়ে গা লাগিয়ে, তোমার চুলের গন্ধ ছুঁয়ে ছুঁয়ে, পুজোটা মনে মনে সেরে নেব দেবী। তুমি ছাড়া আর কে আছে বল- যাকে অর্ঘ্য দেব?
ওরা দেবী বিসর্জন দেয় বলে, আমার সে পূজা ভালো লাগেনা। তোমাকে কি আমি বিসর্জন দিতে পারি? বিসর্জনের কথা শুনে আবার চোখের কোলে মেঘের ছায়া জমল কেন দেবী?
ঠিক আছে চল, যশোর যাই। পুরোন যশোর শহরের কোন এক বাড়ী থেকে তোমাকে একটা মেঘ রঙ এর যশোর স্টিচ এর শাড়ি কিনে দেব। তাতে থাকবে অসংখ্য কারূকাজ আর তাতে থাকবে আমাদের ভালোবাসা খোদাই করা।
যশোরে ভালো লাগছে না। যশোর এলে কেবল যশোর রোডের কথা মনে পড়ে যায়। আজ সমস্ত বেদনার গল্প তোলা থাক। আজ ভালোবাসার গল্পগুলো দখল করে নিক চরাচর।
চলো আমরা নড়াইলে চলে যাই। ওখানে গিয়ে সোজা তোমাকে নিয়ে যাব লাল ভাইয়ের বাসায়। ও লাল ভাইকে চিনতে পারছ না। হ্যাঁ গো আমি শিল্পি এস এম সুলতানের কথা বলছি। তাঁর তুলিতে তুমি কেমন শক্তিশালী চাষী বউ হয়ে ওঠ আমি সেটাই দেখতে চাই। শিল্পি সুলতান শিশুদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছেন। তিনি ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের নিয়ে সমুদ্রে ভাসবেন বলে, এক বিশাল নৌকা বানানো শুরু করেছেন।
ছোট্ট দূরন্ত শিশুর কথা শুনে, গোলাপের সব রঙ তোমার মুখে জমল কেন বুঝতে পারছি না। চলো চিত্রায় তোমাকে নিয়ে একটা বেলা ভাসব।
আচ্ছা এবার চলো, তোমাকে নিয়ে আরেকটু সরে যাই। আসলে ভরা জোৎস্নায় তোমাকে একবার খুব কাছে পাবার শখ আমার। তোমাকে নিয়ে আমার এবাররে গন্তব্য মাদারীপুর। ওখানে বৃটিশদের রেখে যাওয়া বাংলোগুলোর সামনে একটা চমৎকার দীঘি আছে। সেই দীঘিতে এক জোৎস্নায় তোমাকে নিয়ে ভাসব। জোৎস্নার আগুনে পুড়ে যখন তোমার সারা শরীরের রঙ মধুর মত হয়ে যাবে। আমি নিরাপদ দূরত্বে বসে সেই সুধা আকণ্ঠ পান করে নিতে চাই। দীঘি থেকে উঠে এলে কিছু দূরে আছে একটা কূঁচ ফলের দীর্ঘ গাছ। সেই কূঁচ ফল দিয়ে তোমার গহণা গড়ে দেব।
এবার চলো, সাতক্ষিরা যাই। তোমাকে সোজা নিয়ে যাব, কপোতাক্ষ নদের তীরে। সেখানে তোমার জন্য লিখে ফেলব, বেশ কিছু সনেট। কবি মাইকেল জানুক আমার প্রিয়াও আমার চোখে কতটা!!!!
ওভাবে তাচ্ছিল্য দেখিও না। আচ্ছা বেশ তবে চলো পিরোজপুর যাই। ওখানে বলেশ্বর নদীতে খোলা স্পিডবোটে যাব কুয়াকাটা। আহা দূর্দান্ত গতি নিয়ে খোলা জলে উড়ে যাবার মজা তুমি কখনই জানলে না।
না না, ভয় পেও না। কুয়াকাটায় তোমাকে আর বাঘ দেখাব না।
তোমার হাতের কাছে আস্ত একটা বাঘ থাকতে কে আর জঙ্গল ঘেঁটে হরিণ দেখতে যায় বলো।
একটা বাঘ আর হরিণের গল্প শেষে আমরা মাঝ সমুদ্রে দুজন মিলে খুব ঘুমিয়ে নেব।
এবার চট্টগ্রাম যাব। দুদিন ঘুরেফিরে কাটিয়ে দেব বন্দরে। দুজন হাত ধরাধরি করে দূরের জাহাজ দেখব। সন্ধ্যার ম্লান আলোতে হারিয়ে যাওয়া জাহাজের বিষন্ন বাঁশি শুনব।
মন খারাপ করো না দেবী, চলো কাল অন্য কোথাও যাই। ফয়েস লেকে ঢোকার মুখে তোমাকে অনেক মাটির খেলনা কিনে দেব। পুরো লেকটায় যতটা পারা যায় তোমাকে নিয়ে একটা চক্কর খাব। তোমাকে চট্টগ্রামের বেলা বিস্কুট খাওয়াবো। তুমি চায়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে কুট কুট করে সেই বিস্কুট খাবে, আর আমি
ব্যাকুল নয়নে সেটা দেখব।
সময় ফুরিয়ে আসছে দেবী। এ জন্মের মত ছাড়াছাড়ি হয়ে যেতে পারে।
কেঁদ না, দেবী। চলো। তোমায় সমুদ্রে স্নান করাব কাল। সমুদ্র স্নান সেরে তোমাকে নিয়ে ছুটব রাঙ্গামাটি। পাহাড়ি রাস্তায় বাঁকে বাঁকে বিপদ তবুও রোজ রোজ কত মানুষ যাচ্ছে।
রাঙ্গামাটিতে আদিবাসী বাঙ্গালি ভাই-বোনদের সাথে কাটাব ক’দিন। ওদের পাহাড় কেটে পাহাড়ের গায়ে গায়ে গড়ে তোলা যে কোন একটা বাড়ি বেছে নেব।
তারপর খোলা জানালা দিয়ে মেঘেদের আমন্ত্রণ জানাবো। মেঘ তোমাকে ছুঁয়ে পালিয়ে যাবে, আর আমি সে দৃশ্য দেখব। ওখানে শহরে ঢোকার মুখে একটা মোটেল আছে সেখানে প্রচুর ঝাল ঝাল ঝোল দিয়ে কাঁকড়ার মাংস খাব। খাব চিংড়ির মজার মজার সব প্রিপারেশন। তার সাথে ভীষণ ঝাল আঁচার।
দেবী তোমাকে বিদায় দিতে ভালো লাগছে না। আর একটু থাক না আমার সাথে। চলো তোমাকে এবার ভোলা নিয়ে যাই। তুমি কি কখনো চর তজুমিদ্দিনে গেছ? ওখানে তোমাকে মেঘনা দেখাব।
মেঘনার পারে দাঁড়ালে তুমি বুঝবে, মানুষের ছোট্ট একটা জীবন কতটা শুণ্যতায় ভরা। ওখানে দিনমান ছলাৎ ছল ছলাৎ ছল ঘাটের কাছে গল্প বলে নদীর জল।
তোমাকে মেঘনার অপরূপ সৌন্দর্যের কাছে দাঁড় করিয়ে দিয়ে জেলেদের এক বিশাল ডিঙ্গি নৌকায় চেপে হারিয়ে যাব মাঝ গাঙ্গে। যেখানে পদ্মা আর মেঘনা মিলেছে। ওরা মিলে গেলেও ওদের সঙ্গমের বাঁকটা বড় বিপদ সংকুল। ঠিক ওখানে ঐ বাঁকে আমি হারিয়ে যাব।
আমি হারালে কি তুমি খুব কাঁদবে? সন্ধ্যা তারার মত?
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন