শুনতে চাই

এক কথায় ‘ভাল ছেলে’ বলতে গেলে যা যা বোঝায়, অভীক-কে দেখে আমার তেমনটাই মনে হল। সুদর্শন, ব্রাইট, পড়াশুনায় তুখোড়, চাকরি ছেড়ে ব্যবসার পসার জমানো সংসারী অভীক তবে কেন একা?

‘অনেক অল্পবয়স থেকেই বাবা আর মা হঠাৎ একসঙ্গে অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমার বারো বছরের ছোট ভাইকে এক্কেবারে ছোটবেলা থেকেই আমি নিজে হাতে মানুষ করি। আজও যদি কোনও সদ্যোজাত বাচ্চাকে দেখাশোনার ভার আমার ওপর দেওয়া হয় আমি খুব ভাল করে তা করতে পারব। আমার <!–more–>ছোটবেলা থেকে কলেজ পুরোটাই খেলা, কিছুটা পরিবারের দায়িত্ব আর বই নিয়ে কেটে গেছে। আলাদা করে প্রেম, শরীর এগুলো নিয়ে তখন মাথা ঘামাইনি।

কলেজে প্রথমবার একটি পরীক্ষায় আমি সেকেন্ড হই, সেদিন বুঝি আমি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর প্রেমিকাকে ভালবেসেছি। সেইটা আমাকে খুব নাড়া দিয়েছিল। ওরা দুজনেই আমার খুব বন্ধু ছিল। প্রথমটায় নিজেকে সামলাতে সময় লাগলেও পরে ঠিক করলাম ওদের দুজনকেই এই কথাটা জানিয়ে রাখব। আসলে তখন ওদের অনেক ক্ষেত্রেই এড়িয়ে চলতাম। আমার মনের খবর ওদের জানার কিছুদিন পরেই দেবলীনা আর দীপঙ্করের বিয়ে হল। কিন্তু ওদের কিছু আচরণের জন্যে আমি ওদের থেকে দূরে সরলাম। আসলে আমার খুব কাছের মানুষ যারা তারা কেমন তাই নিয়ে আমার কিছু নিজস্ব ধারণা আছে। দীপঙ্কর দেবলীনার বাবার সুপারিশে খুব বড় একটা চাকরি জোটাল, দেবলীনা নানান বিষয়ে অকারণ মিথ্যে বলতে শুরু করল আমায়। আমি কাজে ডুবলাম, বাবা হঠাৎ চলে যাওয়ায় বড় ছেলের দায়িত্ব পালনে জীবনে ব্যস্ত হলাম। বাঙালির ছেলে ভাল চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় নামলাম।

ব্যবসার বাড়বাড়ন্তে মা চেপে ধরলেন বিয়ের জন্যে, প্রেম তো আর হয়ে ওঠেনি অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে রাজি হলাম’। , জিজ্ঞেস করলাম ‘কেমন মেয়ের চাহিদা ছিল তোমার? আসলে দেখাশোনার বিয়েতে তো মেয়ে কেমন চাইয়ের একটা লম্বা ফর্দ থাকে’। , ‘আমি ঘটনাটা বলি, তাহলেই বোঝা যাবে আমার কী চাহিদা ছিল। মা দেখে আসার পরে যে মেয়েটিকে আমি দেখতে যাই সে মেয়েটির নাম জুন। বিএইচইউ-তে পড়াশুনা করা কল সেন্টারের চাকরি ছেড়ে কলকাতায় ফেরা শ্যামবর্ণের সাদামাটা একটি মেয়ে, সোজাসুজি বললে সুন্দরী নয়- এই মেয়েকেই বিয়ে করব বলে ঠিক করলাম। আমার পরমা সুন্দরী মায়ের যদিও একটু খুঁতখুঁতানি ছিল কিন্তু সেটা খুব একটা জোরালো হয়নি।

তিন চার বার পাবলিক প্লেস-এ দেখাশোনার পর আমাদের বিয়ে হল। তৃতীয় রাতে যখন জুনকে আমি আদর করতে গেলাম দেখলাম কেমন এক অদ্ভুত গলায় ও ওর মা-কে ডাকতে আরম্ভ করল। আমি থামলাম। তারপরের রাতে ঘুম ভেঙে চমকে উঠলাম! দেখলাম মধ্যরাতে জুন আমার গায়ের ওপর এক ভয়ঙ্কর ভঙ্গিতে কী সব মন্ত্র আওড়ে যাচ্ছে, ওকে জানতে চাওয়ায় ও বলেছিল আমার মঙ্গলকামনায় ওর এই উদ্ভট নিশি অভিযান। মেনে নিলাম। ভেবেছিলাম ওকে বুঝতে সময় লাগবে। দ্বিরাগমনে গেলাম ওদের বাড়ি। ও একরাশ হাসি ছড়িয়ে ওর আলমারি খুলে ওর গয়না ভর্তি বাক্সগুলো আমায় দেখাতে থাকল। আর বলতে শুরু করল ওর কলেজের এক প্রেমিকের কথা যে প্রায় গায়ের জোরেই এক বিয়েবাড়িতে ওকে মাথায় সিঁদুর আর হাতে হিরের আংটি পরিয়ে তার মায়ের সব গয়না জুনের কাছে দিয়ে গেছে। নামি মাফিয়ার ছেলে তো তাই ভয়ে তাকে না বলা যায়নি। আমি শুনলাম, আর লক্ষ্য করলাম বিয়ের আগের আড্ডায় জুন আমায় এসব কিছুই বলেনি।

আমি যদিও ওর বিয়ের আগের প্রেম কাহিনি নিয়ে খুব একটা চিন্তিত ছিলাম না। কিন্তু আমার চিন্তায় ভয় জন্মাতে শুরু করল তখন, যখন দেখলাম আমার মায়ের অনুপস্থিতিতে আমাদের ছোটবেলার গীতামাসির মুখের ওপর খাবারের থালা ছুঁড়ে দিয়ে তাকে অপমান করছে, আমার সঙ্গেও তেমনভাবে একাত্ম বোধ করতে পারছে না। আমি কিছু বোঝার আগেই ওই একদিন সব বুঝিয়ে দিল আমায়।

ওর অনুরোধেই আমাদের বাড়ির বন্ধুদের পার্টিতে আকণ্ঠ মদ খেয়ে জুন মাঝরাতে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমার ঘুমন্ত ভাই-ও ওর এই অস্বাভাবিক, অস্বস্তিকর, অশ্লীল মন্তব্য আর প্রহার থেকে নিস্তার পায়নি।

সেদিন রাত্রেই আমি ডিভোর্স ফাইল করার সিদ্ধান্ত নিই। আমার গায়ে জুনের নখের দাগ দেখেও ওর পরিবার আমাদের ওপর ৪৯৮ ধারায় মামলা চালায়। আমার জীবনটা বদলাতে থাকে। তিরিশ দিনের বিয়ের জন্যে তিন বছরের মামলায় বিপর্যস্ত হই আমি, আমার পরিবার। বধূহত্যার দাগি আসামী, চোরাকারবারি- এদের পাশে বসে দিনের পর দিন আমায় কোর্টে হাজির থাকতে হয়েছে। আমার পড়াশুনা, শিক্ষা, প্রতিষ্ঠা সবকিছুকে ফুরিয়ে দিয়েছিল মেয়েদের সুরক্ষার নামে তৈরি করা এই ৪৯৮ ধারা। রাস্তা দিয়ে চললেও মনে হত সব্বাই জানে আমার এই ভয়ানক কাহিনি কথা। পাড়ার লোকে জানে কীভাবে আমার প্রাক্তন স্ত্রী আইন অনুযায়ী নিজের জিনিস নিয়ে যাওয়ার অছিলায় আমাদের বাড়ির জলের গ্লাস থেকে মাদুর কোনও কিছুই রেখে যায়নি। আমার উকিলের কথা মতো আমরা কেউ-ই সেদিন বাড়িতে ছিলাম না। ফিরে এসে দেখি বাড়ি ফাঁকা। মাটির ভাঁড়ে, কাগজের ঠোঙায় রুটি সবজি খেয়ে মায়ের পুরনো শাড়ি বিছিয়ে আমরা সেই রাত কাটাই’।

‘তাই বলে আর কাউকে ভালবাসবে না? সঙ্গ করবে না? এ কেমন ধারা’? প্রশ্ন ছুঁড়ে দিই অভীকের সজল নয়নে। ‘না্হ। কাজ, বেড়ানো, বন্ধু, আড্ডা আর আমার এক পোষ্যকে নিয়ে বেশ আছি। অনেক অনেক দেশ বেড়াব, মজা করব আর দারুণ সব কাজ করব। তবে বাচ্চা নেওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল, সে তো আর হবে না। সিঙ্গল ফাদারের তো কোনও কনসেপ্ট নেই। যেন কেবল মেয়েরাই একা বাচ্চা মানুষ করতে পারে’।

অভীক খুব কবিতা পড়ে। ওর সঙ্গে কথা বলে মনে হল ওর এক প্রিয় কবি যেন ওর জন্যেই রেখে গেছেন এই শব্দধারা-

এসো গো, বধির করো । আমি কিছু শুনতে চাই না আর ।

ও পাতাবাহার,

নিন্দা-বাহবা’র এই চড়াই-উৎরাই ভেঙে কতদূর পৌঁছয়, মানুষ ?

এসব আর ভাল্লাগে না । বসে পড়ি । চুপ থাকি ।

ভবিষ্যতে পাতায় পাতায় তুমি আরও কী কী রং আনবে ভাবো –

আমি তার শোভা দেখে যাব ।

-স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
 
Top