সাল ১৯৯৭
রফিক সাহেব তৎকালীন ঢাকার এক মফস্বল এলাকায় নিজ তিন তলা বাড়িতে থাকেন। প্রায় তিন বছর আগে এক দুর্ঘটনায় একটি পা হারাতে হয় তাকে। তবে বাড়িভাড়ার টাকায় স্ত্রী এবং ছেলেকে নিয়ে
sadharon valobasa
ভালোভাবেই চলে যায়। রফিক সাহেবের ছেলে সজীব সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশ করে বেকার অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। দিনের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বারো ঘন্টা ঘুম আর বারো ঘন্টা ঘোরাঘুরি। ছেলে পড়াশুনায় বেশ পটু ছিল। তাই বেকার ছেলেকে নিয়ে ততটা চিন্তা করেন না রফিক সাহেব। তার ধারণা ছেলে কোথাও আবেদন করলে ঠিক চাকুরী পেয়ে যাবে। তবে সজীবের মা শাহানা আক্তার ছেলেকে নিয়ে প্রচন্ড বিরক্তিতে আছেন। এতবড় ছেলে ঘরে পরে পরে ঘুমায় ব্যাপারটা তার একটুও পছন্দ না। তবুও মায়ের দুশ্চিন্তা নিয়ে একটুও চিন্তা করে না সজীব। মায়ের এই বিষয়ক চ্যাঁচামেচি শুরু হলেই ঘরথেকে বেরিয়ে পাড়ার ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

"সজীইইইব। এ্যাএ্যাএ্যইই সজীইইইব", চিৎকার করে নিচ থেকে সজীবের মা ডাকছেন। সজীব স্যান্ডেলটা পড়ে দ্রুত নিচে নামল।
-কি? বল।
-উনারা তিন তলার নতুন ভাড়াটিয়া। যা, একটু হাত লাগা। মালপত্র দিয়ে আয়।
ঠেলাগাড়ি ভর্তি মালপত্র দেখে নিজেকে কেমন কামলা কামলা মনে হচ্ছিল সজীবের। সকলের সামনে কানমলা খাওয়ার চেয়ে মায়ের কথামত কাজ করাটাই শ্রেয় মনে করল সজীব। দুজন লোক অবশ্য মাল টানছে, তবুও সে একটা চেয়ার নিল তিন তলায় রেখে আসার উদ্দেশ্যে। চেয়ারটা তিন তলায় রেখে আসার সময় সজীবের চোখ আটকালো ঘরটার ভেতরে। একটা মেয়ে ঘরের মালপত্র গুছিয়ে রাখছে। মেয়েটা ঘেমে একাকার। ওড়নাটা ঘাড়, পিঠ আর বুক দিয়ে বেশ কসরত করে কোমরে প্যাঁচানো। নাকের নিচে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সজীব চেয়ারটা কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে দেখছে। মেয়েটা ইশারা দিয়ে চেয়ারটা ভেতরে রাখতে বলল। চেয়ারটা রেখে চলে আসার সময় সজীব আরেকবার মেয়েটার দিকে তাকালো। মেয়েটা আসলেই রূপবতী।
সেদিনের পর থেকে মেয়েটাকে গোচরে অগোচরে দেখা একরকম নিয়মমাফিক কর্তব্যে পরিণত হয়ে গিয়েছিল সজীবের জন্য। সামনাসামনি দেখা হলেও সজীব কথা বলত না। বেশ হকচকিয়ে যেত। মেয়েটা অবশ্য ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মুচকি একটা হাসি দিয়ে চলে যেত। আর সেই মুচকি হাসির লোভেই সজীব মেয়েটাকে দেখত। এরকম চক্র ধরেই চলছিল সজীবের দিনকাল।

আর এদিকে মেয়েটাও যে সজীবকে একেবারেই পছন্দ করত না এমনটি নয়। সজীব যখন মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হা হয়ে যেত, সেই দৃশ্য ভেবেই মেয়েটা হাসতে হাসতে পাগল। তবুও মেয়েটা বেশ সতর্ক থাকে। এই ছেলের প্রতি মায়া বাড়ানো যাবে না। এতে করে তার বাবা মার অসম্মান হতে পারে। তাই নিজেকে খুব নিয়ন্ত্রনে রাখত মেয়েটা।

এমনই একদিন পাড়ার ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলছিল সজীব। ক্রিকেট খেলা তো বাহানা, মেয়েটা বারান্দায় এলে তাকে দেখবে ভেবেই বোলিং না করে উইকেট কিপার দাঁড়ালো সজীব। এক সময় মেয়েটা বারান্দায় এলো। ততক্ষনে ব্যাটিংয়ে নেমে গেছে সজীব। মেয়েটাকে যে আজ দেখাতেই হবে সজীব কতটা ভালো খেলোয়াড়। বল আসতেই সজোরে হাঁকিয়ে বল চলে গেল সীমানার বাইরে। তবে ব্যাপারটা উদযাপন করা হল না। সীমানার বাইরে যাবার আগে বজ্জাত বলটা সজীবদের বাসার তৃতীয় তলা হয়ে একটা অঘটন ঘটিয়ে দিয়ে গেছে। কপাল চেপে ভেতরে চলে গেছে মেয়েটি। আর এদিকে পাড়ার ছেলেগুলো হা হুতাশে ব্যস্ত। সজীব ততক্ষনে হাওয়া।

পরদিন বিকালে সজীব তিন তলার সেই মেয়েটাকে দেখতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। খালি হাতে যাবে নাকি ফলমূল কিছু নিয়ে যাবে তা নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়লেও শেষ পর্যন্ত খালি হাতেই বাসার দরজার সামনে দাঁড়ালো। তিন তলা উঠতে যেন প্রান বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। বহুকষ্টে দরজায় টোকা দিল। একবার ভাবলো দৌড়ে চলে গেলে কেমন হয়। পড়ে ভাবল নাহ্। থাক। অনেক্ষণ, তা প্রায় দশ পনের সেকেন্ড পর দরজা খুলল সেই মেয়েটি। মেয়েটিকে দেখে মনে মনে সাজানো কথাগুলো গুলিয়ে গেল সজীবের। কি যেন বলবে ভাবছে সে। মেয়েটাও বুঝতে পারছে অবস্থাটা। ঘরের ভেতরটা একবার দেখে হাত দিয়ে চলে যাবার ইশারা দিল মেয়েটা। কিছু বলার আগেই সজীবের মুখের ওপর খটাশ করে দরজাটা লাগিয়ে দিল মেয়েটা। সজীব মেয়েটার কপালের ফোলা অংশটা দেখে নিজের কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে ছাদে উঠে গেল।

ছাদে বেশ কয়েকটা স্যালোয়ার কামিজ শুকাতে দেয়া অবস্থায় ঝুলছে। সজীব একেবারে নিশ্চিত কাপড়গুলো ঐ মেয়েটার। সন্ধ্যার আগে তো মেয়েটা ঠিক কাপড় নিতে আসবে। ততক্ষণ ছাদেই থাকার সিদ্ধান্ত নিল সজীব। ঠিক কিছুক্ষণ পরই মেয়েটা ছাদে এলো। দুজন দুজনকে দেখে বেশ চমকে উঠল। মেয়েটা কাপড়গুলো নিতে নিতে আড়চোখে সজীবকে দেখছিল। সজীবও আকাশ দেখার বাহানায় মেয়েটির দিকে একটু একটু তাকাচ্ছিল। কাপড় নিয়ে চলে যাচ্ছিল মেয়েটি। সজীব সাহস যুগিয়ে হালকাভাবে বলল, "শুনুন, কালকের ঘটনার জন্য আমি দুঃখিত। আমি ইচ্ছে করে করিনি। ভূলবশত লেগে গিয়েছিল। কাওসার এতো জোরে বল করেছিল যে হালকা ছোঁয়াতেই সাঁই করে বলটা উঠে গেল। আপনি. . . . . . ."
মেয়েটা চলে গেল। সজীবের ওপর প্রচন্ড রেগে আছে হয়ত। তাই কোনো কথা বলেনি মেয়েটা। অনুতপ্ত হয়ে ঘরে ফিরে গেল সজীব।
-আচ্ছা মা, উপরতলার মেয়েটার নাম কি?
-ঐ বোবা মেয়েটার?
-মানে?
-কি মানে? নতুন ভাড়াটিয়ার কথা বলছিস না? মেয়েটাতো বোবা।
-বল কি? মেয়েটা বোবা?
-হুম। কানে শোনে কিন্তু কথা বলতে পারে না।
-এতো সুন্দর একটা মেয়ে কথা বলতে পারে না?
-নাহ।
সজীবের যেন বিশ্বাসই হচ্ছেনা যে মেয়েটা কথা বলতে পারে না। ধ্যাৎ। এটা কোনো কাজ হলো? সজীব ভাবল কথা না বলে কিভাবে থাকা যায়। বাইরে বেরিয়ে বন্ধুদের সাথে কথা না বলার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু সিদ্ধান্ত মাঠে মারা গেল। কথা না বলে থাকাটা বেশ কষ্টকর।

মেয়েটার প্রতি সজীবের দুর্বলতা ক্রমেই বাড়তে লাগল। প্রায় প্রতিদিনই চোখাচোখি হত। মেয়েটা যেহেতু কথা বলতে পারত না সেহেতু দুর থেকেই একজন আরেকজনকে দেখত। মেয়েটার মুচকি হাসি একরকম অমৃতের মত। সজীব ভাবলো আর কত লুকিয়ে লুকিয়ে দেখব মেয়েটাকে? ওকে প্রেম প্রস্তাব দিলে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ। বন্ধুবান্ধব জড় করে প্রেম প্রস্তাব পাঠানোর রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করা শুরু করল। যেহেতু মেয়েটা কথা বলতে পারে না, আর সজীব মেয়েটাকে বই হাতে বারান্দায় দেখেছে সেহেতু চিঠি পাঠানোকেই সর্বসম্মতিক্রমে প্রেম প্রস্তাব দেয়ার মূল উপায় হিসেবে ধার্য্য করা হল। সজীব রাত জেগে চিঠি নিয়ে ব্যাপক জল্পনা কল্পনা করতে লাগল। কি লিখবে, কিভাবে লিখবে এইসব ভাবনা আর কি। তো সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বাইশ পৃষ্ঠার একটা ম্যারাথন প্রেমপত্র নিয়ে বন্ধুবান্ধবের সামনে হাজির হল সজীব। চিঠি দেখে অর্ধেক বন্ধুগণ হাসতে হাসতে ভূপাতিত এবং বাকি অর্ধেক মঙ্গল গ্রহে চানাচুর বিক্রেতা পাওয়া গেছে এমন খবর পেলে যেমনটা অবাক হবার কথা তেমন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সজীবের দিকে। শেষপর্যন্ত সবাই সজীবকে সাহস যুগিয়ে এই বলে পাঠালো যে সজীব যেন দ্রুত চিঠিটা মেয়েটাকে দিয়ে আসে। সজীবও দেরী না করে দ্রুত বাসায় ফিরল। যত দ্রুত সম্ভব কাজটা করতে হবে।

বাসার সামনে এসেই চোখে পড়ল বাসার পাশের মাঠটায় প্যান্ডেল বসানো হচ্ছে। তিন তলা বাড়িটাতেও আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সজীব ভাবল তাদের বাড়িতে বিয়ে কার। ভাবতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। ঐ মেয়েটার বিয়ে নয়ত! দৌড়ে ছাদে উঠে পড়ল সজীব। উঠার সময় মেয়েটার ফ্ল্যাটের বাইরে বারো তেরো জোড়া জুতা। সজীবের আশংকা আরো প্রবল হয়ে উঠল যখন সে ঘরটিতে উঁকি দিয়ে দেখল মেয়েটাকে ঘিরে হয়ত তার আত্মীয়স্বজন বসে গল্প করছে। মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হতেই দ্রুত ছাদে উঠে গেল। ছাদে উঠে আজো কাপড় শুকাতে দেয়া। হয়ত মেয়েটা আসবে। একটু পর কারো পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। সজীব হাতে ধরে রাখা চিঠিটা লুকিয়ে ফেলল। মেয়েটার মা কাপড়গুলো নিতে এসেছে।
-স্লামালেকুম আন্টি।
-ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছ বাবা?
-জ্বী আন্টি ভালো। আপনি?
-এইতো আছি বাবা। কাল তো আমার মেয়েটার বিয়ে। জানো তো?
-হ্যাঁ। আমি বাইরে প্যান্ডেল দেখলাম।
-তুমি বাবা কষ্ট করে একটু থেকো। তোমার মত একটা ছেলে থাকলে বড় উপকার হত।
-জ্বী কোনো দরকার হলে বলবেন।
-আচ্ছা।
মহিলা চলে গেলেন। সজীব লুকোনো চিঠিটা বের করে দেখতে লাগল। মিনিট দশেক পর আবার পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। হ্যাঁ। এবার মেয়েটাই এসেছে। সজীবের কাছাকাছি একটা অবস্থানে এসে দাঁড়ালো মেয়েটা। কিছুক্ষণ হাত পা নাড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টা করল। মেয়েটারও চোখ ভেজা। সজীব মেয়েটার কথার আগা গোড়া কিছু বুঝতে না পেরে হা করে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করে চলে গেল। তবে চলে যাবার আগে একটা চিঠি ফেলে গেল। চিঠিটার লেখা পড়ে খানিকটা স্তব্ধিত হয়ে গেল সজীব। চিঠিতে শুধু লেখা "তুমি একটা কাপুরুষ"।

কাজী সাহেব ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী নিজের কাজ শুরু করলেন। বরপক্ষ চলে এসেছে। তবে বরপক্ষের লোকজন খুব কম। মেয়েটা একবারো সেদিকে তাকায়নি। মাথা নিচু করে ছিল পুরোটা সময়ই। হঠাৎ ই একটা কথা শুনে কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেল মেয়েটা। কাজী সাহেব কি নাম বললেন? বরের জন্য সাজানো মঞ্চের দিকে চোখ গেল মেয়েটার। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলনা সে। বরের বেশে কি বাড়িওয়ালার ছেলেটা বসে আছে? চোখাচোখি হতেই সজীব মুচকি একটা হাসি দিল। এতক্ষণে মেয়েটার মুখেও হাসি ফুটলো। কাজী সাহেব কবুল বলার তাড়া দিচ্ছেন। মেয়েটা মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। ধুমধামের বিয়ে ধুমধাম করেই সম্পন্ন হয়ে গেল।

"তুমি কি ভাবছ আমি জানি। কিভাবে কি হল তাই না? তোমার চিঠিটা আমার বাবাকে দেখিয়েছিলাম। তোমার সব কথা বাবাকে বলেছি। বাবা কিছু না বলে তোমার বাবাকে ডেকে আনতে বললেন। তারা তারপর রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসলেন। বৈঠক শেষে তোমার বাবা হাসিমুখে চলে গেলেন। আর বাবা আমার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললেন, যা শেরওয়ানী কিনে আন। কালই তোর বিয়ে। আর আমার বাবাও এক কাঠি সরেস। তোমার বাবাকে বলেছিলেন উনি যাতে তোমাকে চমকে দেন। আমার সাথে যে তোমার বিয়ে হবে তা শুধু তুমি বাদে সবাই জানত। আর তারপর কি হল তা তো সব জানই। আচ্ছা তোমার নামই তো জানি না। কি নাম তোমার?". . .
মেহেদী রাঙানো হাতে নিজের লেখা নামটা দেখালো মেয়েটা। নীলা। নীলার চোখে আনন্দাশ্রু। সজীব নীলার হাতটা ধরে ছাদে ঠায় দাড়িয়ে রইল। হয়ত এই প্রথম কোনো দম্পতি বাসার ছাদে বাসর রাত কাটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
 
Top