একটা পেইন্টিং। পেইন্টিংটার দিকে তাকিয়েই ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেয়া যায়।
একটা রাস্তা,দুপাশে গাছ। রাস্তাটা লাল হয়ে আছে। সেটা কি দুপাশের গাছ থেকে ঝরে পড়া পাতার কারণে হয়েছে নাকি শিল্পীর বিমূর্ততা আঁকার প্রয়াস সেটা ঠিক ধরা যাচ্ছেনা।
bristir dinরাস্তাটার পাশেই একটা খালি বেঞ্চি। তবে সবচাইতে আকর্ষণীয় যে ব্যাপারটা, সেটা হল, রাস্তা ধরে দুটো অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে। এক জোড়া মানব মানবী।এখানে শিল্পী একটা রহস্য রেখে দিয়েছেন।
মানুষদুটো বেঞ্চিতে বসবে নাকি সামনে এগিয়ে যাবে, সেটা অজানা।
আমি বসে আছি দেশের অন্যতম ধনকুবের নাসির খানের বিলাসবহুল অফিসের রিসিপশনে।অফিসের সাজ সজ্জা মাথা ঘুরিয়ে দেবার মত।
আমি অপেক্ষা করে আছি কখন ভেতরে ডাক পড়ে আমার।
এইমুহুর্তে কী একটা জরুরি কাজ করছেন নাসির খান।আমি তার কাজ শেষ হবার অপেক্ষায় আছি।
কিছুক্ষণ পরই রিসিপশনিস্টের জল তরঙ্গের মত কণ্ঠ শুনতে পেলাম, 'স্যার আপনাকে ভেতরে যেতে বলেছেন। '
আমি উঠে দাড়ালাম। নাসির খানের রুমের সামনে এসে দরজাটা একটু ফাঁক করে বললাম, 'মে আই কাম ইন, স্যার? '
'কাম, 'ছোট্ট করে বললেন নাসির খান।
পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে হবে নাসির খানের বয়স। চেহারায় আভিজাত্য আছে। আভিজাত্যটা সম্ভবত প্রাচুর্যের সাথে আমদানি হয়েছে।তবে নাসির খানের বেশভুষা কিংবা তাঁর ব্যাক্তিগত অফিসের কোথাও অতিরন্জন নেই। ছিমছাম একটা ভাব।আসবাবগুলো দামী হলেও বাহুল্য বর্জিত, যেটা নাসির খানের সুরুচির পরিচয় দিচ্ছে।

আমি নাসির খানের টেবিলের সামনে এসে দাড়ালাম।
যারা এতক্ষণ ধরে ভাবছিলেন আমিও নিশ্চয়ই নাসির খানের মত হোমড়া চোমড়া কেউ হব, তাদের ধারণা ভুল। আমি হোমড়া চোমড়া কেউ নই।আমি একজন ড্রাইভার। নাসির খানের কাছে এসেছি চাকরির জন্য।
এতদিন আমি ট্যাক্সি চালাতাম।যে পরিমান আয় হয় তাতে আমার একলা জীবন সুন্দর চলে যেত।শুধু প্যাসেঞ্জারদের গাল মন্দটাই সহ্য হতনা।খুব করে চাইছিলাম,প্রাইভেট কোনও গাড়ি চালাতে।গালি খেলে একজনেরটাই খাই!
কিছুদিন আগে কাসেম ভাই এসে বলল,সে নাকি বিদেশ চলে যাচ্ছে,আমি চাইলে তার চাকরিটা নিতে পারি।
কাসেম ভাই আমার পূর্ব পরিচিত।বহুদিন ধরে নাসির খানের গাড়ি চালাচ্ছে।সে আর চাকরি করবেনা শুনে নাসির খান তাকে আরেকজন ড্রাইভার যোগার করে দিতে বলে।সেজন্যই আমি আজ এখানে।
দেশের অন্যতম ধনী মানুষটা একটা ফাইল চোখের সামনে ধরে ছিলেন এতক্ষণ।আমি তার সামনে দাড়াতেই তিনি বললেন,‘তোমার নাম সাজু?’
‘জী,’ছোট করে বললাম।ভালো নাম একটা থাকলেও সেটা আর বলতে ইচ্ছে হলনা।
‘তুমি নাকি পড়াশোনা জানা ছেলে?’মনোযোগ দিয়ে আমার দিকে তাকালেন নাসির খান।
‘জী,মাস্টার্স কমপ্লিট করেছিলাম। মা’র চিকিৎসার টাকা যোগার করতে গিয়ে স্টিয়ারিং ধরতে হয়েছে।’
‘স্যাড।’
‘আমার অভ্যেস হয়ে গেছে।এখন বরং অন্য কোনও কাজ করতেই গেলেই সমস্যায় পড়ে যাব।’
‘ঠিক আছে,আমার গাড়ি চালাতে থাক আপাতত,পরে দেখি তোমার জন্য কী করতে পারি।’
কাসেম ভাই আমাকে বলেছিল,নাসির খান নাকি খুবই ভাল মানুষ।তবে এতটা ভাল সেটা বুঝতে পারিনি।বললাম,‘তারমানে স্যার,চাকরিটা আমি পাচ্ছি?’
‘কাসেম যেহেতু তোমাকে পাঠিয়েছে সেহেতু আমার কোনো কথা নেই।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ,স্যার।’
‘তুমি কবে থেকে কাজে জয়েন করতে চাও?’
‘স্যার আপনি বললে আজ থেকেই।’
‘ওকে ফাইন।তাহলে এখন থেকেই কাজে লেগে পড়।গত কদিন ধরে অফিসের ড্রাইভার দিয়ে কাজ চালাচ্ছি।আজ সকালেও সে আমাদের নিয়ে এসেছে।আমাদের মানে আমার আর আমার ওয়াইফকে।ও একটু শপিংয়ে গেছে।এখুনি চলে আসবে।তুমি ওকে বাসায় পৌঁছে দেবে,ওকে?’
‘জী,স্যার।’বলতে বলতেই একটা মৃদু ঘ্রাণ পেলাম।সম্ভবত পারফিউমের।ঘ্রাণটা মৃদু হলেও কেমন যেন নেশা ধরিয়ে দিতে চায়।বোঝাই যাচ্ছে অত্যন্ত দামী পারফিউম।সঙ্গে এটাও বোঝা যাচ্ছে,রুমে কারো আগমন ঘটেছে।
‘এই তো সোহানা চলে এসেছে।’বললেন নাসির খান।

আমি পেছন ফিরে আগন্তুকের দিকে তাকালাম।
বুকের রক্ত ভয়ানকভাবে ছলকে উঠল।সেই সঙ্গে মাথাটাও ঝিম ঝিম করে উঠল।সেটা অবশ্যই দামী পারফিউমের নেশা ধরানো গন্ধে নয়,সোহানাকে দেখে।
কতদিন পর দেখছি মেয়েটাকে?চার,নাকি পাঁচ বছর পর?
এতদিনে অনেক বদলে গেছে মেয়েটা।আগের সেই শান্ত স্নিগ্ধ সোহানার গায়ে আজ দামী শাড়ি চড়েছে।কড়া মেকআপ সেই কমনীয়তা চাপা দেয়ার কাজটা আরো ভালভাবে করছে।
সোহানা খুবই ভাল অভিনেত্রী তাতে কোনও সন্দেহ নেই।আমাকে প্রায়ই ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে বলে ভয় দেখাত।এমন নিখুঁত অভিনয় করত যে আমি গাধাটা প্রতিবারই বিশ্বাস করে বসতাম।
আমি ভয় পাবার সাথে সাথেই সোহানা খিল খিল করে হেসে আমার ভুল ভাঙ্গিয়ে দিত।বুঝিয়ে দিত আমি আসলে কতটা গাধা!
তবে ভুলটা একবার আর ভাঙ্গাল না...
এত পাকা অভিনেত্রী হয়েও লাভ হলনা।আমাকে দেখে বিস্ময়টা লুকাতে পারলনা সোহানা।তবে সেটা খুবই সামান্য সময়ের জন্য।পরক্ষণেই সামলে নিল নিজেকে।
‘সোহানা,এ হল সাজু।আমাদের নতুন ড্রাইভার।’বললেন নাসির খান।‘ও তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেবে।’
সোহানা কিছু বলল না।আস্তে করে মাথা ঝাকাল।সেই একই ভঙ্গিতে,যেটা দেখে আমি মুগ্ধ হতাম।ও এখন পরস্ত্রী হওয়া সত্বেও আমি মুগ্ধ হলাম,আরো একবার।
‘ঠিক আছে,তুমি তাহলে চলে যাও ওর সাথে,আমি দুপুরে আসব।’
‘আচ্ছা,’মৃদু গলায় বলল সোহানা।বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে।ভঙ্গিটা অবশ্য পালিয়ে যাবার বলে মনে হল আমার কাছে।স্বামীর সামনে প্রাক্তন প্রেমিকের সাথে দাড়িয়ে থাকা নিশ্চয়ই সুখকর অভিজ্ঞতা নয়!
আমি নাসির খানের কাছ থেকে গাড়ির চাবিটা নিয়ে সোহানাকে অনুসরণ করলাম।

গ্যারেজে এসে নাসির খানের মার্সিডিজের দরজা খুলে দিলাম সোহানার জন্য।সোহানা কিছু না বলে মাথা নীচু করে গাড়িতে উঠে বসল।আমিও কথা না বলে গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে এলাম।
অফিসের সীমানা পেরিয়ে গাড়িটা রাস্তায় আসতেই বললাম,‘কেমন আছ সোহানা?নাকি ম্যাম বলতে হবে?’
‘তুমি কি সব জেনেই এখানে চাকরী নিয়েছ?’ঝাঁজ ফুটে উঠল সোহানার গলায়।
‘এখন আর কী আসে যায় তাতে?তাছাড়া আমাকে নিশ্চয়ই এতটা নীচ তুমি এখনও ভাবনা যে,আমি পুরনো প্রেম জাগিয়ে তোলার জন্য প্রাক্তন প্রেমিকার গাড়ির ড্রাইভারী করব?চিন্তা কোরনা,চাকরীটা আমি ছেড়ে দেব।’
‘চাকরী ছাড়লে খাবে কী?’
‘একা মানুষ,একটা ব্যাবস্থা করে নেব।’
‘কেন,খালাম্মা এখন কোথায় থাকে?’
‘কবরে।’
এরকম জবাব বোধহয় আশা করেনি সোহানা।একটু থতমত খেয়ে গেল,‘ও,সরি।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,‘তুমি বিয়ে করোনি কেন?’
‘এমনিতেই।তুমি আবার ভেবে বোসো না,তোমার বিরহে আমি চির কুমার থাকব।মেয়ে পছন্দ হয়নি তাই বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি।’ জানিনা কথাটা আমি কতটুকু সত্য বললাম,কিংবা আদৌ সত্য কিনা!
‘একটা মজার ব্যাপার লক্ষ্য করেছ সোহানা,একদিন যে চাকরীর অভাবে তোমাকে হারিয়েছি আজ তোমাকে পেয়ে সেই চাকরী হারাতে হচ্ছে!’
‘অনেক কথা শিখেছ,তাইনা?’
‘হুমম,শিখে নিতে হয়েছে।ঢাকা শহরে ট্যাক্সির ড্রাইভারি করতে গেলে আরও অনেক কিছুই শিখতে হয়।’
‘ড্রাইভারি ছেড়ে ভাল কোনও চাকরী নিতে পারনা?’
‘আগ্রহ নষ্ট হয়ে গেছে।’ নিঃস্পৃহ স্বরে বললাম।
‘শোন,তুমি এই চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে একটা ব্যাবসা শুরু করবে।টাকা যা লাগে আমি দেব।’
‘তোমার অনেক দয়া!’
‘এমনি এমনি দিচ্ছিনা।পরে শোধ করে দেবে।’
আমি মুচকি হাসলাম শুধু।
প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললাম,‘নাসির খানই যে তোমার হাজবেন্ড সেটা তো জানতাম না।কিভাবে বিয়ে হল তোমাদের?’

‘বিয়ের আগে আমিও ওকে চিনতাম না ভাল করে।শুধু জানতাম,অনেক ধনী আমার হবু স্বামী।বিয়ে বাবাই ঠিক করেছিল।আমাকে দেখে নাসিরের পছন্দ হয়ে যায়।ব্যাস,বিয়েটাও হয়ে গেল। অনেক ভাল মানুষ আমার স্বামী।আমি সুখী।’
‘কাকে বুঝ দিচ্ছ,আমাকে নাকি নিজেকে?’
‘বুঝ দিতে যাব কেন?নাসির খুবই ভাল একজন মানুষ।’
‘একজন ভাল মানুষ যে সব সময় একজন ভাল স্বামী হবে এমন কোনও কথা নেই।’
‘তুমি এসব বলে কী প্রমাণ করতে চাইছ আমি জানিনা,কিন্তু আমি সত্যি নাসিরের মত মানুষকে স্বামী হিসেবে পেয়ে সুখী।তাছাড়া পুরো ব্যাপারটাতে আমার কতটুকু ভূমিকা ছিল?কোন বাবা মা তার মেয়েকে একজন বেকার ছেলের হাতে তুলে দেবে?’
‘যে কিনা আবার পরবর্তীতে ট্যাক্সি ড্রাইভার হবে!’
‘তুমি যদি তখন ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাজটাও যোগার করতে পারতে তাহলেও আমি তোমার হাত ধরে বেরিয়ে পড়তাম।’
‘বিশ্বাস কর সোহানা,তোমার উপর আমার এতটুকু রাগ নেই।এতক্ষণ এমনিই দুষ্টুমি করছিলাম।তোমাকে আজ সুখী দেখে আমিও সুখী।’
‘তাহলে তোমাকে এই মুহূর্তে কথা দিতে হবে,তুমি বিয়ে শাদী করে নতুনভাবে জীবন শুরু করবে।’
‘বাংলা সিনেমার ডায়লগ হয়ে গেলনা?জীবন তো একটাই,তাইনা?চাইলেই কী আর নতুন করে শুরু করা যায়?’
‘এসব ফিলসফির কথা আমাকে শোনাতে আসবেনা প্লিজ।আগামী একমাসে মধ্যে আমি তোমার জন্য মেয়ে খুঁজে বের করব,তাকে তোমার বিয়ে করতে হবে।

এমন একজনকে খুঁজে বের করব,যে কিনা আমার মত খারাপ মেয়ে হবেনা।সারা জীবন সে তোমাকে আগলে রাখবে।’
‘একমাস?আমার তো এখনই বিয়ে করে ফেলতে ইচ্ছে করছে!’
‘আমি ফাজলামো করছিনা।’রাগী রাগী ভঙ্গিতে বলল সোহানা।
আমি রিয়ারভিউ মিরর দিয়ে তাকালাম ওর দিকে।‘আমি আবার সেটা কখন করলাম?বাই দ্যা ওয়ে,রাগলে তোমাকে এখনও আগের মত সুন্দর লাগে।’
সোহানা রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেলল।
‘হাসলেও!’ বলে রিয়ারভিউ মিরর থেকে চোখ সরিয়ে উইন্ডশিল্ডের দিকে তাকিয়ে পানির কয়েকটা ফোঁটা দেখতে পেলাম।সকাল থেকেই মেঘ করেছিল,এখন বৃষ্টি নামছে।
দেখতে দেখতেই মুষলধারে নামা শুরু করল।
আমার আর সোহানার জীবনে বৃষ্টির একটা অদ্ভুত যোগ আছে।প্রথম যেদিন সোহানা আমাকে বলেছিল ‘ভালবাসি’, সেদিন বৃষ্টি নেমেছিল।
যেদিন ও আমকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল,সেদিনও বৃষ্টি নেমেছিল।
আজও বৃষ্টি নেমেছে।
জানালা বেয়ে বৃষ্টির ধারা গড়িয়ে গড়িয়ে কাঁচগুলোকে অস্পষ্ট করে তুলছে।
‘সোহানা,তোমার মনে আছে,যেদিন তুমি আমাকে প্রথম ভালবাসার কথা বলেছিলে সেদিন প্রচন্ড বৃষ্টি নেমেছিল?’
চুপ করে থাকল সোহানা।
আমি আবার বললাম,‘সেদিন তুমি আমাকে একটা কথা বলেছিলে মনে আছে?বলেছিলে,“বাঁচলে একসাথে বাঁচব,মরলে একসাথে মরব,”মনে আছে?’
‘তুমি কি আমাকে সত্যি ক্ষমা করেছ?’
‘অনেক আগেই।’
‘তাহলে এসব বলে আমাকে কষ্ট দিচ্ছ কেন?’
‘কষ্ট দিচ্ছিনা।বৃষ্টি দেখে সব মনে পড়ে গেল।’
সোহানা চুপ।
শুধু গাড়ির ছাদে বৃষ্টির ফোঁটা ছন্দ তুলছে একটানা।
‘আচ্ছা,আমাকে দেখানো তোমার সবগুলো স্বপ্নই তো মিথ্যে প্রমানিত হয়েছে।একটা স্বপ্ন না হয় সত্যি হোক?’
‘কোনটা?’
‘ওই যে,“বাঁচলে একসাথে বাঁচব,মরলে একসাথে মরব।”
‘মানে?’সামান্য চড়ে গেল সোহানার গলা।
আমি কিছু না বলে শেষবারের মত রিয়ারভিউ মিরর দিয়ে সোহানার দিকে তাকালাম।সে দৃষ্টিতে কোনো রাগ নেই,ক্ষোভ নেই।আছে শুধু নিখাঁদ ভালবাসা।সোহানার জন্য।

আমি গাড়িটাকে পূর্ণ গতিতে ছুটিয়ে দিলাম রাস্তার পাশের কংক্রিটের দেয়াল লক্ষ্য করে...
 
Top