আমি রিদিতা, সবেমাত্র পড়াশোনার পার্ট চুকিয়ে একটা চাকরিতে ঢুকেছি। আহামরি কিছু নয় তবে ভালো একটা মাল্টিন্যাশনাল এনজিও।প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাচটা অফিস,সময়টা ভালোই কেটে যায়। অন্তত একাকীত্ত্বের হাহাকার তখন কাজ করেনা নিজের মধ্যে,যখন বাসায় ফেরার পথ ধরি হাহাকারটা তীব্র চীতকারে জেগে উঠে তখন।থাকি বাবা মা ভাইয়ার সাথে উত্তরায়।আমার এই প্রীয় মানুষ গুলোর অহেতুক তীব্র ভালোবাসা আমার গলা চেপে ধরে।মোহাম্মদপুর বড় ফুপির বাসা,বৃহৎ পৃথিবীর এই একটাই আমার যাবার জায়গা যেখানে আমি বারবার ফিরে যেতে চাই।
বড়ফুপি তখন কলেজে পড়েন,সাদা ফিতের দুইবেনী সাদা কলেজ ড্রেস,বড়ফুপি বরাবরই অনেক সুন্দর। আবেগী বয়সে এক ছেলের প্রেমে পড়েন।ছেলে চারুকলার ছাত্র,গানও গাইত খুব ভালো।দাদাবাড়িতে জানাজানি হয়ে গেল একদিন,এমন গাটছাট ছাড়া ছেলের সাথে যার কিনা ভবিষ্যতের কোন ঠিকঠিকানা নেই এরকম ছেলের সাথে মেয়ের সম্পর্ক কেও মেনে নিতে পারলেননা।দাদাভাই একরোখা মানুষ ছিলেন,ফুপিকেই ভালোবাসতেন সবথেকেই বেশি তবুও কিছুতেই তার মন নরম হয়নি।ফুপি অতপর ছেলেটির জন্য পরিবার ছড়লেন।বিয়ের ছয় বছর পর ফুপা মারা যান ব্লাড ক্যান্সারে, ফুপির বয়স তখন বাইশ তেইশ হবে। ফুপি পারতেন আবার বিয়ে করতে কিন্তু তিনি করেননি। আমি প্রায়ই একই প্রশ্ন ফুপিকে বারবার করি,
-কেন তুমি আবার বিয়ে করলেনা?
-ভালোবাসা যে আর বাকী কিছু নেই।আমার সমস্ত ভালোবাসা আর ভালোবাসার সত্ত্বা তোর ফুপা।এখনও যখন শব্দটা শুনি তোর ফুপাকে অনুভব করি,কি করে এই শান্তি টুকু হারাই বলতো!এবার বল তুই কেন আবার বিয়ে করছিসনা?জীবনে একা থাকাটা খুব কস্টের।
-তুমি তো থাকছো ফুপি,আমিও পারবো।
-জীবনে সব থেকে বড় সুখ কি জানিস?ভালোবাসতে পারা।কাওকে ভালোবেসে সারাজীবন কাটিয়ে দেয়া সম্ভব।কিন্তু তুই,তুই তো ভালোবাসতে পারিসনি।তুই পারবিনা একা থাকতে।
-খুব পারবো!
একাকিত্ত্বের জীবনে মানুষ নিজে নিজেই সঙ্গী বানিয়ে নেয়।ফুপিও সঙ্গী খুজে নিলেন, রং তুলির আচরে আকা ছবিতে তার ভালোবাসাকে খুজে পেলেন।বন্ধের দিনগুলোতে ফুপির সাথে আমিও আর্ট গ্যালারি গুলো চষে বেড়াই।আমারো ভালোলাগে জীবনের রুপগুলো নানা রং এ দেখতে।
গুলসানের একটা আর্ট গ্যালারির দেয়ালে চোখ বুলাতেই একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল,অন্ধকার সিড়িতে বসে আকাশের দিকে তাকানো একটি মেয়ে চোখে জমে থাকা জল পূর্নিমার আলোতে যেন সব গভীরতা হার মানায়।ফুপিকে ডেকে দেখালাম।
-হুম সুন্দর। নিবি ছবিটা।
-না ফুপি,এরকম ছবি দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়।
-হোক একটু মন খারাপ।মাঝে মাঝে অভিনয়ের জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে হয়,নয়তো নিজের বলতে দেখবি একসময় আর কিছুই নেই।
-নেব ছবিটা,মাঝে মাঝে দেখে কাদবোও।
বলতেই ফুপি পিছন ফিরে একজন কে ডেকে পাঠালেন।আলুথালু জংলী টাইপ একজনকে এগিয়ে আস্তে দেখলাম।উশকোখুশকো কোকড়া বড় চুল,মুখ ঢেকে আছে দাড়িতে,চোখে মোটা চশমা,কাধে ঝোলা ব্যাগ। চোখ দেখেই বোঝা যায় বয়স ত্রিশের উপরে হবেনা।আমাদের দিকেই এগিয়ে আসতে আসতে বলছিলেন,
-কেমন মনে হচ্ছে দিদিমনি,খুব ক্রাইসিসের মধ্যে ছিলাম মনে হচ্ছে এবার কিছুটা কমবে।
-হুম কিছুদিন পর তোমার আর ক্রাইসিস থাকবেনা এটা আমি হলফ করে বলে দিতে পারি।
-সাথে খুকি কে?
আমি কপাল কুচকে তাকালাম কারন কোন এঙ্গেলে আমাকে তার খুকি বলে মনে হচ্ছে তা আমা্র বোধগম্য হলোনা।আমিও খুকি খুকি গলায় বললাম,
-এই আঙ্কেল কে ফুপি?
-সব ছবিতে যার নাম দেখছিস, দেবাশীষ রায় সরকার।আর দেবাশীষ ও রিদিতা আমার ছোট ভাইয়ের মেয়ে।
দুজনই আমার দিকে তাকানো হয়তো প্রত্যাশা ছিল আমি কিছু বলব।আশাহত হয়ে নিজেই বলল,
-কি খুকি ছবি পছন্দ হচ্ছেনা?
-পছন্দ হবেনা আবার! আসার পর থেকে তোমার এই ছবির সাথেই আছে। এটা যে দিতে হবে দেবাশীষ! কিন্তু এবার তোমার প্রাপ্য তোমাকে নিতে হবে।
- ফ্রিতে এবার আমিও দেবনা দিদিমনি, চার দিন হতে চলল সিগারেট খাইনা। কিন্তু খুকি, এই ট্রাজেডি কেন পছন্দ হলো এত ছবি থাকতে?
-ট্রাজেডী আমার ফেভারিট ওয়ার্ড তাই।আঙ্কেল আমি পড়শোনা শেষ করে এখন জব করছি তাই আমাকে আর খুকি সম্বোধন করবেননা প্লিজ।শুনতে কেমন যেন লাগে।
-আমাকে কি আঙ্কেল মনে হয়?
-আঙ্কেলরাই খুকি ডাকে।
-দিদিমনি তোমার ভাইয়ের মেয়ে তো দেখি মহাঝগড়াটে!
-আমি মোটেও ঝগড়াটে না! ফুপি,আমি বাসায় যাব বলে গটগট করে বাইরে চলে এলাম।ছবি আর বাসায় নিতে রাজি হলাম না। ছবি ফুপির সাথে তার বাসায় গেল।
সকাল থেকে গুরিগুরি বৃষ্টি হচ্ছে,তবুও আকাশ কালো হয়ে ঢেকে আছে মেঘে।এমন দেখলে মন আপনা আপনি খারাপ হয়ে যায় ফুপির কথা মনে হলো,ফোন দিলাম
-হ্যলো
-কোথায় ফুপি?
-কেন বাসাতেই আছি আকাশের যে অবস্থা যাব আর কোথায়!
-দুপুরের রান্না কমপ্লিট?
-নাহ! ঢুকিইনি রান্না ঘরে বই পড়ছিলাম একটা।
-গুড! খিচুরি কর,দুপুরে আসছি।
-মন খারাপ লাগছে রি?
-হুম
-চলে আয়।
আমি সহযে অফিস থেকে ছুটি নিই না,আজ কাজের চাপও কম ছিল তাই বসকে বলতেই প্রথমে একটু আমতা আমতা করে পরে তিনি রাজি হলেন ছুটি দিতে।
রাস্তায় নেমে কিছুদুর হাটতেই সারা সকালের গুরি গুরি বৃষ্টি হঠাত অঝড়ে পড়তে শুরু করল। ছাতা নিয়ে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি রাস্তায় জ্যাম নেই তবু বাসের হদিস নেই। সিএনজি গুলো সব গলাকাটা ভাড়া বলছে,জেদের বশে ঠিক করলাম ভিজলে ভিজবো তবুও সিএনজি তে যাবোনা, বাসেই যাব।হঠাত হুরমুর করে ছাতার নিচে ঢুকে প্রশ্ন করল,
-কি খুকি, কেমন আছ? বৃষ্টি বিলাস করছ?
-না ঘোর বর্ষায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে বসন্ত বিলাস করছি!
-হা হা হা।যাচ্ছ নাকি কোথাও?
-চানাচুর বেচতে আসছি এখানে।
-তুমি সবসময়ই এমন রেগে থাক?
-যখন আপনার মত কোন আঙ্কেল খুকি ডাকে তখন রাগ ঠিক রাখতে পারিনা। আচ্ছা আমাকে দেখে কি আপনার স্কুল পড়ুয়া দুই ঝুটি বাধা তের চৌদ্দ বছরের বাচ্চা মেয়ে মনে হয় নাকি!
-বাহ সিনটা দারূন তো, তের চৌদ্দ বছরের বাচ্চা মেয়ে দুই ঝুটি বাধা ছাতা হাতে বৃষ্টির মধ্যে আধীর আগ্রহে কারো জন্য অপেক্ষা করছে! চমতকার!
-আমি এখানে বাসের অপেক্ষায় দাড়িয়েছি।
-অফিস নেই আজ?
উত্তরের অপেক্ষা না করেই সামনে দিয়ে যাওয়া একটা খালি রিক্সায় উঠে বসল,
-খুকি উঠে এস আমি নামিয়ে দিচ্ছি যেখানে যাবে।
-জ্বী না! আমি বাসে যাবো এবং একা যাবো।
-আরে বৃষ্টির সাথে হাওয়া দিচ্ছে,পুরো ভিজে যাচ্ছো।
-তাতে আপনার কি সমস্যা।
-সমস্যা তো আছেই, একটু পর এখানে বাংলা সিনেমার শ্যুটিং এর নায়িকা ভেবে তোমাকে দেখতে জ্যাম লেগে যাবে তখন জ্যাম পেড়িয়ে বের হতে আমার সমস্যা একটু তো হবেই।
সত্যিই পুরো ভিজে যাচ্ছিলাম,ব্যাগে ল্যাপটপ, ফোন,অফিসের দু একটা দরকারি কাগজও থাকতে পারে। তাই চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্তি ফুটিয়ে রিক্সায় উঠে বসলাম।
কিছুক্ষন রিক্সার গতি পর্যবেক্ষন করে খেয়াল করলাম রিক্সাওয়ালা বয়স্ক পানি ভেঙ্গে রিক্সা টানতে তার কস্ট হচ্ছে। বৃষ্টির তীব্রতায় প্রথমে কারো চোখেই পড়েনি রিক্সাওয়ালা যে বয়স্ক।দেবাশীষ হুঠ করেই রিক্সা থেকে নেমে তার ঝোলা ব্যাগ আমার হাতে দিয়ে বলল,
-রিক্সাওয়ালার পাশে বসতে আপ্ততি আছে?
-আপনার পাশে বসার থেকে তো শ গুন ভাল।
-কি চাচামিয়া, নামেন দেখি আপনে তো দুই দিন লাগাইবেন!উইঠা পাশে চাচীর সাথে বসেন।
-অ্যাই শোনেন ফাজলামির একটা লিমিট আছে।আমি নামবো এখানেই।
-আচ্ছা আচ্ছা সরি ভুল হয়েছে।চাচামিয়া আপনার মেয়ে তুল্য কন্যার পাশে উঠে বসেন।
-শোনেন আপনি বেশি স্মার্ট সাজার চেস্টা করবেননা!
রিক্সাওয়ালা পিটপিট চোখে মিটমিট হাসিতে আমাদের ঝগড়া উপভোগ করছেন।আবশেষে, আমি রিক্সায় বসা, দেবাশীষ রিক্সা চালাচ্ছে আর রিক্সাওয়ালা রিক্সার পেছনে হেটে হেটে আসছে। তিনি সামান্য জোরে হাটলেই আমাদের রিক্সা পেছনে ফেলতে পারবেন।
সপ্তাহখানেক পর খালার বাসায় আমার নামে পার্সেল পেলাম। একটু অবাক হলাম,খুলে দেখলাম আমার কিছু ফটোগ্রাফ,সেদিন বৃষ্টিতে ছাতা হাতে অপেক্ষার চোখে বাসের জন্য দাঁড়ানো।ছবির পিছনে ছোট্ট একটা লিখা…
“সরি না বলে ছবি তোলার জন্য,আমি লোভ সামলাতে পারিনি।–দেবাশীষ রায় সরকার।”
আমার ভালো লাগলো কারন আমার নিজেকে আমার সামনে কেও এভাবে তুলে ধরেনি,কেমন আচেনা চোখে নিজেকে দেখতে লাগলাম।
আরেকদিন শান্ত এক বিকেলে হাটার সংগী হল, অফিস থেকে ফিরছিলাম,
-কি ব্যাপার খুকি যেখানেই যাই তোমার সাথে দেখা হয়ে যায় ঘটনা কি?
-ঘটনা হল আমার মনে হয় আপনি আমার পিছু নিচ্ছেন।
-হতে পারে।আসলে আমি তোমাকেই খুজছিলাম।
-আমাকে কেন!
-আমার সাথে যাবে আমি কোথাও নিয়ে যেতে চাইলে।
-আমি কেন যাব আপনার সাথে?
-কারন আমার পাঠানো পার্সেল…
-প্রতিদান চাচ্ছেন!আমি তো বলিনি ছবি তুলতে! আপনি লুকিয়ে আমার ছবি তুলেছেন তার উপর এখন আবার তার প্রতিদান চাচ্ছেন!
-আরে রেগে যাচ্ছ কেন?প্রতিদান না হেল্প চাচ্ছি।
-আমি কেন?
-ভাবছিলাম যখন তখন তোমার চাহারা ছাড়া আর কারো চেহারা মাথায় আসেনি।
-যেতে হবে কোথায়?
-সুর্য ডোবা দেখতে যাব।
ভাবলাম ভালো তো এবার এনাকে এক হাত দেখে নেয়া যাক, বললাম
-যাব, তবে শর্ত প্রযোজ্য!
-কিসের শর্ত!
-চুল দাড়ি কাটতে হবে।
অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে সে হয়ত ভাবছে আমি মজা করছি, আমি সিরিয়াস মুড নিয়ে তাকালাম এবার।সে হেসে বলল,
-ধুর এটা কেমন শর্ত!আমি কোন শর্ত টর্ত মানতে পারবোনা খুকি!
-সরি আঙ্কেল, আমিও আপনার সাথে যেতে পারবোনা।
-সমস্যা কি?
-সমস্যা হলো আমি এমন কারো সাথে বের হবোনা যাকে টারজান ভেবে লোকজন বারবার ঘুরে তাকাবে সাথে দু এক নজর আমাকেও দেখবে কৌতুহল নিয়ে। আপনার কাটতে কি সমস্যা, উকুনের ফার্ম দেবেন নাকি?
-অসম্ভব এগুলো কাটাই যাবেনা, এগুলো না থাকলে কেঊ আর্টিস্ট বলে মানবে নাকি?
-ওকে আপনার ইচ্ছা।আসি,ভালো থাকবেন।
বলেই জোরে হে্টে সামনে চলে এলাম,পেছন থেকে আওয়াজ পেলাম,
-অই আমি রাজী।
বিজয়ের হাসি নিয়ে পিছন ফিরে দেখি করুন মুখে মাথা চুলকোচ্ছে।
চোখে ট্রেড মার্ক চশমা না থাকলে হয়ত চিনতেই পারতাম না ইনিই দেবাশীষ। দাড়ি গোফ চুল কেটে এখন একদম মানুষ মানুষ লাগছে।
-কি এখন যাওয়া যায় আমার সাথে?
-চলুন।
শেষ বিকেলের সুর্য ডোবা দেখলাম, লালচে আলোর বিকেল পেরিয়ে নীলাভ আকাশের আধার হবার নিয়তী দেখলাম পাশেই দেবাশীষের ক্যামেরার শাটারে বারবার ঝড় উঠছিল।মুগ্ধ চোখে দেখছিল লালচে আলো আধারের নীলাভ খেলা, যেন আজই প্রথম দেখছে।আকাশের হালকা মেঘ আড়াল করে চাদ উকি দিচ্ছে তখনই দেবাশীষের গম্ভীর কন্ঠ শুনতে পেলাম,
-রিদিতা যাব এখন আমরা।
-এক্ষুনি! চাদটা কেবলই তো…
-হুম এক্ষনি যাবো!
কথা কেমন যেন কানে বাজলো,আমিও আর ঘাটালাম না।চাদ দেখতে ভালো লাগছিল তবু ফিরে এলাম। সারা রাস্তা দেবাশীষের চোখে কেমন উদ্ভ্রান্ত ভাব দেখতে পেলাম কোন কথাও নেই। ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় দশটা এখন বাসায় গেলে আব্বু আম্মু হাজার প্রশ্ন করবে তাই ফুপির বাসায় নেমে গেলাম। দেবাশীষের আড়াল হবার পর থেকেই কেমন যেন অস্থির লাগছিল সেই অস্থিরতায় সারারাত কাটল, হঠাত কি হল এমন করে দেবাশীষের একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথেই তার কাছে দেবাশীষের নাম্বার চাইলাম,নাম্বার ছিল না ফুপির কাছে কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই জোগাড় করে ফেললেন।ফোন দিলাম বুঝতে পারলাম আমার কন্ঠ শোনার পরেই ফোন কেটে দিল, আবার ট্রাই করতেই এবার ফোন বন্ধ।অস্থিরতা দ্বিগুন হলো, আমি অফিস কামাই দিলাম, সারাদিন তার নাম্বার ট্রাই করলাম কিন্তু কেন নিজেরও বোধগম্য হলোনা। আমার এই অবস্থা দেখে ফুপি জানতে চাইল ঘটনা কি, আমি তাকে আদ্যপান্ত জানালাম। সব শুনে তিনি হঠাতই বলে বসলেন,
-ভালবাসিস দেবাশীষকে?
-ধুর কি বলো!
-তাহলে সকাল থেকে অফিস কামাই দিয়ে ফোন নিয়ে পড়ে আছিস কেন!
-জানিনা!
আমি সত্যিই জানিনা কেন এমন করছি, কেন এতবার ফোন করছি কেনই তার কি হলো তাতে এত ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছি আর সে হঠাত ফোন ধরলে আমিই বা কি বলবো! এই ভেবে ফোনটা দূরে রেখে জোড়াশীন হয়ে বসলাম,ভাবলাম কেন এমন করছি, ফলাফল যা পেলাম তা নিয়ে সোজা ফুপির কাছে গেলাম,
-ফুপি, তুমিই ঠিক! ভালোবেসে ফেলেছি! কিন্তু আমি মুসলমান ও হিন্দু!আর আমার অতীত?
-তোদের দোষ ওইটা! আর অতীত তো অতীত। তুই তোর গতকাল আজ ধরে রাখতে পারবিনা তেমন তোর আগামীকাল কি হবে তুই আজ ঠিক করতে পারবিনা। আজ যেটুকু তোর সাধ্যে আছে সেটুকু করে যা।
ফুপি খুব ভালো মাথা ওয়াস করতে পারেন, রাতে খাবার টেবিলে আচ্ছা মত তেল শ্যাম্পু পানি ছাড়াই আমার মাথা ওয়াস করে দিলেন। তার বীনের তালে তালে আমিও একটু পর নাচতে নাচতে বললাম, “হুম কাল সকালেই আমি দেবাশীষ কে সব বলব, তারপর যা হবার হবে!”
দিনটা মেঘলা মেঘলা ফুপির দেওয়া ঠিকানায় এসে হাজির হলাম,চারতলা বাসা সামনে বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছ। সিড়ি বেয়ে উঠে গেলাম তিনতলায়।কলিংবেল চাপলাম, তের চৌদ্দ বছরের কাজের ছেলে এসে দড়জা খুলে দিল।
-দেবাশীষ আছেন?
-আছে,কিন্তু ঘুমায়।
-ডাক দিয়ে বল একজন দেখা করতে আসছে।
-ডাকা যাইবোনা নিষেধ আছে।
-আচ্ছা তুমি দড়জা থেকে সরে দাড়াও আমি ভিতরে বসে অপেক্ষা করছি।
ঢুকেই আমি বারান্দায় উকি দিলাম,সব জিনিস খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছি আর কাজের ছেলেটা কপাল কুচকে আমাকে দেখছে।ওকে ভড়কে দেয়ার জন্য সামনের রুমে পা বাড়ালাম,সাথে সাথেই দৌড়ে এসে হাত ছড়িয়ে দড়জা আগলে দাড়ালো। এবার আমি চোখ মুখ কপাল কুচকে ভয়ঙ্কর লুক দিলাম,বেচারা আর কোন উপায় না পেয়ে মাথা নিচু করে সরে দাড়ালো।মায়াই লাগলো ছেলেটার জন্য রুমে ঢুকে ঘুরে তাকিয়ে ওকে আরেক দফা ভড়কে দিয়ে ভুবন ভুলানো হাসি দিলাম। ঘরে ঢুকে দেখি সারা রুমের মেঝেতে ছবির ছেড়া টুকরোতে ঢাকা,ছবির টুকরোতে আমাকেও খুজে পেলাম।চিন্তা ভাবনা আমার আবার ঘোলাটে রুপ ধারন করলো। ওদিকে যাহাপনা চাদর মুরি দিয়ে ঘুমুচ্ছেন,আমি চেচিয়ে বলে উঠলাম, “দেবাশীষ সাহেব আপনার সমস্যা কি?” ধরফর করে উঠে রুমে আমার উপস্থিতি তাকে অবাক করল, দাড়ি গোফ নেই লম্বা নেই তবু তাকে দিব্যি দেবদাসের মত লাগছে।
-বলি আপনার সমস্যা কি?
-কেন কি হয়েছে আর তুমি এখানে কি কর?
-আপনার ফন অফ কেন?
-চার্জ নেই।
-কই দেখি!
-চার্জ দিয়েছি এখন ফুল চার্জড
-তাহলে ফোন অন করেননি কেন?
-আচ্ছা মেয়ে তো আমার বাসায় এসে আমাকেই একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছ অথচ আমার প্রশ্নের উত্তর নেই।আর তুমি আমার রুমে কি কর? লজ্জা করেনা একটা ছেলের রুমে একা ঢুকতে?!
-আপনি ছেলে নাকি আপনি তো বুড়ো, আর বুড়ো হয়ে আপনার লজ্জা করেনা একটা পর মেয়ের ছবি নিজের রুমে রাখতে?!আমার ছবি ছিড়েছেন কেন?আপনি আমার ছবি তুলবেনই কেন আর ছিড়বেনই বা কেন?!এত ভাব কেন আপনার, সেদিন কি হয়েছিল দুই গালে দুই রসগোল্লা পুরে চলে আসলেন কোন কথা নেই ফোন ধরে পরে অফ করে দেন বুঝিনা আমি না!
-আমার যা ইচ্ছা করি তোমার কি?
-আমার অনেক কিছু কারন আমি আপনাকে ভালোবাসি,তাই আপনি আমার ছবি ছিড়বেন তা সহ্য করতে পারবোনা,আমার ফোন ধরে ফোন অফ করে দিবেন তা মেনে নিতে পারবোনা, দেবদাসের মত চাদর মুড়ি দিয়ে ঝিমুবেন তা দেখতে পারবোনা,অযথা আমার উপর রাগ দেখাবেন তা হবে না।
-ব্রেক!কি সব আবোল তাবোল বলছো নিজে বুঝতে পারছো তো!
-না বোঝার কি আছে?
-দেখো খুকি, আমি গাটছাড়া মানুষ ফ্যামিলি বা পরিবার যা ই বলো আমাকে টানতে পারেনি কখনই, কিছু মানুষ আছে যারা কখনই সংসার করতে পারেনা আমি সেই ধাচের মানুষ আমার সাথে যে জড়াতে চাইবে তাকে সারাজীবন পুড়তে হবে, আমার নিজের কোন পরিচয় নেই, কেঊ জিজ্ঞেস করলে বলা যায়না যে রাস্তায় রাস্তায় ছবি তুলে বেড়াই রংতুলিতে ছবি আকি,আমার নিজের জীবনেরই কোন ঠিক নেই আর সবথেকে বড় কথা আমার তোমার ধর্ম আলাদা।
-তো আপনি আমাকে পছন্দ করেন, কিন্তু আপনার কাছে এগুল মেইন সমস্যা!আমার এই সমস্যাতে কোন সমস্যা নেই। আমি রাজী আপনার সাথে আমার জীবন কাটাতে বা পুড়াতে যাই বলেন।এখন আপনার কথা শোনার আগে আমারো উচিত আপনাকে সব জানানো, শুনেছেন কিনা ফুপির কাছে জানিনা, আমার আগে বিয়ে হয়েছিল এই আধুনিক যুগেও ওটাকে প্রতারনা ছাড়া আর কিছু বলা যায়না। ভালোবাসতে পারিনি কখনো,আপনার মত আমি ভাবতাম কিছু মানুষ আছে যারা কখনো ভালোবাসতে পারেনা আমিও হয়তো ভালোবাসতে পারবোনা কখনো, তবে আমার ভুল ভেঙ্গেছে গত কিছুদিনে অল্পদিনের পরিচয়ে এলোমেলো একটা মানুষের প্রেমে বেশ উপর থেকেই পড়েছি নয়তো এসব ন্যাকা কথা বলার জন্য এভাবে এখানে ছুটে আসার মত মেয়ে আমি না।এখন আপনি বলুন আমাকে আপনার জীবনে জড়াতে কোন সমস্যা আছে?
-এ্যাই মেয়ে তুমি যে এখানে এভাবে এসেছ তোমার মা বাবা তোমার ফুপি জানে?
- আপনি কি আমাকে চলে যেতে বলছেন?আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি,উত্তর দিন আমি চলে যাচ্ছি।
-আমি যা বলার বলেছি উত্তর ওখান থেকেই খুজে নাও।
-ও আচ্ছা! ঠিক আছে চলে যাচ্ছি, তবে একটা কথা বলে যাই, আমি জীবনে যাকে একবার পেছনে ফেলে গেছি তার দিকে কখনো আর ফিরে তাকাইনি। আসি।
মেঝে থেকে আমার ছবির টুকরো গুলো কুড়িয়ে নিয়ে বাসায় চলে এলাম।আমার মন খারাপও লাগছেনা কান্নাও পাচ্ছেনা বড়ং এমন একটা পাগলামী করে আমার বেশ মজা লাগছে। আর শেষের ওমন ভারী ডায়লগটা দিয়ে কেমন যেন শান্তি শান্তি লাগছে।
দুইদিন পরের কথা,
সকালের চা নিয়ে আমার রুমের জানালার কাছে গিয়ে দেখি নিচে দেবাশীষ হাঠছে,সিগারেট মুখে আর বারবার বারান্দার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে।মনে মনে বললাম এসেছ দেবাদাশ এবার পার্বতীর কাছে।কিছু লোকজন কেমন চোখে দেখছে কেউ কেউ এসে আবার কি যেন জিজ্ঞেস করছে বেচারা বিপদে পরে কিনা কে জানে।আমি তৎষ্ণনাৎ বারান্দায় গিয়ে এক ঢু দিয়ে আসলাম তাকে দেখলাম এবং এমন ভাব নিলাম যেন ভুলক্রমে সে উটকো একজন আমার চোখে এসে পরেছে।সাথে সাথে রুমে চলে এলাম কিছুক্ষন পরেই আমার ফোন কম্পিত হলো আমি ফোন ধরলাম এবং তার হ্যালো শোনা মাত্রই ফোন কেটে তা অফ করে দিলাম,প্রতিশোধ যাকে বলে আর কি! পর্দার আড়াল থেকে দেখলাম সিগারেট চলছে তো চলছেই একটার আগুন দিয়ে আরেকটা জালাচ্ছে আর অনবরত ফোন দিয়েই যাচ্ছে।এর মধ্যে আবার বারান্দায় গেলাম সেই একই ভাব আবার নিলাম,মন চাচ্ছিল একটা ভেংচি কাটি কিন্তু ব্যাপারটা হালকা হয়ে যাবে ভেবে নিজেকে সামলে নিলাম।এর মধ্যেই টুপ করে ঝুপ বৃষ্টি নামলো। প্রায় একঘন্টা কাকভেজা হয়ে ভিজছে ঠোটে নিভে যাওয়া সিগারেট নিয়ে অভিমানের চোখে বারান্দার দিকে তাকানো। হঠাত খেয়াল করলাম যেন মনে হচ্ছে কিছুক্ষন পর পর সে কেপে কেপে উঠছে। আমি আর পারলাম না লুকিয়ে প্রতিশোধের খেলা খেলতে এবার যা হবে সামনা সামনিই। ছাতা একটা হাতে নিয়ে নিচে গিয়ে চেচিয়ে বললাম,
-আই আপনার সমস্যা কি? চোরের মত বাসার সামনে ঘুরঘুর করছেন কেন অনেক্ষন যাবত খেয়াল করছি।
-কথা আছে তোমার সাথে।
-কি?
-বলি তোমার সাথে কথা আছে
-আমি আপনাকে সেদিন বলে এসেছি যাকে একবার পেছনে ফেলে আসি তার দিকে কখনো আর ফিরে তাকাইনা।
-তবে আমার জন্য তো শুধু ফিরেই তাকাও নি আবার বৃষ্টির মধ্যে নিচেও নেমে এসেছ!
-কি বলতে আসছেন তারাতারি বলে এখান থেকে যান।
-না মানে আমি ভাবলাম অনেক, ভেবে দেখলাম আমি গাটছাড়া মানুষ হলেও বা পরিবার আমাকে টানতে না পারলেও কখন যে টানবেনা তা কিন্তু না কোন একসময় হয়তো মনে হতেও পারে যে হুম একটা ফ্যামিলির দরকার ছিল, আরো ভাবলাম কেউ হয়তো পারবে আমাকে দিয়ে সংসার চালাতে আর এগুলো যখন ভাবছিলাম তখন তোমার কথাই মনে হল যে হুম তুমিই পারবে আমার সাথে পুড়তে।তাই দেরি না করে চলে এলাম।
-আর আপনার পরিচয়!মানুষ তো জিজ্ঞেস করবে কি করেন তখন?
-তখন ইংরেজীতে বলবো I am a photographer and artist ওতেই হবে
-আর ধর্ম?
-এখন তো অঞ্জন দত্তের গান ধরতে হয়…ধর্ম আমার আমি নিজে বেছে নিইনি…………
-আপনি গান গাইতে পারেননা…থামেন।
-না আগে তুমি বলো তুমি রাজী কিনা আমার সাথে জীবন জড়াতে?
-শর্ত আছে।
-আবার শর্ত! আচ্ছা আচ্ছা কি শর্ত?
-এতক্ষন আপনি যা বললেন তা এবার এখানে হাটু গেড়ে বসে কানে ধরে আবার বলতে হবে।
-কেন কানে ধরে বলতে হবে কেন?
-অনেক কারন, সেদিন ভাবিস্ট সেজে বসে ছিলেন কেন? আমার ছবি ছিড়েছেন, ফোন কেটেছেন,রাগ দেখিয়েছেন এক্স্রেট্রা এক্স্রেট্রা।
আমার চোখে মুখের সিরিয়াস ভাব দেখে আর বেশি দেরি করলোনা, কান ধরার আগে করুন চোখে তাকিয়ে রইলো আমি হয়তো এই সাজা মাফ করবো এই ভেবে, কিন্তু আমার কিছুই করার নেই তারো কিছু করার নেই তাই কানটা ধরে অনর্গল সব বলে গেল। ইসস আরও বেশি মায়া পড়ে গেল ছেলেটার জন্য, তাই এগিয়ে গিয়ে তাকে ছাতার নিচে নিয়ে এলাম, সে তাকিয়ে আছে আমি বাইরের বৃষ্টি দেখছি,।
কেউ কোন কথা বলছিনা,শুধু কারো ভেজা হাতের স্পর্শে আমি বৃষ্টি ছুয়ে দিলাম।
-কেন তুমি আবার বিয়ে করলেনা?
-ভালোবাসা যে আর বাকী কিছু নেই।আমার সমস্ত ভালোবাসা আর ভালোবাসার সত্ত্বা তোর ফুপা।এখনও যখন শব্দটা শুনি তোর ফুপাকে অনুভব করি,কি করে এই শান্তি টুকু হারাই বলতো!এবার বল তুই কেন আবার বিয়ে করছিসনা?জীবনে একা থাকাটা খুব কস্টের।
-তুমি তো থাকছো ফুপি,আমিও পারবো।
-জীবনে সব থেকে বড় সুখ কি জানিস?ভালোবাসতে পারা।কাওকে ভালোবেসে সারাজীবন কাটিয়ে দেয়া সম্ভব।কিন্তু তুই,তুই তো ভালোবাসতে পারিসনি।তুই পারবিনা একা থাকতে।
-খুব পারবো!
একাকিত্ত্বের জীবনে মানুষ নিজে নিজেই সঙ্গী বানিয়ে নেয়।ফুপিও সঙ্গী খুজে নিলেন, রং তুলির আচরে আকা ছবিতে তার ভালোবাসাকে খুজে পেলেন।বন্ধের দিনগুলোতে ফুপির সাথে আমিও আর্ট গ্যালারি গুলো চষে বেড়াই।আমারো ভালোলাগে জীবনের রুপগুলো নানা রং এ দেখতে।
গুলসানের একটা আর্ট গ্যালারির দেয়ালে চোখ বুলাতেই একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল,অন্ধকার সিড়িতে বসে আকাশের দিকে তাকানো একটি মেয়ে চোখে জমে থাকা জল পূর্নিমার আলোতে যেন সব গভীরতা হার মানায়।ফুপিকে ডেকে দেখালাম।
-হুম সুন্দর। নিবি ছবিটা।
-না ফুপি,এরকম ছবি দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়।
-হোক একটু মন খারাপ।মাঝে মাঝে অভিনয়ের জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে হয়,নয়তো নিজের বলতে দেখবি একসময় আর কিছুই নেই।
-নেব ছবিটা,মাঝে মাঝে দেখে কাদবোও।
বলতেই ফুপি পিছন ফিরে একজন কে ডেকে পাঠালেন।আলুথালু জংলী টাইপ একজনকে এগিয়ে আস্তে দেখলাম।উশকোখুশকো কোকড়া বড় চুল,মুখ ঢেকে আছে দাড়িতে,চোখে মোটা চশমা,কাধে ঝোলা ব্যাগ। চোখ দেখেই বোঝা যায় বয়স ত্রিশের উপরে হবেনা।আমাদের দিকেই এগিয়ে আসতে আসতে বলছিলেন,
-কেমন মনে হচ্ছে দিদিমনি,খুব ক্রাইসিসের মধ্যে ছিলাম মনে হচ্ছে এবার কিছুটা কমবে।
-হুম কিছুদিন পর তোমার আর ক্রাইসিস থাকবেনা এটা আমি হলফ করে বলে দিতে পারি।
-সাথে খুকি কে?
আমি কপাল কুচকে তাকালাম কারন কোন এঙ্গেলে আমাকে তার খুকি বলে মনে হচ্ছে তা আমা্র বোধগম্য হলোনা।আমিও খুকি খুকি গলায় বললাম,
-এই আঙ্কেল কে ফুপি?
-সব ছবিতে যার নাম দেখছিস, দেবাশীষ রায় সরকার।আর দেবাশীষ ও রিদিতা আমার ছোট ভাইয়ের মেয়ে।
দুজনই আমার দিকে তাকানো হয়তো প্রত্যাশা ছিল আমি কিছু বলব।আশাহত হয়ে নিজেই বলল,
-কি খুকি ছবি পছন্দ হচ্ছেনা?
-পছন্দ হবেনা আবার! আসার পর থেকে তোমার এই ছবির সাথেই আছে। এটা যে দিতে হবে দেবাশীষ! কিন্তু এবার তোমার প্রাপ্য তোমাকে নিতে হবে।
- ফ্রিতে এবার আমিও দেবনা দিদিমনি, চার দিন হতে চলল সিগারেট খাইনা। কিন্তু খুকি, এই ট্রাজেডি কেন পছন্দ হলো এত ছবি থাকতে?
-ট্রাজেডী আমার ফেভারিট ওয়ার্ড তাই।আঙ্কেল আমি পড়শোনা শেষ করে এখন জব করছি তাই আমাকে আর খুকি সম্বোধন করবেননা প্লিজ।শুনতে কেমন যেন লাগে।
-আমাকে কি আঙ্কেল মনে হয়?
-আঙ্কেলরাই খুকি ডাকে।
-দিদিমনি তোমার ভাইয়ের মেয়ে তো দেখি মহাঝগড়াটে!
-আমি মোটেও ঝগড়াটে না! ফুপি,আমি বাসায় যাব বলে গটগট করে বাইরে চলে এলাম।ছবি আর বাসায় নিতে রাজি হলাম না। ছবি ফুপির সাথে তার বাসায় গেল।
সকাল থেকে গুরিগুরি বৃষ্টি হচ্ছে,তবুও আকাশ কালো হয়ে ঢেকে আছে মেঘে।এমন দেখলে মন আপনা আপনি খারাপ হয়ে যায় ফুপির কথা মনে হলো,ফোন দিলাম
-হ্যলো
-কোথায় ফুপি?
-কেন বাসাতেই আছি আকাশের যে অবস্থা যাব আর কোথায়!
-দুপুরের রান্না কমপ্লিট?
-নাহ! ঢুকিইনি রান্না ঘরে বই পড়ছিলাম একটা।
-গুড! খিচুরি কর,দুপুরে আসছি।
-মন খারাপ লাগছে রি?
-হুম
-চলে আয়।
আমি সহযে অফিস থেকে ছুটি নিই না,আজ কাজের চাপও কম ছিল তাই বসকে বলতেই প্রথমে একটু আমতা আমতা করে পরে তিনি রাজি হলেন ছুটি দিতে।
রাস্তায় নেমে কিছুদুর হাটতেই সারা সকালের গুরি গুরি বৃষ্টি হঠাত অঝড়ে পড়তে শুরু করল। ছাতা নিয়ে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি রাস্তায় জ্যাম নেই তবু বাসের হদিস নেই। সিএনজি গুলো সব গলাকাটা ভাড়া বলছে,জেদের বশে ঠিক করলাম ভিজলে ভিজবো তবুও সিএনজি তে যাবোনা, বাসেই যাব।হঠাত হুরমুর করে ছাতার নিচে ঢুকে প্রশ্ন করল,
-কি খুকি, কেমন আছ? বৃষ্টি বিলাস করছ?
-না ঘোর বর্ষায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে বসন্ত বিলাস করছি!
-হা হা হা।যাচ্ছ নাকি কোথাও?
-চানাচুর বেচতে আসছি এখানে।
-তুমি সবসময়ই এমন রেগে থাক?
-যখন আপনার মত কোন আঙ্কেল খুকি ডাকে তখন রাগ ঠিক রাখতে পারিনা। আচ্ছা আমাকে দেখে কি আপনার স্কুল পড়ুয়া দুই ঝুটি বাধা তের চৌদ্দ বছরের বাচ্চা মেয়ে মনে হয় নাকি!
-বাহ সিনটা দারূন তো, তের চৌদ্দ বছরের বাচ্চা মেয়ে দুই ঝুটি বাধা ছাতা হাতে বৃষ্টির মধ্যে আধীর আগ্রহে কারো জন্য অপেক্ষা করছে! চমতকার!
-আমি এখানে বাসের অপেক্ষায় দাড়িয়েছি।
-অফিস নেই আজ?
উত্তরের অপেক্ষা না করেই সামনে দিয়ে যাওয়া একটা খালি রিক্সায় উঠে বসল,
-খুকি উঠে এস আমি নামিয়ে দিচ্ছি যেখানে যাবে।
-জ্বী না! আমি বাসে যাবো এবং একা যাবো।
-আরে বৃষ্টির সাথে হাওয়া দিচ্ছে,পুরো ভিজে যাচ্ছো।
-তাতে আপনার কি সমস্যা।
-সমস্যা তো আছেই, একটু পর এখানে বাংলা সিনেমার শ্যুটিং এর নায়িকা ভেবে তোমাকে দেখতে জ্যাম লেগে যাবে তখন জ্যাম পেড়িয়ে বের হতে আমার সমস্যা একটু তো হবেই।
সত্যিই পুরো ভিজে যাচ্ছিলাম,ব্যাগে ল্যাপটপ, ফোন,অফিসের দু একটা দরকারি কাগজও থাকতে পারে। তাই চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্তি ফুটিয়ে রিক্সায় উঠে বসলাম।
কিছুক্ষন রিক্সার গতি পর্যবেক্ষন করে খেয়াল করলাম রিক্সাওয়ালা বয়স্ক পানি ভেঙ্গে রিক্সা টানতে তার কস্ট হচ্ছে। বৃষ্টির তীব্রতায় প্রথমে কারো চোখেই পড়েনি রিক্সাওয়ালা যে বয়স্ক।দেবাশীষ হুঠ করেই রিক্সা থেকে নেমে তার ঝোলা ব্যাগ আমার হাতে দিয়ে বলল,
-রিক্সাওয়ালার পাশে বসতে আপ্ততি আছে?
-আপনার পাশে বসার থেকে তো শ গুন ভাল।
-কি চাচামিয়া, নামেন দেখি আপনে তো দুই দিন লাগাইবেন!উইঠা পাশে চাচীর সাথে বসেন।
-অ্যাই শোনেন ফাজলামির একটা লিমিট আছে।আমি নামবো এখানেই।
-আচ্ছা আচ্ছা সরি ভুল হয়েছে।চাচামিয়া আপনার মেয়ে তুল্য কন্যার পাশে উঠে বসেন।
-শোনেন আপনি বেশি স্মার্ট সাজার চেস্টা করবেননা!
রিক্সাওয়ালা পিটপিট চোখে মিটমিট হাসিতে আমাদের ঝগড়া উপভোগ করছেন।আবশেষে, আমি রিক্সায় বসা, দেবাশীষ রিক্সা চালাচ্ছে আর রিক্সাওয়ালা রিক্সার পেছনে হেটে হেটে আসছে। তিনি সামান্য জোরে হাটলেই আমাদের রিক্সা পেছনে ফেলতে পারবেন।
সপ্তাহখানেক পর খালার বাসায় আমার নামে পার্সেল পেলাম। একটু অবাক হলাম,খুলে দেখলাম আমার কিছু ফটোগ্রাফ,সেদিন বৃষ্টিতে ছাতা হাতে অপেক্ষার চোখে বাসের জন্য দাঁড়ানো।ছবির পিছনে ছোট্ট একটা লিখা…
“সরি না বলে ছবি তোলার জন্য,আমি লোভ সামলাতে পারিনি।–দেবাশীষ রায় সরকার।”
আমার ভালো লাগলো কারন আমার নিজেকে আমার সামনে কেও এভাবে তুলে ধরেনি,কেমন আচেনা চোখে নিজেকে দেখতে লাগলাম।
আরেকদিন শান্ত এক বিকেলে হাটার সংগী হল, অফিস থেকে ফিরছিলাম,
-কি ব্যাপার খুকি যেখানেই যাই তোমার সাথে দেখা হয়ে যায় ঘটনা কি?
-ঘটনা হল আমার মনে হয় আপনি আমার পিছু নিচ্ছেন।
-হতে পারে।আসলে আমি তোমাকেই খুজছিলাম।
-আমাকে কেন!
-আমার সাথে যাবে আমি কোথাও নিয়ে যেতে চাইলে।
-আমি কেন যাব আপনার সাথে?
-কারন আমার পাঠানো পার্সেল…
-প্রতিদান চাচ্ছেন!আমি তো বলিনি ছবি তুলতে! আপনি লুকিয়ে আমার ছবি তুলেছেন তার উপর এখন আবার তার প্রতিদান চাচ্ছেন!
-আরে রেগে যাচ্ছ কেন?প্রতিদান না হেল্প চাচ্ছি।
-আমি কেন?
-ভাবছিলাম যখন তখন তোমার চাহারা ছাড়া আর কারো চেহারা মাথায় আসেনি।
-যেতে হবে কোথায়?
-সুর্য ডোবা দেখতে যাব।
ভাবলাম ভালো তো এবার এনাকে এক হাত দেখে নেয়া যাক, বললাম
-যাব, তবে শর্ত প্রযোজ্য!
-কিসের শর্ত!
-চুল দাড়ি কাটতে হবে।
অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে সে হয়ত ভাবছে আমি মজা করছি, আমি সিরিয়াস মুড নিয়ে তাকালাম এবার।সে হেসে বলল,
-ধুর এটা কেমন শর্ত!আমি কোন শর্ত টর্ত মানতে পারবোনা খুকি!
-সরি আঙ্কেল, আমিও আপনার সাথে যেতে পারবোনা।
-সমস্যা কি?
-সমস্যা হলো আমি এমন কারো সাথে বের হবোনা যাকে টারজান ভেবে লোকজন বারবার ঘুরে তাকাবে সাথে দু এক নজর আমাকেও দেখবে কৌতুহল নিয়ে। আপনার কাটতে কি সমস্যা, উকুনের ফার্ম দেবেন নাকি?
-অসম্ভব এগুলো কাটাই যাবেনা, এগুলো না থাকলে কেঊ আর্টিস্ট বলে মানবে নাকি?
-ওকে আপনার ইচ্ছা।আসি,ভালো থাকবেন।
বলেই জোরে হে্টে সামনে চলে এলাম,পেছন থেকে আওয়াজ পেলাম,
-অই আমি রাজী।
বিজয়ের হাসি নিয়ে পিছন ফিরে দেখি করুন মুখে মাথা চুলকোচ্ছে।
চোখে ট্রেড মার্ক চশমা না থাকলে হয়ত চিনতেই পারতাম না ইনিই দেবাশীষ। দাড়ি গোফ চুল কেটে এখন একদম মানুষ মানুষ লাগছে।
-কি এখন যাওয়া যায় আমার সাথে?
-চলুন।
শেষ বিকেলের সুর্য ডোবা দেখলাম, লালচে আলোর বিকেল পেরিয়ে নীলাভ আকাশের আধার হবার নিয়তী দেখলাম পাশেই দেবাশীষের ক্যামেরার শাটারে বারবার ঝড় উঠছিল।মুগ্ধ চোখে দেখছিল লালচে আলো আধারের নীলাভ খেলা, যেন আজই প্রথম দেখছে।আকাশের হালকা মেঘ আড়াল করে চাদ উকি দিচ্ছে তখনই দেবাশীষের গম্ভীর কন্ঠ শুনতে পেলাম,
-রিদিতা যাব এখন আমরা।
-এক্ষুনি! চাদটা কেবলই তো…
-হুম এক্ষনি যাবো!
কথা কেমন যেন কানে বাজলো,আমিও আর ঘাটালাম না।চাদ দেখতে ভালো লাগছিল তবু ফিরে এলাম। সারা রাস্তা দেবাশীষের চোখে কেমন উদ্ভ্রান্ত ভাব দেখতে পেলাম কোন কথাও নেই। ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় দশটা এখন বাসায় গেলে আব্বু আম্মু হাজার প্রশ্ন করবে তাই ফুপির বাসায় নেমে গেলাম। দেবাশীষের আড়াল হবার পর থেকেই কেমন যেন অস্থির লাগছিল সেই অস্থিরতায় সারারাত কাটল, হঠাত কি হল এমন করে দেবাশীষের একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথেই তার কাছে দেবাশীষের নাম্বার চাইলাম,নাম্বার ছিল না ফুপির কাছে কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই জোগাড় করে ফেললেন।ফোন দিলাম বুঝতে পারলাম আমার কন্ঠ শোনার পরেই ফোন কেটে দিল, আবার ট্রাই করতেই এবার ফোন বন্ধ।অস্থিরতা দ্বিগুন হলো, আমি অফিস কামাই দিলাম, সারাদিন তার নাম্বার ট্রাই করলাম কিন্তু কেন নিজেরও বোধগম্য হলোনা। আমার এই অবস্থা দেখে ফুপি জানতে চাইল ঘটনা কি, আমি তাকে আদ্যপান্ত জানালাম। সব শুনে তিনি হঠাতই বলে বসলেন,
-ভালবাসিস দেবাশীষকে?
-ধুর কি বলো!
-তাহলে সকাল থেকে অফিস কামাই দিয়ে ফোন নিয়ে পড়ে আছিস কেন!
-জানিনা!
আমি সত্যিই জানিনা কেন এমন করছি, কেন এতবার ফোন করছি কেনই তার কি হলো তাতে এত ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছি আর সে হঠাত ফোন ধরলে আমিই বা কি বলবো! এই ভেবে ফোনটা দূরে রেখে জোড়াশীন হয়ে বসলাম,ভাবলাম কেন এমন করছি, ফলাফল যা পেলাম তা নিয়ে সোজা ফুপির কাছে গেলাম,
-ফুপি, তুমিই ঠিক! ভালোবেসে ফেলেছি! কিন্তু আমি মুসলমান ও হিন্দু!আর আমার অতীত?
-তোদের দোষ ওইটা! আর অতীত তো অতীত। তুই তোর গতকাল আজ ধরে রাখতে পারবিনা তেমন তোর আগামীকাল কি হবে তুই আজ ঠিক করতে পারবিনা। আজ যেটুকু তোর সাধ্যে আছে সেটুকু করে যা।
ফুপি খুব ভালো মাথা ওয়াস করতে পারেন, রাতে খাবার টেবিলে আচ্ছা মত তেল শ্যাম্পু পানি ছাড়াই আমার মাথা ওয়াস করে দিলেন। তার বীনের তালে তালে আমিও একটু পর নাচতে নাচতে বললাম, “হুম কাল সকালেই আমি দেবাশীষ কে সব বলব, তারপর যা হবার হবে!”
দিনটা মেঘলা মেঘলা ফুপির দেওয়া ঠিকানায় এসে হাজির হলাম,চারতলা বাসা সামনে বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছ। সিড়ি বেয়ে উঠে গেলাম তিনতলায়।কলিংবেল চাপলাম, তের চৌদ্দ বছরের কাজের ছেলে এসে দড়জা খুলে দিল।
-দেবাশীষ আছেন?
-আছে,কিন্তু ঘুমায়।
-ডাক দিয়ে বল একজন দেখা করতে আসছে।
-ডাকা যাইবোনা নিষেধ আছে।
-আচ্ছা তুমি দড়জা থেকে সরে দাড়াও আমি ভিতরে বসে অপেক্ষা করছি।
ঢুকেই আমি বারান্দায় উকি দিলাম,সব জিনিস খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছি আর কাজের ছেলেটা কপাল কুচকে আমাকে দেখছে।ওকে ভড়কে দেয়ার জন্য সামনের রুমে পা বাড়ালাম,সাথে সাথেই দৌড়ে এসে হাত ছড়িয়ে দড়জা আগলে দাড়ালো। এবার আমি চোখ মুখ কপাল কুচকে ভয়ঙ্কর লুক দিলাম,বেচারা আর কোন উপায় না পেয়ে মাথা নিচু করে সরে দাড়ালো।মায়াই লাগলো ছেলেটার জন্য রুমে ঢুকে ঘুরে তাকিয়ে ওকে আরেক দফা ভড়কে দিয়ে ভুবন ভুলানো হাসি দিলাম। ঘরে ঢুকে দেখি সারা রুমের মেঝেতে ছবির ছেড়া টুকরোতে ঢাকা,ছবির টুকরোতে আমাকেও খুজে পেলাম।চিন্তা ভাবনা আমার আবার ঘোলাটে রুপ ধারন করলো। ওদিকে যাহাপনা চাদর মুরি দিয়ে ঘুমুচ্ছেন,আমি চেচিয়ে বলে উঠলাম, “দেবাশীষ সাহেব আপনার সমস্যা কি?” ধরফর করে উঠে রুমে আমার উপস্থিতি তাকে অবাক করল, দাড়ি গোফ নেই লম্বা নেই তবু তাকে দিব্যি দেবদাসের মত লাগছে।
-বলি আপনার সমস্যা কি?
-কেন কি হয়েছে আর তুমি এখানে কি কর?
-আপনার ফন অফ কেন?
-চার্জ নেই।
-কই দেখি!
-চার্জ দিয়েছি এখন ফুল চার্জড
-তাহলে ফোন অন করেননি কেন?
-আচ্ছা মেয়ে তো আমার বাসায় এসে আমাকেই একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছ অথচ আমার প্রশ্নের উত্তর নেই।আর তুমি আমার রুমে কি কর? লজ্জা করেনা একটা ছেলের রুমে একা ঢুকতে?!
-আপনি ছেলে নাকি আপনি তো বুড়ো, আর বুড়ো হয়ে আপনার লজ্জা করেনা একটা পর মেয়ের ছবি নিজের রুমে রাখতে?!আমার ছবি ছিড়েছেন কেন?আপনি আমার ছবি তুলবেনই কেন আর ছিড়বেনই বা কেন?!এত ভাব কেন আপনার, সেদিন কি হয়েছিল দুই গালে দুই রসগোল্লা পুরে চলে আসলেন কোন কথা নেই ফোন ধরে পরে অফ করে দেন বুঝিনা আমি না!
-আমার যা ইচ্ছা করি তোমার কি?
-আমার অনেক কিছু কারন আমি আপনাকে ভালোবাসি,তাই আপনি আমার ছবি ছিড়বেন তা সহ্য করতে পারবোনা,আমার ফোন ধরে ফোন অফ করে দিবেন তা মেনে নিতে পারবোনা, দেবদাসের মত চাদর মুড়ি দিয়ে ঝিমুবেন তা দেখতে পারবোনা,অযথা আমার উপর রাগ দেখাবেন তা হবে না।
-ব্রেক!কি সব আবোল তাবোল বলছো নিজে বুঝতে পারছো তো!
-না বোঝার কি আছে?
-দেখো খুকি, আমি গাটছাড়া মানুষ ফ্যামিলি বা পরিবার যা ই বলো আমাকে টানতে পারেনি কখনই, কিছু মানুষ আছে যারা কখনই সংসার করতে পারেনা আমি সেই ধাচের মানুষ আমার সাথে যে জড়াতে চাইবে তাকে সারাজীবন পুড়তে হবে, আমার নিজের কোন পরিচয় নেই, কেঊ জিজ্ঞেস করলে বলা যায়না যে রাস্তায় রাস্তায় ছবি তুলে বেড়াই রংতুলিতে ছবি আকি,আমার নিজের জীবনেরই কোন ঠিক নেই আর সবথেকে বড় কথা আমার তোমার ধর্ম আলাদা।
-তো আপনি আমাকে পছন্দ করেন, কিন্তু আপনার কাছে এগুল মেইন সমস্যা!আমার এই সমস্যাতে কোন সমস্যা নেই। আমি রাজী আপনার সাথে আমার জীবন কাটাতে বা পুড়াতে যাই বলেন।এখন আপনার কথা শোনার আগে আমারো উচিত আপনাকে সব জানানো, শুনেছেন কিনা ফুপির কাছে জানিনা, আমার আগে বিয়ে হয়েছিল এই আধুনিক যুগেও ওটাকে প্রতারনা ছাড়া আর কিছু বলা যায়না। ভালোবাসতে পারিনি কখনো,আপনার মত আমি ভাবতাম কিছু মানুষ আছে যারা কখনো ভালোবাসতে পারেনা আমিও হয়তো ভালোবাসতে পারবোনা কখনো, তবে আমার ভুল ভেঙ্গেছে গত কিছুদিনে অল্পদিনের পরিচয়ে এলোমেলো একটা মানুষের প্রেমে বেশ উপর থেকেই পড়েছি নয়তো এসব ন্যাকা কথা বলার জন্য এভাবে এখানে ছুটে আসার মত মেয়ে আমি না।এখন আপনি বলুন আমাকে আপনার জীবনে জড়াতে কোন সমস্যা আছে?
-এ্যাই মেয়ে তুমি যে এখানে এভাবে এসেছ তোমার মা বাবা তোমার ফুপি জানে?
- আপনি কি আমাকে চলে যেতে বলছেন?আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি,উত্তর দিন আমি চলে যাচ্ছি।
-আমি যা বলার বলেছি উত্তর ওখান থেকেই খুজে নাও।
-ও আচ্ছা! ঠিক আছে চলে যাচ্ছি, তবে একটা কথা বলে যাই, আমি জীবনে যাকে একবার পেছনে ফেলে গেছি তার দিকে কখনো আর ফিরে তাকাইনি। আসি।
মেঝে থেকে আমার ছবির টুকরো গুলো কুড়িয়ে নিয়ে বাসায় চলে এলাম।আমার মন খারাপও লাগছেনা কান্নাও পাচ্ছেনা বড়ং এমন একটা পাগলামী করে আমার বেশ মজা লাগছে। আর শেষের ওমন ভারী ডায়লগটা দিয়ে কেমন যেন শান্তি শান্তি লাগছে।
দুইদিন পরের কথা,
সকালের চা নিয়ে আমার রুমের জানালার কাছে গিয়ে দেখি নিচে দেবাশীষ হাঠছে,সিগারেট মুখে আর বারবার বারান্দার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে।মনে মনে বললাম এসেছ দেবাদাশ এবার পার্বতীর কাছে।কিছু লোকজন কেমন চোখে দেখছে কেউ কেউ এসে আবার কি যেন জিজ্ঞেস করছে বেচারা বিপদে পরে কিনা কে জানে।আমি তৎষ্ণনাৎ বারান্দায় গিয়ে এক ঢু দিয়ে আসলাম তাকে দেখলাম এবং এমন ভাব নিলাম যেন ভুলক্রমে সে উটকো একজন আমার চোখে এসে পরেছে।সাথে সাথে রুমে চলে এলাম কিছুক্ষন পরেই আমার ফোন কম্পিত হলো আমি ফোন ধরলাম এবং তার হ্যালো শোনা মাত্রই ফোন কেটে তা অফ করে দিলাম,প্রতিশোধ যাকে বলে আর কি! পর্দার আড়াল থেকে দেখলাম সিগারেট চলছে তো চলছেই একটার আগুন দিয়ে আরেকটা জালাচ্ছে আর অনবরত ফোন দিয়েই যাচ্ছে।এর মধ্যে আবার বারান্দায় গেলাম সেই একই ভাব আবার নিলাম,মন চাচ্ছিল একটা ভেংচি কাটি কিন্তু ব্যাপারটা হালকা হয়ে যাবে ভেবে নিজেকে সামলে নিলাম।এর মধ্যেই টুপ করে ঝুপ বৃষ্টি নামলো। প্রায় একঘন্টা কাকভেজা হয়ে ভিজছে ঠোটে নিভে যাওয়া সিগারেট নিয়ে অভিমানের চোখে বারান্দার দিকে তাকানো। হঠাত খেয়াল করলাম যেন মনে হচ্ছে কিছুক্ষন পর পর সে কেপে কেপে উঠছে। আমি আর পারলাম না লুকিয়ে প্রতিশোধের খেলা খেলতে এবার যা হবে সামনা সামনিই। ছাতা একটা হাতে নিয়ে নিচে গিয়ে চেচিয়ে বললাম,
-আই আপনার সমস্যা কি? চোরের মত বাসার সামনে ঘুরঘুর করছেন কেন অনেক্ষন যাবত খেয়াল করছি।
-কথা আছে তোমার সাথে।
-কি?
-বলি তোমার সাথে কথা আছে
-আমি আপনাকে সেদিন বলে এসেছি যাকে একবার পেছনে ফেলে আসি তার দিকে কখনো আর ফিরে তাকাইনা।
-তবে আমার জন্য তো শুধু ফিরেই তাকাও নি আবার বৃষ্টির মধ্যে নিচেও নেমে এসেছ!
-কি বলতে আসছেন তারাতারি বলে এখান থেকে যান।
-না মানে আমি ভাবলাম অনেক, ভেবে দেখলাম আমি গাটছাড়া মানুষ হলেও বা পরিবার আমাকে টানতে না পারলেও কখন যে টানবেনা তা কিন্তু না কোন একসময় হয়তো মনে হতেও পারে যে হুম একটা ফ্যামিলির দরকার ছিল, আরো ভাবলাম কেউ হয়তো পারবে আমাকে দিয়ে সংসার চালাতে আর এগুলো যখন ভাবছিলাম তখন তোমার কথাই মনে হল যে হুম তুমিই পারবে আমার সাথে পুড়তে।তাই দেরি না করে চলে এলাম।
-আর আপনার পরিচয়!মানুষ তো জিজ্ঞেস করবে কি করেন তখন?
-তখন ইংরেজীতে বলবো I am a photographer and artist ওতেই হবে
-আর ধর্ম?
-এখন তো অঞ্জন দত্তের গান ধরতে হয়…ধর্ম আমার আমি নিজে বেছে নিইনি…………
-আপনি গান গাইতে পারেননা…থামেন।
-না আগে তুমি বলো তুমি রাজী কিনা আমার সাথে জীবন জড়াতে?
-শর্ত আছে।
-আবার শর্ত! আচ্ছা আচ্ছা কি শর্ত?
-এতক্ষন আপনি যা বললেন তা এবার এখানে হাটু গেড়ে বসে কানে ধরে আবার বলতে হবে।
-কেন কানে ধরে বলতে হবে কেন?
-অনেক কারন, সেদিন ভাবিস্ট সেজে বসে ছিলেন কেন? আমার ছবি ছিড়েছেন, ফোন কেটেছেন,রাগ দেখিয়েছেন এক্স্রেট্রা এক্স্রেট্রা।
আমার চোখে মুখের সিরিয়াস ভাব দেখে আর বেশি দেরি করলোনা, কান ধরার আগে করুন চোখে তাকিয়ে রইলো আমি হয়তো এই সাজা মাফ করবো এই ভেবে, কিন্তু আমার কিছুই করার নেই তারো কিছু করার নেই তাই কানটা ধরে অনর্গল সব বলে গেল। ইসস আরও বেশি মায়া পড়ে গেল ছেলেটার জন্য, তাই এগিয়ে গিয়ে তাকে ছাতার নিচে নিয়ে এলাম, সে তাকিয়ে আছে আমি বাইরের বৃষ্টি দেখছি,।
কেউ কোন কথা বলছিনা,শুধু কারো ভেজা হাতের স্পর্শে আমি বৃষ্টি ছুয়ে দিলাম।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন