bristi veja monআজ বৃষ্টি নেমেছে। কাজে যেতে ইচ্ছে করছে না স্বপ্নের। কিন্তু ওকে যেতেই হবে। না গেলে যে মেঘকে দেখতে পারবে না। তখন সারাদিন ছটফট করে মরতে হবে। মেঘ ওদের সাথে একি সেকশনে কাজ করে।মেয়েটাকে ও নিজের চেয়েও বেশী ভালোবাসে। কিন্তু কোনোদিনও সে তাকে মুখ ফুটে বলতে পারেনি। অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু লাভ হয়নি। এমনিতেই ওর সাথে কথা বলতে কোন সমস্যা হয় না। কিন্তূ ওর ভালবাসার কথা বলতে গেলেই কেমন জানি হয়ে যায় স্বপ্ন।

অনেক কষ্টে ঘুম থেকে উঠে চাকরিতে গেল স্বপ্ন। একটু পর পর মেঘের দিকে তাকাচ্ছে। মেয়েটাও কেমন যেন বুঝেও না বুঝার ভান করে সব কিছু। ও বুঝতে পারছে স্বপ্ন ওর দিকে তাকিয়ে আছে তারপর ও স্বপ্নের দিকে একটুও তাকিয়ে দেখছে না। এমন সময় স্বপ্নের এক বন্ধু পিছন থেকে বলে উঠলো, "কিরে শুধু দেখেই যাবি, কিছুই বলবিনা?" স্বপ্ন বললো, "সময় হলেই বলব। ভয় লাগে যদি ফিরিয়ে দেয়।"
ওর বন্ধু বললো, "ভয় করিস না। বলে দে চোখ বুজে দেখবি হয়ে যাবে। চিন্তা করিস না।"
স্বপ্ন আর কিছু বলল না।
এভাবেই ২ মাস কেটে গেল। এর মাঝে স্বপ্ন নিজেকে ধীরে ধীরে নিজেকে মেঘের জন্য তৈরী করে নিল। সে ঠিক করলো ২৪ তারিখ মেঘকে প্রপোজ করবে। এর মাঝে অনেকবার দুজনের চোখাচোখি হয়েছে। স্বপ্ন অনেক ভাবেই মেঘকে বুঝাতে চেয়েছে, কিন্তু মেঘ বুঝেনি বা বুঝতে চায়নি।
আজ ২৪ তারিখ। আজ যেভাবেই হোক মেঘকে নিজের ভালোবাসার কথা বলবে স্বপ্ন।

আজকে কয়েকবার চোখাচোখি হলো দুইজনের কিন্তু কেউ কাউকে কিছু বলল না। গার্মেন্টস ছুটি হলে স্বপ্ন মেঘের পিছু পিছু হাঁটতে লাগলো। মেঘের বাসা কাছে হওয়ায় সে হেঁটে হেঁটেই বাসায় যায়। কিছুদুর যাওয়ার পর মেঘ একা হলে একটু জোরে হেঁটে মেঘের কাছে আসল স্বপ্ন। তারপর সে মেঘকে বলল, "তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো। আমাকে কি একটু সময় দিতে পারবে?"
মেঘ বলল, "কি বলেন?"
স্বপ্ন বলল, "আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তুমি কি আমাকে একটু জায়গা দিতে
পারবে তোমার মনের মাঝে যাতে আমি সারাটা জীবন তোমার পাশে থাকতে পারি।"
মেঘ কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকলো, "দেখ প্রেম বা ভালবাসার আমার কাছে কোন মূল্য নেই। আসলে আমি আছেব নিয়ে কখনো চিন্তাও করিনি। আমার উপর আমার পঙ্গু বাবা, আমার মা আর ২ বোন নির্ভর করে আসে। তাই এসব আমার কাছে বিলাসিতার মত। আমি এসব নিয়ে ভাবতেও চাই না।"
স্বপ্ন বললো," আমি কখনো তোমার কোন কাজেই বাধা হব না। প্লিজ আমাকে একটা সুযোগ দাও তোমার হাত দুটো ধরার। আমি শুধু তোমার চোখে চোখ রেখে সারাটা জীবন কাটাতে চাই। তুমি যদি না চাও তবে আমি তোমার চলার পথের বাধা হব না।"
মেঘ বললো," ঠিক আছে। আমাকে ১ সপ্তাহ সময় দাও। আমি চিন্তা ভাবনা করে দেখি। আমি তোমাকে সামনের বৃহস্পতিবার আমার সিদ্ধান্তের কথা তোমাকে জানাব।"
এরপর মেঘ হেটে চলে গেল। স্বপ্ন তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ।
মেঘ পথ শেষে মিলিয়ে যাওয়ার পর স্বপ্ন ধীরে ধীরে তার নিজের বাসায় ফিরে এলো।

হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল স্বপ্নের। মেঘ তো তাকে আজকেই কোন সিদ্ধান্ত দিয়ে দিতে পারতো। যদি মেঘ বৃহস্পতিবার বলে যে, মেঘ ওকে ভালোবাসে না তবে ও কি করবে? ও তো মেঘ কে ছাড়া বাচতে পারবেনা। এই চিন্তায় চিন্তায় স্বপ্নের রাতে ঘুম হয় না। কিভাবে ও এই সপ্তাহটা কাটাবে?
নির্ঘুম রাত কাটাতে কাটাতে মঙ্গলবার চলে আসে।
মঙ্গলবার:
আজ তাদের অফিস বিল্ডিংয়ে একটা ফাটল দেখা দিয়েছে। সে মেঘকে বললো,"কাল চাকরিতে এসোনা। বলা যায়না কখন কি হয়ে যায়। বিল্ডিংয়ে ফাটল দেখা দিয়েছে।"
মেঘ বললো,"কাল চাকরিতে না আসলে বেতন দিবেনা। আমার জন্য একদিনের বেতন ও অনেক কিছু। আমার এই সামান্য বেতনের উপর ৫ জনের সংসার নির্ভর করছে। তাই আমি না চাইলেও আমার আসতে হবে।"
স্বপ্ন আর কিছু বললো না।
বুধবার:
আজ চাকরিতে আসার কোনো ইচ্ছে ছিলোনা স্বপ্নের। কিন্তু সে এসেছে মেঘকে দেখতে। অনেকক্ষণ সে মেঘের দিকে তাকিয়ে ছিলো। একসময় মেঘ বুঝতে পারলো যে স্বপ্ন ওর দিক্‌তে দিকে আছে। মেঘ স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিল। কিছুক্ষণ পর ফ্যাক্টরি থেকে বের হয়ে এলো চা খাওয়ার জন্য। সে বিল্ডিংয়ের সামনের একটা চায়ের দোকানে চা খেতে বসলো।

চা খাচ্ছে এমনসময় চারিদিকে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হলো। চারিদিকে ধুলোবালি উড়তে লাগল। কি হয়েছে দেখার জন্য ছুটে দোকানের বাইরে বেরিয়ে এলো স্বপ্ন। বাইরে প্রচুর ধুলোবালি উড়ছে। এই ধুলোবালির উৎস ওদের গার্মেন্টস। কি হয়েছে দেখার জন্য স্বপ্ন দৌড়ে সামনে এগিয়ে গেল। ওর মনে এক অজানা আশংকা নাড়া দিয়ে উঠল। মেঘের কিছু হলো নাকি? সামনে যেয়ে সে দেখল তাতে স্বপ্ন স্তম্বিত হয়ে গেল। ওদের অফিস বিল্ডিংটা ধসে পড়েছে। এ দৃশ্য দেখে পাগলের মতো হয়ে গেল স্বপ্ন। দিকবিদিক্‌শূন্য হয়ে সে ছুটে গেল ধসে পড়া বিল্ডিংয়ের উপর। পাগলের মত পাথর সরাতে লাগল আর দুচোখের কোল বেয়ে অশ্রু বেয়ে পড়ছে। ও শুধু মেঘের নাম ধরে ডাকছে আর পাথর সরাচ্ছে। ওর এই পাগলামি দেখে স্থানীয় লোকেরা ওকে নিয়ে দূরে একটা জায়গায় বসিয়ে দেয়। ও সেখানে বসে বসে কাঁদতে থাকে। ততোক্ষনে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার কাজ শুরু করে দিয়েছে। কিছুক্ষন পর ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা এসে ঊদ্ধার কাজ শুরু করল। আর স্বপ্ন? সে বসে আছে তার বুক ভরা আশা নিয়ে, মেঘ আবারও ফিরে আসবে তার কাছে। কিন্তু কখন? আস্তে আস্তে দুপুর গড়িয়ে গেল, বিকেল গড়িয়ে গেল। কিন্তু কৈ মেঘকে তো কেউ বের করল না। তবে কি মেঘ? না তা হতে পারে না। তাকে জবাব না দিয়ে মেঘ কোথায় যাবে না। আস্তে আস্তে রাত চলে এলো তারপরও মেঘের কোনো খবর নেই। এবার নিজেকে সামলে স্বপ্ন নিজে উদ্ধার কাজে যোগ দিলো। অনেক ছোট ছোট ফাটল দিয়ে ঢুকে সে মেঘকে অনেক খুঁজল। কিন্তু
পেল না। এর মাঝে সে অনেক লোক কে বাঁচিয়েছে। কিন্তু সে যাকে খুঁজছে তার কোন দেখা নেই।
সকাল ৯ টা:
একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বসেছে স্বপ্ন। এখনও সে মেঘকে খুঁজে পায়নি। অনেক খুঁজেছে কিন্তু কোথায় যে ছিলো। ফ্লোর ভাঙতে ভাঙতে ওর হাত ব্যাথা হয়ে গেছে। একটু বিশ্রাম নিয়ে উঠতে যাবে এমন সময় দেখল স্ট্রেচারে করে একটা মেয়েকে নিয়ে আসা হচ্ছে দেখতে ঠিক মেঘেরই মত। হ্যাঁ। এই রংয়ের জামাটাই তো পড়ে ছিলো মেঘ। ছুটে যায় স্বপ্ন। ছুটে গিয়ে স্বপ্ন মেঘের সামনে দাড়ায়। মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে মেঘ। তখনও তার প্রাণ ছিলো। স্বপ্নের দিকে এক পলক তাকালো মেঘ। ছেলেটার চেহারার এই হাল কেন? এভাবে কাঁদছে কেন ছেলেটা? মেঘ মুখ খুলল,"তোমার সাথে আর কথা বলা হবে না। তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম তোমায় আমি কতটুকু ভালোবাসি। আর বলা হলনা। চেয়েছিলাম শুক্রবার দিনটা তোমার সাথে কাটাব। তাও হলনা। ভুল বুঝো না আমায় আমি তোমারি ছিলাম।"
হো হো করে কেঁদে উঠে স্বপ্ন,"দেখ কিছু হবে না তোমার। আমি আছি না। দেখবে আবার ভাল হয়ে যাবে তুমি।"
তাড়াতাড়ি মেঘকে এম্বুলেন্‌সে তুলল স্বপ্ন। ছুটে চলল মেডিকেলের দিকে। তখনও কেঁদে যাচ্ছে স্বপ্ন। আস্তে আস্তে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো মেঘ। কোন নড়াচড়া নেই মেঘের। স্বপ্ন মনে করলো মেঘ ঘুমিয়ে পড়েছে।
মেডিকেলে পৌছালো ওরা, মেডিকেলের স্টুডেন্টরা ছুটে এলো মেঘকে ভিতরে ঢুকানোর জন্য। স্বপ্নও গেল ওদের পিছু পিছু। ডাক্তার মেঘকে পরীক্ষা করে বললো,"সে আর বেচে নেই।"
স্বপ্ন কিছুই বলতে পারছিল না। তার চোখ দিয়ে জল পড়া বন্ধ হয়ে গেল। আস্তে আস্তে সে পিছন দিকে হাঁটতে লাগলো। ধীরে ধীরে সে মেডিকেল থেকে বের হয়ে এলো।

আজও সাভারের রানা প্লাজার সামনে একটা ছেলেকে ঘুরতে দেখা যায়। সে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকে মেঘের আশায়। আকাশে মেঘ জমলে সে তাকিয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে। কখন তা বৃষ্টি হয়ে নেমে আসবে ধরায়। ছুঁয়ে দেবে তাকে। এই অপেক্ষায়।
 
Top