তুমি সত্যিই ডোবাবে আমাকে একদিন।/ লাল ঠোঁট নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোলে/
লাল ঠোঁট নিয়েই বাড়ি ফেরা উচিত/ আর না ফিরলে সেই ফ্যাকাশে ঠোঁটের দিকে/
শুরু হয়ে যেতে পারে লাল-চোখের তল্লাশী/ এটা কি পেরেক মেরে ঢোকাতে হবে আপনার মগজে?/ শুভঙ্কর, প্লীজ! ডাকাতেপনাটা একটু কমাও। (পূর্ণেন্দু পত্রী)
সকালের কৃষ্ণকলি মেঘ যে এভাবে ডিসেম্বরের ভর দুপুরে বৃষ্টি ডেকে আনবে, এতটাই বা কে ভেবেছিল! নিম্ননাভি ক্ষীণমধ্যা, প্রিয়দর্শিনী মেঘবালিকার হাত ধরে শীত সন্ধের কলকাতা তাই, টিপিস টিপিস বৃষ্টি জলে ভিজে যেন ছলবলি মধুশালা! মধ্য একুশের রঞ্জা-ও সকাল থেকে সজল বাতাসে ভাসিয়ে দিয়েছে মেঘপিওনের চিঠি। কালিদাস থেকে রবিঠাকুর, মায় সুমনের বাদল দিনের গানে সিক্ত ওর প্রতিটি সাইবার-সংলাপ। সেলফোনে টেক্সট চালাচালি করতে করতে একসময় মনে হল ইনবক্স উপচে তুমুল শ্রাবণ নামল বুঝি আমার দু’হাতে।
নিশিঠেকের উদ্দেশ্যে পথে নেমে ঝির-ঝির বৃষ্টির ভিতর প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটে হাঁটতে হাঁটতে, প্রথম শীতের এমন মহার্ঘ্য বাদলানিতে কেন জানি না, নাকে চাঁপার গন্ধ এসে লাগল। রঞ্জার কথা ভাবতে ভাবতে ওকে নিবেদন করে তাই ফিসফিসিয়ে পূর্ণেন্দু আউড়ালাম, ‘আজকে তুমি প্রথম শ্রাবণ, সঙ্গে চাঁপার গন্ধ/ মাখবো’? রঞ্জা এখন কোথায়?
কথা আর উপকথনে সেই দুপুরেই রঞ্জা উষ্ণতার আমন্ত্রণে জানিয়ে ছিল, ও এমন ঠাণ্ডি দিনে আমাকে নিয়ে যাবে সরগরম এক পানশালায়। ১৮, এ-র পার্ক স্ট্রিটের, পিটার ক্যাটে। ‘দ্য স্ট্রিট দ্যাট নেভার স্লিপস’- চির বিনিদ্রিত পার্ক স্ট্রিটের পিটার ক্যাটের ঠিকানায় পৌঁছে, ট্যাক্সি থেকে নেমেই দেখি, রেস্তোরাঁর একচিলতে আশ্রয়ের নিচে দাঁড়িয়ে ও।
কালো ঢাকাই জামদানির আঁচলকে সহবত শেখাতে শেখাতে কার সঙ্গে যেন সেলফোনে কথা বলছে রঞ্জা। ট্যাক্সিটা ছেড়ে দু’ দণ্ড দাঁড়িয়ে ওকে দেখলাম অপলক। কালো জামদানির জমিতে যেন চন্দনবনের সুখের জয়জয়ন্তী বিস্তার। হাজার বুটির কারুশালা। পাড়ে সরু তামারঙ ফিতের নদীরেখা। কালো ডিপ স্কোয়ার কাট ব্লাউজের খুল্লমখুল্লা পিঠের দিকটা একটু বেশি নির্জন। ওর এলো খোপায় ডোকরার শাণিত কাঁটা। সঙ্গে কারিগর হাটের তামরঙা অক্সিডাইজের পরিশীলিত অঙ্গসাজে রঞ্জাকে দেখে এই ভিখু জন্মের ইচ্ছে হল ডাকাত হতে। নাহ! দুঃসাহস এবার সত্যিই কোনদিন ডাকাতি করে ছাড়বে!
- এমন দিনে ঘরে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম জানো ফকির। মনে হচ্ছিল কলকাতা যেন মেঘের ধূসর ডানায় ঢাকা পড়ে যাবে এক্ষুনি! পার্ক স্ট্রিটের ফুটপাত বদলে যাবে জল রঙের ক্যানভাসে। মাথার মধ্যে অমনি পিটার ক্যাটে বসার পাগলামির নেশা পেয়ে বসল…
- রঞ্জা, রবিঠাকুর আর সুমনের গানে তুমি তো সেই কবেই- কোন দুপুরে দজ্জাল বৃষ্টি নামিয়েছ শহরের দরজা-জানলা হাট করে। এই দ্যাখো, দ্যাখো না… তোমার পাঠানো মেঘ-জলে কথায় ভিজে একসা আমার সেলফোন। আমার পকেটের গহন কোটর, যেখানে রাখা ছিল তোমার বৃষ্টি-ধ্বনির আগাম বার্তা। সারা শরীর জুড়ে মেঘ-বৃষ্টির দারুণ খপ্পর!
রঞ্জার কথার জবাবে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলতে বলতে রেস্তোরাঁর মন্দ্রসুরে প্রায় ভেসে সিঁড়িতে উঠছিলাম। ঠিক আমার সামনে দিয়ে উঠতে উঠতে দোলনমায়ার ছন্দ থামিয়ে, মৃদু শাসনের অছিলায় ফিরে মেয়ে বলল,
- তুমি আজকাল বড্ড বেশি ভাবুক!
জবাবে ওর দিকে ওত পেতে শক্তির সেই অমোঘ লাইনগুলি বললাম,
- কষ্ট হয়তো একটু হবে, এই তো ছিরির ঘর/ আমার কাছে অল্প সময় বাইরে অতঃপর-/ বৃষ্টি ভালো লাগছে যখন, পদ্মপাতায় রাখুক।/ ওইটুকু তো মেয়ে/ ছোট্ট আমার চেয়ে/ এতই যদি লজ্জা তাহার, দু’ হাতে মুখ ঢাকুক/ আমার কাছে থাকুক, তবু আমার কাছে থাকুক!
আমার কথায় প্রশয়ের চাহনি পেলাম ওর চোখে। ওপরে প্রায় কোনও টেবিল-ই খালি নেই। ওর নিকটবর্তী হয়ে উষ্ণতার আঁচে আঁচ পোয়াতে দোতলায় একটি মাত্র ফাঁকায় বসলাম। ওর সুগন্ধী শরীর প্রতি প্রতি শ্বাসে ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার শীলিত স্পর্শের মধুকর। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত অভিজাত রেস্তোরাঁর নরম আলোয় মনে হল, ভিতরমহল যেন অপূর্ব এক রাতকুঠুরি। আমরা বসেছি ঠিক সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠেই ডান দিকের কুনো-নিভৃতিতে।
এর আগে যত বার এখানে এসেছি, রঞ্জা এঁদের সুবিদিত ফিউশন ফুড চেলো কাবাব অথবা সিজলারের অর্ডার দিয়েছে। কন্টিনেন্টাল থেকে নর্থ ইন্ডিয়ান প্রায় সব খানাপিনার আয়োজনেই এঁরা রহিস। তবে এঁদের স্ক্রু ড্রাইভার, ব্লাডি মারি বা, ওল্ড ফ্যাশনড্ আমার দিব্যি লাগে। পান বাদ দিয়ে দু’জনের খরচ-ও সামান্য। সকাল সাড়ে দশটাতেই খুলেও যায়। কিন্তু আজ মাখনে মাখামাখি রাইস, ডিম, শিক কাবাব, রোস্টেড টোম্যাটোর চেলো-তে না গিয়ে, রঞ্জা অর্ডার দিল দু’ পাত্তর হুইস্কির সঙ্গে রোস্টেড চিকেনের।
-আবীর মুখোপাধ্যায়
ক্রমশ...সুত্রে ঃ হ্যালো টুডে
লাল ঠোঁট নিয়েই বাড়ি ফেরা উচিত/ আর না ফিরলে সেই ফ্যাকাশে ঠোঁটের দিকে/
শুরু হয়ে যেতে পারে লাল-চোখের তল্লাশী/ এটা কি পেরেক মেরে ঢোকাতে হবে আপনার মগজে?/ শুভঙ্কর, প্লীজ! ডাকাতেপনাটা একটু কমাও। (পূর্ণেন্দু পত্রী)
সকালের কৃষ্ণকলি মেঘ যে এভাবে ডিসেম্বরের ভর দুপুরে বৃষ্টি ডেকে আনবে, এতটাই বা কে ভেবেছিল! নিম্ননাভি ক্ষীণমধ্যা, প্রিয়দর্শিনী মেঘবালিকার হাত ধরে শীত সন্ধের কলকাতা তাই, টিপিস টিপিস বৃষ্টি জলে ভিজে যেন ছলবলি মধুশালা! মধ্য একুশের রঞ্জা-ও সকাল থেকে সজল বাতাসে ভাসিয়ে দিয়েছে মেঘপিওনের চিঠি। কালিদাস থেকে রবিঠাকুর, মায় সুমনের বাদল দিনের গানে সিক্ত ওর প্রতিটি সাইবার-সংলাপ। সেলফোনে টেক্সট চালাচালি করতে করতে একসময় মনে হল ইনবক্স উপচে তুমুল শ্রাবণ নামল বুঝি আমার দু’হাতে।
নিশিঠেকের উদ্দেশ্যে পথে নেমে ঝির-ঝির বৃষ্টির ভিতর প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটে হাঁটতে হাঁটতে, প্রথম শীতের এমন মহার্ঘ্য বাদলানিতে কেন জানি না, নাকে চাঁপার গন্ধ এসে লাগল। রঞ্জার কথা ভাবতে ভাবতে ওকে নিবেদন করে তাই ফিসফিসিয়ে পূর্ণেন্দু আউড়ালাম, ‘আজকে তুমি প্রথম শ্রাবণ, সঙ্গে চাঁপার গন্ধ/ মাখবো’? রঞ্জা এখন কোথায়?
কথা আর উপকথনে সেই দুপুরেই রঞ্জা উষ্ণতার আমন্ত্রণে জানিয়ে ছিল, ও এমন ঠাণ্ডি দিনে আমাকে নিয়ে যাবে সরগরম এক পানশালায়। ১৮, এ-র পার্ক স্ট্রিটের, পিটার ক্যাটে। ‘দ্য স্ট্রিট দ্যাট নেভার স্লিপস’- চির বিনিদ্রিত পার্ক স্ট্রিটের পিটার ক্যাটের ঠিকানায় পৌঁছে, ট্যাক্সি থেকে নেমেই দেখি, রেস্তোরাঁর একচিলতে আশ্রয়ের নিচে দাঁড়িয়ে ও।
কালো ঢাকাই জামদানির আঁচলকে সহবত শেখাতে শেখাতে কার সঙ্গে যেন সেলফোনে কথা বলছে রঞ্জা। ট্যাক্সিটা ছেড়ে দু’ দণ্ড দাঁড়িয়ে ওকে দেখলাম অপলক। কালো জামদানির জমিতে যেন চন্দনবনের সুখের জয়জয়ন্তী বিস্তার। হাজার বুটির কারুশালা। পাড়ে সরু তামারঙ ফিতের নদীরেখা। কালো ডিপ স্কোয়ার কাট ব্লাউজের খুল্লমখুল্লা পিঠের দিকটা একটু বেশি নির্জন। ওর এলো খোপায় ডোকরার শাণিত কাঁটা। সঙ্গে কারিগর হাটের তামরঙা অক্সিডাইজের পরিশীলিত অঙ্গসাজে রঞ্জাকে দেখে এই ভিখু জন্মের ইচ্ছে হল ডাকাত হতে। নাহ! দুঃসাহস এবার সত্যিই কোনদিন ডাকাতি করে ছাড়বে!
- এমন দিনে ঘরে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম জানো ফকির। মনে হচ্ছিল কলকাতা যেন মেঘের ধূসর ডানায় ঢাকা পড়ে যাবে এক্ষুনি! পার্ক স্ট্রিটের ফুটপাত বদলে যাবে জল রঙের ক্যানভাসে। মাথার মধ্যে অমনি পিটার ক্যাটে বসার পাগলামির নেশা পেয়ে বসল…
- রঞ্জা, রবিঠাকুর আর সুমনের গানে তুমি তো সেই কবেই- কোন দুপুরে দজ্জাল বৃষ্টি নামিয়েছ শহরের দরজা-জানলা হাট করে। এই দ্যাখো, দ্যাখো না… তোমার পাঠানো মেঘ-জলে কথায় ভিজে একসা আমার সেলফোন। আমার পকেটের গহন কোটর, যেখানে রাখা ছিল তোমার বৃষ্টি-ধ্বনির আগাম বার্তা। সারা শরীর জুড়ে মেঘ-বৃষ্টির দারুণ খপ্পর!
রঞ্জার কথার জবাবে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলতে বলতে রেস্তোরাঁর মন্দ্রসুরে প্রায় ভেসে সিঁড়িতে উঠছিলাম। ঠিক আমার সামনে দিয়ে উঠতে উঠতে দোলনমায়ার ছন্দ থামিয়ে, মৃদু শাসনের অছিলায় ফিরে মেয়ে বলল,
- তুমি আজকাল বড্ড বেশি ভাবুক!
জবাবে ওর দিকে ওত পেতে শক্তির সেই অমোঘ লাইনগুলি বললাম,
- কষ্ট হয়তো একটু হবে, এই তো ছিরির ঘর/ আমার কাছে অল্প সময় বাইরে অতঃপর-/ বৃষ্টি ভালো লাগছে যখন, পদ্মপাতায় রাখুক।/ ওইটুকু তো মেয়ে/ ছোট্ট আমার চেয়ে/ এতই যদি লজ্জা তাহার, দু’ হাতে মুখ ঢাকুক/ আমার কাছে থাকুক, তবু আমার কাছে থাকুক!
আমার কথায় প্রশয়ের চাহনি পেলাম ওর চোখে। ওপরে প্রায় কোনও টেবিল-ই খালি নেই। ওর নিকটবর্তী হয়ে উষ্ণতার আঁচে আঁচ পোয়াতে দোতলায় একটি মাত্র ফাঁকায় বসলাম। ওর সুগন্ধী শরীর প্রতি প্রতি শ্বাসে ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার শীলিত স্পর্শের মধুকর। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত অভিজাত রেস্তোরাঁর নরম আলোয় মনে হল, ভিতরমহল যেন অপূর্ব এক রাতকুঠুরি। আমরা বসেছি ঠিক সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠেই ডান দিকের কুনো-নিভৃতিতে।
এর আগে যত বার এখানে এসেছি, রঞ্জা এঁদের সুবিদিত ফিউশন ফুড চেলো কাবাব অথবা সিজলারের অর্ডার দিয়েছে। কন্টিনেন্টাল থেকে নর্থ ইন্ডিয়ান প্রায় সব খানাপিনার আয়োজনেই এঁরা রহিস। তবে এঁদের স্ক্রু ড্রাইভার, ব্লাডি মারি বা, ওল্ড ফ্যাশনড্ আমার দিব্যি লাগে। পান বাদ দিয়ে দু’জনের খরচ-ও সামান্য। সকাল সাড়ে দশটাতেই খুলেও যায়। কিন্তু আজ মাখনে মাখামাখি রাইস, ডিম, শিক কাবাব, রোস্টেড টোম্যাটোর চেলো-তে না গিয়ে, রঞ্জা অর্ডার দিল দু’ পাত্তর হুইস্কির সঙ্গে রোস্টেড চিকেনের।
-আবীর মুখোপাধ্যায়
ক্রমশ...সুত্রে ঃ হ্যালো টুডে
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন