জুলেখা কাঁদিতেছে ।
ভালবাসার গান,love photo
রাত নয়টা, কর্মচঞ্চল এই শহরে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সময় । আর আকাশে গোল থালার মতো একটি বিশাল স্বচ্ছ চাঁদ এই গুরুত্বটাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে উঠতি সাহিত্যিকদের কাছে । ফেসবুকে আজ এই মূহূর্তে তাই চাঁদময় স্ট্যাটাসের ছড়াছড়ি । কিন্তু এই মায়াবী রাতের সকল কর্মব্যস্ততাকে পেছনে ফেলে, ফেসবুকের চৌম্বক আকর্ষণকে বিকর্ষণ করে, সবসময় কানে ধরে রাখা মোবাইলটাকে সাইলেন্ট মুডে রেখে বিশাল বড় বারান্দার ছোট্ট একটি কোণে দাঁড়িয়ে, বারান্দার গ্রিলগুলোকে দুই হাতে শক্ত করে ধরে বয়ফ্রেন্ডের দেয়া ব্যান্ড্র নিউ সানি লিওন জামাটাকে চোখের জলে ভাসিয়ে হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছে অষ্টাদশী কন্যা জুলেখা । এ কান্না গ্লিসারিনের কান্না নয় । সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে চোখ থেকে নির্গত কাজল মিশ্রিত কান্না । সম্পূর্ণ একা দাঁড়িয়ে রয়েছে জুলেখা । বারান্দায় আর কেউ নাই । চুরি করে জ্যোত্‍স্নার এক ফালি আলো গ্রিলের ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করেছে । প্রবেশ করিয়া চোখের জল আর মুখের অজস্র মেকাপের কম্বিনেশনে প্রতিভাত জুলেখার ভৌতিক চেহারাটাকে দেখে সে যেন থমকে দাঁড়িয়েছে । 

কেন এ কান্না ??? কি সেই কারণ ???

প্রেম !!!! - হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে । এই সুন্দর চন্দ্রবিধৌত রাতে সুন্দরী অষ্টাদশী কন্যার ডাগর চোখে অশ্রুর উপস্থিতির কারণ, প্রেম হতে পারে । জুলেখার জীবনে প্রেম কয়বার এসেছিলো কিংবা আদৌ এসেছিল কিনা সেই গবেষণায় আমি যাবো না । তবে বিশ্বস্ত সূত্রে এতটুকু জানা গেছে, সত্যিকারভাবে সাগর খান নামের একটা ছেলেকে জুলেখার খুব মনে ধরেছিল । পাশের বাসার ভার্সিটি পড়ুয়া মায়াবী চেহারার ব্যাকব্রাশ চুলের ছেলেটিকে জুলেখার খুব ভালো লেগেছিলো । ভালো লাগা থেকে হয়তো ভালবাসাও হয়ে যেত কিন্তু যেদিন জুলেখা জানতে পারলো যে, সাগরের পকেটমানি জুলেখা ও তার বান্ধবীদের দৈনিক ফুর্তিখরচের কাছে বেশ নগণ্য ঠিক সেদিনই সেই ভালোলাগা খান খান হয়ে জানালা দিয়ে রীতিমতো রকেটের বেগে পালিয়ে গিয়েছিলো । তাই বর্তমান যুগের প্রেমের অলিখিত নিয়মকে প্রতিষ্ঠা করতেই জুলেখা বিল্ডিং এর উপরতলার চৌধুরী সাহেবের একমাত্র ছেলে আকাশ চৌধুরীকে তার বয়ফ্রেন্ড বানালো । আকাশকে জুলেখা এ কারণে বয়ফ্রেন্ড বানায়নি যে, আকাশের সাথে সবসময় একটি পেটমোটা মানিব্যাগ থাকে বরং আকাশ জুলেখার বয়ফ্রেন্ড রেসে প্রথম হয়েছিলো এই কারণে যে, ঐ পেটমোটা মানিব্যাগটাকে জুলেখার পিছনে সম্পূর্ণ খালি করার হিম্মত আকাশের ছিলো । আর এ কারণেই গার্লফ্রেন্ডের অনুরোধে আকাশ তার ফেসবুক প্রোফাইল নেম রেখেছিলো 'হিম্মতওয়ালা আকাশ' ।

হয়তো এই গভীর রাতে জ্যোত্‍স্নার আবেশে সেই সাগর ছেলেটিকেই জুলেখার বার বার মনে পড়ছিলো । নির্জন বারান্দায় তারই স্মরণে হয়তো এই অকস্মিক অশ্রুবিসর্জন ।

হতেই পারে । নারীর মন বড়ই বিচিত্র । তাদের মনস্তত্ত্বও অদ্ভুত । সে সম্বন্ধে চট করে কোন মন্তব্য করা উচিত বলে আমি মনে করি না । বস্তুত স্ত্রী জাতির সম্বন্ধে কোন কিছু মন্তব্য করাই দুঃসাহসের কাজ । বিশেষ করে ফেসবুকে । ফেসবুক প্রোফাইল পিকচার দেখে যে রমনীকে মনে হয়, বয়স বোধ হয় ঊনিশ কুড়ি, চেহারা সুরতের দিক দিয়ে ক্যাটরিনা কাইফের যমজ বোন অথচ অনুসন্ধান করলে জানা যাবে যে, উক্ত রমনীর বয়স আটাশ কিংবা ত্রিশ আর বাংলার ময়ূরী উহার থেকে অধিকতর সুন্দরী ।

সুতরাং এ যুগের নারী সংক্রান্ত কোন ব্যাপারে বেকুবের মতো ফস করিয়া কিছু একটা বলে বসা ঠিক নয় । সর্বদা ভদ্রভাবে ধৈর্য্য ধরাই সঙ্গত । জুলেখার কান্না সম্বন্ধে সহসা আমি কিছু বলবো না । কারণ আমি জানি না । তাই এই কান্নার শোভন ও সঙ্গত কারণ যতগুলো হওয়া সম্ভব, তার প্রত্যেকটা তুলে ধরার চেষ্টা করবো আমি ।

গভীর রাতে একা বারান্দায় একটি যুবতী কন্যা দাঁড়িয়ে ক্রমাগত কেঁদে চলেছে - ইহা একটা ডিটেকটিভ উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদের বিষয়ও হতে পারে । কিন্তু আমি বিশ্বস্তসূত্রে অবগত আছি - তা নয় । পাঠক পাঠিকাগণ অন্তত এ বিষয়ে নিশ্চিত থাকুন । জুলেখা আর তার বয়ফ্রেন্ড আকাশকে যতদূর জানি, তাতে তাদের ডিটেকটিভ উপন্যাসের নায়ক নায়িকা হবার মতো যোগ্যতা আছে বলে আমার মনে হয় না । তবে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত বয়ফ্রেন্ড আকাশের আগে জুলেখার ঠিক কতজন বয়ফ্রেন্ড ছিলো তার সঠিক হিসাবটা বের করা রীতিমতো ডিটেকটিভদের কাজ । আর এতটুকু নিশ্চিত থাকুন যে, নামকরা ডিটেকটিভরা যে এই কাজে ডাক (গোল্লা) মারবে সে বিষয়ে কোনরকম সন্দেহ নেই ।

সাগর, আকাশ তাদের কথা ছেড়ে দিলে জুলেখার কান্নার আর একটি সম্ভাবনার কথা মনে হচ্ছে । কিছুদিন পূর্বে ফেসবুকে জুলেখা 'Princess Mehjabin' নামে একটি একাউন্ট খুলেছিলো । দাদার দেয়া এই আদি খ্যাতমার্কা জুলেখা নামটা তার কাছে কখনোই গ্রহণযোগ্য ছিলো না । তাই বাংলাদেশী মডেল মেহজাবিনের নামখানা ধার করে তার পূর্বে Princess লাগিয়ে ফেসবুক সেলেব্রেটি হওয়ার জন্য সে কিই না করেছে । প্রতি মিনিটে মিনিটে ফটোশপের কারিশমায় প্রায় ক্যাটরিনার মতো দেখতে ছবি আপলোড কিংবা 'তুমি এত্তোগুলা পঁচা', 'আজকে এত্তোগুলা মার্কেট করেছি', 'এত্তোগুলা মন খারাপ' টাইপ স্ট্যাটাস দিয়ে নিজের নাম মেহজাবিন প্রতিষ্ঠায় জুলেখা অনবরত ব্যস্ত থেকেছে । কিন্তু বিধি বাম !!! হঠাত্‍ গত মাসে জুকারবার্গের ফেকবুকীয় ছলাকলায় ডলা খেয়ে জুলেখার সাধের একাউন্টখান চিরতরে ব্লক খেয়ে ফেসবুকের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে হারিয়ে গেছে । হতে পারে সেই একাউন্টের হোমপেজ জুলেখার সেলেব্রেটি হৃদয়কে কাঁদাইতেছে । একাউন্টের মৃত্যুর পর জুলেখা দুই দিন ফেসবুক বর্জন করেছিলো । এটা আমি বিশ্বস্তসূত্রে জানি । চিরকালের জন্য যা হারিয়ে গেছে তাকে ক্ষণিকের জন্যও ফিরে পাবার আকুলতা কঠোর পুরুষের মনেও মাঝে মাঝে হয় । কোমলহৃদয়া জুলেখার মনে তা হওয়া কিছুমাত্র বিচিত্র নয় । কান্নার কারণ তাই ব্লক খাওয়া সেই একাউন্টের শোকও হতে পারে ।

বর্তমান এই ফেসবুক যুগে একাউন্ট শোক খুব বড় শোক । নানান বর্ণে, নানান ঢঙে সজ্জিত এসব একাউন্ট আমজনতার কাছে প্রায় সন্তানতুল্য । তবে হ্যাঁ - আর একটা কারণও হতে পারে । সন্তানসম একাউন্ট শোক - প্রসঙ্গের পর এই কথাটি বলছি বলে আপনারা আমাকে ক্ষমা করুন । কিন্তু জুলেখার কান্নার এই তুচ্ছ সম্ভাবনাটাকেও আমি উপেক্ষা করতে পারলাম না । বিগত কয়েক দিন হইতে জ্বলন্ত খলিলের "ভালবেসে জীবন দিয়েছি - Love takes away my life" ছবিখান বসুন্ধরা স্টার সিনেপ্লেক্সে দেখানো হচ্ছে । জুলেখার অগণিত বন্ধু বান্ধবী ছবিটি দেখে এসেছে এবং উচ্ছ্বসিত হয়ে ফেসবুকে প্রশংসামূলক অজস্র স্ট্যাটাসও আপডেট দিয়েছে । কিন্তু আকাশ বড়ই বেরসিক । এতোটাই বেরসিক যে, জুলেখার বার বার ন্যাকু ন্যাকু অনুরোধ সত্ত্বেও সে জুলেখাকে উক্ত সিনেমা দেখাতে নিয়ে যায়নি । বিশ্বস্তসূত্রে আমি জেনেছি, আকাশ তার এক্স গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে এ কয়দিন স্টার সিনেপ্লেক্সে বেশ ব্যস্ত ছিলো । তাই কোনভাবেই যাতে এক্স এবং প্রেজেন্ট গার্লফ্রেন্ডের মধ্যে কোন কলিশন না হয় সেজন্য আকাশ কোনোরকম রিস্ক নেয়নি।

তাই হয়তো এই নিশ্চুপ মায়াবী উদাসী রাতে জুলেখার বুকে সিনেমা শোক উথলে উঠেছে । হতেই পারে । কোন সম্ভাবনাকেই ছোট করে দেখা যাবে না । সবই হওয়া সম্ভব ।

বাস্তবিকভাবে আমি যতই ভাবছি, ততই আমার বিশ্বাস পোক্ত হচ্ছে । জুলেখার কান্নার হেতু সবগুলোই হতে পারে । হয়তো এ পর্যন্ত আমার তুলে ধরা প্রত্যেকটা কারণের সম্মিলিত দুঃখে জুলেখার এই কান্না । কিংবা আজকে দুপুরেই মার্কেটে জামা কিনতে গিয়ে আকাশের সাথে যে মতভেদ হয়েছে সেটাও একটা কারণ হতে পারে । লিওন প্রেমী অকাশের 'সানি লিওন' জামা খুবই পছন্দ । কিন্তু ক্যাটরিনাকে রোল মডেল মানা জুলেখার 'চিকনী চামেলী' জামার প্রতিই বেশী আকর্ষণ । যদিও তার ইচ্ছা ছিলো বয়ফ্রেন্ডকে ভাঙ্গিয়ে 'সানি লিওন' ও 'চিকনী চামেলী' দুটো জামাকেই কুক্ষিগত করা কিন্তু আকাশের পীড়াপিড়িতে শুধু 'সানি লিওন' জামা নিয়েই তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে । যদিও এটা নিয়ে ফোনে আকাশের সাথে তার তুমুল ঝগড়া হয়েছে । রূঢ়ভাষী কঠোর পুরুষেরা যা করে - আকাশও তাই করেছে । গলার জোরে অর্থাত্‍ চিত্‍কার করে জিতেছে । আর ন্যাকা ঢঙ্গী মেয়েরা যে উপায়ে বয়ফ্রেন্ড এর সাথে জিতে থাকে জুলেখা সম্ভফত তাই করছে অর্থাত্‍ জুলেখা কাঁদছে।

কারণ যাই হোক, ব্যাপারটা নিঃসন্দেসে করুণ । জ্যোত্‍স্না রাত্রি হওয়াতে আরও করুণ অর্থাত্‍ করুণতর । কোন সহৃদয় পাঠক কিংবা পাঠিকা যদি একে করুণতমও বলেন তা হলেও আমি প্রতিবাদ করবো না । কারণ জুলেখা তরুণী । রাত্রি যতই নিবিড় কিংবা জ্যোত্‍স্না যতই আকাশপ্লাবনী হোক না কেন, এ বিষয়ে খুব সম্ভবত আমরা একমত যে, এই রাত দুপুরে একটা বালক কিংবা একটা বুড়ি কাঁদলেও আমরা এতটা বিচলিত হতাম না । উপরন্তু হয়তো বিরক্তই হতাম ।

জুলেখা কিন্তু তরুণী । আর এ কারনেই আমাদের সবার মন কমবেশী বিচলিত হয়েছে এবং এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নাই যে, জুলেখার কান্নার কারণ না নির্ণয় করা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি না । এমনকি সাগরকে জড়িয়ে একটা সস্তা গোছের ভালবাসার গল্পও ফেসবুকে নোট আকারে প্রকাশ করার ইচ্ছাকে দমন করতে পারছি না । মন বলছে - কেন নয় ??? এমন চাঁদনী রাতে সেই অর্ধ প্রস্ফুটিত প্রেম কি পূর্ণতা পেতে পারে না ???? এমন দুর্লভক্ষণে সাগরের কথা মনে হওয়া কি অসম্ভব, না অপরাধ ???

মনের বক্তৃতা আমার বন্ধ হয়ে গেল । কারণ ততক্ষণে বেডরুম আর বারান্দার সংযোগস্থলে সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকা দরজাটি হঠাত্‍ করেই খুলে গেল । ব্যস্তসমস্ত জুলেখার মা শ্রদ্ধেয় সুলেখা আন্টি বারান্দায় প্রবেশ করলেন । মুখে শঙ্কার ছায়া । হয়তো কন্ন্যার কান্নার হেতু তিনি নিজেই ।

কিন্তু এ কি !!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!

সুলেখা আন্টির চোখেও যে বিন্দু বিন্দু জল চিকচিক করছে যে কোন সময় ভারী বর্ষণের অপেক্ষায় ।
মুখটাকে আরো কাঁদো কাঁদো করে তিনি মেয়েকে বললেন,

"আমার জুলেখা মামনি, আর কান্না করো না । তোর বাবা বিদ্যুত অফিসে ফোন দিয়েছিলো । ওরা বলেছে কালকে সকালের আগে আর কারেন্ট আসবে না । একদিন না হয় স্টার জলসার সিরিয়ালগুলো নাইবা দেখলি । কিইবা এমন হবে ??? প্লিজ মামনি আর কাঁদিস না ।"

এই বলে ভেউ ভেউ করে তিনি নিজেই কেঁদে দিলেন । 
বিপুল জ্যোত্‍স্নাময় এই মায়াবী রাতে বারান্দায় বসে মা ও মেয়ে একে অপরের গলা জড়িয়ে হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছে মাত্র একদিন স্টার জলসার সিরিয়াল মিস হওয়ার শোকে ।

থমকে দাঁড়ানো সেই জ্যোত্‍স্নার টুকরাটি তখন মুচকি মুচকি হাসছে ।

দেখলেন তো সবাই ??? প্রথমেই বলেছিলাম - সবই সম্ভব ।

(গল্পটি বনফুলের 'সুলেখার ক্রন্দন' গল্প অবলম্বনে রচিত । 'সুলেখার ক্রন্দন' গল্পটিকে পরিবর্তন করে 'জুলেখার কান্না' তে রূপান্তরিত করা হয়েছে । মূল কথা হচ্ছে 'সুলেখার ক্রন্দন' গল্পের প্রেজেন্ট ভার্সন হচ্ছে 'জুলেখার কান্না'
 
Top